প্রবাসী আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম উদ্ভাবন হল স্টেম সেল প্রযুক্তি। স্টেম সেলের নৈতিক এবং ধার্মিক দিক, স্টেম সেলের সম্ভাবনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে এর গবেষনা শুরু হওয়ার দিন থেকেই।
স্টেম সেল কি?
ইংরাজী স্টেম কথাটার অর্থ হল কান্ড আর সেল শব্দের মানে হল কোষ। গাছের কান্ড থেকে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ে যেমন পুরো গাছ জন্ম নেয় একই ভাবে স্টেম সেল থেকে তৈরী হয় মানব দেহের সমস্ত কোষ, কলা, অঙ্গ প্রত্যংগ ইত্যাদি।
শুক্রানু(spermatozoa) এবং ডীম্বানূ(Ovum) মিলনের ফলে তৈরী হয় এক কোষী জাইগোট(Zygote), যা ব্লাস্টোসিস্ট(Blastocyst), মরুলা(Morula), ফিটাস (Fetus) থেকে ক্রমশ পরিপূর্ন শিশু হিসেবে জন্ম নেয় জাইগোট তৈরী হওয়ার ২৬৫দিনপর ।
এক কোষী জাইগোট থেকে জন্ম নেয় মানব দেহের প্রায় দুই শ’ ধরনের কোষ। উদাহরন স্বরুপ বলা যায় স্টেম সেল থেকে জন্ম নেয় রক্তের কোষ বা লোহিত কনিকা(Red Blood Cell) , হাড়ের কোষ বা অস্টিওসাইট(Osteocyte), মাংশপেশী’র কোষ বা মাইওসাইট(Myocyte) ইত্যাদি। এই এক কোষ থেকে অনেক গুলো কোষ তৈরী হতে লাগে দুটো প্রক্রিয়া ১) বিভাজন(Cell Division) এবং ২) পৃথকীকরন(Cell Differentiation) । বিভাজন হল একটা কোষ থেকে দুটো কোষ তৈরী হওয়া আর পৃথকীকরন হল এক ধরনের কোষ থেকে অন্য এক ধরনের কোষ তৈরী হওয়া। যদি রক্তের কনিকার কথা ধরি তাহলে- আমাদের অস্থি মজ্জার হিমাটোপয়টিক স্টেম সেল (Hematopoietic Stem Cell) থেকে বিভাজন এবং পৃথকীকরনের মাধ্যমেই তৈরী হচ্ছে অসংখ্য লোহিত কনিকা(Red blood Cell), শ্বেতকনিকা(White blood cell), অনুচক্রিকা(platelet) ইত্যাদি ।
স্টেম সেল থেকে তৈরী হয় অন্য চেহারার, অন্য ধর্মের, অন্য কাজের, লোহিত কনিকা বা শ্বেত কনিকা, যা স্টেম সেল থেকে, এবং একে অপরের থেকে আলাদা ধরনের , এটাই হল পৃথকীকরন ।
বিভাজন এবং পৃথকীকরন হওয়ার ক্ষমতা’র উপর ভিত্তি করে আমাদের শরীরের কোষ গুলোকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
১) পার্মানেন্ট কোষ(Permanent Cell) ; এই ধরনের কোষ বিভাজন হয় না এবং পৃথকী করনও হয় না, যেমন স্নায়ু কোষ(Nerve cell)। স্ট্রোকের ফলে বা আঘাতের ফলে স্নায়ুকোষ যখন মারা যায় নতুন স্নায়ু কোষ আর তৈরী হয় না । স্ট্রোক বা স্পাইনাল কর্ড এ আঘাতের ফল হয় স্থায়ী কর্মক্ষমতা লোপ।
২) ইউনিপোটেন্ট (unipotent)- এই ধরনের কোষগুলোর পৃথকীকরনের ক্ষমতা নেই কিন্তু বিভাজন হতে পারে ফলে এই কোষ গুলো মারা গেলে বেচে থাকা কোষগুলো বিভাজনের ফলে সেই ক্ষতি পূর্ন হয় যেমন চামড়া কেটে গেলে আশেপাশের চামড়ার কোষগুলো বিভাজন হয়ে ক্ষত সারিয়ে তোলে।
৩) প্লুরিপোটেন্ট(pluripotent) এই ধরনের কোষগুলো থেকে একাধিক বহুসংখ্যক কোষ তৈরী হতে পারে যেমন হেমাটোপয়টিক স্টেম সেল থেকে তৈরী হয় বহূসংখ্যক শ্বেত বা লোহিতকনিকা।
৪) ওমনিপোটেন্ট(Omnipotent) সেল এই কোষগুলো থেকে শরীরের যে কোণ ধরনের, যে কোণ সংখ্যার কোষ তৈরী হতে পারে যেমন - ভ্রুনের কোষ।
স্টেম সেলের ইতিহাসঃ-
১৯০৮ সালে রাশিয়ান বিজ্ঞানী ম্যক্সিমভ স্টেম সেল এর ধারনা দেন।
১৯৬০ সালে টরন্টো ইউনিভার্সিটিতে ম্যককুলাচ এবং টিল সর্বপ্রথম ইন্দুরের স্টেম সেল আলাদা করে তা পরীক্ষাগারে কালচার করেন।
১৯৬৮ সালে অস্থিমজ্জার স্টেম সেল প্রতিস্থাপন হয়।
১৯৮১ সালে মার্টিন ইভান্স ইন্দুরের থেকে “ এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল” তৈরী করেন
১৯৯৮ সালে জেমস থম্পসন মানুষের ভ্রুনের থেকে স্টেম সেল আহরন করেন।
২০০১ সালে বিজ্ঞানীরা মানুষের ভ্রুনের স্টেম সেল “ক্লোন” করেন।
২০০৭ সালে জাপানী বিজ্ঞানী মানব দেহের কোষ থেকে স্টেম সেল উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া আবিস্কার করেন। একে তারা নাম দেন “ হিউম্যান ইনডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল” ।
২০১০ সালে মানব দেহে স্টেম সেলের পরীক্ষা নীরিক্ষা চালান হয়
২০১১ সালে ইজরায়েলী বিজ্ঞানী বেন নুন বিপন্ন প্রজাতির স্টেম সেল আলাদা করেন।
স্টেম সেলের ধর্ম হল তা আজীবন ভাগ হয়ে এবং পৃথকীকরন হয়ে অসংখ্য এবং অনেক প্রকারের কোষ তৈরী করে যাবে। যেমন রক্তের ক্যান্সার বা লিউকেমিয়াতে প্রতিস্থাপন করা অস্থিমজ্জার স্টেম সেল রক্তের বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরী করে যাবে আজীবন।
প্রকারভেদঃ-
এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেলঃ-(Embryonic Stem Cell) স্টেম সেল গবেষনা হল এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল কে ঘিরেই। মানুষের বা ইন্দুরের ভ্রুন থেকে আলাদা করা হয়ে থাকে এই স্টেম সেল।
জাইগোট এর ৪/৫ দিন পর মানব ভ্রুন রুপান্তরিত হয় ১০০-১৫০ কোষের ব্লাস্টোসিস্ট এ। এই ব্লাস্টোসিস্ট থেকেই সংগ্রহ করা হয় এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল। এই কোষ বা সেল গুলো হল প্লুরিপোটেন্ট অর্থাৎ এ গুলো থেকেই বিভিন্ন ধরনের মানব কোষ তৈরী করা সম্ভব।
ফিটাল স্টেম সেল এবং এমনিওটিক স্টেম সেলঃ- (Fetal Stem Cell , Amniotic stem cell)গর্ভে বাচ্চা থাকে জরায়ুর ভিতর পানির মধ্যে যাকে বলে এমনিওটিক ফ্লুইড। এই ফ্লুইডের থেকে বা গর্ভস্থিত বাচ্চা থেকে কোষ সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে জন্মিয়ে বা কালচার(culture) করে পাওয়া যেতে পারে স্টেম সেল।
এডাল্ট স্টেম সেলঃ- (Adult Stem Cell)এই স্টেম সেল পাওয়া যায় নবজাত শিশু থেকে শুরু করে পূর্ন বয়স্ক লোকের শরীরের থেকে । মুশকিল হল এই ধরনের স্টেম সেল গুলো হয় মাল্টিপোটেন্ট এবং কেবল একই গ্রুপের কোষ তৈরী সম্ভব হয় এই ধরনের স্টেম সেল থেকে। যেমন হেমাটোপয়টিক স্টেম সেল থেকে শুধুমাত্র রক্তের কোষ গুলো পাওয়া যেতে পারে। এডাল্ট স্টেম সেল এর সুবিধা হল তা এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল সংগ্রহ করতে যেমন ব্লাস্টোসিস্ট বা একটি ভ্রুন হত্যা করা হয়ে থাকে এডাল্ট স্টেম সেলে তার দরকার পড়ে না। এই কারনেই এডাল্ট স্টেম সেল গবেষনায় জোর দেওয়া হচ্ছে বেশী করে।
এডাল্ট স্টেম সেলের একটা অসুবিধা হল যে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার পর তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেম দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। এডাল্ট স্টেম সেল এর একটা ভাল উৎস হল ৮/১০ বছরের শিশুর সবচে পেছনের দাঁত থেকে স্টেম সেল সংগ্রহ করা। দাতঁএর থেকে পাওয়া শ্তেম সেল থেকে ২৯ প্রকারের সেল বা কোষ তৈরী করা সম্ভব হয়েছে।
ইন্ডিউসড এমব্রায়োনিক স্টেম সেলঃ- (Induced Embryonic stem Cell) এখানে পুর্নবয়স্ক মানূষের কোষ থেকে তৈরী করা হয় এম্ব্রায়োনিক স্টেম সেল যা ব্যবহৃত হতে পারে ওমনিপোটেন্ট স্টেম সেল হিসেবে এবং এ থেকে মানব দেহের যে কোন ধরনের কোষ তৈরী করা সম্ভব।
বিতর্কঃ- ১৯৯৮ সালে প্রথম সম্ভব হল বালস্টোসিস্ট থেকে এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল সংগ্রহ করে তা থেকে বিভিন্ন ধরনের কোষ পরীক্ষাগারে তৈরী করা।
মুশকিল হল যে ব্লাস্টোসিস্ট থেকে তা সংরহ করা হয়ে থাকে সেই ব্লাস্টোসিস্ট মারা যাবে। এ ভাবে ব্লাস্টোসিস্ট হত্যা ভ্রুন হত্যার শামিল এবং তা অনৈতিক। এই অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশান বা কৃত্রিম টেস্ট টিউব বেবীতে ব্যবহৃত অপ্রয়োজনীয় ব্লাস্টোসিস্ট থেকে এম্ব্রাইয়োনিক স্টেম সেল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সম্ভাবনাঃ- বিভিন্ন রোগে , আঘাতে বা বয়সের কারনে আমাদের শরীরের কোষ মারা যায় ফলে হয়ত ঐ অঙ্গের কাজকর্ম বিঘ্নিত হয়। যদি মরে যাওয়া কোষগুলোর পরিবর্তে জীবন্ত কোষ প্রতিস্থাপন করা যায় তাহলে অনেক রোগই সারিয়ে তোলা সম্ভব।
যেমন ধরুন মেরুদন্ডের আঘাতে স্পাইনাল কর্ড ছিড়ে (spinal Cord Injury) গেল ফলে হল প্যারাপ্লেজিয়া(Paraplegia) বা শরীরের নীচের অংশ হয়ে গেল কর্মক্ষমতা হীন। যদি স্নায়ু কোষ দিয়ে স্পাইনাল কর্ড আবার জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে হয়ত প্যারাপ্লেজিক রোগী আবার হেটে চলে বেড়াতে পারবে, মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশান(Myocardial Infarction) বা হার্ট এটাকে হৃৎপিন্ডের মারা যাওয়া কোষকে প্রতিস্থাপন করা যাবে , লিভার সিরোসিসে(liver cirrohosis) অকেজো লিভারকে সারিয়ে তোলা যাবে। বস্তুতঃ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন শাখার জন্ম হয়েছে কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রোগ সারিয়ে তোলার এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে যার নাম রিজেনারেটিভ মেডিসিন।
এখন পর্যন্ত স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু হয় নি বলতে গেলে। রক্তের ক্যানসারে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশান (Bone Marrow transplantation)বস্তুতঃ স্টেম সেল চিকিৎসা।
বোন ম্যারোর মাধ্যমে রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসা হচ্ছে আজ অনেক বছর। আরো যে সমস্ত রোগে স্টেম সেল দিয়ে চিকিৎসা করার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা হল পার্কিনসন’স ডিজিজ(Parkinson’s Disease), আলঝেইমার ডিজিজ(Alzheimer’s Disease), মস্তিষ্কে আঘাত(Traumatic Brain Injury) , স্পাইনাল কর্ড আঘাৎ(Spinal Cord Injury) , মাস্কুলার ডিস্ট্রফী(Muscular Dystrophy), রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেটে বাত, ( Rheumatoid Arthritis) অস্টিওয়ার্থ্রাইটিস( Osteoarthritis ) ইত্যাদি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।