আধুনিক যুগ দূরকে কাছে আনা বিজ্ঞানের যুগ বা যোগাযোগের যুগ হিসবে খ্যাত। সামাজিক যোগাযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার আলোকে যোগাযোগের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও বিশেষ করে ইন্টারনেট মাধ্যমের সুবাদে সামাজিক যোগাযোগের মাত্রা অতীতের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে। ইন্টারনেটে চালু হওয়া সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো মানবীয় যোগাযোগের সর্বাধুনিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এইসব চ্যানেল গ্রাহকদের ব্যক্তিগত জগতকে পরস্পরের কাছে তুলে ধরছে এবং তাদের মধ্যে দূরত্বকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
ওয়েব সাইট-কেন্দ্রীক সামাজিক চ্যানেলগুলোয় গ্রাহকরা দৃশ্যতঃ একই পর্যায়ের।
তারা এ সব চ্যানেলের নানা সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক দূরত্বের বাধাকে প্রায় পুরোপুরি অকার্যকর করতে সক্ষম।
ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক চ্যানেলগুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর এ থেকে মনে হয় গোটা ভার্চুয়াল জগত বা বিশ্বের সাথে সাদৃশ্যময় কৃত্রিম জগতটি ব্যাপক মাত্রায় এসব চ্যানেলের মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছে। আর এই চ্যানেলগুলোর অগ্রপথিক বা পথিকৃত হচ্ছে ‘ফেসবুক'। ইন্টারনেটকেন্দ্রীক সামাজিক চ্যানেলগুলোর মধ্যে ফেসবুকই বৃহত্তম।
ফেসবুক যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। মার্ক যুকারবার্গ নামের এক যুবক ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। মার্ক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ কক্ষে এটি চালু করেছিলেন। এটি কেবল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই সীমিত ছিল। ইন্টারনেটভিত্তিক এই সামাজিক চ্যানেল এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে চালু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ'র মধ্যেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী এর সদস্য হয়।
আরো কিছু দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন মানুষ ফেসবুক-এর গ্রাহক তালিকায় যুক্ত হন। এভাবে এ চ্যানেল পারস্পরিক যোগাযোগের এক শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়।
ফেসবুক পুরনো বন্ধু খুঁজে পাওয়া ও নতুন বন্ধু সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়াও এর মাধ্যমে যুব সমাজ পরস্পরের সাথে নানা বিষয়ে মত বিনিময় করছে। ফেসবুকের মত চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের এই প্রান্তের যুবক বা যুবতীরা বিশ্বের অন্য প্রান্তের যুবক ও যুবতীদের কাছ থেকে দ্রুততম সময়ে নতুন ধারণা পাচ্ছেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক বা মত-বিনিময়ে লিপ্ত হচ্ছেন।
যোগাযোগ বিজ্ঞানের উন্নতি সামাজিক যোগাযোগ ও সম্পর্ককে অতীতের চেয়ে অনেক সহজ, দ্রুততর ও বিস্তৃত করেছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
এ অবস্থায় ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক চ্যানেলগুলো বহু মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। অবশ্য এ ধরনের মাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাবই রয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক চ্যানেলগুলো ও বিশেষ করে ফেসবুক অনেক সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ল্যারি রোজেন এক গবেষণায় দেখেছেন যে, মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ফেসবুক-এর ব্যবহার মানুষের মধ্যে আত্মপূজার মনোভাব সৃষ্টি করে এবং এর ফলে দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের মানসিক অপরিপক্কতা।
যেমন, অসামাজিক আচরণ, তীব্র টেনশন বা উত্তেজনা সৃষ্টি, কিশোর ও কিশোরীদের সহিংস আচরণ প্রভৃতি। রোজেনের গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু ও বয়স্কসহ ফেসবুক-এর বহু গ্রাহক মানসিক রোগের শিকার হয়েছে।
ফেসবুক-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন এই চ্যানেলের গ্রাহক তালিকায় দুই লাখ নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। চ্যানেলটির কোটি কোটি গ্রাহক ও ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ইন্টারনেট জগতের মহারথী ও মুনাফালোভীদের লোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। এরা ফেসবুক-এর অন্ততঃ একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
আবার অনেকে ফেসবুক-এর মত মাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছেন। এ জাতীয় চ্যানেলগুলো গোপনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও সহায়তা করছে বলে জানা গেছে। এসব নেটওয়ার্কের সদস্য হওয়ার জন্য দৃশ্যতঃ কোনো অর্থ দিতে হয় না। কিন্তু অনেক সদস্যই এ ব্যাপারে অসচেতন যে, এই নেটওয়ার্কগুলো বিনা পয়সায় তাদের জীবনের অনেক গোপন ও ব্যক্তিগত তথ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে।
কথিত অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অস্যাঞ্জ বলেছেন, ফেসবুক মানুষের ইতিহাসে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে নিয়োজিত সবচেয়ে ঘৃণাব্যঞ্জক হাতিয়ার।
যারাই নিজ বন্ধুদের নাম ও তাদের জীবনের নানা দিক বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্য এই চ্যানেলকে সরবরাহ করছেন তাদের জানা উচিত যে, তারা আসলে বিনা অর্থে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। অন্য কথায় ফেসবুক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য তথ্যের এক বিশাল ভান্ডার। মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তথ্যের এইসব ভান্ডার বা উৎস ব্যবহার করছে। এভাবে ফেসবুক জনগণের জন্য ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
ফেসবুক-এর মত মাধ্যমগুলো পরিবার ব্যবস্থায় ধ্বস নামাতেও সাহায্য করছে।
এসব চ্যানেল যুব সমাজ ও পরিবারের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একদল আইনজীবী জানিয়েছেন, দেশটির শতকরা ২৫ ভাগ তালাকের ঘটনা বা মোট তালাকের এক পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী ফেসবুক। এই সাইটের অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে মার্কিন দম্পতিরা এর মাধ্যমে পরস্পরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আরো ভালো সুযোগ পেয়েছেন। এমনকি অনেক স্বামী-স্ত্রী ফেস বুকে গিয়ে স্বামী বা স্ত্রীর পৃষ্ঠায় ঢুকে তাদের গোপন সম্পর্কের সম্ভাব্য সূত্র বা লক্ষণগুলো বের করার চেষ্টা করেন।
যুবক-যুবতীদের অনেকেই নিজ জীবনের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য ফেসবুকের পাতায় তুলে ধরছেন।
এর ফলে অনৈতিক ও গোপন সম্পর্ক সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। সুযোগ-সন্ধানী বা মুনাফাকামী লোকেরা এসব তথ্য অপব্যবহার করে অন্যদের ধোকা দিচ্ছে এবং বহু যুবক-যুবতীর জন্য সৃষ্টি করছে মানসিক যন্ত্রণা ।
২০১১ সালের মে মাস নাগদ ফেসবুক-এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭০ কোটি। এসব সদস্য বা গ্রাহকের প্রায় সত্তুর শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের নাগরিক। ফেসবুক-এর দেশ-ভিত্তিক গ্রাহকদের মধ্যে মার্কিন গ্রাহকদের সংখ্যাই এককভাবে সবচেয়ে বেশি।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ফেসবুক-এর বেশির ভাগ সদস্যই আমেরিকা মহাদেশের অধিবাসী।
ফেসবুক-জাতীয় ওয়েব সাইটগুলোকে কল্যাণকর কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন, ২৬ বছর বয়স্ক তিউনিশিয় যুবক মুহাম্মাদ বু আজিজির ছবিগুলো ফেসবুক-এ প্রচারিত হওয়ায় তা আরব বিশ্বে স্বৈরাচার বিরোধী গণ-আন্দোলন জোরদারে সহায়তা করেছে। বু আজিজি তার দেশের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে নিজ দেহে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন।
আরব বিশ্বে গত নয় মাস ধরে চলা স্বৈরশাসন বিরোধী ইসলামী গণ-জাগরণে জনগণ ও বিশেষ করে যুব সমাজ ফেসবুকে প্রতিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। এমনকি বৃটেনসহ ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও সরকার-বিরোধী গণ-প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে ফেসবুক-এর মত চ্যানেলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ জন্যই পাশ্চাত্যের কোনো কোনো সরকার তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কোনো কোনো সেবামূলক খাত বন্ধ করে দিতে ফেসবুক-কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। মোটকথা, বিশ্বের জনগণ ধীরে ধীরে এটা বুঝতে পেরেছেন যে, ফেসবুক-এর মত মাধ্যমগুলোকে অনৈতিক ও নিরাপত্তাহীনতার কাজে যেমন ব্যবহার করা যায়, তেমনি এসব সামাজিক মাধ্যমকে দেশ ও জনগণের স্বার্থেও ব্যবহার করা সম্ভব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।