ঢং ঢং ঢং ঢং। স্কুলের ঘন্টাটা বেজে যাচ্ছে একনাগাড়ে। ঘন্টার কথা মনে হলেই কারোরই ছুটির ঘন্টার কথা মনে না এসে পারেনা। কিন্তু শুরুটাও যে ঢং ঢং ঘন্টার এই অনর্গল শব্দের মাধ্যমেই হয়। দিনের এই দুইটা সময়ই মনে হয় ঘন্টাটা তার ক্ষমতা দেখিয়ে সন্তুষ্টিতে ভোগে।
বাকিটা সময় এক ঘন্টা পর পর শুধু স্কুলের দাদু তার ঘন্টার সংখ্যা এক এক করে বাড়িয়ে যায়। স্খুলের ছাত্রীরাও ঘন্টার এই এক এক করে বেড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে প্রতিমূহুর্তই। এখন ঘন্টাটি বেজে যাচ্ছে সবাইকে লাইন ধরার আহবান জানিয়ে। বালিকা বিদ্যালয়টিতে আজকের মতো নিত্যদিনের কর্মসূচীর সূচনা ঘটলো। ছাত্রীরা ক্লাস থেকে বের হয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লম্বা বারান্দায় লাইন ধরলো।
সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ায় আজ বারান্দাতেই সমবেত হয়েছে তারা। মাঠটা শূন্য হয়ে পড়ে আছে।
শিলার শরীরটা ভালোনা। জ্বর জ্বর লাগছে। গলার স্বর বেশ শক্তিশালী হওয়ায় প্রতিদিনের শপথ বাক্য তাকেই পাঠ করাতে হয়।
আজ সে গলার স্বর অনেকেরই কানে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছেনা। রত্না দি এসে ধমক দিয়ে গেলেন, “এই শিলা, কিরে ভাত খাসনা? আরো জোড়ে বল। কি মিন মিন করে বলিস”? ধমক খেয়ে শিলার গলার জোড় যেন আরো কমে গেলো। অন্যান্য ছাত্রীরা শিলার সাথে শপথ পড়তে লাগলো-“আমি শপথ করিতেছি যে, বিদ্যালয়ের সকল নিয়ম-কানুন মানিয়া চলিব...”। চলিত ভাষার এই যুগে কোন কোন জায়গায় এখনো সাধু ভাষা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
সেই সাধু ভাষাতেই সবাই সমস্বরে নীতি কথাগুলো বুঝে কি নাবুঝে বলতে লাগলো। স্বরটা এক হলেও বারান্দার প্রান্তভাগে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা শিলার কন্ঠ শুনতে না পেয়ে নিজেরা আন্দাজ করে করে বলতে লাগলো। এতে দেখা গেলো শিলার আমিন বলা হয়ে গেলেও তাদের আমিন বলতে এখনো এক-দুই লাইন বাকি। জাতীয় সংগীত শুরু হয়ে গেলে আমিন বলার তোয়াক্কা না করে তারাও জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করলো। বিদ্যালয়ের সকল নিয়ম কানুন সব সময় কি মেনে চলা সম্ভব? আমিন না বললে কিইবা এসে যায়? জাতীয় সংগীতের শুধু মাত্র ই প্রত্যয় যুক্ত শব্দ গুলোতে সবাই যেন জেগে উঠে।
গেয়ে চলে তারা-“আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালোবাসি,ইইইইইই”।
ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন এই নিয়েই ছায়েরা খাতুন নামে এই স্কুলটা। কাছাকাছি একটা বয়েজ স্কুল। লোকমুখে শোনা যায়, ক্লাস সিক্স থেকে মেয়েদেরকে ছেলেদের কাছ থেকে আলাদাভাবে পড়াশোনা করে ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বয়েজ স্কুলটাতেও শুধুমাত্র ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ছেলে-মেয়ে একসাথে ক্লাস করলেও, সিক্স থেকে মেয়েদের জন্য প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যায়।
শিলা ক্লাস টেনে পড়ে। দেখতে বেশ ছোটখাটো। চেহাড়াটা মায়ায় ভরা। ইচ্ছে করলে, ক্লাস ফাইভের বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। আচার-আচরণেও বেশ শিশুসুলভ।
আর লেখাপড়ায় সবসময়ই ফার্স্ট। এই দুই কারনেই স্কুলের সব দিদিদের বেশ আদরের ছাত্রী এই শিলা।
অবিরাম ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। তবে এর সাথে তাল রেখে ক্লাসগুলো ঝমঝমিয়ে উঠেনা। আকাশ যতই মেঘলা হয়, ক্লাসরুমগুলোতে ততই আলোর বড় অভাব দেখা দেয়।
বৈদ্যুতিক বাল্বগুলোর অনেকদিন খবর না নেওয়ার কারনে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাই তার এই চরম প্রয়োজনীয়তার দিনে সে কোন কাজে আসতে পারেনি। প্রয়োজনে তার খবর নেওয়া হয় ঠিকই তাকে সারিয়ে তোলার কথাও উঠে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে আর সেরে উঠেনা। তার এই দুর্ভাগ্য আবার পড়া ফাঁকি দেওয়া ছাত্রীদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে। এমন স্বল্প আলোতে একমাত্র গল্পই ভালো মানায়।
তাই দিদিরা গল্পে মেতে উঠেন, আর সেসব ছাত্রীরা স্বল্প আলোর দীর্ঘস্থায়ীতা মনে মনে কামনা করতে থাকে। ‘আলোয় নাকি ভুবন ভরা’ অবস্থা বিশেষে অন্ধকারই কারো কারো কাছে আশার আলো হয়ে উঠে।
যাই হোক এই অন্ধকারেই নার্গিস আপা বৃষ্টির দিনের নানা অসুবিধার কথা বলে যাচ্ছেন। এমন বৃষ্টি পড়তে থাকলে তার বাড়ি যাওয়ার কি উপায়ে অসুবিধার কারন হয়ে দাঁড়াবে তাই ঠিমে তালে বলে যাচ্ছেন তিনি। এমন সময়ে তিনি শিলাকে দরখাস্ত লিখার প্রস্তাবনা করলেন।
এই বৃষ্টির দিনে এমনিও ক্লাসগুলো ঠিকমতো ক্লাসগুলো হচ্ছেনা, শুধু শুধু এই অন্ধকার রুমে বসে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই তিনি নিজের সমস্যা যে শুধু তার সমস্যা নয়, অনেক ছাত্রছাত্রী অনেক দূর থেকে আসে, এবং স্কুল ছুটি হতে হতে রাস্তায় হাঁটুপানি দাঁড়িয়ে যাবে সে বিষয়ে সবাইকে অবগত করলেন। শিলার সকলেরই প্রিয়, দরখাস্তটা তার হাত দিয়ে গেলে হয়তো ছুটি হয়েও যাবে। তাই নার্গিস আপা দরখাস্তের ব্যাপারটা শিলার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে সেদিনের মতো ক্লাস শেষ করলেন।
শিলার ক্লাসের আর একজনকে পরিচয় না করিয়ে দিলেই নয়।
নিশি। সব কাজেই তুমুল আগ্রহ। আর তার অনেক বড় বড় আশা। সেও চায় সে যেন দ্বিতীয় শিলা হতে পারে।
শিলা দরখাস্ত লিখতে বসলো।
কিন্তু এই দায়িত্বটা নিশি শিলার কাছ থেকে চেয়ে নিলো। শিলা দরখাস্তের ভাষা দিচ্ছে আর নিশি সম্পূর্ণ সাদা কাগজটায় তা লিখে তাকে আর সাদা থাকতে দিচ্ছেনা। দরখাস্ত লিখা হচ্ছে দরখাস্তের মতোই।
“আজকে সারাদিন অনেক বৃষ্টি। এমন চলতে থাকলে হাঁটুপানি দাঁড়িয়ে যাবে।
এতে স্কুলের ছাত্রীদের বাসায় ফিরতে অনেক অসুবিধা হবে। শুধু ছাত্রী নয় স্কুলের ম্যাডামদেরও বাসায় ফিরতে অনেক সমস্যা হবে”
শেষ লাইনটি শিলা অবচেতন মনেই বলেছিল। আর নিশির আইডল শিলার এই বাক্য সে দরখাস্তে টুকে নিয়েছে। দরখাস্ত দেওয়া হলো। ফলাফল ছুটি মিললনা।
ছুটি না মিলায় সবাই মনে মনে দুঃখ পেলো। কিন্তু সব চাইতে দুঃখ পেলো দরখাস্তকারী ওই দুজনেই। বলছিলামনা ওই শেষ লাইন। স্কুলের হেড মিস্ট্রেস এই দরখাস্ত পড়ার পর বুঝে গেলেন এই দরখাস্তের পিছনে কোন না কোন শিক্ষিকার ইন্ধন আছে। এই নিয়ে তিনি সব দিদিদের অনেক কথা শুনালেন।
এত গুলো কথা শুনার পর সবাই অনেক ক্ষেপে উঠলেন। এর জন্য তার সবাই ক্লাস টেনকে দোষ দিতে লাগলেন।
সেদিনকার মতো নার্গিস আপার ক্লাস টেনে যাওয়ার আর কোন কারন না থাকলেও দুপুর ছুটির পর তার সমস্ত রাগ নিয়ে গেলেন ক্লাস টেনে। ঢুকেই প্রথম কথা
-দরখাস্ত কে লিখেছে?
অতি আগ্রহী নিশি বেশ গর্বের সাথে তার নাম জানালো। এরপর যা হওয়ার তাই হলো।
ডজনখানে ভৎর্সনা প্রাপ্তি। এতোগুলো ভৎর্সনা শুনার পর নিশির গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এলো। সে ক্ষীণ স্বরেই বললো –“ম্যাডাম শিলা বলে দিয়েছে, আমি লিখেছি”। নার্গিস আপা শুনলেন। কিন্তু এমন নির্বুদ্ধিতা শিলা করতে পারে তা তার বিশ্বাস হলোনা।
তবু তিনি দু’জনকেই শাসিয়ে গেলেন, কালকেই বন্দনা দি তোমাদের একটা ব্যবস্থা করছেন। বলে রাখা ভালো, শাস্তির জন্য বন্দনা দি স্কুল বিখ্যাত।
স্কুল ছুটি হলো। কিন্তু ঠিক সময়েই। শিলা রাজ্যের ভয় নিয়ে বাসায় ফিরলো।
কালকের দিন যেন কখনোই না আসে এই মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো। ধরনী কেন দ্বিধা হয়না? রাতের বেলা শিলা একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখলো। সে দেখলো এসেম্বলীতে বন্দনা দি শিলাকে সবার সামনে কান ধরে উঠবস করাচ্ছে, আর শিলা বলে যাচ্ছে এমন নির্বুদ্ধির কাজ আমি আর কোনদিন করবোনা,কোনদিন করবনা…। সকাল বেলা উঠে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো-‘যেভাবেই শাস্তি দিক, সৃষ্টিকর্তা কেউ যাতে দেখতে না পায়!!’ স্কুলের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় শিলার পা যেন সামনে এগোতে চাচ্ছিলনা। কচ্ছপের গতিতে হাঁটার পরও এসেম্বলী সময়ের আগেই স্কুলে পৌঁছে গেলো শিলা।
নাহ এসেম্বলীতে তার শাস্তি হলোনা। ভাগ্য ভালো ছিলো। বন্দনা দি তখনো পৌঁছায়নি। এরপর এক এক ঘন্টা যায়, আর শিলার ভয়ের মুহূর্তগুলো শেষই হতে চায়না।
অবশেষে সেই মুহূর্তের অবসান ঘটলো।
বন্দনা দি এলো। কিন্তু দরখাস্তের ব্যাপারে কোন কথায় বললেন না। আসন্ন পরীক্ষা নিয়ে তিনি সবাইকে কিছু নির্দেশনা দিলেন। শিলা যারপরনাই বিস্মিত হলো। কাল যে কোন ঘটনা ঘটেছে বন্দনা দি কি তা ভুলে গেলেন?
ভয় পর্বের অবসান ঘটলো।
সেই ঢং ঢং ছুটি হলো। শিলা বাসায় ফিরলো। রাতে ভয়হীন চিন্তামুক্ত ঘুম হলো। রাতে স্বপ্ন দেখলো-“বন্দনা দি ক্লাসে এসেছেন। শিলাকে বলছেন আমি কালকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলতে ভুলে গেছি।
ভালো কথা দরখাস্তটা কে লিখেছিল??”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।