সংবাদপত্রেরচে’ ক্ষণস্থায়ী আর কোনো প্রজাতি আল্লার জমিনে আছে বলে আমার জানা নেই। বিশেষত দৈনিক সংবাদপত্র। ‘প্রজাতি’শব্দটির প্রয়োগে কারো প্রশ্ন থাকলে জানিয়ে রাখি, সংবাদপত্রকে জড়পদার্থের কাতারে গণ্য করার কোনো কারণ নেই। আমি দৃঢ়ভাবেই মনে করি, সংবাদপত্রের জীবন আছে। জীবনি শক্তি আছে।
সেই শক্তি প্রয়োগের শক্তিও আছে। এবং সেটা অন্য যে কোনো কারো চেয়ে অনেক বেশি।
২৪ ঘন্টারও কম এক্সপেয়ার ডেট নিয়ে জন্ম নেয় একটি খবরের কাগজ। শারীরিক গঠন প্রণালীর দিক দিয়ে সেই কাগজ আবার খুবই দুর্বল। আমরা বলি নিউজ প্রিন্ট।
একই সঙ্গে আবার স্থায়িত্ব ও ক্ষমতার দিক দিয়ে বিচার করলে সংবাদপত্রের ধারেকাছেও কিছু নেই। এক্ষেত্রে নিউটন সাহেবের তৃতীয় সূত্রটি বেশ ভালভাবেই কার্যকর। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে।
একটি দৈনিক সংবাদপত্রের আয়ূস্কাল কয়েকঘন্টা মাত্র। আবার শত বৎসরও।
যুগের পর যুগ চলে যায়, বর্তমান হারিয়ে যায় অতীতের অরণ্যে, তবুও হারিয়ে যায় না সংবাদপত্রের কিছু অক্ষর, কিছু শব্দ। যুগ যুগ পরে আবারো ফিরে আসে নতুন করে, নতুন লেখকের হাত ধরে। দেশসেরা লেখকের কলমে শতবছর আগের সংবাদ কিংবা প্রতিবেদন উঠে আসে উদ্ধৃতির চাঁদর গায়ে জড়িয়ে। সঙ্গতকারণেই স্থায়িত্বের মানদন্ডে সংবাদপত্রের অবস্থান অনেক শক্ত ও মজবুত। স্বীকার করতেই হবে।
অত্যন্ত দুর্বল অবয়বে গঠিত একটি সংবাদপত্রের ক্ষমতা কতো?
কথাটি সহজে বুঝবার জন্য কিছু বাস্তব চিত্র সামনে নিয়ে আসা যেতে পারে। আমাদের দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চিহ্নিত অপরাধীকে ধরার পর কখনো কখনো আবার ছেড়েও দেয়, লাল টেলিফোন’র চাপ থাকলে। মাঝেমধ্যে লেনদেনজনিত সন্তোষজনক পরিবেশও এক্ষেত্রে ভুমিকা রাখে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু মিডিয়া বা সংবাদপত্র কোনো অপরাধীর পিছু নিলে তাকে কবরে পোঁছার ব্যাবস্থা না করে পিছু ছাড়ে না। শায়খ রহমান ও বাংলা ভাই’র কথাতো আমরা এখনো ভুলে যাই নি! বাংলা ভাইকে ধরা হয়েছে আবার ছেড়ে দেয়াও হয়েছে।
কিন্তু মিডিয়া যখন ধরেছে, প্রশাসন আর ছাড়তে পারে নি।
চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড শারমিন রিমা হত্যার ঘাতক মুনির বেঁচে যাওয়ার রাস্তা তো প্রায় বের করেই ফেলেছিলো। সম্ভব হয়নি মিডিয়ার কারণে। এরশাদ শিকদারের কথা কি মনে আছে? ‘‘আমি তো মরে যাবো চলে যাবো রেখে যাবো সবি- আছিস কি কেউ সঙ্গের সাথী সঙ্গে আমার যাবি, আমি মরেই যাবো...’’গান বানিয়ে ছিলো সে। নিস্তার পায় নি।
স্বর্ণকমল ছেড়ে তাকেও চলে যেতে হয়েছে । সঙ্গের সাথী দূরে থাক, প্রকাশ্যে পাশে দাঁড়ানোর মতোও কাউকেই পায়নি। কারণ পেছনে ছিলো মিডিয়া। আরো স্পেসিফিক করে বললে প্রিন্ট মিডিয়া বা সংবাদপত্র। তখনকার সময়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এতো তোড়-জোড় ছিলো না।
একবার তাহলে ঘুরে আসা যায় জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা পাড়ায়। দেখে আসা যায় সেখানকার চিত্রটি কেমন?
নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষহীন ভালো পত্রিকা যেগুলো, (জানি না কোনগুলো, আছে নিশ্চই) সেগুলো নিয়ে কথা নেই। আমার বক্তব্য পাইকারিগুলো নিয়ে। রং মাখিয়ে ‘সঙ’ সাঝিয়ে বাজারজাতকৃত পত্রিকার কোনো অভাবই নেই দেশে। ব্যাঙ'র ছাতার সাথে তুমূল প্রতিযোগিতা করে যেভাবে নতুন নতুন পত্রিকা গজাচ্ছে, তাতে করে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরো’র পক্ষেও সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
যদিও সংবাদপত্রের আধিক্য আশাবাদি হবার মতেই ব্য্যাপার ছিলো, কিন্তু সততা ও বস্তুনিষ্টতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যবসাপ্রধান নীতি অবলম্বন করে সংবাদের পরিবর্তে সঙবাদ প্রকাশে বেশি পারদর্শী অই পত্রিকাগুলো জাতির জন্য বরং খতরনাক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ভুল তথ্য পাওয়ারচে’ তথ্য না পাওয়াইতো ভালো। ফারসি একটি কবিতাংশ হচ্ছে, কুউওয়াতে নেকি নাদারি বদ্ মকুন। এর মানে নেকি করতে না পারলে অন্তত গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা দরকার। সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি পায়ে দলে অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ পরিবেশনকারী অনেকগুলো সংবাদপত্রেরচে’ সংবাদপত্র না থাকাইতো ভালো।
জন্ম ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে কিছু পূঁজিপতি আছেন, গরীবের ঘাম বিক্রি করে করে যারা প্রচুর টাকা-পয়সা বানিয়ে ফেলেছেন। পত্রিকা প্রকাশ করা আজকাল তাদের অন্যতম একটি শখে পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বড় কোনো ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান একটি পত্রিকা বের করলে প্রতিপক্ষ প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রত্রিকা বের করার আগ পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে প্রেস্টিজ ইস্যু প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মেঘনা গ্র“প (মনে করা যাক আর কি) কালান্তর নামে পত্রিকা বের করে ফেলেছে।
অতএব, বুড়িগঙ্গা গ্র“পকে তো আর বসে থাকলে চলে না। আবার আসুন্ধরা গ্র“পও যে কারোচে’ কম না, সেটা প্রমাণ করারওতো একটা ব্যাপার আছে। অতএব, মোমের আলো, জমানার কণ্ঠ ...
এগুলোকে সংবাদ সেবা না বলে পত্রিকাবাণিজ্য বলাই ভালো। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং নিজেকে ডিফেন্স করার কাজেই অসব পত্রিকাগুলো বেশি সচল থাকে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আছে, টাকাগুলো গিলে ফেলার নিয়ত করা হয়েছে, অতএব, হজম করার সুবিধার জন্য একটি পত্রিকা থাকলে সুবিধা।
ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা দরকার, নিজের ঝুড়িতে একটি পত্রিকা থাকলে অনেক সুবিধা। কাজটি আসান হয়ে যায়। ঠিক যেমনটি আমরা এই কিছুদিন আগেও হতে দেখলাম। দু’য়েকটি জাতীয় পত্রিকার আচরণে। এই যদি হয় অবস্থা, সংবাদপত্রের খাসলত যদি হয় ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করা বা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, অথবা এটা যদি হয় নিছক বাণিজ্য, তাহলে কী আর করা?
আমাদের সমাজে আরো কিছু ওজনদার লোক আছেন, মারাত্মক জ্ঞানী লোক।
বুদ্ধির ফেরিওয়ালা। কেতাবি ভাষায় যাদের নাম বুদ্ধিজীবি। মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ি বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা অর্থে তারা বুদ্ধিজীবি হলে বাংলাদেশে তাদের বেঁচা-বিক্রি কখনো মন্দ হয় না। তাদের স্টকে সিজনাল মাল থাকে প্রচুর । যখন যেটা দরকার, মার্কেটে সেটাই ছাড়েন।
সিজন পরিবর্তন হলে পণ্যও পাল্টে ফেলেন। এই বুদ্ধিটি তাদের ভালোভাবেই আছে। স্বাধে কি আর তারা বুদ্ধিজীবি!
আমরা এমন অনেক বুদ্ধিজীবির কথা জানি, বঙ্গবন্ধুর সময়ে যারা গাছেরটা খেয়েছেন গোড়ারটাও ছাড়েন নি। প্রশংসা করতে করতে বঙ্গবন্ধুকে তখন অনেকটা ফেরেশতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা তাদের মনোভাবেরও পরিবর্তন করে ফেলেছেন।
তখন বঙ্গবন্ধুকে আর তাদের কাছে ফেরেশতাতো পরের কথা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য ইয়াহইয়া খানের সঙ্গে আপোষকামী একজন সাধারণ মানুষেরচে’ বেশি কিছু মনে হয় নি।
কিছু আছেন এমন, বঙ্গবন্ধুর কাছে যারা অন্যায় আবদার নিয়ে গিয়ে পাত্তা পাননি বা সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসুন্দর মন্তব্য করতেও ছাড়েন নি। আজকাল তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর নামের তসবীহ জপে জপে পেরেশান। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সকল মৃত মানুষকে সাক্ষী বানিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন বঙ্গবন্ধু তাকে কতো বেশি ভালো বাসতেন। দেশের প্রতি তাদের ভয়াবহ দরদের কারণে স্থায়ীভাবে বিদেশে পড়ে থাকেন।
আমরা এমন অনেক বুদ্ধিজীবির কথা জানি, একসময়, সময় ভালো ছিলো যখন, সকাল-সন্ধ্যা যারা কুর্ণিশ করতেন পল্লিবন্ধুর চৌকাটে। সেই পল্লিবন্ধু, যে নেককার লোকটি প্রতি বৃহস্পতি বার দিবাগত রাতে একটি বরকতি স্বপ্ন দেখতেন। এবং পরেরদিন দলবল নিয়ে যথারীতি হাজির হতেন স্বপ্নে দেখা সেই মসজিদে। গিয়ে বলতেন, আমি গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনাদের মসজিদে জুমআর নামাজ আদায় করছি... , সেই নেতাকেও আজকাল তার সময়ে সুবিধাভোগিরা গালি-গালাজ করেন। অন্যরা একবার স্বৈরাচার বললে তারা দশবার বলতে চেষ্টা করেন।
এই ক্যাটাগরির বুদ্ধিজীবিরা যখন বুদ্ধি বিক্রির জন্য ভালো কাস্টমার পান না, তখন তারা তাদের মালদার ব্যবসায়ী বন্ধু-বান্ধবকে মটিভেট করেন একটি পত্রিকা বের করার জন্য। এতে প্রধান দু’টি লাভের মধ্যে একটি লাভ হলো, স্বাস্থ্যবান ফিগারের বেতন-ভাতা ,বাড়ি-গাড়ি এবং এক্সট্রা অডিনারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আর দ্বিতীয়টি হলো, মাথার ভেতরে কিলবিল করতে থাকা সৎ/অসৎ চিন্তাগুলো সমাজে ছড়িয়ে দেয়া যায়।
বিশেষ ব্যাক্তি, গোষ্টি বা দলের পদলেহন বা তল্পিবহন যদি হয়ে যায় একটি পত্রিকার মূলনীতি, পত্রিকাটি যদি তার জন্মদাতা ও অন্নদাতাদের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করতে থাকে, তাহলে সেই সংবাদপত্রের আর জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না।
ব্যাবসায়ি বুদ্ধিজীবিদের খপ্পরে পড়ে কিছু কিছু সংবাদপত্র আজ নিজস্ব ঐতিহ্য হরাতে হারাতে অস্তিত্বই হারাতে বসেছে।
এর প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশে কোনো মিডিয়া নীতিমালা নেই। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে কেউই জবাবদিহিতার উর্দ্ধে নয়। অন্তত থাকা উচিৎ নয়। অথচ আমাদের দেশে সংবাদপত্রগুলোকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। যার ফলে সেচ্ছাচারের দরজা-জানালা খোলাই থাকে।
ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য পত্রিকার ব্যবহার উচিৎ নয়, আমাদের দেশে তাই হয়। ব্যক্তিগত জেদ বা আক্রোশ মেটানোর জন্য পত্রিকার ব্যবহার কাম্য নয়, আমাদের দেশে তা-ও হয়। যে কারণে বস্তুনিষ্টতা নামক ব্যাপারটিকে পত্রিকার পাতায় না খুঁজে যাদুঘরে গিয়ে তালাশ করা উচিৎ কি না, কিছু কিছু মানুষ আজকাল তাই ভাবতে শুরু করেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।