আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

না বলা ভালবাসার গল্প

" সাহিত্যের কাজ হচ্ছে মানুষকে খেলাচ্ছলে শিক্ষা দেওয়া " - প্রমথ চৌধুরী চারদিকে এত অন্ধকার কেন????????.........এ প্রশ্নটা মাত্র এক মুহূর্তের জন্য মাথায় আসল আমায়......তারপর মনে হল,অন্ধকারই তো আমার নিয়তি.........এটাই সত্য......। যেদিন প্রথম তোমার সাথে পরিচয় হয়েছিল,সেদিন হয়ত আমার অন্ধকার জীবন একটু আলোর সন্ধান পেয়েছিল। জীবনের নিকষ কাল অমাবস্যার মাঝে এক চিলতে ম্লান চাঁদের আলো হয়ে এসেছিলে তুমি। তারপর চাঁদের সে ম্লান আলোটুকু হয়তবা ছিল,কিন্তু সেই আকাশটাই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল,হারিয়ে গেল মহাকালের অতল গর্ভে......। আমি ততটা ভাল ছাত্র না।

এস এস সিতে কোনমতে জিপিএ ৫ পেলেও এইচ এস সিতে পাইনি। খুব ইচ্ছা ছিল BUET এ পরব। কিন্তু রেজাল্ট এর পর সে স্বপ্নটাও আর থাকল না। ভর্তি হয়েছিলাম ফার্মগেটের এক কোচিং সেন্টার এ। ঢাকার যে কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়াটাই তখন আমার লক্ষ্য ছিল।

জীবনটা চলছিল ঠিকভাবেই,কিন্তু একদিন......... তারিখটা আমার সঠিক মনে নেই। মনে হয় জুলাই এর প্রথম দিকের ঘটনা। তখন মাথায় অত চিন্তা ছিলনা। বেশ ফুরফুরে মেজাজে সেদিন মেস থেকে বের হয়েছিলাম। ক্লাসের একেবারে সামনের সিটে বসেছিলাম সেদিন।

যথাসময়ে ক্লাস শুরু হয়েছিল। ১০ মিনিট পার হওয়ার পর দরজার মুখে রিনরিনে কণ্ঠ শুনতে পেলাম ‘’আসতে পারি ভাইয়া???’’ ভাইয়া বোধহয় একটু বিরক্ত হলেন। সাথে সাথে যারা ক্লাস এ মনোযোগী ছিল,তারাও। আমিও তাদের মাঝেই ছিলাম। মোটামুটি বিরক্তি নিয়েই তোমার দিকে তাকালাম।

কিন্তু...... আমি ভালভাবে কথা গুছিয়ে বলতে পারিনা। কারোর বর্ণনাটাও তাই হয়ত অতটা গুছিয়ে দিতে পারব না আমি। তাই তোমার বর্ণনা দেয়ার দুঃসাহস করলাম না। যাক......তুমি এসে বসলে আমার পাশের বেঞ্চে। ইচ্ছা থাকলেও তোমার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না আমার।

হয়তবা আমি একটু বেশিই ভীতু। ক্লাস শেষ হল,কিন্তু আমার মন পড়ে থাকল ওখানেই। সত্যি বলছি,ওরকম অনুভুতি আমার কখনও হয়নি। ক্লাস থেকে সেদিন বের হলাম একটা ঘোরের মাঝে। বুজছিলাম না কি হল আমার।

সে দিনটা এভাবেই কাটল আমার। পড়ায় মোটেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। বই এর প্রতিটি পাতার প্রতিটি অক্ষর আমার কাছ থেকে লুকিয়ে বেড়াতে লাগলো যেন। এভাবেই কেটে গেল একটা রাত। বুঝছিলাম,আমার অন্ধকার মনের মাঝে তুমি ঠিকই নিজের জায়গাটা করে নিয়েছ।

আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম পরের ক্লাসের দিনটির জন্য। তোমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পরের দিনটি মনে হল এক যুগের মত দীর্ঘ। তারপর......এল পরের দিন। একটা অন্যরকম অনুভুতি নিয়ে রওনা দিলাম কোচিং এর দিকে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তোমাদের লাল গাড়িটা আমাকে অতিক্রম করল।

আমি থামলাম এক মুহূর্তের জন্য। বুঝলাম,আজ তুমি বেশ আগেই এসেছ। তাড়াতাড়ি পা চালালাম। বেশিক্ষণ লাগলো না কোচিং এ পৌছাতে। ক্লাসরুম এ গিয়ে দেখি তুমি আছ আর কয়েকটা মেয়ের সাথে।

আমি দ্বিধায় পরে গেলাম,তোমার সাথে কথা বলব না কি। আমি এম্নিতেই একটু মুখচোরা স্বভাবের। তোমার থেকে একটু দূরে একটা বেঞ্চের দখল নিলাম আমি। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম,আজ যে করে হোক কথা বলবই তোমার সাথে। কিন্তু কিভাবে শুরু করব,বুঝছিলাম না।

আমি মেয়েদের সাথে কথা বলতে কখনই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। হঠাৎ আমাকে অবাক করে তুমিই এগিয়ে এলে। - কিছু বলবেন???? - নননা,নাহ......কেন???? - তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে????মাথায় Common Sense নেই,stupid…….. এরকম অযাচিত আক্রমনে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। বোকার মত চেয়ে ছিলাম তোমার দিকে। ততক্ষণে তুমি তোমার বান্ধবীদের কাছে ফিরে গেছ।

মাথায় কিছুই ঢুকল না আমার। কি হতে কি হয়ে গেল......। সেদিন আমার আর ক্লাস করা হল না। মনে হচ্ছিল ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রচণ্ড মন খারাপ করে সেদিন মেসে ফিরলাম আমি।

তোমার উপর বেশ মেজাজ খারাপ হয়েছিল সেদিন। ধনীর দুলালীরা এমনই হয়-নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিলাম আমি। তারপর মেজাজ ঠাণ্ডা করতে পারছিলাম না। সেই মেজাজ খারাপ পুরোটাই ঠিক হয়ে গেল যখন এর পরের কোচিং এর দিন তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাইলে। - আসলে ঐদিন আমার মেজাজ এম্নিতেই ভাল ছিল না।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেছিলাম মার বকা শুনে। তাই হয়ত এরকমটি হয়েছে। মাইন্ড করেন নি তো??? আমার দেড়টা দিন পুরা নষ্ট হয়েছিল তোমার জন্য,তবুও কেন যেন তোমার উপর মেজাজ খারাপ ভাবটা আর ধরে রাখতে পারলাম না। - না না,মাইন্ড করব কেন?? আসলে আমারই ভুল হয়েছিল। সেজন্য দুঃখিত।

- আমার মনে হয় আপনি আমার উপর চরম রেগে আছেন। - কেন কেন?? এরকম মনে হল কেন? - আপনার মুখের ভাব দেখে এরকমই মনে হচ্ছে আমার। দেখুন, যাই করেন, কিন্তু বদদোয়া করবেন না। সামনে রেজাল্ট আছে, বুঝেনই তো। বলে একটু মুচকি হাসলে তুমি।

মনে মনে বললাম “ I Have Gone……Gone…..” - নাহ, আমি কাউকে সহজে বদদোয়া দেইনা। আর আপনি তো ওরকম কিছু করেননি,যে আপনাকে বদদোয়া দিব। - যাক বাবা......বাচাঁলেন। আচ্ছা, পরে কথা হবে...... ঐদিন থেকেই শুরু,আমার নতুন এক জীবনের। ধীরে ধীরে তোমার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল আমার।

তোমাকে ‘তুমি’ ডাকার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কখনও ডাকতে পারিনি। একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিল তোমার-আমার মাঝে। আমার বন্ধুত্বের উষ্ণতা বা ভালবাসার শক্তি-কোনটাই সে দেয়াল ভাঙ্গার জন্য যথেষ্ট ছিলনা। তোমাকে জীবনের অনেক গোপন কথাই বলতে চাইতাম আমি।

কিন্তু সেই হতচ্ছাড়া দেয়াল আমাকে সেই সামান্য সুযোগটুকুও তৈরি করতে দেয়নি। কিন্তু একজন বন্ধু হিসেবে তুমি অনেক করেছ আমার জন্য। আমার মনে আছে, রেজাল্ট পেয়ে যখন খুব মন খারাপ ছিল আমার, যখন পড়াশুনা সব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম, তখন তুমিই আমাকে সাহস যুগিয়েছিলে। তোমার কথাগুলো আমার এখনও মনে আছে। - তুমি পরিবারের বড় ছেলে।

তোমার কাছে তোমার বাবা-মার অনেক চাওয়া আছে। এছাড়া তোমার ছোট ভাইও তোমাকে আদর্শ হিসেবে দেখে। এখন তুমি যদি এরকম হতাশায় ভুগো, তবে তোমার বাবা-মা কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে??? তোমাকে পড়াশুনা করতে হবে.........ভাল জায়গায় ভর্তি হতে হবে......তবেই তোমার বাবা-মার স্বপ্ন সত্যি হবে। - জানি সবই......কিন্তু মনে হয় আমি পারব না...। - পারতে হবে......তোমাকে পারতে হবে...তোমার পরিবারের দিকে তাকিয়ে হলেও তোমাকে পারতে হবে......।

মানুষের কাছে কোন কিছুই অসম্ভব নয়...আমার বিশ্বাস...তুমি পারবে,পারবে...। হয়তবা পারতাম। বাবা-মার চোখের দিকে তাকিয়ে, কিংবা তোমার কথাগুলো স্মরণ করে হয়ত আমি পারতাম। আমাকে পারতেই হত......বাবা মার স্বপ্ন আর তোমার কথা মাথায় রেখে। যেরকম মায়ার বাঁধনে আমাকে জড়িয়ে রেখেছ তুমি,তা কি অত সহজেই অগ্রাহ্য করা যায়??? সেদিন তোমার গাড়ি আসেনি।

তুমি তোমার বন্ধু-বান্ধবিদের সাথে বাসে যাওয়ার মনস্থির করেছ। তোমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম। - আরে তুমি? কোথায় যাবে?? - আমার এক বন্ধুর বাসায়। অনেকদিন ধরে দেখা হয়না তার সাথে। - বন্ধুর বাসা কোথায়? - মিরপুর ১০ এ।

(তোমার বাসা যে মিরপুর ১১ তে, সেটা আরো আগ থেকেই জানি আমি) - আমি তো ওদিক দিয়েই যাব। ভালই হল। - হুম......বাসে করে তো মনেহয় কখনও যাননি,না?? - উম......এক দুই বার যেতে হয়েছিল,বাধ্য হয়ে। এরকম কথাবার্তা বলতে বলতে বাসে উঠলাম আমরা। ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ মোটামুটি দূরে।

তার উপর আছে ট্র্যাফিক জ্যাম। কথাবার্তা বলতে বলতে কখন যে সময় পার হল, বুঝলামই না। মিরপুর ১০ নেমে আমি বললাম “আপনার বাসা কোথায়?” - মিরপুর ১১ তে। - চলুন। - কোথায়? - আপনি তো একা একা চলাফেরা করে অভ্যস্থ না,চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি আপনাকে।

- তোমার দেরি হবে না তাতে? - অসুবিধা নেই... সে রিক্সা ডাকা শুরু করল। আমি বললাম “রিক্সাতে না গেলে হয় না??” - কেন কেন?? - না এমনি। সে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমি বললাম “হাঁটতে আমার ভাল লাগে। “ - তাই নাকি?? - হুম - আচ্ছা,চল তাহলে।

- থ্যাংকস আমরা হাঁটতে লাগলাম তোমার বাসার দিকে। অনেক কথাবার্তা হচ্ছিল তোমার সাথে। হঠাত তুমি রাস্তার অপর পাশে আরেক রাস্তা দেখিয়ে বলল “ঐ রাস্তায় আমাদের বাড়ি। চল। “ তখন বাজে ১২ টা।

ব্যস্ত রাস্তা পার হতে লাগলাম আমরা। বোঝা যাচ্ছিল, রাস্তা পার হওয়ায় অভ্যস্থ নও তুমি। রাস্তার মাঝে আইল্যান্ড এ দাঁড়িয়ে আছি আমরা। হঠাৎ দেখলাম, তুমি একাই আইল্যান্ড থেকে রাস্তায় নেমে গেছ। ঠিক তখন একটা গাড়ি ফুল স্পীডে রাস্তা দিয়ে আসছে।

তাড়াতাড়ি তোমার হাত চেপে ধরলাম আমি,নিজের অজান্তেই। - দেখলেন...আরেকটু হলেই তো...... - আসলে আমি রাস্তা পার হতে অভ্যস্থ না ত,তাই... - তারপরও......চোখ কান খোলা রাখবেন না...আমি না ধরলে তো............ আমি তোমার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম খুব। তোমার লালচে ফর্সা মুখ তখন ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। আমার কথা শুনে তুমি শুধু লাজুক হাসলে। তারপর তোমাকে নিয়ে রাস্তা পার হলাম।

বাকি সময় বেশি কথা বললাম না আমি। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগছিল তোমার সাথে কথা বলতে। নিজের অজান্তে এমন একটা কাজ করে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম আমি। জানি না,তোমার লজ্জা লাগছিল কি না। ভালই চলছিল সময়।

নতুন উদ্দামে পড়াশুনা শুরু করেছিলাম আমি। সম্বল ছিল বাবা মার স্বপ্ন আর তোমার সহযোগিতা। কিন্তু............... ভাবিনি যে যে কারনে তোমার উপর বিরক্ত হয়েছিলাম,সেটাই আমার মৃত্যুর কারন হবে। জানলে হয়ত তোমার উপর বিরক্ত হতাম না। যাত্রাবাড়ী চাচার বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলাম।

বাস টার্মিনাল এর সামনে প্রচণ্ড জ্যাম। মেজাজ খারাপ করে বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। সবকিছু দেখেই রাস্তা পার হচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। কিছু বুঝার আগেই যা হবার, হয়ে গেল।

জানিনা,তুমি আমার মৃত্যুর খবর জান কিনা। হতেও পারে আমাকে তোমার মনেও নেই। মারা যাবার আগ মুহূর্তে মনে হয়েছিল তোমার কথা। আর হাসি আসছিল এই ভেবে যে, তোমার উপর যে কারনে বিরক্ত হয়েছিলাম,সেটাই আমার মৃত্যুর কারন হল। হায়রে দুনিয়া....... আচ্ছা,তুমি কি এখন ঠিকমত রাস্তা পার হতে পার??? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।