আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্থাপত্যশিল্পের আইনস্টাইন ড.এফ আর খানের ৮৩তম জন্মদিনে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা

আমি সত্য জানতে চাই বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী ড.এফ আর খান, পুরো নাম ফজলুর রহমান খান। বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশের এই স্থপতি ও প্রকৌশলী ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তত্কালীন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যক্ষ খান বাহাদুর আবদুর রহমান। আধুনিক উচ্চ ইমারতের জনক, স্থাপত্যশিল্পের আইনস্টাইন ড.এফ আর খানের ৮৩তম জন্মদিনে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা। শিক্ষা জীবনের শুরুতে ১৯৪৪ সালে ফজলুর রহমান খান আরমানিটোলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতার শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, শিবপুর) ভর্তি হন।

ফাইনাল পরীক্ষা চলাকালে পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তিনি ঢাকায় ফিরে এলে তৎকালীন আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাকি পরীক্ষা সমাপ্ত করেন ৷ কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার এবং আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উভয় পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে তাঁকে বিশেষ বিবেচনায় ব্যাচেলর অফ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রদান করা হয় ৷ এ মূল্যায়নে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জনের পর আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্তি লাভ করেন ফজলুর রহমান খান। এর পর ১৯৫২ সালে এফ আর খান যুগপৎ সরকারী বৃত্তি ও ফুল ব্রাইট বৃত্তি নিয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন ৷ সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং তত্ত্বীয় ও ফলিত মেকানিক্স-এ যুগ্ম এম এস করার পর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ১৯৫৫ সালে তিনি আমেরিকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিড মোর এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে এ কোম্পানীর শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ৷ পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। সেখানে পরে তিনি প্রফেসর এমিরিটাস হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন ডঃ এফ আর খান নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকেও সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ৷ ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পূর্ব পদে যোগদান করেন।

(সঙ্গীত চর্চারত ড.এফ আর খান) উনিশ শ ষাটের দশকে ড.এফ আর খান একের পর এক বড় বড় সব ভবনের নকশা আঁকতে থাকেন। ১৯৬৯ সলে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ কোম্পানি তাদের সব কর্মীদের জন্য ( তখন এই কোম্পানীর কর্মচারীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার) একটি মাত্র কার্যালয় বানানোর স্বপ্ন দেখেন। সিয়ারস অ্যান্ড কোম্পানীর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেন আমাদের ড.এফ আর খান। (ফজলুর রহমান খানের নকশায় গড়া সিয়ার্স টাওয়ার, শিকাগো। ১৯৭৪ সালে নির্মিত এই ভবনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্বের উচ্চতম ভবন ছিলো) পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন (১১০ তলা, এক হাজার ৪৫৪ ফুট উঁচু) শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমানে উইওলস টাওয়ার) ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি।

১০১ একর জমির ওপর তিন বছর এক মাস ১০ দিনে সেই ভবনটি সিয়ারস টাওয়ার (১৬ জুন, ২০০৯ থেকে পরিবর্তিত নাম উইলিস টাওয়ার) দাঁড়িয়ে যায় সম্পূর্ণ মাথা উঁচু করে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এক বাঙালি ব্যক্তিত্বও। এই ভবনই ড.এফ আর খানকে এনে দেয় বিশ্বখ্যাতি। এফ আর খানের জীবদ্দশায় (১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ) তাঁর নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারই ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন এবং এখনো আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন সেটিই। (১৯৬৯ সালে নির্মিত জন হ্যানকক সেন্টার যার প্রধান ডিজাইনার ছিলেন ব্রুস গ্রাহাম এবং এর স্থাপত্য প্রকৌশলী ছিলেন ফজলুর রহমান খান ) তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে শিকাগোর জন হ্যানকক সেন্টার, সিয়ার্স টাওয়ার (Sears Tower) এর নকশা প্রনয়ন, জন হ্যানকক সেন্টার এর নকশা (১০০ তলা), জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, হজ্ব টার্মিনালের ছাদ কাঠামো (৫০,০০০ বর্গফুট), ও মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য নকশা প্রনয়ন করেন।

(হজ্ব টার্মিনালের ছাদ কাঠামো) এ ছাড়াও তিনি জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের, হজ্ব টার্মিনাল এবং মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য মডেল অংকন করেন। (জন হ্যানকক সেন্টারের প্রধান ডিজাইনার ব্রুস গ্রাহাম ও প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খান) বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন তিনি৷ ১৯৭১ সালে যখন দেশ ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ লিপ্ত, প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি একটা ফান্ড গঠন করেছিলেন। এফ আর খানই প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর গৌরবোজ্জল অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে তাঁকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।

১৯৭২ সালে এফ আর খান 'ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড'-এ ম্যান অব দি ইয়ার বিবেচিত হন এবং পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পে সবচেয়ে বেশী অবদানকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত হবার গৌরব লাভ করেন (৬৫,৬৮,৭০,৭১,৭৯ সালে)৷ ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সনে আমেরিকার 'নিউজ উইক' ম্যাগাজিন শিল্প ও স্থাপত্যের উপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে তাঁকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে ৷ স্থপতি ডঃ এফ, আর, খান আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ৷ এফ, আর, খান মুসলিম স্থাপত্য বিষয়ের উপর নানা ধরনের গবেষণা করেছেন ৷ ডঃ খান Tube in Tube নামে স্থাপত্য শিল্পের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন যার মাধ্যমে অতি উচ্চ (কমপক্ষে একশত তলা) ভবন স্বল্প খরচে নির্মাণ সম্ভব ৷ গগনচুম্বী ভবনের উপর সাত খন্ডে প্রকাশিত একটি পুস্তকের তিনি সম্পাদনা করেন ৷ ১৯৮২ সনের ২৬শে মার্চ জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন এফ আর খান৷ মৃত্যুর পর তার দেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং শিকাগোতে তাকে সমাহিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের সিয়ার্স টাওয়ারের পাদদেশে অবস্থিত জ্যাকসন সড়ক পশ্চিম পার্শ্ব এবং ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বের সংযোগস্থলটিকে নামকরণ করা হয় "ফজলুর আর. খান ওয়ে"। ১৯৯৯ সালে ফজলুর রহমান খানের স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে । ৪ টাকা মূল্যমানের এই টিকিটটিতে রয়েছে ফজলুর রহমান খানের আবক্ষ চিত্র, আর পটভূমিতে রয়েছে সিয়ার্স টাওয়ারের ছবি।

(ফজলুর রহমান খান এর সম্মানে প্রকাশিত বাংলাদেশের ডাক টিকিট) আধুনিক উচ্চ ইমারতের জনক, স্থাপত্যশিল্পের আইনস্টাইন ড.এফ আর খানের ৮৩তম জন্মদিনে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।