বাংলার আলো-জলে ধূলো মেখে বেড়ে ওঠা মুক্তি রক ক্যাডেট : গারদখানার আমলনামা-এর `ষষ্ঠ' এপিসোড এটি, এর প্রথম পাঁচটি এপিসোডের লিংক নিচে দেয়া আছে।
##################################################
এই কয়দিনে সিনিয়রদের পানিশমেন্ট শেষ হয়ে গেল। এখন শরীফ আর রিজভীর পালা। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার পর হাউসের নোটিশবোর্ডে এসে নতুন নোটিশ দেখল রিজভী। ওদের একস্ট্রা ড্রিল বাতিল হয়ে গেছে।
তার বদলে সাতদিন জেল দেয়া হয়েছে ওদেরকে। নিচে এ্যজুডেন্ট মেজর দবিরের স্বাক্ষর। অবাক হয়ে গেল রিজভী। নিয়ম অনুযায়ী কোন পানিশমেন্টটা গুরু আর কোনটা লঘু তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তবে খুশিতে নেচে উঠল সে।
সাতদিন টানা এক্সট্রা ড্রিল। চিন্তা করা যায়! রিজভীর চোখের সামনে ভাসতে থাকে আগেরবারের ভয়ানক অভিজ্ঞতা। পিঠে আধমন বালুর বস্তা, নিচে পিচের রাস্তা, উপরে রোদের তাপ। দৌড় লাফ গড়াগড়ি কিছুই বাদ যায় না। একঘন্টা শেষে ঘামে ভেজা মাথা থেকে পা।
হাটু-কনুই সব ছেলা চামড়া । বিভৎস দৃশ্যগুলো আবার জীবন্ত দেখছে সে চোখের সামনে।
আর যাই হোক। জেলে থাকলে অন্তত এতো খারাপ অবস্থা হবে না। কয়েকসেট কাপড় আর নিয়ে জেলের দিকে চলে গেল রিজভী।
হাসপালের পিছনে আলাদা দুটো রুম আছে। এগুলোকে আইসুলেশন রুম বলে। এটা এক রকমের নির্বাসন। সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ থাকে তখন। শুধু সময়মতো খাবার দিয়ে যায় এসে ডাইনিং থেকে।
কেউ কোন কথা বলে না। একদম সঙ্গছাড়া করে এখানে দেয়া হয় একাকীত্বের যন্ত্রণা। শুধু সাদা দেয়াল দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এটা এক রকমের শাস্তি। কাডেটদেরকে অনেক সময় এই রুমগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে আটকে রাখা হয়।
এটাই জেলখানা।
জেলখানায় ঢুকে নিজের বিছানাটা গুছিয়ে নিচ্ছে রিজভী। এখনো বাইরে থেকে দরজা আটকে দেয়া হয়নি। এর মধ্যেই শরীফ এলো। কাপড়ের ভাঁজের ভিতর থেকে বের করে কয়েকটা বই দিল রিজভীকে।
রিজভী সেগুলো লুকিয়ে রাখল বাথরুমের ফ্লাসের আড়ালে। শুভ যাত্রা বলে একগাল হাসি দিল শরীফ। তারপর চলে গেল নিজের কামরায়।
শরীফের কাছে হুমায়ন আহমেদের কয়েকটি বই দেখেছে রিজভী। সাথে একটা প্যাডও ছিল মনে হয়।
ছেলেটার মাথায় বুদ্ধি আছে। কয়েকটা বই দিয়ে গেছে। সময়গুলো হয়তো খারাপ হবে না । উল্টো ভালোই কিছু সময় যাবে বলে মনে হচ্ছে।
শরীফ তাকে আহমদ ছফার ‘ওংকার’, ‘গাভী বিত্তান্ত’ ও শেক্সপীয়ারের ‘ওথেলো’ দিয়ে গেছে।
সুমি আপার কাছ থেকে নতুন বছরে এই বইগুলো উপহার পেয়েছে সে। সুমি আপা ওর খালাত বোন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আধুনিক বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্যে নিয়ে গবেষণা করে। তার কাছ থেকেই শরীফ বই পড়ার অভ্যাসটা রপ্ত করেছে।
কয়েকটা বই পড়েই শরীফ হুমায়নের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছে। প্রতিবার ছুটিতে বাসায় যেয়ে হুমায়নের নতুন বইগুলো কিনে ফেলে সে। তিনটি নতুন বই নিয়ে জেলে ঢুকেছে। চোখমুখ বন্ধ করে এখন শুধু পড়ে যাবে। শরীফের সময়টাও ভালোই কাটবে।
মন দিয়ে ‘গাভী বিত্তান্ত’ পড়া শুরু করল রিজভী। বিকেল গড়িয়ে রাত হল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা বুঝতেই পারে নি সে। দরজায় ঘটঘট শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠল। বইটা লুকিয়ে ফেলল পাপসের নিচে।
মেজর দবির দাড়িয়ে আছে দরজায়। রিজভী সোজা হয়ে দাড়ালো।
চোখ ঘুড়িয়ে মেজর একবার রুমটাকে দেখে নিল। তারপর রিজভীকে রুমের বাইরে আসতে বলল।
রিজভী রুম থেকে বের হয়ে এলো।
এ্যজুডেন্টের পিছে পিছে হাটছে সে। একটুপর মেজর মুখ খুলল।
হাউ আর ইউ রিজভী।
বুক টানটান করে রিজভী বলল, ফাইন স্যার।
আর ইউ রিয়েলি ফাইন।
ইয়েস স্যার।
উপরে নিচে মাথা ঝাকাচ্ছে এ্যজুডেন্ট। ইয়েস। ইউ আর রিয়েলি ফাইন। সাতটা এক্সট্রা ড্রিল মাফ পেয়ে গেছো তুমি।
তুমি আসলেই একজন ভাগ্যবান। কিন্তু তুমি কি জান- কেন তোমার পানিশমেন্টের ধরণ বদল হলো।
নো স্যার। ভীরু চোখে অজুডেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে রিজভী ।
তোমার হাউস মাষ্টার তোমার জন্য আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সুপারিশ করেছিল।
সামনে স্পোর্টস। বার্ষিক ক্রীড়া। তুমি আবার সুপার অ্যাথলেট। আর ইউ সুপার অ্যাথলেট? রিজভীর দিকে চোখ বাঁকা করে তাকালো মেজর।
নো স্যার।
ভয়ে ভয়ে রিজভী বলল।
নো ম্যান। ডোন্ট বি অ্যাফরেড। আমি তোমার ফাইল দেখেছি। টানা দুইবারের বেষ্ট অ্যাথলেট তুমি।
এবার হ্যাটট্রিক চান্স। আই কান্ট ইমাজিন। কলেজ জীবনের প্রথম দুই বছরে তিনটা রেকর্ডের মালিক তুমি। তোমার হাউজ মাষ্টার আমাকে না বললে তো আমি জানতামই না কিছু।
আই এ্যাম ভেরী হ্যাপি টু ইউর পারফরমেন্স।
বাট ইয়োর ডিসিপ্লিন ইজ ভেরী পুউর। বি ডিসিপ্লিন। এবার আরো রেকর্ড চাই তোমার কাছ থেকে। সামনে ইন্টার ক্যাডেট কলেজ অ্যাথলেটিক্স। তোমাকে বেষ্ট হতে হবে।
কলেজকে চ্যাম্পিয়ন বানাতে হবে। কলেজের জন্য তুমি সুনাম নিয়ে আসবে। এজন্যই তোমাকে মাফ করে দেয়া হলো। সাথে শরীফও মাফ পেয়ে গেল। পারফর্ম ওয়েল ইয়াং ম্যান।
এনুয়াল স্পোর্টসকে এবার প্রাকটিস হিসেবে নাও। তোমার ফাইনাল ডেসটিনেশন হবে ইন্টার ক্যাডেট কলেজ অ্যাথলেটিকস। দশ ক্যাডেট কলেজে সেরা হতে হবে তোমাকে। না হলে কিন্তু একশ’টা এক্সট্রা ড্রিল দিয়ে দিব। ট্রাই ইয়োর লেভেল বেষ্ট।
হাসতে হাসতে চলে গেল মেজর দবির।
বেশ মজা পাচ্ছে রিজভী। অ্যাজুডেন্টের কাছে এতো ভালো ব্যবহার আশাই করেনি সে। মালু স্যার এতোদিনে একটা ভালো কাজ করেছে তাইলে। মালু স্যারের প্রতিও রাগ কিছুটা কমে গেল রিজভীর।
আড়ালে থেকে লোকটা এবার খুবই ভালো একটা কাজ করেছে। মালু স্যার কখনো বিপদ থেকে বাঁচাবে তা কখনো কল্পনাও করেনি সে।
আর একমাসও নেই হাতে। খেলাধূলা শুরু হয়ে যাবে। যাই হোক এখন এই সাতটা দিন অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে।
মালু স্যার এবার হাউসকে চ্যাম্পিয়ন বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। জোড় করে পড়ালেখা করিয়েছে। দুই তলার ছেলেদের রেজাল্ট কিছুটা ভালো হচ্ছে এখন এজন্যই।
সব পয়েন্ট হিসাব করা শেষ। এখন শুধু বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টটাতে আর বার্ষিক ক্রীড়ায় চ্যাম্পিয়ন হলেই হয়।
তাহলে তিনবছর পর আবার নিজেদের হাউস চ্যাম্পিয়ন হবে। ভাবতে ভালোই লাগছে রিজভীর।
এসব নিয়ে এ্যজুডেন্টের অবশ্য কোন মাথাব্যাথা নেই। তার চিন্তা আন্তঃ ক্যাডেট কলেজ অ্যাথলেটিকস নিয়ে। যাই হোক, এই খেলাধূলার সুবাদে হঠাত করে নিজের দাম বেড়ে গেছে দেখে বেশ মজা পাচ্ছে রিজভী।
অ্যাজুডেন্ট চলে যাবার একটু পরে নিজের রুমে ঢুকল রিজভী।
রাতের খাবার দিয়ে গেল ওয়েটার। তারপর আবার দরজায় তালা মেরে দিল। নির্বাসনে এসে যে এতো সুবিধা তা আগে ভাবতেই পারেনি রিজভী। কতদিন পর যে হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছে সে।
বাটিভরা গরু ভূনা, পুইশাক ভাজি, আর ভারী করে রাঁধা মসুরের ডাল। হাত দিয়ে আয়েস করে ভাত খেল রিজভী।
তারপর আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’টা নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। পড়ে বেশ মজা পাচ্ছে সে। খুব সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যকে উপহাস করে লেখা হয়েছে উপন্যাসটা।
উপাচার্যের নাম জুনায়েদ মিয়া। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বিশেষ জায়গায় তেলবাজি, সন্ত্রাসী লালন সবকিছুই করে যাচ্ছে সে। তার কাজ-কারবার পড়ে খুব মজা পাচ্ছে রিজভী। ‘উপাচার্য’ শব্দটা শুনে যেমন নিস্পাপ আর জ্ঞানী মনে হয়, আসল ব্যাপার তাইলে তেমন না। ধারণাই বদলে যাচ্ছে।
এখনকার উপাচার্যরা সব তাহলে জুনায়েদ মিয়ার মতোই হয়। মিয়াদের তুলনায়তো মালু স্যার কিংবা মেজর দবির, এদেরকেও অনেক ভালো মনে হচ্ছে এখন।
######################
জেলখানায় সাতদিন থাকতে হলো না আর। রিজভী-শরীফ এই তিনটা দিন জেলের ভিতর অনেক ভালো সময় কাটালো। সময়গুলো তাদের ক্যাডেট জীবনের সেরা কিছু সময়ের মধ্যে অন্যতম।
কিন্তু সুখ কপালে সইলো না।
সবাই বুঝতে পেরেছে আসল ব্যাপারটা। একাকিত্ব যন্ত্রণা নয়। রিজভী আর শরীফের কাছে একাকিত্ব হলো ভালো থাকার প্রেরণা। তাই আর কেউ ওদেরকে ভালো থাকতে দিলো না।
ওরা যদি দুইদিন পর মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে যেত তাহলে ঠিকই ওদেরকে সাতদিন বন্দী করে রাখা হত। কিন্তু এই বন্দীদশার তিনদিনে ওদের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। আবার গায়ের রং ফর্সাও হয়েছে একটু। রীতিমত হাত দিয়ে ভাত খাচ্ছে। গল্পের বই পড়ছে।
আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ব্যাস। ছুটিতে বাড়িতে গেলেও এতো আরামে থাকে না কেউ।
তিনদিন পর ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হল।
পাশাপাশি দুটি রুমে থাকলেও কেউ কারো মুখ দেখেনি এই সময়টা।
রুম থেকে বের হয়ে রিজভী আর শরীফ মুখোমুখি তাকালো। হেসে দিল শরীফ। বিজ্ঞের মতো বললÑ যাক, ভালো কিছু সময় কাটলো। হুমায়ন আহমেদের নতুন তিনটা বই পড়ে ফেললাম। বেশ মজা লাগল।
বাক্স-পেটরা গুছিয়ে মন খারাপ করে হাউসে চলে গেল ওরা।
######################################
কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর মতি আবার ফিরে এল। মতির চোখের লাল ভাবটা কমে গেছে। মুখে হাসি। হাফপ্যান্ট-শার্ট আর সাদা কেডস পড়ে মতি হেটে বেড়াচ্ছে বাগানের সবুজ ঘাসের উপর।
চোখ আর মাথা ব্যথার অসহ্য যন্ত্রণা অনেক কমে গেছে। বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সুখ সুখ ভাব ফুটে উঠেছে চেহারায়।
হাত থেকে বাস্কেট বলটা ফসকে যাওয়ার পরেই মতির দিকে চোখ পড়ল রিজভীর। আহারে! কি নিস্পাপ চেহারা ছেলেটার। দেখলেই মায়া জাগে মনে।
মেহগিনি বাগানের ভিতর আস্তে আস্তে হেটে বেড়াচ্ছে মতি। কখনো বাগানের পপি ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। আবার কখনো নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘ উড়ে যাওয়া দেখছে সে অপলক দৃষ্টিতে। কি অপার্থিব সেই নির্মোহ দৃষ্টি।
বাস্কেট গ্রাউন্ড থেকে বের হয়ে এসে মতিকে ডাক দিল রিজভী।
কাছে এসে মতি একটা মলিন হাসি হেসে জানতে চাইল, কেমন আছেন ভাইয়া? মতির সাথে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে রিজভী বলল, ভালো। তুমি এখন কেমন আছ ? ব্যথা কমেছে?
মতির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হ্যা ভাইয়া ব্যথা কমেছে। গত কয়েকদিন তো ব্যথা বুঝতেই পারিনি। ডাক্তার বলেছে মাইগ্রেনের ব্যথা।
যখন ব্যথা উঠেছে তখনই ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। টানা ঘুমালাম কয়েকদিন। আজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন অনেক ভালো লাগছে। মতির মুখে একথা শুনে বেশ খুশি হল রিজভী।
আর্মির এক স্টাফ এদিকে এগিয়ে আসছে। মতিকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে ঢুকে পড়ল রিজভী। তারপর বাস্কেট বলটা হাতে নিয়ে ডিবলিং করে করে- প্রজাপতির মতো নেচে নেচে খেলতে লাগল।
ক্যাডেট কলেজ এমনি এক আজব জায়গা যেখানে খেলার সময়ও দাড়িয়ে থাকা যায় না। কিংবা একটু নিরিবিলি চিন্তাও করা যায় না কোথাও বসে।
খেলার সময় খেলতেই হবে। ঘড়ির কাঁটা মেপে মেপে জীবনকে পরিমাপ করা হয় এখানে। আবেগের কোন স্থান নেই এই যান্ত্রিক শৃঙ্খলায়। জীবন এখানে তীব্র গতিময়।
টানা একঘন্টা বাষ্কেট খেলে হাপিয়ে উঠেছে রিজভী।
ঘেমে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। সাদা গেনজি ভিজে গেছে। দরদর করে ঘাম ঝড়ছে কপাল ও চিবুক বেয়ে। আর্মির ষ্টাফ খেলা শেষের হুইসেল দিল।
বাঁশির শব্দে থেমে গেল সব ফুটবলারের দুরন্ত গতি।
ফুটবলগুলো মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নিরব হয়ে গেল। বাস্কেট বলগুলো ডিবলিং করে করে অবশেষে গড়িয়ে গেল মাঠের কোনে । আকাশের উড়ন্ত ভলিবল সেই যে নিচে পড়ল আর উঠল না। সবাই নিজ নিজ জায়গায় পাথরের মূর্তির মত দাড়িয়ে আছে। আরেকটা হুইসেলের অপেক্ষা।
স্টাফ লেফট-রাইট করে গিয়ে খেলাধূলা শেষ করার অনুমতি নিল মেজর দবিরের কাছে। মেজর দবির হাত দিয়ে ইশারায় অনুমতি দিল। এবার স্টাফ বাঁশিতে ছোটছোট দুটো ফু দিয়ে- তারপর বড় করে শেষের হুইসেল বাজিয়ে দিল।
ফু.. ফুউ... ফুউউউউ।
সাথে সাথে সবাই দৌড় শুরু করল নিজ নিজ রুমের দিকে।
জুনিয়ররা ভো দৌড়। আর সিনিয়ররা মাঠ ছাড়ছে দুলকি চালে। স্লো মোশনে দৌড়াতে দৌড়াতে।
এটাই নিয়ম। সকালের শারীরিক কসরতের পর ও বিকেলের খেলার পর কেউ হেটে মাঠ ছাড়তে পারবে না।
দৌড় দিয়ে মাঠ থেকে বের হতে হবে সবাইকে। তারপর ক্লাসে যাওয়া কিংবা ডাইনিং হলে খাবার খেতে যাওয়ার সময়ও সবাই যাবে লেফট-রাইট লেফট-রাইট করতে করতে । সিনিয়ররা অবশ্য সব সময় লেফট-রাইট করে না। কিন্তু জুনিয়রদেকে করা লাগে। এটা আইন না, ট্রেডিশান।
কলেজের আইনগুলো ক্যাডেটরা মেনে নিতে বাধ্য হয় কিন্তু মনে নেয় না। কিন্তু ট্রেডিশানগুলো মন থেকে মেনে চলে। এটা কাউকে বলা লাগে না।
দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ধরে রাখার অনেক সুবিধাও আছে। জুনিয়ররা কোন ভুল করে ফেললে সিনিয়ররা তাদেরকে সব ঠিক করে শিখিয়ে দেয়।
বিপদে পড়লে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কোন অপরাধ করে সিনিয়রের সামনে পড়লে জুনিয়রটা কতৃপক্ষের হাত থেকে বেঁচে যায়। কলেজ প্রশাসনের আইনে তখন জুনিয়র ছেলেটার কোন পানিশমেন্ট হয় না। কারণ প্রশাসন আর জানতেই পারে না। সিনিয়ররা নিজে বিপদে পড়লেও বাঁচিয়ে দেয় জুনিয়রকে।
জুনিয়রের নামে স্যার কিংবা আর্মির স্টাফদের কাছে বিচার দেয়াটা গর্হিত অপরাধ এখানে। তাই জুনিয়রদের যেকোন ব্যাপার সিনিয়ররা নিজেরাই সমাধান করে। তখন জুনিয়রদের বিচার হয় ক্যাডেটদের আদালতে। ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা ক্যাডেটদের নিজেদের আইনে। অনেক সময় তা অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতাও হয়ে যায় বটে।
######################
খেলা শেষ করে বাথরুমে গিয়ে দল বেঁধে গোসল করে সবাই। রিজভী যখন বাথরুমে গোসলের জন্য ঢুকছে তখন ক্লাসের শান্তছেলেদের গোসল শেষ। কোমড়ে তোয়ালা পেচিয়ে হাতে সাবানকেস আর ভেজাকাপড় নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আর কাকের গলায় গান ছেড়ে সাওয়ারের নিচে ভিজছে তখন দুষ্টছেলেরা।
রিজভী গোসল শেষে সাদা পাজামা-পান্জাবি পড়ে নিচে নেমে গেল।
প্রতিদিন মাগরিবের নামাজটা বাধ্যতামূলক। কিছুখনের মধ্যে সবাই এসে দাড়িয়ে গেল হাউসের সামনের পিচ ঢালা রাস্তায়। তারপর কলেজ ক্যাপ্টেন এসে মসজিদে পাঠিয়ে দিল সবাইকে।
মাগরিবের আযান দেয়ার সাথে সাথে সবাই দাড়িয়ে গেল নামাজের জন্য। প্রত্যেকটা ক্লাসের জন্য আলাদা আলাদা কাতার আছে।
সবার সামনের কাতারে ক্লাস সেভেন। দ্বিতীয় কাতারে ক্লাস এইট। এভাবে সর্বশেষ কাতারে ক্লাস টুয়েলভ।
রিজভী ওযু না করেই নামাজে দাড়িয়েছে। এই অপকর্মটা সে নিয়মিতই করে।
অবশ্য এটাকে অপকর্মই মনে করে না সে। সবাই যখন সেজদা দিতে মাটিতে মাথা ঠেকাল তখন রিজভী ডানে বামে তাকিয়ে দেখল মসজিদের অন্য কোনায় শরীফ তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাচ্ছে। রিজভীও শব্দ না করে একগাল হাসি উপহার দিল শরীফকে। পিছন থেকে কোন এক বেনামাজি সিনিয়র এসব দেখে টুপি ঢিল দিল রিজভীকে। রিজভী আবার নামাজে মেকী মনোযোগ দিল।
নামাজের পর হালকা চা নাস্তা খেয়ে সবাই চলে গেল লেখাপড়া করতে।
সবার নিজের ডেস্ক ও চেয়ার আছে। সকালে যেখানে ক্লাস হয়- সন্ধ্যায় লেখাপড়া করতে ঠিক সেখানেই যেতে হয়। রিজভী গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল। ডেস্ক থেকে কয়েকটা বই খাতা বের করে চারপাশে সাজিয়ে রাখল।
তারপর একটা মাসুদ রানার থ্রিলার বের করে পড়তে শুরু করল সে। আর শরীফ একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার জন্য।
(......................চলবে....)
পাচ নম্বর এপিসোডের লিংক নিচে দেয়া হল। আর পাচ নম্বরের নিচে বাকি চারটা এপিসোডের লিংক দেয়া আছে।
রক ক্যাডেট : গারদখানার আমলনামা- Click This Link (ফর পাঁচ নম্বর এপিসোড)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।