জনারণ্যে নির্জনতায় আক্রান্ত। নির্জনতাই বেশী পছন্দ, নিজের ভেতরে ডুবে থাকতেই ভাল লাগে। কিছুটা নার্সিসিস্টও। মোঘল শাসনামলে এই বাংলায় 'ভুলুয়া' নামে একটি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। মেঘনার পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ রাজ্য, যার অধিকাংশ এলাকা বর্তমানের বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেণী) এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এর অন্তর্ভুক্ত।
আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ওই রাজ্যের নাম লেখা আছে 'বালাজোয়ার'।
তিয়রী, রৈগা, পাগাচং প্রভৃতি অর্থহীন গ্রামের ন্যায় ভুলুয়াও একটি মৌলিক শব্দ। ভুলুয়া নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক তথ্য উপকরণ ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যেমন ‘ভুলনা’ দ্বীপ বা চর হতে ভুলুয়া নামকরণ হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে মেঘনা নদীর তীরবর্তী বঙ্গোপসাগরের মেঘনা উপকূলের একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রামের নাম থেকে ভুলুয়া নামের উদ্ভব হয়েছে।
বর্তমানের মেঘনার একটি শাখা নদীর নামও ভুলুয়া, যেটি বর্তমান লক্ষ্মীপুরে পড়েছে।
বাংলার আদি ইতিহাসে সেন বংশের রাজত্বকালকে গৌরবের ধরা হয়। হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন ছিলেন সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বিজয়সেন (মৃত্যু ১১৫৯ খৃঃ) সমগ্র বাংলার অধিপতি ছিলেন। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন মিথিলা রাজ্য জয় করে তার রাজ্য পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করেন।
যথা-রাঢ় (পশ্চিমবঙ্গ), বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ), বাগড়ী(দক্ষিণবঙ্গ), বঙ্গ(পূর্ববঙ্গ) এবং মিথিলা। মিথিলার রাজা ছিলেন বিশ্বম্ভর শূর। তিনি ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি মিথিলাধিপতি আদি শূরের নবম পুরুষ।
খ্রীষ্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কুতুবউদ্দিনের সেনানী ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী (১২০৩-১২০৫ খৃঃ) বঙ্গের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন, সেই সময় গৌড় নদীয়ার রাজাগণ স্ব-স্ব রাজ্য ত্যাগ করে পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গে পলায়ন করেন।
মিথিলা রাজ্যের বিতাড়িত রাজা বিশ্বম্ভর শুরকে এরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয়। বিশ্বম্ভর শুরের তিন-চার পুরুষ পরে সম্রাট আকবরের সময় ওই রাজ্যের রাজা হন লক্ষ্মণ মাণিক্য। তার রাজত্বকালে রাজ্যে চলছিল মগদস্যুদের উৎপাত। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মি. গ্রান্ট এ সম্পর্কে বলেন, ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভয়ানক জলপ্লাবনে বিশেষ করে মগদের দৌরাত্ম্যে সাগর তীরবর্তী অঞ্চলটি জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। লক্ষ্মণ মাণিক্য মগদের প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু ছোট ভাই রামানুজ রাজ্যের লোভে আরাকানরাজের সহায়তায় উচ্ছেদ করেন লক্ষ্মণ মাণিক্যকে। লক্ষ্মণ মাণিক্য তখন সাহায্যের আশায় ছুটে যান খিজিরপুরের ভূঁইয়া ঈশা খাঁর কাছে। ঈশা খাঁ লক্ষ্মণ মাণিক্যকে পৌঁছে দেন মোগল দরবারে এবং বাদশাহর সহায়তায় ফিরে পান নিজ রাজ্য। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে মগদের বিপক্ষে নৌ-যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে লড়তে গিয়ে মারা যান রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য।
পরে বৃটিশ আমলে ভুলুয়া জেলা'র মর্যাদা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এঅঞ্চলে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা নেন। তিনি সমগ্র বাংলাকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন করে কালেক্টর নিয়োগ করেন। এ ১৯টি জেলার একটি ছিল কলিন্দা। এ জেলাটি গঠিত হয়েছিল মূলতঃ নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে।
কিন্ত ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করে জেলাগুলোকে করা হয় প্রদেশের অধীনস্থ অফিস।
১৭৮৭ সালে পুনরায় জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং এবার সমগ্র বাংলাকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। এ ১৪ টির মধ্যেও ভুলুয়া নামে নোয়াখালী অঞ্চলে একটি জেলা ছিল। পরে ১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৮২১ সালে ভুলুয়া নামে নোয়াখালী জেলা প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চল ত্রিপুরা জেলার (বর্তমানে কুমিল্লা) অন্তর্ভূক্ত ছিল।
এখানে উল্লেখ্য, আধুনিক অর্থে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় ১৭৯০ সালে। এর পূর্বে কোম্পানীর শাসন বলতে আইনত ছিল শুধু বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব শাসন। আর সিভিল প্রশাসন ছিলো নবাবের হাতে। জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ সময় পর্যন্ত কোম্পানী কর্তৃক যে সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তা শুধু রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব থেকে কোম্পানীর আয় বৃদ্ধির জন্য। কিন্ত ১৭৯০ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ নবাবকে তার নিজামত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেন এবং রাজস্ব প্রশাসনের সাথে সমস্ত ফৌজদারী বিচার ও পুলিশী ক্ষমতা জেলা কালেক্টর এর উপর অর্পণ করেন।
ফলে সমাপ্ত হয় বাংলার নবাবী এবং প্রতিষ্ঠিত হয় সমগ্র বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচ্ছত্র শাসন। আর এ শাসন পরিচালনার সমুদয় ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করা হয় কালেক্টর পরিচালিত জেলা প্রশাসন ব্যবস্থায়।
১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে ভুলুয়া, ওমরাবাদ এবং শমসেরাবাদ পরগণার কিছু অংশ হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও অন্যান্য দ্বীপ নিয়ে নোয়াখালীকে জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তৎপূর্বে উক্ত ভূখন্ড ভূতপূর্ব ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান কুমিল্লা জেলা) অন্তর্ভুক্ত ছিল। শমসেরাবাদ বলতে বর্তমান কুমিল্লা জেলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের কিয়দংশকে বুঝানো হয়।
সমগ্র ভুলুয়া ও ওমরাবাদ পরগনা নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও পরগনাদ্বয়ের মধ্যে প্রাচীনতম পরগনা ভুলুয়া । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।