“হোমস! কোথায় যাওয়া হচ্ছে এই রাত-দুপুরে?”
“এক আসামীকে পাকড়াও করতে যাচ্ছি, স্যার। যাবেন নাকি?”
হোমসের মুখে ‘স্যার’ ডাক শুনে ওয়াটসন কিন্তু মোটেই অবাক হল না। এখানে এটাই নিয়ম।
ওয়াটসন তৈরিই ছিল। ড্রাইভারকে ডেকে সাদা পোষাকেই বেরিয়ে পড়ল দুই স্যাঙ্গাত, ১৯ বছরের পুরানো বিশ্বস্ত পিকআপটায় চড়ে।
‘কোথায় যাচ্ছি বললে না তো হে?’
হোমস নির্বিকার।
‘যাক গে!’, হোমসের মুখ থেকে আর কিছু বেরোনোর আশা ছেড়ে দেয় ওয়াটসন। তবে অন্ধকারেও তার দেঁতো হাসি টা ঠিকই লক্ষ্য করে সে।
একটা গেঁয়ো পথের ধারে আসতেই বাঁয়ে বাঁক নিতে বলল হোমস। নড়েচড়ে বসে ওয়াটসন।
খেল শুরু বোধহয়! একটা চায়ের দোকানের সামনে আসতেই গোয়েন্দাপ্রবরের নির্দেশে গাড়ি থেমে যায়। এত রাত্তিরে হতভাগার চা খাবার শখ হল কেন বুঝতে পারে না নবিস গোয়েন্দা। তবু উত্তর না পাবার ভয়ে আর জিজ্ঞাসা করল না কিছু
কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে হোমসের মধ্যে চা খাবার কোন লক্ষন দেখা গেল না। চায়ের দোকানের চারপাশের অর্ধেকটা একবার চক্কর দিয়ে এসে দুই কাস্টমারকে – বেশভূষা দেখে মনে হয় গ্রামেরই মাঝি - এক নজর পরখ করে নিয়েই সামনের পাড়ার কয়েকটা বাড়ির দিকে ইশারা করে কানে কানে কি যেন জিজ্ঞাসা করল চা-ওয়ালাকে। চা-ওয়ালাও তৎক্ষণাৎ একই দিকে হাত তুলে মাথা ঝোঁকাল।
দেঁতো হাসি হেসে সবার জন্য চা দিতে বলে হোমস আবার চা-ওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দিল।
এরই মধ্যেই মাঝি দুজন বিদায় নিয়েছে। চা খাওয়া শেষে হোমস চা-ওয়ালাকে কিছু বখশিশ দিয়ে কানে কানে আরো কিছু বলতেই চা-ওয়ালা দোকানের ঝাঁপি নামিয়ে হোমসের পাশেই গাড়িতে উঠে বসল। ওয়াটসনও বুঝে নেয় আজ রাতে তার চেয়ে চা-ওয়ালার গুরুত্বই বেশি।
পাড়ার বাড়িগুলো থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই হোমস গাড়ি থামায়।
ড্রাইভার ছাড়া বাকি ৩ জনই নেমে পড়ল। হেঁটে একটা সাধারণ বাড়ির সামনে আসতেই হোমস আস্তে জিজ্ঞাসা করে, “এটাই তো, মজিদ?” চা-ওয়ালাও মাথা নাড়ায়।
চা-ওয়ালাকে ইঙ্গিত করতেই সে দরজায় নক করে আস্তে আস্তে।
“মইত্যা”!
কোন সাড়া নেই।
“মইত্যা-আ-আআ!” গলার জোর আর হাতের থাবা দুটোই বাড়ে এবার মজিদের।
আরেকটু জোরে নক করতেই ভিতর থেকে কড়াগলায় এক মহিলা তেড়ে উঠে,”ইবে খন?”
“আঁই মজিদ!”
সাথে সাথে মহিলা কাকে যেন ঝাড়ি দেয়, “তুঁই আজু টিঁয়া ন-দ-না হারামজাদারে! খতবার খইলাম টিঁয়া লাইলি আঁর-তুন লই যাইয়ু! আর বাসাত চা খাইলি ন হয়? বা-রে খম ফরে না?”
“টিঁয়া ত ইতেরে দিই এলায় খালিয়ে!”, বলতে বলতেই দরজা খুলে দেয় স্বামীপ্রবর।
“এত রাইতে...”, মজিদের পাশে দুজন আগন্তুক দেখে মইত্যা ওরফে মতির কথা মুখেই থেকে যায়।
“স্যাররা থানা থেইকা আইসে”, মতির পাংশুটে মুখে আরো ছাই মেখে দেই মজিদ।
হোমস অভয় দেয় ভীত মজিদকে, “মতি ভাই, চিন্তার কিছু নাই। একটু জরুরি দরকারে আপনাদের ডিসটার্ব করলাম এত রাতে।
”
হোমসকে এত ভদ্রভাবে কথা বলতে দেখে খানিকটা অবাকই হয় ওয়াটসন। ঘড়িতে দেখে নেয় রাত ১২.৩০। এই গাঁয়ের জন্য রাতটা একটু বেশিই, মনে মনে ভাবে সে।
মতির বউও ঘোমটা দিয়ে হাজির হয় পাশে। “স্যার, মতির কোন দোষ নাই স্যার! হের নামে কেউ কি মিথ্যা অভিযোগ দিসে স্যার?”
“জি ভাবী, আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
ব্যাপারটা তো আমরা বুঝিই। তবু অভিযোগ যেহেতু আসছে ওকে একটু যেতে হবে আমাদের সাথে। মতি ভাই, একটু চলেন আমাদের সাথে। সকালে একটু কাগজপত্র করে দুপুরেই চলে আসতে পারবেন। ”
“আমি কি করসি...” বিড়বিড় করতে করতে তৈরি হয়ে নেয় মতি।
এতোক্ষন উশখুশ করতে থাকা ভাবী এবার বলে, “ কিসের অভিযোগ আসছে স্যার? কে দিসে স্যার? আমিও আসি স্যার? পুতুলের বাপের বুদ্ধিশুদ্ধি কম, কি কইতে কি কইয়া ফেলায় ঠিক নাই”।
হোমসও খুশি হয়ে উঠে এই প্রস্তাবে, “জি ভাবী, চলেন। অভিযোগ এর কথা আর বলবেন না... মানুষের ও খেয়ে দেয়ে কাজ নাই... আরেকজনের পিছে লাগে খামাখা... কোন অসুবিধা নাই। সকালে দুইজন একসাথেই চলে আসবেন”।
“জি স্যার, এখন আমাদের দুইটা পয়সা হইসে দেইখা মানুষের গা জ্বলে”
স্বামী-স্ত্রীর সাথে দিব্যি গল্প চালিয়ে যেতে থাকে হোমস।
ওয়াটসন এর মাথায় কিছুই ঢুকছে না কি হচ্ছে! চুপচাপ শুনতে লাগল সে। এক ফাঁকে মতি বাথরুমে যেতে চাইলে তাকে অনুমতি দিল হোমস। মতি যাওয়া মাত্রই হোমস ভাবীকে সবার ক্লান্তির কথা বলে একটু পানির ব্যাবস্থা করতে বলল। বুদ্ধিমান ভাবীও তৎক্ষণাৎ চা-বিস্কুটের ব্যাবস্থা করার কথা বলে চলে যায় রান্নাঘরে, মতির দ্রুত ছাড়া পাওয়ার আশায় বোধহয়। সাথে সাথে সচল হয়ে উঠে হোমস।
বিস্মিত চার চোখের সামনে বিছানা-টেবিলের নিচে, ড্রয়ারে, কাঠের আলমারির উপরে, পেছনে হাতড়াতে থাকে। একটু পরেই খুশিমনে বসে পরে আগের চেয়ারে।
এই ফাঁকে রান্নাঘরে ভাবিকে হাতে বটি নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে ওয়াটসন কিছুটা চিন্তিত হল। চা-বিস্কুটের জন্য বটি লাগবে কেন? মতি আসা মাত্রই চা-বিস্কুটও চলে আসল। ভাবির হাতে বটি অনুপস্থিত দেখে ওয়াটসনও কিছুটা স্বস্তি পেল, হোমসের গল্পও শুরু হল আবার।
খাওয়া শেষে মতিকে উঠার ইঙ্গিত করল হোমস। তার গিন্নীও তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে নেয়।
“তুঁই যাইবা না স... তোঁয়ার ত য’নর দরখার নাই...”, মতির হাল্কা উদ্বেগ থামিয়ে দেয় পুতুলের মা, “তুঁই আর খতা ন খইয়ু। আযু এক্কানা বুদ্দি গরি চলিত ন শিখলা”।
হোমস মজিদকে বিদায় জানায়।
ওয়াটসন আর মতিকে নিয়ে হোমস গাড়ির কাছে যেতেই মতির বউ দরজার শেকল টেনে তালা লাগিয়ে সুরসুর করে পিছে পিছে আসতে থাকল দেখে খানিকটা মজাই পেল ওয়াটসন। থানায় পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল ৭ টা।
“মতি ভাই, আমি একটু ঘুমিয়ে নি। আপনারাও একটু রেস্ট নেন। আর ভাবী কোন চিন্তা করবেন না।
সকালে লোকজন আসলেই মতি ভাইকে ছেড়ে দেব। “
পুতুলের মা আরো আশ্বস্ত হয়। থানার ডিউটি অফিসার কে ওদের দিকে লক্ষ রাখতে বলে ওয়াটসনকে হোটেলে চা খেতে নিয়ে এল হোমস।
পরটা চায়ে ডুবিয়েই ওয়াটসন এর প্রশ্ন, “তিন-কাপ চা খেয়ে ফেললাম কিন্তু কি ব্যাপার কিছুই তো বুঝলাম না হে!”
“স্যার, ৯টায় অফিসে লোকজন আসলেই বুঝবেন স্যার!”
শুনে গায়ে জ্বালা ধরে ওয়াটসনের। কিন্তু কিছুই করার নেই।
ঠিক ৮.৫৫ তে থানায় পৌঁছাই দু’জন। ঢুকতেই হোমস জিজ্ঞাসা করে নেয় মহিলা কনস্টেবল দুইজন পৌঁছেছে কিনা। একজন এসেছে জেনেই খুশি হোমস। তাকে নিয়ে থানার মুনশির রুম থেকে একটা কাগজ নিয়ে এসে বসল পুতুলের বাপ-মার সামনে। ওয়াটসনসহ।
পুতুলের মা তাগাদা দেয়, “স্যার, পুতুল আইজকা হের নানির বাড়ী থেইকা আসবো। আমাগোরে একটু সকাল সকাল ছাড়লে ভাল হয়”।
“চুপ থাকেন!”, হোমসের কর্কশ গলা শুনে ওয়াটসন নিজেই ভয় পেয়ে যায়! “লাকী বেগম! দাঙ্গা ও গুরুতর আঘাতের অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। ”
এরপর মহিলা কন্সটেবলের দিকে তাকিয়ে পড়ে শুনানোর ইঙ্গিত করতেই কন্সটেবল পড়া শুরু করল, “... ... ... একপর্যায়ে আসামি লাকী বেগমের বটির আঘাতে আমি আব্দুল হক ও আমার স্ত্রী মিনারা বেগম গুরুতর জখম হই, যার ফলে আমাদের উভয়কে ১ মাস যাবত হাসপাতালে শয্যাগ্রহণ করতে হয় ... ... ... ”
পড়া শেষ হতেই মতি বিড়বিড় করে বলে লাকীকে, “তোঁয়ারে এত্তে মানা গরিলাম ইতারার সীমানাত চারা ন’ লাগাইয়ু... খইজ্জে ন’ গইজ্জু... তুঁই ত আঁর খতা ন ধরিলা। ইয়া অইয়িনি!”
“মতি, আপনি এখন যেতে পারেন।
আপনার স্ত্রীকে কোর্টে চালান দেয়া হবে। আপনি জামিনের চেষ্টা করেন। ” হোমসের পরামর্শ শুনে মতি বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে।
“চলেন স্যার”, ওয়াটসনকে প্রায় ঠেলেই থানা থেকে বের করে আনে হোমস।
*** *** *** *** ***
“তুমি আসলে তাহলে ভাবীকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিলে?!”
“জি স্যার।
”
“এত রাতে গেলে কেন?”
“আমি আগেই খোঁজ নিসি স্যার, মহিলা ঘটনার পর থেকে দিনে বাড়িতে থাকেনা। তাই রাতে গেলাম। ”
“প্রথমে মতিকে গ্রেপ্তার করার ভান করলে কেন?”
“স্যার, মহিলা পুলিশ ছাড়া রাতে মহিলাকে গ্রেপ্তার করলে অনেক জবাবদিহি করতে হবে। তাছাড়া আসল ঘটনা বললে ওরা ওদের পক্ষের আশপাশের লোকজন ডেকে রাতে আমাদের আটকে রাখত, বা অন্য ঝামেলা হতে পারত। আমাদের বেশিরভাগ ফোর্স ৩ দিন ধরে লংমার্চের জন্য শহরে ডিউটিতে আছে।
পরশু আসবে ওরা। কিন্তু গ্রেপ্তার আদেশ তামিলের লাস্ট ডেট আজই। তাই কাজটা একটু ঘুরিয়ে করতে হল, স্যার। ”
[বিঃদ্রঃ ঘটনাটা সত্যি! ওয়াটসন আসলেই একজন নবিস গোয়েন্দা – আমাদের মহাজ্ঞানী এএসপি সাইফ ভাই। আর হোমস আর কেউই নয়, সাইফ ভাইয়ের শিক্ষানবিসকালীন কর্মস্থল সাতকানিয়া থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টর,আসল নামটা বোধগম্য কারনে উহ্য রাখলাম।
সাইফ ভাইয়ের কাছে ঘটনাটা শুনে বেশ মজা পেয়েছিলাম, তাই শেয়ার করলাম। শুধু একটু রঙ চড়িয়েছি কোথাও কোথাও, দু-একটা ডায়ালগ যোগ করেছি হয়তোবা। চা-ওয়ালা একটু দুধ-চিনি না’হয় বেশিই দিল ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।