ন্যুরেমবার্গের বিচার কাজ চলছে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত পদস্হ ২৩ জন উচ্চ পদস্হ জার্মান সামরিক অফিসার, রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীদের বিচারের জন্য ন্যুরেমবার্গ নামক জার্মানীর একটা শহরে একটি আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইবুনাল গঠিত হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করে।
এই আদালতের কার্যক্রম পরে আরো অনেকদিন অন্য জায়গাতেও চলে। এই ট্রাইবুনালে শুধুমাত্র উচ্চপদস্হ অফিসারদেরই বিচার করা হয়।
আমি এখানে শুধু ন্যুরেমবার্গের ঐ ২৩ জনের বিচারের কিছু কথা তুলে ধরব যার রায় দেয়া হয়েছিল অক্টোবর ১৯৪৬।
প্রথমে বলে নেই প্রসিকিউশন আসামীদের অপরাধগুলোকে ৪ টি ভাগে বা কাউন্টে ভাগ করেন:
১ নং কাউন্ট: আক্রমনাত্মক যুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র করা।
প্রসিকিউশনের কাজ করা যুক্তরাস্ট্রের দায়িত্ব।
২ নং কাউন্ট: শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ। যুক্তরাজ্যের দায়িত্ব।
৩ নং কাউন্ট: যুদ্ধাপরাধ: রাশিয়া ও ফ্রান্সের দায়িত্ব।
৪ নং কাউন্ট: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
রাশিয়া ও ফ্রান্সের দায়িত্ব।
আসামীদের ডকে সব আসামীরা।
কারা ছিলেন বিচারক
এই ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের বা আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইবুনালের বিচারক ছিলেন কারা তা একবার দেখে নেয়া যাক।
১। কর্নেল স্যার জিওফ্রে লরেন্স: বৃটিশ: ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট।
মাঝখানের ভদ্রলোকটিই জিওফ্রে লরেন্স সাহেব।
২। স্যার নরমান বারকেট: বৃটিশ: বিকল্প বিচারক।
৩। মেজর জেনারেল আইয়োনা নিকিচেন্কো।
রাশিয়ান বিচারক, রাশান সুপ্রীম কোর্টের জাজ ছিলেন।
৪। লেঃ কর্নেল আলেকজান্ডার ভলচকভ: রাশিয়ার বিচারক:
নীচে ছবিতে বা দিক থেকে নিকিচেন্কো আর ভলচকভ। একেবারে ডানদিকে ফরাসী বিচারক প্রফেসর হেনরি ডনেদ্য দ্যা ভাব্রে।
৫।
ফ্রান্সিস বীডল: মার্কিন বিচারক
৬। জন জে পারকার: মার্কিন বিকল্প বিচারক।
দুজনের ছবি নীচে:
৭। প্রফেসর হেনরি ডনেদ্যু দ্যা ভাব্রে: ফরাসী বিচারক।
৮।
রবার্ট ফাকো: ফরাসী বিকল্প বিচারক।
আদালতে কর্মরত বিচারক আটজনের ছবি নীচে দেখুন।
পেছনের সারিতে বসা ৮ জনই ছিলেন বিচারক। আমেরিকান ২ জন, বৃটিশ দুজন, রাশান দুজন ও দুজন ফ্রেন্চ বিচারক।
বিচারের জন্য অভিযুক্ত মোট ২৩ জন আসামীকে ন্যুরেমবার্গে আনা হয়।
বিচার শুরুর আগেই এক আসামী জার্মান শিল্পপতি গুস্তাভ ক্রুপ ফন বোহলেন আসামী হলেও তার বিচারই করা হয়নি তিনি অতি বৃদ্ধ ছিলেন বলে। তখন তার বয়স ৭৭।
আরেকজন আসামী রবার্ট লে ন্যুরেমবার্গেই ফাসীতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।
অস্ত্র কারখানার মালিক গুস্তাভ ক্রুপ আর তার স্ত্রী
আত্মহত্যা করে বেচে যাওয়া আসামী রবার্ট লেম্যান।
বাকি রইল ২১ জন।
এই ২১ জনের বিচার করা হয় নুরেমবার্গে।
ন্যুরেমবার্গ প্যালেস অফ জাস্টিস
বিচারের জন্য অভিযুক্ত বন্দীরা ভেতরে, বাইরে আমেরিকান গার্ড পাহারা দিচ্ছে।
অভিযুক্ত আসামীরা ডকে বসা।
চলুন দেখি কারা কারা আসামী ছিলেন আর তাদের কার ভাগ্যে কি রায় জুটেছিল।
১।
এডমিরাল কার্ল ডয়েনিৎয।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মান নেভীর সর্বাধিনায়ক । হিটলারের পর তারই ফুয়েরার হওয়ার কথা ছিল্ । এডলফ হিটলার ফুয়েরার বাংকারে আত্মহত্যা করার পর জার্মানীর প্রেসিডেন্ট হন। বার্লিনে রাশিয়ার কাছে জার্মান বাহিনীর আত্মসমর্পনের কাজটা তিনি সারেন।
অসাধারন দক্ষ আর খ্যাতিমান অফিসার ছিলেন। বিচারের সময় তার মন্তব্য ছিল
'রাজনীতিবিদরা নাৎসীদের ক্ষমতায় এনেছে আবার যুদ্ধ শুরু করেছে। তারাই জঘন্য সব অপরাধ করেছে আর এখন তাদের সাথে আমাদের ঐ একই ডকে দাঁড়াতে হচ্ছে, দোষের ভাগীদার হতে হচ্ছে'!
গ্রেফতার হলেন যুদ্ধের সময়কার জার্মান নেভী চীফ এডমিরাল কার্ল ডয়েনিৎয।
বিচারে তার ১০ বছর জেল হয় যা তিনি জার্মানীর স্পান্ডাউ কারাগারে কাটান। ১৯৮০ সালে তিনি জার্মানীতেই মারা যান।
স্পান্ডাউ কারাগেরের ছবি নীচে দেখুন। এটা মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে পাছে নব্য নাজীরা আবার এটাকে স্মৃতিসৌধ টৌধ বানিয়ে ফেলে কিনা!।
২। মার্টিন বোরম্যান
নাজী পার্টির চ্যান্সেলারী, হিটলারের প্রাইভেট সেক্রেটারী, যুদ্ধের শেষদিকে তিনিই হয়ে উঠেন জারর্মানীর সেকেন্ড ম্যান, হিটলারের পরই । হিটলারের আত্মহত্যার সময় তিনি ফুয়েরার বাংকারেই ছিলেন, হিটলার মারা গেলে তিনি পালান।
তাকে আর খুজে পাওয়া যায়নি।
তার অপরাধ ছিল পোল্যান্ডে লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের বিতারিত করা, ইউক্রেনের মহিলাদের উপর অত্যাচার করা।
তার অবর্তমানেই তার বিচার করা হয় আর তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
তবে তিনি না থাকাতে সেটা কার্যকর হয়নি।
৩।
হ্যানস ফ্র্যাংক
ছবিতে আদালতে বসা হ্যানস ফ্র্যাংক, পেছনে মিলিটারী পুলিশ দাড়ানো। তিনি ছিলেন নাজী সদস্য, আইনমন্ত্রী আর ১৯৩৯ থেকে পোল্যান্ড দখলের পর সেটার হিটলার নিযুক্ত গভর্ণর।
পোল্যান্ডে ইহুদীদের বিতারন, ক্যাম্প সৃস্টি, তাদের দাস হিসেবে ব্যাবহার করা এসবই ছিল তার অপরাধ।
প্রথম দিকে অপরাধ অস্বীকার করলেও পরে হিটলারের কাধে দোষ চাপিয়ে বাচার চেষ্টা করেন, রায়ে তার মৃত্যুদন্ড হয়।
১৬ই অক্টোবর ১৯৪৬ জার্মানীর স্পান্ডাউ কারাগারে ফাসীতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
৪। উইলহেম ফ্রীক
১৯৩৩- ১৯৪৩ পর্যন্ত নাজী জার্মানীর ইন্টেরিয়র মিনিষ্টার ছিলেন। গোয়েরিংএর সাথে ইহুদীদের ধনসম্পদ সরকারীকরনের কাজ করতেন।
বিচারে তার মৃত্যুদন্ড হয়।
১৬ ইঅক্টোবর ১৯৪৬ তারিখে ন্যুরেমবার্গে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকন করা হয়।
৫। হ্যানস ফ্রিৎযে।
এই সুদর্শন লোকটি হিটলারের প্রচার কাজ করতেন, রেডিওতে বা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে। না তখন টিভি ছিলনা।
সৌভাগ্যবশত নাজীদের প্রচার কাজটি বিখ্যাত মিথ্যেবাদী গোয়েবলস একাই নিয়ন্ত্রন করতেন আর তার নির্দেশ ছাড়া ঐ কাজে কেউ নাকই গলাতে পারতনা।
আদালত হ্যানসের কতৃত্ব আর ক্ষমতা বিবেচনা করে 'তার কিছু করার ছিলনা' দেখে
তাকে বেকসুর খালাশ দেন।
৬। ওয়ালথার ফাংক।
জার্মান নাজীদের ইকনমিকস মিনিষ্টার। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দী ইহুদীদের ধনসম্পদ এনে সরকারী তহবিলে জমা করতেন, মৃত ইহুদিদের দাত পর্যন্ত এনে জমা করতেন।
অবশ্য মানুষ মেরেছেন এমনটা প্রমান পাওয়া যায়নি তার বিরুদ্ধে।
নুরেমবার্গের আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন।
১৯৫৭ সালে ভগ্ন স্বাস্হ্যের জন্য জেল থেকে মুক্তি পান আর
১৯৫৯ সালে মারা যান।
৭। ফিল্ড মার্শাল হারম্যান গোয়েরিং।
আদালতে আসামীর ডকে প্রবেশ করছেন ফিল্ড মার্শাল হারম্যান গোয়েরিং
নীচে আসামীদের ডকে অন্য সবার সাথে সবার ডানে আকাশী রংএর স্যুট পড়া ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিং
তার আইকিউ ছিল ১৩৮। ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিং ছিলেন জার্মান বিমান বাহিনীর প্রধান, ছিলেন রাইখ মার্শাল আর রাইখস্টাডের অর্থাৎ পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট। নাজীদের ৪ বছরের পরিকল্পনার তিনি ছিলেন পরিচালক।
ইহুদীদের সমস্ত ব্যাবসা দখল করা, রাজনৈতিক ভাবে তাদের পংগু করে দেয়া বা উৎখাত করা ছিল তার কাজ।
বিমান আক্রমন পরিকল্পনা তো ছিলই।
রায়ে তার মৃত্যুদন্ড হয়।
কিন্তু ফাসীতে ঝুলে মরে যাওয়া তার কাছে অপমানজনক মনে হয়েছে। তাই ফাসীর আগের দিন রাতে গোপনে তার কাছে পাচার করা সায়ানাইড পীল খেয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যার পর ফিল্ড মার্শাল গোয়েরিংএর লাশ দেখুন।
বাকি অংশ আরেকদিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।