আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নার্গিসকে লেখা কবি নজরুলের ঐতিহাসিক চিঠি-6

আর একটা ছোট কথা এইখানে মনে পড়ে গেল। শুনে তুমি হয়ত আমায় কী ভাববে, জানি না। তোমার বিরুদ্ধে যে যে কারণে আজ এত বড় বুক-জোড়া অভিমান নিয়ে যাচ্ছি, এটাও তারই একটা। সেটা আর কিছু নয়, কাল চিঠিগুলো তোমার পড়তে পড়তে হঠাৎ ও-কথাটা মনে পড়ে গেল। তুমি জানো আমি বড্ডো হিংসুটে।

তোমায় অন্যে ভালোবাসবে, এ চিন্তাটাও সইতে পারিনে, দেখতে পারা তো দূরের কথা। সকলে তোমার খুব প্রশংসা করুক, তোমায় ভালো বলুক, তাতে খুবই আনন্দ আর গৌরব অনুভব করব, কিন্তু তাই বলে অন্যকে তোমায় ভালোবাসতে তো দিতে পারিনে। আমি চাই, তুমি একা আমারÑ শুধু আমারÑ ভিতরে বাইরে পরিপূর্ণরূপে আমার হও, আর আমিও পূর্ণরূপে তোমার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সুখী হই। আমি ছাড়া তোমাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে নাÑ কখনই না, কিছুতেই না। তাই যখনই আমি দেখেছি, যে, অন্যে তোমার দিকে একটু চেয়ে দেখেছে আর তুমিও তার পানে হেসে চেয়েছ, অমনি মনে হয়েছে এক্ষুণি গিয়ে তার বুকে ছোরা বসিয়ে দিই।

কিন্তু খোদা তোমাকে রূপ আর গুণ এত অপর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছেন যে, তোমায় দেখেই লোকে ভালোবেসে ফেলে। ভালোবাসা-পিয়াসী তৃষাতুর মানুষের মন তোমাকে যে ভালো না বেসেই পারে না। তাই কত দিন মনে হয়েছে যে, তোমাকে নিয়ে এমন বিজন বনে পালাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া কেউ থাকবে না। চোখ মেললেই আমি তোমাকে দেখব, তুমি আমাকে দেখবে। আমার এ যেন রাহুর প্রেম।

নয়? আমায় ছেড়ে অন্যকে তুমি ভালোবাসবে, আমার এই ব্যথাটাই সবচেয়ে মর্মন্তুদ। তাই তো এমন করে তোমার কাছে যাঞ্চা করে এসেছি যে, আমার চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসতে পারবে না-পারবে না। কিন্তু তুমি আমার অত সকরুণ মিনতি শুনেও কোনোদিন কথা কয়ে তা জানাওই নি, একটু মিথ্যা করে মাথা দুলিয়েও বলনি, যে, হাঁ গো হাঁ। ... শুধু নিস্তব্ধ মৌন হয়ে গেছ। তোমার তখনকার ভাবের মানেটা আজও বুঝতে পারছি নে বলেই আমার এত প্রাণ-পোড়ানি আর ছটফটানি।

আজ আমি বড় সুখে মরতে পারতাম, যদি আমার এই চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ির ক্ষণেও জানতে পারতাম তোমার সত্যিকার মনের কথা। এখন জানতে চাইলে হয়ত আর জানাতে পারবে না। যদিই পারতে, তা হলে হয়ত চির-হতভাগ্য বলে একটু করুণা করে আমায় অনেক কিছু সিক্ত সান্ত¡না দিয়ে আমায় প্রবোধ দিতে, কিন্তু হায় প্রিয় আমার, এ মৃত্যুপথের পথিককে আর ভুলাতে পারতে না, সে সুযোগ তাই আমি ইচ্ছা করেই দিলাম না তোমায়। যখন তুমি আমার এই চিঠি পড়বে, তখন আমি তোমার নাগালের বাইরে গিয়ে পড়ব। দেখ, আমার আজ মনে হচ্ছে; পুরুষদের মতন বোকা ভ্যাবাকান্ত আর নেই, অন্তত মেয়েদের কাছে।

পুরুষ যেমন করে ভালোবাসা পাবার জন্যে হা-হা করে উন্মাদের মতন ছুটে যায় তা দেখে মনে হয়, এর এ বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা বুঝি স্বয়ং ভগবানও মেটাতে পারবে না, কিন্তু তাকে একটি ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে তোমরা এমনই ভুলিয়ে দিতে পার যে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়। এত বড় দুর্দান্ত দুর্বিনীতকে ঐ একটু মিষ্টি করে ‘লক্ষ্মীটি’ বলে গিয়ে একটু কপালে হাতটি রাখলে বা গিয়ে তার হাতটি ধরলেই সে যত দূর হতে পারা সম্ভব সুশীল সুবোধ বালকটির মতন শান্ত হয়ে পড়ে। তোমার মনে কী আছে, তা ভেবে দেখতে চায় না, ঐ একটু পেয়েই ভালোবাসার কাঙাল পুরুষ এত বেশি বিভোর হয়ে পড়ে। তবু তোমরা এই বেচারা হতভাগা পুরুষদের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ধরা দাও না। কিছুতেই তোমাদের মনের কথাটি পাওয়া যায় না, সব ভালোবাসাটুকু পাওয়ার আশা তো মরীচিকার পেছনে ছোটার মতোই, কোথায় যেন তোমাদের মনের সীমা রেখা, কোথায় যেন তোমাদের ভালোবাসার তল, কোথায় যেন তার শেষ! আমি তাই অবাক হয়ে অনেক সময় ভাবি আর ভাবি! মনে করো না যে, এগুলো সকলেরই মনের ভাব।

আমি আমার এখনকার মনের ভাবগুলো সোজাসুজি জানাচ্ছি। তোমার সঙ্গে তা না মিলতেও পারে। এমনি করে পুরুষ নারীর কাছে চিরদিন প্রতারিত হয়ে আসছে। কারণ তারা বাইরে যত বড় কর্মী বিধান আর বীর হোক না কেন তোমাদের কাছে তারা একের নম্বর বোকা, একেবারে ভেড়া বনে যায় বললেও অত্যুক্তি হয় না। তোমাদের কাছে থেকেও তোমাদের মন বুঝতে স্বয়ং ভগবান পারবে না, এ আমি আজ জোর গলায় বলছি।

তোমরা নারী, তোমাদের স্বভাবই হচ্ছে স্নেহ করা, সেবা করা, যে কেউ হোক না কেন, তার দুঃখ দেখলে তোমাদের প্রাণ কেঁদে ওঠে, একটু সেবা করতে ইচ্ছা হয়। ওতে তোমাদের গভীর আত্মপ্রসাদ, নিবিড় তৃপ্তি। এইখানে তোমরা দেবী, সন্ন্যাসিনী। এই ব্যথিতের ব্যথা মুছাতে তোমরা সকল রকম ত্যাগ স্বীকার করতে পার, কিন্তু তাই বলে সবাইকে ভালোবাসতে পার না, আর ভালোবাসও না। এইখানে পুরুষ সাংঘাতিক ভুল করে বসে।

তোমাদের ঐ সেবা আর করুণাটুকু সে ভালোবাসা বলে ভুল করে দেখে। অবশ্য যদি সে তোমায় ভালোবেসে ফেলে। আর যাকে জান যে সে সত্যি সত্যিই তোমাকে বড় প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, অথচ তুমি কিছুতেই তাকে ভালোবাসতে পারছ না; তাহলে তার জন্যেও তুমি সকল রকম বাইরের ত্যাগ স্বীকার করতে পার, তার সেবা করো, শুশ্রƒষা করো, তার ব্যথায় সান্ত¡না দাও কত চোখের জল ফেল করুণায়,Ñ তবু কিন্তু ভালোবাসতে পার না। বাইরের সব সুখে জলাঞ্জলি দিতে পার তার জন্যে, কিন্তু মনের সিংহাসনে রাজা করে কিছুতেই তাকে বসাতে পার না। কিন্তু অন্ধ অবোধ পুরুষ তোমাদের ঐ স্বভাবজাত করুণাকেই ভালোবাসা মনে করে বড় বেশি আনন্দ পায়, সুখ অনুভব করে।

হায় রে অভাগা! তাকে পরে তার জন্যে আবার দুঃখও পেতে হয় অনেক গুণ বেশি। কারণ, মিথ্যা যা, তা একদিন-না একদিন ধরা পড়েই। হঠাৎ একদিন নিশীথে বুকে জড়িয়ে ধরেও সে ধরে ফেলে যে, আমার এই নিকটতম মানুষটি আমার সবচেয়ে সুদূরতম। আমার বুকে থেকেও এ আমার নয়। একে হারিয়েছি, হারিয়েছি এ জনমের মতো।

সে-যাতনা যে কী নিদারুণ, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। এ ভুল-ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই বুক নিষ্করুণভাবে ভেঙে যায়, তার জীবন চিরতরে নিষ্ফল ব্যর্থ হয়ে যায়। সে তখন নির্মম আক্রোশে নিজের ওপর নির্দয়তম ব্যবহার করে নিজের সে ভুলের শোধ নেয় সে আত্মহত্যা করে, এক নিমেষে নয়, একটু একটু করে কচলিয়ে কচলিয়ে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।