সাদ আহাম্মেদ আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেছি। মনে আছে এক গভীর সকালে কাধে একটা বিশাল ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের রাস্তা দিয়ে হেটে হেটে ওসমানী হলের দিকে যাচ্ছিলাম। আশেপাশে দু একটা রিকশা ছিলো, কিন্তু কেন যেন ভোরটা খুব উপভোগ করতে ইচ্ছা হলো। আমি হেটে যাচ্ছি, আমার পাশে কুয়াশার উন্মাদ করা সৌন্দর্য। মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোয়ার মত বের হচ্ছিলো, তাই একটা অন্যরকম ভাবে ছিলাম।
আমি আস্তে আস্তে হেটে যখন মাটির রাস্তায় পৌছালাম তখন বিশাল একটা ট্রাক কোথা থেকে যেন তেড়ে ফুড়ে এলো। আমার শেষ স্মৃতিটা ছিলো অনেক আলোয় ভরা। আমার খুব প্রিয় মুখটা সামনে এসে বললো, “এই সাবধান”।
দুঃখিত মা, সাবধান হতে পারিনি।
টার্সাল, ফেবুলা আর কি কি যেন ভেঙ্গে গেছে।
ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এমন গাধার মত রাস্তা পার হও কেন?”
আমি যন্ত্রণাকাতর চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ছাগলের মত কথা বলেন কেন?আমি সোজা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ট্রাক আধো আলোতে আমাকে দেখতে না পেয়ে বাড়ি দিছে”।
আমার মুখে এমন উত্তর শুনে ডাক্তার সাহেবের চোয়াল মনে হয় ঝুলে পড়লো। পাশের নার্স কিছু না শোনার ভঙ্গি করে আমার কাছে এসে বসে থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মাপার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ডাক্তার সাহেব একটু মনুমনু কন্ঠে বললেন, “বেশি রক্ত গরম তো। মুখে যা আসে বলে ফেলো।
তোমার মত চেংড়া পোলারে আমি দেখাচ্ছি মজা দাঁড়াও”।
আমি মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিকর আওয়াজ করি। আওয়াজটা দুটো অর্থ প্রকাশ করে। এক, ধুর মিয়া। দুই, ব্যাটা গেলি।
ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার পর নার্স ম্যাডাম আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, “উচিত শিক্ষা দিছেন। বেশি ঝাড়ি নেয় ব্যাটা”।
আমি হাসি। হাসতে হাসতে বলি, “সে জন্মের পর থেকেই এমন ঝাড়ি নেয়। আমিও জন্মের পর থেকেই তাকে উলটা ঝাড়ি মারি”।
নার্স বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি হয়?”
আমি কৌতুকভরা দৃষ্টিতে নার্সের দিকে তাকিয়ে বলি, “আমার চাচ্চু। ছোট চাচ্চু”।
দুপুরবেলা আমার চাচা হাতে একটা পত্রিকা নিয়ে আসলেন। আমাকে বললেন, “এটা পড়ে দেখ।
মাঝের পাতায় জীব বৈচিত্র নিয়ে একটা চ্যাপ্টার আছে। সেখানে আমাজনে কিছুদিন আগে পাওয়া একটা বিশাল এলিগেটরের ছবি আছে”।
আমি স্যুপ খেতে খেতে চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তুমি এত ফকিন্নী প্রজাতির কেন চাচ্চু?এইরকম মাছের ঝোলের মত স্যুপ আমাকে খাওয়াইতে পারলা?”
ছোটচাচা আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে বললো, “আমাদের হাসতালে এর থেকে ভালো স্যুপ বানানো হয়না। ২০ টাকায় এর বেশি আশা করোনা”।
আমি অসহায় দৃষ্টিতে চাচার দিকে তাকিয়ে বললাম, “একটু বিরিয়ানী খেতে ইচ্ছা করছে।
আনায় দাও”।
ছোট চাচা কিছু বলেন না। পত্রিকা রেখে উঠে চলে গেলেন। দু মিনিটের মধ্যে সকালের নার্স ম্যাডাম একটা সুন্দর থালা আর বিরিয়ানী এনে আমার সামনে উপস্থিত হলেন। চাচা আগেই এনে রাখছিলেন।
আমি এতে অবাক হইনাই। আমার ছোটচাচা আমাকে জন্মের পর থেকে এভাবেই ভালোবাসতেন। চাচী আমাকে আরো বেশি ভালোবাসতেন। তিনি মারা যাওয়ার সময় আমি পাশে ছিলাম না। নিজেকে আজও এর জন্য ক্ষমা করতে পারিনি।
চাচার কোন ছেলে মেয়ে নেই। আল্লাহ যেই মানুষটার মনে এত ভালোবাসা দিয়েছেন, তার বুকে একটা ছোট্ট প্রাণ এনে দিতে এত দ্বিধা করলেন কেন জানিনা।
পত্রিকাটা হাতে নিয়ে পাঠকের মন্তব্য আগে পড়ছিলাম। একটা চিঠিতে হঠাৎ করে দৃষ্টি আটকে গেলো। চিঠিটা পাঠিয়েছে মায়া নাজিয়া।
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়তে থাকলামঃ
“প্রিয় সম্পাদক,
আগডুম বাগডুম নামে এই পত্রিকাটি যে কতটা বিরক্তিকর তা কি আপনি জানেন?আপনার এই লিটল মাগে যে বিগ বিগ গাধামী করা হয় এটা হয়তো আপনি নিজেও বুঝতে পারেন না। দুদিন আগে সুজির হালুয়া নামে একটা বিশাল কবিতা আপনার কাব্য পাতায় প্রকাশ পেয়েছিলো। সেখানে ডায়রিয়া ও হালুয়ার সম্পর্ক উদঘাটন পূর্বক তাদের উৎকট বর্ণনা ছন্দে ছন্দে দুলিয়া আনন্দে গ্রন্থিত হয়েছে। এইরকম আলতু ফালতু কবিতা দিয়ে আপনারা দেশ ও জাতির কোনরূপ উপকার করছেন না বলে নিশ্চিত থাকুন। ছাগলের রুচিবোধও আপনাদের থেকে উত্তম।
দয়া করে পাঠককে আর বিরক্ত করবেন না এহেন কবিতা দিয়ে”।
আমি চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ মনে মনে হাসলাম। যেই মেয়েটি চিঠিটি লিখেছে তাকে হঠাৎ করে খুব দেখতে ইচ্ছা হলো। আচ্ছা মেয়েটা কি চোখে কাজল দেয়?আমার মনে হলো, তাকে একটা চিঠি লিখি। সৌভাগ্যবশত তার ঠিকানা তার লিখা প্রতিবাদলিপির নিচে দেয়া আছে।
এটা একটা সুখকর কাকতালীয় ব্যাপার। আমার মনে হলো তাকে একটা চিঠি লিখি। কিন্তু চিঠিতে কি লিখবো তা মাথায় আসছিলোনা। এইসবকিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! কিন্তু ঘুমেও মায়া নাজিয়া আমার পিছু ছাড়লোনা। জেগে উঠার পর স্বপ্নে দেখা সবকিছু প্রায় ভুলেই গিয়েছি।
আধো আধো মনে পড়ে সবকিছু। মনে পড়ে শুধু চোখে কাজল দেয়া কেউ একজনকে আমি অনেক আলোতে হাতড়ে হাতড়ে খুজে বেড়াচ্ছি। একটা প্রিয় মুখ বারবার সামনে ভাসতে থাকলো, কিন্তু আমি তাকে অনুভব করতে পারিনা কোনভাবেই।
হাসপাতাল থেকে আমাকে রিলিজ দিলো প্রায় এক সপ্তাহ পরে। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, পড়াশোনা শুরু করতে হবে।
কিন্তু উপায় নাই আইজুদ্দিন, মাইনকার চিপায় ফেসে গেছি। চাচ্চুর বাসায় যেয়ে দেখি ঘরের অবস্থা ভয়ংকর খারাপ। চাচী চলে যাওয়ার পর চাচা বাসায় থাকেন না জানতাম। রাতেও চাচা বাসায় আসতে চান না। প্রায় সময় হাসপাতালে কাটিয়ে দেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এমন করে। চাচা বলেছিলো, “ভালো লাগেনা বাসায় যেতে অর্ক। তোর চাচী একটু ঘুম পেলেই সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। আমি তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাই। এগুলা সহ্য হয়নারে”।
গভীর রাতে আমি এক দিস্তা কাগজ নিয়ে বসলাম। মায়াকে চিঠি লিখা দরকার। এই নামটা যতবার মনে পড়ছে ততবার একটা অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। পাঠককে জানানো দরকার এই নামটা কেন এত ভালো লেগেছে। আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি তখন একটু লুইস ক্যাটাগরীর ছিলাম।
আমার বাসার ছাদে একটা গোলাপ বাগান ছিলো। আমি প্রায়ই গোলাপ ফুল নিয়ে স্কুলে যেয়ে একটু কিউট টাইপ টাইপ মেয়েদেরকে তা উপহার দিতাম। বেশি কিউট হলে সাথে লাজুক ভঙ্গীতে বললাম, “এই ফুল তোমার মতই সুন্দর”।
এক মেয়ে একবার গাল ফুলিয়ে বলেছিলো, “চড় খাবি?”
সেই মেয়েটার নাম ছিলো মায়া। ক্লাস থ্রিতে মেয়েটা হারিয়ে যায়।
কোথায় হারিয়ে যায় তা অবশ্য জানিনা। শুধু মনে আছে একদিন স্কুলে এসে মেয়েটা আমার পাশে বসে পিচিক করে হেসে বলেছিলো, “আমি তোকে ভালোবাসি”।
এমন সুন্দর একটা কথা আর কেউ কখনো আমাকে বলেনি, শুনতে ইচ্ছা হয়েছিলো কারো কাছে তাও কিন্তু নয়।
মায়াকে কি লিখবো ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। আমার হাতে কলম, মাথায় অজস্র চিন্তা।
হঠাৎ করে মনে হলো, ছোট্টকালের মায়াকে নিয়েই লিখা শুরু করি। আমি তাকে লিখতে থাকলামঃ
“প্রিয় মায়া,
আমি যখন অনেক ছোট্ট তখন সেন্ট প্যাট্রিকস নামে একটি স্কুলে আপনার নামের একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। সাল ১৯৯২, আমি তাকে একটি ফুল নিয়ে প্রপোজ করেছিলাম। জবাবটা সুন্দর ছিলোনা। তাই সে প্রসংগ বাদ দেই।
আমি জানি আপনি সে নন। কিন্তু মেয়েটার প্রতি একটা ভালোলাগা সবসময় আমার হৃদয়ে আলোড়ন তুলতো। অনেকদিন পর সেই নামের কাউকে দেখে মনে হলো একটা চিঠি লিখি। এই চিঠিটা আপনাকে লিখা আমার প্রথম চিঠি। এটা শেষ চিঠি হতে পারে যদি আপনি আপত্তি করেন।
মায়া আমার ব্যাপারে আপনাকে তেমন কিছু জানানোর নেই। আমি সাধারণ একজন মানুষ। মাঝে মাঝে গল্প কবিতা লিখি, শুধু আমার জন্য। আপনাকে জানাই আমার একটি কবিতার নাম ছিলো মায়া। কবিতার শেষের চারটি পংক্তি লিখছিঃ
আচ্ছা তবে সাঙ্গ হোক এই বালুকাবেলায় কাটানো সময়টুকু
আমি নাহয় ফিরে যাই নিজ নীড়ে নির্জনে তোমায় ভাবতে
তোমার আমার না বলা কথাগুলো আজ নাহয় আড়ালে থাকলো
আমাদের ভালোবাসা বেচে থাক নয়নের অবগাহনে নীরবে নিভৃতে
মায়া, আমার সবসময় ইচ্ছা ছিলো কেউ একজন বহু দূর থেকে আমাকে চিঠি লিখবে।
আমি তাকে কবিতা লিখে দিবো আমার প্রতিটি চিঠিতে। আপনাকে বন্ধু হিসেবে চাই। কথা দিচ্ছি যোগাযোগটা চিঠি লিখালিখির বাইরে আর কিছুতে চাইবোনা। ভালো থাকুন”।
চিঠিটা পোস্ট করার দু সপ্তাহ পরে উত্তর পেয়েছিলাম।
আমি আসলে ভাবিনি উত্তর পাবো। খুব সুন্দর একটা খামে ভরা খুব সুন্দর একটা চিঠি। খামের উপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখা, মায়া। আমি সেদিন রাতের বেলা বেশ আয়েশ করে চিঠিটা পড়া শুরু করি। হলের বন্ধুরা তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
চিঠিটা খুলে আমি পড়তে পারিনা একেবারে। কারণ এত সুন্দর হাতের লিখা আগে দেখেছি মনে পড়েনা। অবশেষে পড়তে থাকলামঃ
“প্রিয় অর্ক,
আপনাকে উত্তর দেয়ার কোন ইচ্ছা হয়তো হতোনা যদিনা আপনি এমন একটা কবিতা লিখে দিতেন। আমার একটা ছোট্ট নীল মলাটের ডায়েরী আছে যেখানে আমি এমন সুন্দর সুন্দর সব কথা লিখে রাখি। আপনার কবিতাটা আমি সেখানে যত্ন করে লিখে রেখেছি।
আমি সেই মায়া নই অবশ্যই। কারণ আপনি জেনে হয়তো বিষম খাবেন আমি অত্যন্ত পিচ্চি একটা মেয়ে। মাত্রই দশম শ্রেনীতে উঠেছি। আপনার চিঠিটা আমার বাবা যখন আমার হাতে দেয় তখন বেশ পুলকিত বোধ করেছিলাম। কেউ আমাকে আগে কখনো চিঠি লিখেনি।
আমার বাবা খুব হেসেছিলো সেদিন। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো চিঠিতে কি লিখা আছে। আমি বাবাকে শুধু কবিতাটা পড়ে শুনিয়েছিলাম। বাবা আপনার কবিতা পছন্দ করেছেন।
আমার ব্যাপারে বলি।
আমার পুরোটা জগত জুড়ে আমার বাবা বাস করে। মা অনেক ছোটকালে মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আমাকে কত কষ্ট করে মানুষ করেছেন তা অনেকে হয়তো অনুধাবন করতে পারবেনা। আমার বাবা সাংবাদিক, একটু হালকা পাতলা লিখালিখি করেন। আমার কাছে আমার বাবার থেকে বড় লেখক কেউ নেই। আমার কোন ভাইবোন নেই।
আমার বাবা কিন্তু কলকাতার মানুষ। মা আর বাবা দুজনই ভারতের শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করতেন। বাবা মাকে খুব ভালোবাসতেন। তাই মা যখন বললেন, তাকে বিয়ে করতে হলে চাটগায় থাকতে হবে বাবা সব ছেড়েছুড়ে এখানে এসে পড়েছিলেন।
আমি অনেক বই পড়ি।
যা পাই তাই পড়ি। আমার যদি এমন একটা চিঠি বন্ধু থাকে তাহলে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাববো। শর্ত একটাই আমাকে বিশাল বিশাল চিঠি লিখতে হবে।
আর হা আমার প্রেমে পড়তে পারবেন না। আমি একজনকে অনেক ভালোবাসি।
সেই ছেলেটাকে বলা হয়নি এখনো কথাটা। আসলে কখনো বলতে সাহস পাইনি। বাবা বলে, কাউকে ভালোবাসলে সেটা না বললে তা আমাদেরকে মনকে দগ্ধ করে। তাই আমার উচিত ছেলেটাকে খুব সুন্দর ভাবে কথাটা বুঝিয়ে বলা। যার কথা বলছি তিনি আমাকে বাসায় এসে পড়ান।
তার একটা মাত্র বাদামী রঙের শার্ট আছে। সে যেন একটা শার্ট কিনতে পারে, এজন্য বেশ কয়েকবার বেতন দেয়ার সময় কিছু টাকা বেশি দিয়েছিলাম, ভাব ধরেছিলাম যে ভুল হয়েছে। উনি প্রতিবার ঘন্টাখানেক পরে এসে ফেরত দিয়ে গেছেন। তার নাম অয়ন। আমি তাকে নিয়ে একটা ছোট্ট কবিতা লিখেছিলামঃ
অয়ন অয়ন
আপনি আমার নিঃশ্বাসে বেচে থাকা
এক একটা জীবন
নয়নে নয়নে আপনাকে লুকিয়ে রাখি
রাখবো প্রতিটা ক্ষণ
ভালো থাকুন অর্ক।
আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো”।
প্রায় তিনবছর আমি আর মায়া চিঠির পর চিঠি লিখেছি। তাকে চিঠি লিখতে ভালো লাগতো, কারণ আমার সাধারণ মানের সেই চিঠিগুলোর সে এত্ত সুন্দর করে উত্তর দিতো আমার বেশ ভালো লাগতো।
“প্রিয় মায়া,
আজ ২২শে শ্রাবন, আমার প্রথম চিঠি লিখার তিন বছর শেষ হলো। তুমি বলেছিলে তোমার প্রেমে না পড়তে।
কিন্তু আমি হয়তো তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। কারণ তোমার প্রথম দেয়া চিঠিটা আজও আমি অনেকবার পড়ি। প্রেমের সিনড্রোম, তাই না?
আচ্ছা অয়নকে তুমি এত ভালোবাসো, তুমি হয়তো তা উনাকে কখনো বলোনি। উনি কখনো বুঝে নাই?তুমি কিভাবে এমন কিছু তার এত কাছে থেকেও লুকিয়ে রাখো বলো তো?
এবার একটা বিশেষ কথা। একদিন বলেছিলাম তোমার সাথে কখনো এই মৃত্তিকার পৃথিবীতে দেখা করতে চাইবোনা, কথা বলতে চাইবোনা।
কিন্তু আজ কেন যেন মনে হলো তোমার সাথে একবার দেখা হতেই পারে। এতোটা দিন যার সাথে এত এত কথা হলো, সে আসলে কেমন?কিভাবে কথা বলে?কেমন করে হাসে?তোমার লিখা একটা কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে যদি শোনাও তবে তা কেমন হবে?এইসব আগ্রহগুলোর জন্ম কেমন করে হলো, তা জানিনা। তোমাকে জানালাম। তুমি সিদ্ধান্ত নিও”।
এই চিঠিটা লিখার পর মায়া আমাকে খুব তাড়াতাড়ি একটা চিঠি দিলোঃ
“প্রিয় অর্ক,
ভালোবাসার কথা কাছে বসে গুছিয়ে বলতে হয়।
একসময় ভাবতাম, আমি তাকে আমার সব কথাগুলো, তার জন্য আমার ভালোবাসাটা গুছিয়ে বলবো। তার চোখে হাত দিয়ে, তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে সব কিছু তাকে জানাবো। আমি পারিনি অর্ক। ছেলেটা হারিয়ে গেছে, অনেক অনেক দূরে। যেদিন জানলাম ও আর নেই সেদিন থেকে আমি আর কবিতা লিখিনা।
আমি শুধু তোমাদের লেখা কবিতাগুলো পড়ি, তাতে হারাই। আচ্ছা আর কখনো বলোনা অয়নের কথা।
তুমি দেখা করতে চাচ্ছো জেনে একটু পুলকিত বোধ করলাম। তোমাকে বলি শোন, কোন একদিন তোমার পাহাড় নিয়ে একটা খুব সুন্দর কবিতা আমাকে লিখে দিয়েছিলে। এরপর থেকে আমার তোমাকে একটা পাহাড় দেখাতে খুব ইচ্ছা ছিলো।
পাহাড়টা আমার শহরের একেবারে শেষ মাথায়। নামটা অবশ্য জানা নেই। ক্ষমা করো তোমাকে পাহাড়টা এই জীবনে হয়তো দেখাতে পারবোনা। আর দু মাস পর আমার বিয়ে। বাবা আমার জন্য একটা বেশ সৌখিন ছেলে ঠিক করেছে।
আমার সাথে যেদিন তার প্রথম দেখা হয় সে কেমন করে যেন তাকিয়ে আমাকে দেখছিলো। আমার ভালো লাগেনি। পরদিন সে উদ্ভ্রান্তের মত আমার বাসায় এলো গভীর রাতে। হাতে একটা বিশাল বড় পোট্রেট। আমি তাকিয়ে ছিলাম সারাটা সময় আমার আকা সেই পোট্রেটের দিকে।
ইশ যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম বন্ধু।
তুমি বলেছিলে, তোমার কবিতা কেউ ছাপতে চায়না। কেউ পড়তে চায়না। আমার কি মনে হয় জানো?মানুষগুলো খুব বোকা। তুমি কি সুন্দর করে সব কবিতা লিখো,আমার অনেক ভালো লাগে।
আমরা একটা ছোট্ট বাড়ি কিনেছি জানো। সেই বাড়িতে আমার ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে আমি সবুজ পাহাড় দেখতে পাই। এর থেকে বেশি কিছু আর কি চেয়েছিলাম জীবনে। আমি অনেক রাত পর্যন্ত জেগে জেগে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে রাখি। আমার খুব ভালো লাগে যখন পাহাড়ী বুনো হাওয়া আমার হাতটা ছুয়ে দিয়ে যায়।
মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাদে ঢাকা পাহাড় দেখি। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চাদটাকে ছোয়া যাবে কিনা। বাবা কিছু বলেনি, শুধু বলেছে আমি পাগল হয়ে গেছি। আমার বাড়ির পাশে একটা ছোট্ট ফুলের দোকান আছে জানো! সেখানে একদিন সকালে আমি গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখি একগুচ্ছ নীল পদ্ম ঈষাণ কোণে লুকিয়ে রাখা।
দুষ্টু ফুলের দোকানী আমাকে কিছুতেই বিক্রি করলোনা ফুলগুলো। আমাকে বললো এই ফুলগুলো শুধু তার মেয়ের জন্য। তার মেয়েকে এভাবে থোকা ভরা ফুল না দিলে সে রাগ করে। আমি বলেছিলাম তার মেয়ের কাছে নিয়ে যেতে। আমি ছোট্ট মেয়েটাকে অনুরোধ করলে সে আমাকে একটা ফুল তো দেবেই।
আমি তখন জানতাম না মেয়েটা একটা ছোট্ট কবরে ঘুমিয়ে আছে। আমি নিজ হাতে সেই কবরে তার প্রিয় নীল পদ্ম রেখে এসেছি। একটাও আমি চাইনি।
প্রিয় অর্ক, হয়তো এটা তোমাকে লিখা আমার শেষ চিঠি। তাই তোমাকে আমার নতুন ঠিকানাটা দিলাম না।
আমি আমার পুরোটা সময়, মনোযোগ আর ভালোবাসা আমার জীবনে আসা নতুন সেই অসাধারণ মানুষটাকে দিতে চাই। কিন্তু তোমাকে একটা কথা জানাই। তুমি আমার অনেক কাছের একজন। তোমার একটা চিঠিও কেন যেন আমি একটুও অযত্ন করিনি। আমি মাঝে মাঝে ভয় পেয়েছি তোমাকে অন্যভাবে চাই কিনা তা ভেবে।
যদি চেয়েও থাকি সেই চাওয়াটা আমার মাঝে থাক। ভালো থেকো। অনেক ভালো। কখনো কবিতা লিখা ছাড়বেনা”।
আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষন।
আমার কিছু বলার ছিলোনা। একটা প্রচন্ড শূণ্যতা হঠাৎ করে আমাকে গ্রাস করে ফেললো, এই শূণ্যতার কোন আদি নেই অন্ত নেই। এই ভয়ংকর অনুভূতিটা আমাকে কখনোও পিছু ছাড়বেনা আমি জানি। আমি ভয় পাই, এই গভীর রাতে মায়ার চিঠির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই ভয়টা আরো বাড়ে। কি অদ্ভুত ! এই মেয়েটাকে কখনো দেখিনি, তার কন্ঠ কখনো শুনিনি।
অথচ আজ মনে হচ্ছে আমার সবচেয়ে কাছের একজন হারিয়ে গেলো।
এরপর এক মাস আমি একটা প্রচণ্ড জরায় জরাজীর্ণ হয়ে ছিলাম। আমি একের পর এক চিঠি লিখেছি মায়াকে। আমি মায়াকে বলতে চেয়েছি আমি তাকে আর চিঠি লিখতে চাইনা। রোদেলা একটা শুভ্র সকালে অথবা আধার কালো নিশুতি রাতের অল্প একটু রুপালী আলোয় আমি তার পাশে বসে তাকে আমার জীবনের সবগুলো জরুরী কথা বলতে চাই।
আমি তাকে জানাতে চাই এই পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর কবিতাগুলো আমি তার জন্য লিখবো।
এতোগুলো চিঠি লিখে পাঠানোর পর একটারও উত্তর পাইনি। একটারও না। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমি ভুল ঠিকানায় চিঠি দিয়েছি। একসময় বুঝতে পারলাম, কাউকে চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটায় ভয়ংকর একটা নিষ্ঠুরতা আছে।
কখনো কখনো কাউকে প্রবল ভাবে চাওয়া যায়। বিশ্বাস করুন সেই চাওয়ার কোন সীমা আপনি খুজে পাবেন না। সেই চাওয়াটা আপনাকে সারা দিনমান গ্রাস করে রাখবে। আমি ঠিক তেমন সর্বগ্রাসী রুপে মায়াকে চেয়েছিলাম। নিষ্ঠুরতাটা লুকিয়ে আছে, এই মানবী যাকে আমি এমন করে চেয়েছি সে আমার চোখের সামনে হারিয়ে যাচ্ছে।
একদিন অনেক অনেক ভোরবেলা আমি সিদ্ধান্ত নিলাম চাটগা যাবো। আমি জানিনা সে এখন কোথায় থাকে। আমি শুধু একবার জেনেছিলাম তার বাসার পাশে একটা ছোট্ট ফুলের দোকান আছে যেখানে নীল পদ্ম পাওয়া যায়। আমি জানিনা কিভাবে কোথায় তাকে পাবো। আমাকে যেতে হবে।
যেভাবেই হোক যেতে হবে।
রম্যবচন নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের সামনে আমি বসে আছি। আমার উশকোখুশকো চুল দাড়ি দেখে সম্পাদক আনু ভাই আমাকে বললেন, “তোমার কবিতা যেটা ছাপাইছি সেটা আমার ভালো লাগেনি ব্যক্তিগতভাবে। তোমরা আধুনিক পোলাপাইন কবিতা লিখো ছন্দ ধরে। একটা লিমেরিক কেমনে লিখতে হয় তা কি তোমরা জানো?তোমরা শুধু সত্যেন্দ বাবুরে ফলো মারো।
কবিতার ভিতর ওই জিনিসটা থাকতে হয়। তোমাদের ওটা কেন যেন থাকেনা। যাই হোক তারপর কেন আসছিলা বলো?”
আমি সরাসরি তাকে বলি, “আনু ভাই আমার কবিতা ছাপা হইলে বলেছিলেন ৫০০ টাকা দিবেন। টাকাটা কি আজকে পেতে পারি?আমার একটু কাজ ছিলো ঢাকার বাহিরে। টাকাটা খুব জরুরী দরকার ছিলো”।
আনু ভাই পান চিবোয়। আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বলে, “আমার একটু কাজ আছে। তোমার সাথে পরে কথা হবে। এখন বিদায় হও”।
আমি টাকাটা নিয়ে চলে আসি।
আমি জানি আনু ভাইয়েরা আমার প্রয়োজন বুঝবেনা। একবার মনে হলো ছোট চাচার কাছে যাই। কিন্তু ইচ্ছা করলোনা। চাচার কাছে টাকা চাইলে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতেও হবে। এটা সম্ভব না, একদম সম্ভব না।
আমি কাউকে ওর কথা বলতে চাইনা। বললে কেমন যেন আরো শূণ্যতা বোধ হয়। আমার কাছে সব মিলিয়ে গুণে গুণে এখন ৭৫২ টাকা আছে। এর মধ্যে ট্রেনের টিকেট কিনতে খরচ হয়েছে ৫১২ টাকা। বাকি টাকাটা দিয়ে কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছিনা।
আমার জমানো টাকা সব আমার এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছি কিছুদিন আগে। বাবা মা টাকা পাঠাতে আরো এক সপ্তাহ। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বুঝলাম ধার কর্জ করতে হবে। আচ্ছা তাই নাহয় করা যাবে।
পরের দিন খুব ভোরে যখন চাটগা পৌছালাম তখন পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে। আমার প্রচন্ড শীত লাগছিলো। গায়ে শাল জড়িয়ে আমি রেল স্টেশন থেকে বের হয়ে আসলাম। মায়ার শহরে এসে আমার বেশ ভালো লাগছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন মায়ার স্পর্শ পাচ্ছি শীতল কুয়াশার হৃদকম্পনে।
আমি জানিনা মায়াকে কিভাবে খুজে পাবো। আমি শুধু জানি আমাকে সেই ফুলের দোকানটা খুজে বের করতে হবে। মায়াকে খুজে পেতেই হবে। তাকে হারানোর সামর্থ্য আমার নেই।
আমি পাগলের মত চাটগার আশেপাশে ঘুরতে থাকলাম।
রাস্তায় দিকহীন হয়ে আমি হাটতে থাকি। আমি জানিনা আমার ঠিক কোথায় যেতে হবে। একটু পরপর বিরতি নিয়ে আমি আশেপাশের মানুষজনকে ফুলের দোকানের কথা জিজ্ঞেস করি, পাহাড়ের কথা জিজ্ঞেস করি। অনেকগুলো ফুলের দোকানে আমি গিয়েছি, নীল পদ্মর কথা জিজ্ঞেস করেছি। কেউ আমাকে তার সন্ধান দিতে পারলোনা।
একটাসময় ক্ষুধায় ক্লান্ত হয়ে আমি রাস্তার ধারে ফুটপাতের ওপর বসে পড়লাম। তখন রাত্রি সাড়ে দশটা বাজে। হঠাৎ করে মনে হলো আমি যদি তাকে আর না পাই। এটা ভাবতেই আমার ভিতরে অসহ্য একটা কষ্ট জন্ম নিলো। আমি জানিনা কবে থেকে মায়াকে এমন করে চেয়েছি।
আমি জানিনা মায়াকে কেন এত ভালোবাসেছি। মায়াকে বলতে চাই, আমার সমস্ত সত্তায় সে বাস করে। প্রতিমুহূর্তে প্রতিক্ষণে সে আমাকে ছেয়ে থাকে।
এই জগৎটা অনেক নিষ্ঠুর, এটা আমার থেকে ভালো কে বুঝতে পেরেছিলো। আমি প্রায় দশদিন চাটগার এখানে সেখানে ঘুরে যখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে গেলাম তখন কিছু দয়া দাক্ষিন্য আমাকে আবার বেচে থাকতে সাহায্য করেছিলো।
সেই অচেনা অজানা মানুষগুলো আমাকে আমার শহর ঢাকায় পৌছিয়ে দেয়। বাবা মা, ছোট চাচা আমাকে খুব বকেছিলো। আমাকে অনেক প্রশ্ন তারা করেছিল, আমি কোনটির উত্তর দেইনি। কিভাবে তাদেরকে বলবো, কয়েকটা চিঠির পরিচয়ে মায়াকে অন্তহীন ভালোবাসার কথা। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম নিঃশব্দের গহীনে।
মাসখানেক একটু স্বাভাবিক হয়ে ভার্সিটির হলে গেলাম। আমাকে দেখে আমার বন্ধুরা অবাক চোখে তাকালো। এভাবে টার্মের মাঝে দেড় মাস ছুটি নিয়ে পাগলামী করে বেড়ালে কারো স্বাভাবিকভাবে তাকানোর কথা না। ক্লাসে গেলে ফারিয়া আমার পাশে বসে। আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে, “দোস্ত তোকে কেমন যেন ভয় লাগতাছে”।
আমি ওর দিকে তাকাই। ও আরো ভয় পেয়ে যায়। আমি অনেকদিন পর একটু হাসি। ওকে হাসতে হাসতে বলি, “একটু পাগলামী হয়েছিলো। ঘুরে বেড়াইছি রাস্তা ঘাটে।
এই কয়দিনে যে ক্লাস নোট গুলো তোলা হয়নি সেগুলো সুন্দর করে আমাকে বুঝায় দিস। ঠিক আছে?”
রাতের বেলা হলে পৌছালে দীপু আমাকে বলে, “দোস্ত তোর একটা চিঠি আছে। তোর মাই ডিয়ার প্রেমিকা দিছে। আমি কি তোরে আবৃত্তি করে শোনাবো?”
আমি কিছুক্ষণ নীরব থাকলাম। তারপর বললাম, “চিঠিটা দে”।
মায়ার আমাকে লিখা শেষ চিঠি। আমি জানি এই চিঠিতে মায়া আমায় তার বিয়ের দাওয়াত দেবে। বিয়ের জমকালো সাজপোশাকে তাকে কেমন লাগে একথা বলবে। মায়াকে একটা চিঠিতে বলেছিলাম, সে চোখে কাজল দেয় কিনা। কেন যেন মনে হচ্ছে মায়ার বিয়েতে মায়া তার নয়নজোড়া কাজল দিয়ে আকবে।
আমি চিঠিটা খুলতে খুলতে মায়ার কাজল চোখে দেয়া একটা ছবি কল্পনা করতে চেষ্টা করি। আফসোস তাকে আমি কখনো দেখিনি।
“প্রিয় অর্ক,
তুমি আমাকে এমন ভয়ংকর চিঠিগুলো কেন দিয়েছো জানিনা। আমি তোমার চিঠিগুলো পড়ে রাগ করেছিলাম অনেক। আমি তোমাকে এতবার বলেছি আমাকে ভালো না বাসতে, অথচ তুমি তাই করলে।
তবুও বলি, তোমার চিঠিগুলোতে একটা পাগলাটে ভালোবাসার সৌরভ ছিলো। আমি তা অনুভব করেছি প্রতিটা সময়।
একদিন আমার হবু বর আমার ছবি আকছিলো আমার পাশে বসে। আমার খুব ভালো লাগছিলো জানো। সেসময় হঠাৎ করে একটা কবিতা আমার মাঝে খেলা করলো।
আমি গুনগুন করে তা আবৃত্তিও করছিলাম। এই কবিতাটা তুমি আমার জন্য লিখেছিলে। যদিও তুমি বলোনি কবিতাটা আমার জন্য, তবুও আমি জানতাম অর্ক এই কবিতাটা শুধু আমাকে নিয়েই লিখতে পারে। জানো তোমার কবিতাটা আমি যখন আবৃত্তি করছিলাম তখন আমার পুরো নয়নজুড়ে একগাদা জল এসে পড়লো। অর্ক আমি তোমাকে কতটা চাই এটা ঠিক সেসময় বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাকে ক্ষমা করো, আমি ব্যাপারটা আগে এমনভাবে বুঝতে পারিনি। আমি আসলে বুঝতেও চাইনি। একবার একজনকে ভালোবেসে ধাক্কা খেয়েছিলাম তো, তাই ভয় পেয়েছি। ভেবেছিলাম আমার পরিবার যাকে ঠিক করে দেবে ঠিক সেই মানুষটাকেই ভালোবাসার চেষ্টা করবো। তুমি মাঝ দিয়ে এসে সব উল্টিয়ে দিলে।
এমন করে আমাকে পাগল করলে কেন?
অর্ক খামের পিছনে আমার ঠিকানা লিখা আছে। তোমাকে দেখার জন্য এই আমি সারাটিদিন আমার বারান্দায় বসে থাকি। একা একা আর পাহাড়টা দেখতে ইচ্ছা করেনা। তোমার ভালোবাসার মানুষকে আর অপেক্ষার কষ্ট দিওনা। কবে আসবে?”
মায়ার চোখে কাজল লেপ্টে ছিলো।
আমার বারবার মনে হচ্ছিলো তার চোখ দুটো ছুয়ে দিতে। আচ্ছা এই মানবীকে আমি কেমন করে এমনটা চেয়েছিলাম। আমার তার প্রথম দেখায় আমি তার দিকে তাকিয়ে প্রথম কথাটা বলেছিলাম, “একটু তোমার গালে হাত রাখি?একটু চোখটা ছুয়ে দেই?”
মায়া মাটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। আমি তার চোখে আমার জন্য গাঢ় ভালোবাসা দেখতে পাই। আমি অপেক্ষা করি কখন তার গালে হাত দিয়ে ভালবাসার কথা বলবো।
তাকে বোঝাবো, এই ভালবাসাটা শুধু একটা মানুষের জন্য। আমার খুব ভালো লাগছে অপেক্ষার সময়টুকু।
*************************************************************
এই গল্পটার অর্ধেকটা লিখে আমি অনেকদিন একটা উপসংহারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটা অসম্পূর্ণ গল্প লেখকের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক। ভাগ্যক্রমে দুদিন আগে সেই যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটেছিলো।
প্রিয় পাঠক, আমার লুতুপুতু লেখাগুলো থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেও পারছিনা। তবে এটা একটা সত্যি গল্প, বিশ্বাস করুন আর নাইবা করুন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।