. আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া...
লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার নামটির সঙ্গে বই-পড়ুয়া মানুষের নিশ্চয় পরিচয় আছে। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি বই লিখে তাও আবার আত্মজীবনী, কেউ যে এতো জনপ্রিয় হতে পারে লরা ইঙ্গলস তার উৎকৃষ্ট উদাহরন। লরা ইঙ্গলসের জন্ম ৭ই ফেব্রুয়ারী ১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের কাছে পেপিন শহরের কাছে " বিগ উডসে"। বাবা চার্লস ফিলিপস ইঙ্গলস, মা ক্যারোলিন লেক কুইনার ও বড় বোন মেরীর সাথে লরা বিগ উডসের সেই বাড়ীতে কাটানোর স্মৃতি দিয়েই তার লেখা শুরু করেন।
বৈচিত্রপ্রিয় যাযাবরমনা বাবার সাথে লরা ঘুরে বেড়িয়েছে আমেরিকার এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে।
বিগ উডস থেকে বাবা তাদের নিয়ে অজানার উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মিশৌ্রী, মিসিসিপি পার ইনডিপেন্ডেন্ট শহর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে জন-মানবহীন ঘাসের জঙ্গলে বাবা তাদের ছই-ওয়ালা ঘোড়ার গাড়িটি থামান। নতুন করে বসত শুরু করেন। প্রতিবেশী বলতে নদীর পাড়ে রেড-ইন্ডিয়ানদের বসতি। মা'কে ঘরের কাজে সাহায্য, বাবার প্রতিটি কাজে সংগী হওয়া, ঘাসের বনে লুকোচুরি খেলা, খোলা আকাশের নিচে দিগন্ত বিস্তৃত প্রেইরীর শনশন বাতাসের শব্দের মাঝে ঝিকিমিকি তাঁরাদের নেমে আসা দেখে অস্থির হয়ে যাওয়া।
লরার প্রতিটি কর্মকান্ডে আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম। এই বইটিতেই সেসবের বর্ননা দেয়া আছে।
তারপর একদিন ঘাসের বনের এই ছোট্ট কুটির, সদ্য উঙ্কুরিত নতুন ফসলের ক্ষেত ফেলে আবার অজানার উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে লরারা। এবার আস্তানা গাড়ে উইলো গাছের ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট এক এক নদীর পাড়ে মাটির নিচের এক বাড়ীতে। প্লামক্রিক।
এখানেই লরা-মেরী জীবনের প্রথম ইস্কুলে যায়। হিংসুটে মেয়ে নেলী ওলসনের সঙ্গে এখানেই পরিচয় ঘটে। বাবা নতুন কাঠের বাড়ী বানান। নতুন গমের ফসল পংগপালের আক্রমনে নষ্ট হয়ে যায়। চরম কষ্টে বাবা কাজের খোঁজে আরো পশ্চিমে চলে যান।
লরারা বাবার অপেক্ষায় দেয়ালে দাগ কেটে অপেক্ষায় থাকে। অবশেষে প্রচন্ড তুষারঝড়ের পর বাবা ঘরে ফিরে আসেন। সেসব অনাহার, কষ্টকে হাসি মুখে মেনে নেয়ার কথা আমরা পাই এই বইটিতে।
পরপর দুবার পঙ্গপালের আক্রমন, কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মেরীর অন্ধত্ব লরাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তবুও তারা হাল ছাড়েনি।
মেরীর দায়িত্ব লরার উপরে দেন বাবা। মেরীর চোখ হয়ে লরার পথচলা শুরু হয়। তার চোখে দৃশ্যমান প্রতিটি দৃশ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে দিতো মেরীকে। স্কুলের পড়াও সে উচ্চস্বরে পড়তো যাতে মেরীও মুখস্ত করে নিতে পারে। অংকও তাই।
আবারও জায়গা বদল। বাবার সঙ্গে ডেকোটা অঞ্চলে পাড়ি জমালো তারা। তখনই জানতে পারলো অন্ধদের জন্য স্কুলের কথা। মায়ের স্বপ্ন বোনা শুরু হলো মেরীকে সেই স্কুলে ভর্তী করার। আর লরা মনে মনে সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার শপথ নিলো।
সেসব দিনের বর্ননা আছে এই বইটিতে।
সরকার থেকে প্রাপ্ত খাস-জমিতে বসতির উদ্দ্যেশ্যে আবার লরাদের সংক্ষিপ্ত যাত্রা। খামার বাড়ীর পত্তন, নতুন একটি শহর গড়ার লক্ষ্যে প্রথম বসতি স্থাপন ডেকোটা ডী-স্মীথে। ঘন ঘাসের জঙ্গল কেটে-চষে পত্তনি জমি চাষেও লরা বাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজ করেছে। নতুন শহরে নতুন স্কুল তৈরী হওয়ার পর স্কুলে গিয়েছে।
পড়তে লরার মোটেই ইচ্ছে করতোনা। বাবার সঙ্গে কাজ করতে আর প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াতেই তার ভালো লাগতো। কিন্তু মেরীকে ব্লাইন্ড কলেজে পাঠাতে হলে অনেক টাকার প্রয়োজন। আর সে টাকা যোগাড়ে বাবাকে সাহায্য আর মা-মেরীর স্বপ্ন-পুরনের জন্য লরাকে হাই-স্কুল পাশ করে স্কুল টিচারের চাকুরী যোগাড় করতেই হবে। তাই লরা প্রানপনে নিজের ও বোন মেরীর পড়া চালিয়ে গিয়েছে।
সেবার ভয়ংকর শীত পড়লো। পলকা, পাতলা খামার-বাড়ী ছেড়ে তারা শহরের এক কামরার ছোট্ট মজবুত কাঠের ঘরে আশ্রয় নিলো। দীর্ঘ সাত মাস ব্যাপি সেই ভয়ানক শীতের সঙ্গে লড়াই করলো তারা। খাবার, জ্বালানী সব ফুরিয়ে গেলেও তাদের আত্মবিশ্বাষ অটুট ছিলো। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা এই বইতে লিখা হয়েছে।
সেই ভয়ংকর শীতের ধকল কাটিয়ে লরা ফিরে গেলো তাদের প্রিয় খামার-বাড়ীতে। সেখান থেকেই ছোট বোন কেরীকে সাথে করে স্কুলে যাতায়াত করতো। গ্রীষ্মের ছুটিতে শহরে লরার চরম অপছন্দের কাজ সেলাইএর চাকুরী করে অবশেষে মেরী ও মায়ের স্বপ্ন-পূরন করে। মেরী কলেজে যায়। আস্তে আস্তে শহরটিকে লরা পছন্দ করা শুরু করে।
পরিচয় হয় আলমানজোর সাথেও। অবশেষে ষোল বছর পুরবার আগেই লরা স্কুলে পড়ানোর সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। এসব কিছু পাবো আমরা এ বইটিতে।
দুই টার্ম স্কুলে পড়ানোর পর আলমানজো ওয়াইল্ডারের সাথে লরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সেই সোনালি দিনগুলোর কথাই লরা লিখেছেন এই বইটিতে।
খুব সাধারন ভাবে নিজের জীবনের কথা লরা তুলে ধরেছেন তার লেখায়। আর সেটা সবাই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে গ্রহন করেছেন। তার এই লিটল হাউজ সিরিজ স্কুলের পাঠ্য-সুচীতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
এখনও আমেরিকার মানুষ এই লেখিকাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবেসে স্মরন করে। লরার বর্ননা অনুযায়ী তারা প্রেইরীর বুকে তাদের সেই ছোট্ট কুটিরের জায়গায় একটি কুটির তৈরী করেছে।
নির্মিত হয়েছে মিউজিয়াম। লরার এই সিরিজ নিয়ে তৈরী হয়েছে টিভি সিরিয়াল " লিটিল হাউজ অন দ্যা প্রেইরী"। যা অতন্ত্য জনপ্রিয় হয়েছিলো আমাদের দেশেও। ছোটবেলা থেকেই লরা আমার খুবই প্রিয় ও আদর্শ চরিত্র। আমি সব সময় লরা হতে চাইতাম।
আমিও মনে মনে ভাবতাম, " আমিও লরার মতো লিখবো"। আজ এই সুরঞ্জনার জন্ম হয়েছে লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের কারনেই। লরার বোনা বীজ আজ অঙ্কুরিত হয়ে সামান্য, ছোট্ট সুরঞ্জনার জন্ম।
আজ লরার জন্মদিন। লরাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবেসে স্মরন করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।