প্রবাসী
বাংলাদেশের মাংসের চাহিদা পূরন করে থাকে প্রধানতঃ গরু, মুরগী এবং খাসি। এর মধ্যে গরুর মাংসের দাম অপেক্ষাকৃত কম । লস এঞ্জেলস টাইমস(২০১০ সাল) এর হিসাব অনুসারে বছরে ৫০ কোটী ডলারের বা ৪০০০ কোটী টাকার গরু ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরাচালানের মাধ্যমে আসে, যা বাংলাদেশের গরুর মাংসের ৫০% এর ও বেশী চাহিদা পূরন করে থাকে । ঈদের সময় এই চোরাচালান আরো বেশী পরিমানে হয়।
পৃথিবীর মধ্যে সবচে বেশী গরু পালিত হয় ভারতে।
পশ্চিমবংগ এবং কেরালা ছাড়া ভারতের অন্য সব রাজ্যে গরু জবাই করা নিষিদ্ধ। ফলে বিপূল পরিমান গরু থেকে যায় স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায়। ভারত থেকে সরকারীভাবে গরু রফতানী করাও নিষিদ্ধ তবুও তা একটা বড় ব্যাবসা। বছরে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ গরু চোরাচালানের মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসে। এই গরুর চামড়াই আবার চোরাচালান হয়ে ফিরে যায় ভারতে।
এর প্রধান কারন হল ভারতে এবং বাংলাদেশে গরুর দামে পার্থক্য। ভারতে যে গরুর দাম ১০০ ডলার তা বাংলাদেশে ৩০০ থেকে ৩৫০ ডলার মূল্যে বিক্রি হয়। ফলে গরু চোরাচালান সবচে লাভ জনক ।
বাংলাদেশে গরুর মাংসের চাহিদা আছে, দাম বেশী অথচ চাহিদার তুলনায় গরুর সংখ্যা কম। বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত সুরক্ষিত নয়।
কারন হল ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব নয়। এর উপর আছে সীমান্ত রক্ষীদের উপরি আয়, ফলে ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যাবসায়ীদের জন্য গরু চোরাচালান এক লোভনীয় ব্যাবসা।
এই গরু চোরাচালান সীমান্ত হত্যার প্রধান কারন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গরু চোরাচালান বন্ধের সহজ উপায় হল এই ব্যবসাকে বৈধতা দেওয়া। এতে করে সীমান্ত হত্যা কমে যাবে, উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা হবে এবং ব্যবসায়ীরা ও লাভবান হবে।
বাংলাদেশ সব সময়ই ভারত থেকে বৈধ ভাবে গরু আমদানী করতে আগ্রহী। কিন্তু ভারত সরকার গরু রফতানী করতে আগ্রহী নয় যদিও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা একে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে। ২০০৬ সালে বি এস এফ এর ডিরেক্টর জেনারেল এ কে মিত্র গরু চোরাচালানের পরিবর্তে বৈধভাবে বাংলাদেশে গরু রফতানীর আহবান জানান। বি, ডি আর বিদ্রোহে নিহত তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ ও একই ধরনের মনোভাব পোষন করেন। প্রথম কারন ধর্মীয়।
গরু ভারতীয়দের কাছে পবিত্র প্রানী এবং অনেক স্থানে দেবতা তূল্য। ভারত থেকে বৈধ ভাবে গরু ধর্মীয় কারনে রফতানী করা হয় না ভারতীয়দের এই বক্তব্য ও গ্রহনযোগ্য নয় কারন ভারত ২০০৫ সাল হতে বাৎসরিক ১০ লক্ষ গরু সরকারীভাবে পাকিস্তানে রফতানী করে আসছে।
দ্বিতীয় কারন হল চামড়া এবং গরুর মাংশ রফতানী। ভারত পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম গরুর মাংস রফতানীকারক দেশ। পশ্চিমবংগ ভারতের গরুর মাংস এবং চামড়ার যথাক্রমে ৩০% এবং ৫৫% সরবরাহ করতে থেকে।
গরু রফতানী তাদের এই ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। পশ্চিমবংগ চাইবে গরু জবাই করে চামড়া এবং মাংস প্রক্রিয়াজাত করে তা রফতানী করতে । এতে করে ভারতের গরুর ব্যবসায়ীরা তাদের গরুর ন্যায্যমূল্য পাবে, তাদের কর্মসংস্থান হবে ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে যদি গরুর পরিবর্তে বাংলাদেশকে গরুর মাংশ আমদানী করতে হয় তাহলে তা করতে হবে আন্তর্জাতিক মূল্যে। ভারতীয় গরুর মাংসের প্রধান আমদানীকারক হল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
আন্তর্জাতিক মূল্যে গরুর মাংস আমদানী করা হলে তা থাকবে বাংলাদেশের সাধারন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এই মুহুর্তে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গরুর মাংস প্রক্রিয়াজাতকরন ক্ষমতা সীমিত। ফলে এই উদবৃত্ব গরু চোরাচালান করাই তাদের জন্য একমাত্র ভরসা। ভারতের পশ্চিমবংগ সরকার গরুর চোরাচালান সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল কিন্তু তা রোধ করতে কার্য্যকর কোণ পদক্ষেপ নিতে তারা আগ্রহী নয় কারন এটা হল একটা লাভজনক ব্যাবসা।
যদি ভারতীয় গরু না আসে তাহলে বাংলাদেশের চামড়া এবং চামড়াজাত শিল্পকেও এক অসম প্রতিযোগিতার সম্মূখীন হতে হবে।
চামড়া বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ন বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের উৎস।
চোরাচালানের জন্য ভারতের দুরের রাজ্য যেমন হরিয়ানা বা পাঞ্জাব থেকে গরু এনে জড় করা হয় পশ্চিমবঙ্গে। এই ব্যবসার সাথে জড়িত তিন পেশা ১)ঘাটিয়াল,২) দালাল,৩) রাখাল।
ঘাটিয়ালরা হলেন গরু এবং গরু রাখার জায়গা বা বাথানের মালিক অর্থাৎ তারাই প্রধান ব্যাক্তি। দ্বীতিয়ত দালালদের কাজ হল সীমান্ত রক্ষী বি এস এফ এবং বি,জি,বি কে ম্যানেজ করা এবং ভারতীয় এবং বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা।
রাখালদের কাজ হল সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত থেকে গরু বাঙ্গলাদেশী ব্যবসায়ীদের কাছে পৌছে দেওয়া । এই রাখালদের কাজই হল সবচে’ ঝুকিপূর্ন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ভারত থেকে গরু আমদানীর জন্য ১৩ টি করিডোর চিহ্নিত করে, ফলে বাংলাদেশে গরুর পরিবহন সহজ হয়। কিন্তু মূল সমস্যা থেকেই যায়। গরুচালানের সাথে সীমান্ত রক্ষীদের উপরি আয় জড়িত।
ভারতীয় বি এস এফ কিংবা বাংলাদেশের বি,জি,বি সবাই নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকে। সুতরাং তারা দেখেও না দেখার ভান করে। বিজিবি গরু প্রতি ৫০০ টাকার বিনিময়ে চোরাচালানকৃত গরুর উপর সীল মেরে বৈধতা দেয়। সীমান্তে গরু পাচারকারী যারা ধরা পড়ে মারা যায় বা নির্যাতনের শিকার হয় তারা প্রকৃতপক্ষে রাখাল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা সীমান্তের অধিবাসী নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য।
ফলে এরা সহজে প্রলুব্ধ হয় এবং কোন কোন রাতে ৫০০০-৬০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করে থাকে।
পরিশেষে আমাদের দাবী দুই দেশের সরকারকে গরু আমদানী রফতানীকে সীমিতভাবে হলেও বৈধতা দেওয়া হোক। এতে সীমান্তে অনুপ্রবেশ এবং হত্যাও কমে যাবে । আর আমাদেরকেও গরুপালনের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে যাতে ভারতীয় গরু ছাড়া আমরা আমাদের মাংসের এবং চামড়ার চাহিদা মেটাতে পারি। স্বাবলম্বী হওয়ার কোন বিকল্প নেই।
১। May 02, 2010|By Mark Magnier, Los Angeles Times
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।