গত বছরের আগের বছর নেপাল ট্যুরে বিমান ভ্রমনের অভিজ্ঞতা হবার পর গত বছর বিমান ভ্রমণের আনন্দ প্রায় শূণ্যের কোঠায় চলে এসেছে। ভাবখানা এমন বিমানে চড়তে আর ভাল্লাগেনা।
আচ্ছা, ভুটানে কী রিকশায় চড়ে যাওয়া যাবেনা?
ছয় সদস্যের হারাধনের পুত্রসম দল নিয়ে এয়ারপোর্টে যখন বোর্ডিং পাস নিতে এসেছি তখন আমার এক আত্মীয়কে অকৃতকার্য ঘোষণা করে দিল বিমান কর্তৃপক্ষ। তিনি যেতে পারবেনা। তার পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যাপ্ত নেই।
এমন একটা সময়ে ঘটনা ঘটল যখন মন খারাপ করার মতো পর্যাপ্ত সময়ও আমাদের হাতে ছিল না।
এক প্রকার অমীংমাসিত বিদায় আমাদের মধ্যে হলো। আমি পাসপোর্ট আগে খেয়াল করিনি। হারাধনের একজন কমে যাওয়ার পর বাকীরাই বিষন্নতা নিয়ে বিমানে গিয়ে উঠলাম।
বিমানে ওঠার পর থেকে মন খারাপের সূচনা হলো এবং দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নিলো।
সকলেরই মন খারাপ।
আমার মন খারাপটা কিছুক্ষণের মধ্যে মেজাজ খারাপে রূপ নিলো। কারণ আমার পাশে থাকা দুই বিদেশী। এশিয়ার অনেকগুলো দেশের চু মোবারক দৃশ্যমানের চেয়ে বেশি ছোট হওয়ায় ঠিক আন্দাজ করা যায়না তারা কোন দেশের? এমনকি এটা আন্দাজ করা যায় না কে কোণটা?
তাদের ব্যাপারে ধারণার উপর চলতে হয়। আমিও করলাম।
যেহেতু এরা ট্রানজিট যাত্রী ব্যাংকক থেকে এসেছে তাই ধরে নিলাম তারা থাই সুপের দেশ থাইল্যান্ডের অধিবাসী।
থাই স্যুপ যত প্রিয় এরা ততই বিরক্তী কর ছিল। কিছুণ পর পর দাত কেলিয়ে হাসে আর ভাষার সুবিধা নিয়ে কি যেন বলে। আমি বুঝিনা বলেই বোধ হয় বেশি কথা বলে।
আমি তাদের হাসাহাসির ক্রসফায়ার থেকে বাঁচতে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিতেই জানলাম আমরা এসে গেছি।
মাত্র ৫০ মিনিটেই ভুটান। কিংডম অব রয়েল ভুটান।
২.
আমরা দ্রুক এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে নামলাম পারো এয়ারপোর্টে। পারো, তাদের একটি শহরের নাম। জানামতে এটা পৃথিবীর ছোট এয়ারপোর্টগুলোর অন্যতম।
এখানে রানওয়ের দৈর্ঘ্য অনেক কম। বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত বৈমানিকরাই এই বিমানে চাকরী করেন। যাই হোক প্রতিদিনের মতো তাদের কারসাজিতে এবার আমরাও নিরাপদে নামলাম।
নেমেই চারদিকে তাকাতে যে শব্দ বেরিয়ে মুখ থেকে, অসসাধারণ।
মনে হলো ধনীর বাড়ির গোছানো ড্রইংরুম।
যার উপরের দিকে আকাশের একটা অসামান্য চিত্রকর্ম ঝুলছে।
আকাশ এতো যে সুন্দর হতে পারে তা এই প্রথম জানা হলো।
আমাদের শরতের আকাশ দেখে আমরা এতো মুগ্ধতায় আবিষ্ট যে থাকি তার চেয়ে কয়েকগুন অসাধারণ আকাশ সেটা বলতে দ্বিধা নেই।
প্রকৃতির যত্ন নিলে প্রকৃতি যে তার নিজের ভালো চেহারাটাই যে দেখায় ভুটান তার বড় প্রমাণ।
আমরা বিমান বন্দরে নেমেই দেখলাম রাজা'রা দাঁড়িয়ে।
পুরুষানুক্রমে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে বাস্তবে নয় বিলবোর্ডে। এরা হচ্ছেন, উগিয়েন ওয়াংচুক, জিগমে ওয়াংচুক, জিগমে দর্জি ওয়াংচুক, জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুক শেষ জন বর্তমান ক্ষমতায় থাকা এবং সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রাজা জিগমে খেচার নাগেয়াল ওয়াংচুক। বিগত ১০৪ বছর যাবত যারা এই দেশকে ক্রমে ক্রমে শান্তির দেশে পরিণত করে গেছেন।
তাদের সবার প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা প্রদর্শনপূর্বক আমরা ইমিগ্রেশনে ঢুকলাম।
ভুটানের প্রকৃতির সাথে সাথে একটা বিষয় বারবার দৃষ্টিতে চলে আসছিল তাদের পোশাক। সবাই একই পোশাক পড়ে ঘুরছে। কে পুলিশ কে কাষ্টমকর্মকর্তা, কে কুলি মজুর কিছুই বুঝিনা। সব এক পোশাক। যে কারণে কুলিকে পুলিশ ভেবে ভুল করে ফেলার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম একবার।
যাই হোক আমরা বিমান বন্দরে সকল চেকআপ সেরে মূল ভুটানে পা রাখার জন্য ক্রমশ ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম।
৩.
আমি নরমালই রেডিমেড জামাকাপড়ই পড়ি। তাই দেশে খুব একটা পরিচিত দর্জি আমার নাই। বিদেশেও ছিলনা। ভূটান যাবার আগ পর্যন্ত।
ভুটানের মূল মাটিতে পা রাখতেই এক দর্জির সাথে পরিচয় হয়। নাম, সেতেন দর্জি। অসম্ভব বিনয়ী নম্র ভদ্র এক চরিত্র। যার সাথেই পরের কয়েকদিন আমার সাথে গড়ে ওঠেছিল অসম্ভব সখ্যতা। সে আমাদের গাইড।
ট্যুর অপারেটর।
দর্জির সাথে নিয়ে আসা গাড়ীতে করে আমরা প্রথমেই হোটেলে যেতে পারলাম না। আমাদের আজকের হোটেল এই পারো শহরে নেই। আমাদের হোটেল বুক করা থিম্পুতে। পারোতে আমাদের দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে এখানে দেখে যেতে হবে তাদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম।
প্রথমে আমরা খেতে গেলাম। পারোর একটা হোটেলে আমাদের খাবার ব্যাবস্থা। খাবার ইন্ডিয়ান ঘরানার। খাবার দাবার নিয়ে আমার সমস্যা পুরোনো। খেতে পারিনা।
তাই কোনোমতে মাছের জায়গায় আলু, ঝোলের জায়গায় ঢাল দিয়ে খাওয়া সারলাম। বাইরে গেলে মাংস খেতে সবচেয়ে সমস্যা হয়। তাই মাংশ অধরাই রয়ে গেলো।
কাওয়া দাওয়া শেষে আমরা গেলাম ন্যাশনাল মিউজিয়োমে। যাওয়ার যে পথ, তা সুন্দর কোনো কবিতার মতো।
যেখানে যেমন হবার কথা তেমনই। পুরোটাই পাহাড়ী পথ। এই উচু নিচু। হঠাৎ বাক। আর পথের পাশ জুড়ে ছোট নদী।
পুরো ভুটান জুড়েই নদী। দর্জি এই নদী নিয়ে বেশ বাহাদুরী ঝাড়তে চেয়েছিল। বলল, ভুটান জুড়ে প্রায় শতাধিক নদী আছে।
আমি দর্জির অহংকারকে পাহাড়ের চুড়ো থেকে ফেলে দিলাম। বললাম, আমাদের দেশে হাজার বারোশো নদী।
এবং একেকটা সমুদ্রের মতো বিশাল।
দর্জি চুপশে গেলো। আমিও ভয়েছিলাম, ভাবছিলাম দর্জি যদি জিজ্ঞাসা করে বসে তোমাদের নদীর পানি কী এতোটাই স্বচ্ছ?
আমি কী করে অস্বীকার করতাম যে আমাদের কালো পানি না।
আমরা নদীর স্রোতের মতোই গাড়ীতে ভেসে ভেসে চলে এলাম ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। ছোট্ট একটা মিউজিয়াম।
পুরোটাই ঠাসা তাদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্যের দ্রব্য সামগ্রীতে। দেখে দেখে কোথাও অবাক। কোথাও মুগ্ধও হলাম। জানলাম তাদের পোশাকের রহস্য। রাজা থেকে পিয়ন পর্যন্ত একই ড্রেস পড়লেও পার্থক্য তাদের কাপড়ের রঙে।
সব দেখে দেখে এবার রওয়ানা হলাম থিম্পুর দিকে। ঘন্টা তিনেকের পথ। পুরোটাই আমাদের হোটেল অপেক্ষা করে আছে সেখানে। আবার আমরা গাড়ীতে। পাশাপাশি দুটো মাইক্রোবাস দর্জির তত্ত্বাবধানে চলছে একই সাথে।
মসৃন রাস্তায় গাড়ীগুলো থেকে তেমন কোনো ইঞ্জিনের শব্দ না আসলেও কিছুন পর পর শুধু শব্দ আসছিল, বাহ বাহ।
বুঝলাম, ভুটানে মুগ্ধ বাঙালী সমাজ।
(চলবে)
১.ভুটান সুন্দীররা
২. ভুটানী শিশু প্রথমে ফটোশেসনে রাজী হলেও শেষ সময়ে অজ্ঞাত কারণে মুখ ঢেকে ফেলে
৩. পাহাড়ী রাস্তা
৪. গৌতম বুদ্ধের মূর্তি
৩.
৪.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।