আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের মিলগুলো...

সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ! আমি প্রথম এমন একটা পরিবারে গেলাম। ভর ভরন্ত সংসার যাকে বলে। কি জৌলুশ ! সে সময় কার চাকচিক্য আমার বালিকা বয়সের বিস্ময় নিঃসন্দেহে। দরজার গোড়ায় তাঁকে প্রথম দেখলাম। লম্বা ওভারকোটে আচ্ছন্ন আগাগোড়া।

নতুন জায়গায় আসাটাকে পূর্ণ মাত্রা দিতেই বুঝি তাকে দেখলাম। মাথার সামনের দিকটায় ছোট করে ছাঁটা ফাঁপানো চুল। হালকা রং করা। মাথায় হ্যাট। সামনে সামনে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।

পথ দেখিয়ে । আমি আতংক নিয়ে এগুচ্ছি। আমার চোখ সামনের সিঁড়িতে নিচের দিকে। তাঁর পেন্সিল হিলের তলা থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে এই বুছি হিল সহ পা হড়কে যাবে! এমন মানুষ আমি টিভি পর্দার বাইরে খুব একটা দেখিনি।

তাঁর মেয়েটাও পরীর মেয়েদের মত। আমার কল্পনায় পরীরা এমন ই হয়। আমি বসে বসে কড়ি খেললাম। পরীর মেয়েটাই শিখিয়ে দিল এভাবে নম্বর ধরতে হবে। আমার তখন দেখা শেষ হয়নি।

মেয়েটা আমাকে নিয়ে খেলছে আমি চোখ ভরে দেখতে পাচ্ছিনা ঘরের সৌন্দর্য্য। কি বিরক্তই না লাগছে। পরে শুনলাম এ সব কিছু মেয়েটির বাবা যখন যে দেশে গেছে সে দেশ থেকে স্যুভেনির হিসেবে এনেছে। শব্দটা আমি নতুন শিখেছি। সুযোগ মত ব্যবহার করতে পারছিলাম না।

আজ করলাম। মেয়েটি রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে চুপি চুপি বলল,তোমার কয়টা মা? জানো আমার বাবা বিদেশ থেকে আরেকটা মা গিফট এনেছিল। আমার আম্মুকে দেখলানা? গিফট দেখলে এত খুশি হয়! আর সেদিন বাবার সাথে কি ঝগড়াটাই না করল! বাবা রাগ করে চলে গেল। একটা আম্মু মানে কম আদর। দুইটা আম্মু মানে বেশী আদর।

তাইনা বলো? আমার আম্মুটা না ভিষণ হিংসুটে। রাতের বেলা ও ঘর থেকে জিনিস ভাঙার শব্দ শুনে ভয় পেতেই পরীর মেয়েটা আমাকে অভয় দিল। আরে ভয় পেওনা। আম্মু ড্রিংক করেছে। এখন ওসব ভেঙে ভেঙে আব্বুকে গালাগালি করবে।

তারপর নানু যেয়ে বকা দিলে কাঁদবে আর ঘুমুতে যাবে । এই তুমি কখনো ড্রিংক করেছো? আমি বড় বড় চোখ মেলে বললাম ওটা কি? সে অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আমিও মাথা নেড়ে খুব বুঝেছি ভান করলাম। যদি আবার পরীর মেয়েটা বিরক্ত হয়। আমাকে বলে আমার মাথায় বুদ্ধি নেই্ আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনা।

আমার মা যেভাবে মাঝে মাঝে আমার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালে ঠুঁকে দিয়ে বলে গাধি জন্ম দিয়েসি একটা। এমন হাবার মত তাকিয়ে থাকিস কেন? মানুষের বাড়ি নিয়া যাব। ঠিক কইরা বইসা থাকবি। কাউরে খাইতে দেখলেই তর লালা বাইর হয় কেন? কি করতাম আমি! আমি মাকে বড় ভয় পেতাম। আমার সারাক্ষন ভয় করতো।

মনে হত এই বুঝি কোথাও ভুল হয়ে গেল। আর মা আমার চুলের মুঠি ধরতে এল। আমি তখন যত্ন করে দুটো চিকন রবার দিয়ে আঁকা বাঁকা সিঁথি কেটে চুল বাধতাম। রবার দুটো দু বারে যোগাড় করেছিলাম। মা যে বাড়িতে কাজ করত সে বাড়ির বারান্দায় বসে থাকতাম।

একদিন ওখানে পেয়েছিলাম একটা রবার। আমি চুপ করে প্যান্টের কষিতে গুঁজে নিয়েছিলাম। আরেকটা পেয়েছিলাম রাস্তায়। আমি খুব নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটিতো। কিচ্ছু আমার চোখের বাইরে যেন না যায়।

একদিন দু টাকার একটা নোট পেয়েছিলাম। সেই থেকে আমি জানি মাটি অনেক কিছু দেয়। শুধু চোখ মেলে রাখলেই হয়। আমার মা এত কিছুর দিকে খেয়াল করেনা বলে বাঁচা। কিমবা কে জানে এসব না দেখাটাই মা রপ্ত করে নির্লিপ্ত হতে শিখেছিল।

তবে আমি জানি এক মা থাকাটাই আতঙ্কের সেখানে দুই দুইটা মা। তাহলে তো চুলের গোড়ায় সারাক্ষন ব্যাথা থকতো! কি যে বলে পরীর মেয়েটা! আমি মনে মনে হাসি। আবার বিশ্বাস করতেও শুরু করি। দুটা মা থাকা হয়ত সত্যিই বেশ আনন্দের। এক মা যদি মারতে আসে আরেক মা নিশ্চয় আটকাবে।

অথবা পরীর মেয়েদেরকে তার মায়েরা মারেনা। মারবেই বা কি করে। কেমন পুতুলের মত ভাল মেয়েটা। আমাকে দিন দিন লেখা পড়া শিখিয়ে ফেলল। এই গাধি আমি কি করে যেন অ আ ক খ শিখে ফেললাম।

অবশ্য প্রথম দিকে পরীর মেয়েটা খুব অবাক হত। আমি বুঝতে পারিনা। মনে রাখতে পারিনা। এসব তাকে বিস্মিত করত। সে বারবার তার আম্মুকে ডেকে ডেকে বলত দেখো আম্মু ও এসব জানেনা।

কি অদ্ভুত না? আমি বুঝতাম ওর আম্মুকে ডাকলে বিরক্ত হয়। ভয়ে ভয়ে ভাবতাম হয়ত এক্ষুনি আমাকে ধমক দিয়ে ও ঘরে পাঠিয়ে দেবে। আমি সবসময় পরীর মত মেয়েটার কাছে কাছে থাকতে চাইতাম তো! পায়ের কাছে চুপ করে বসে থাকতেও আমার ভাল লাগতো। কি সুন্দর বেলি ফুলের মত একটা সবুজ সবুজ গন্ধ আসতো মেয়েটার শরীর থেকে। মনে হত ফুল হাতে নিয়ে কচলে গায়ে মাখিয়ে দিয়েছে মেয়েটার।

আমি মাথা নিচু করে আমার হলুদ সোয়েটারটার একটা ঝুলে যাওয়া ফুল হাত দিয়ে নাড়া চাড়া করতাম। এটা আমার ভীষণ ভাললাগার একটা কাজ। এই সোয়েটারটা প্রথম দিনেই পরীর মেয়েটার মা আমাকে দিয়ে দিল। আমি ঠান্ডায় কাঁপছিলাম তো। আমার একটা পোকায় খাওয়া সোয়েটার ছিল খয়েরি রঙের।

ওটা খুব গরম। কিন্তু মা যখন এ বাড়িতে আমাকে রাখতে এল সোয়েটারটা গায়ে দিতে দিলনা। বলল যাদের বাড়ি রেখে আসব এরাই তোকে সোয়েটার দিবে। তারপর মা কে করুন মুখ করে মিথ্যে বলতে শুনলাম। আমি ঠান্ডায় কাঁপতে ভাবলাম তাই তো আমার সত্যিই ভাল সোয়েটার নাই।

যেটা ছিল সেটা কি এই বাড়িতে মানায়! পরীর মেয়েটা আমার সাথে স্কুল থেকে ফিরে কত যে গল্প করত! আমি অপেক্ষা করতাম। কখন ফিরবে। আমি কখনো পরীর মেয়েটাকে ছুঁয়ে দেখিনি। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করতো চিকন চিকন লাঠি বিস্কুটের মত মোলায়েম আঙ্গুল গুলো মুখে নিয়ে চুষতে নিশ্চয় খুব ভাল লাগবে। কেন যেন সে সময় খুব স্বপ্নে দেখতাম আমি মেয়েটার আঙ্গুল ধরে বসে আছি।

যখন আমি পড়তে শিখে গেলাম আমার খুব অন্যরকম লাগতো। আমার জগৎটাকে চোখের সামনে বড় হতে দেখে আমার ভেতরে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হত। আমি কখনো ফিরে যেতে চাইনি। ঐ নোংরা পরিবেশটাতে। যেখানে কথায় কথায় বুলি, হাফি, জুনি এরা নোংরা আর খারাপ খারাপ গালি দিত।

খামচা খামচি করতো। ওরা ভদ্র ভাষায় টোকাই ছিল। আমি কোনোদিন মনে প্রানে টোকাই হতে পারিনি। একদিন যখন আমাদের বস্তির এক চাচা এ বাড়িতে এসে বলল আমার মা মরে গেছে আমি সেদিন মিথ্যে বলবনা মুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এবার আর পরীর মেয়েটা থেকে আমাকে কেউ আলাদা করতে পারবেনা।

আমাকে দেখতে নিয়ে যেতে চাইল। সেই একদিনই আমি খুব কঠিন হয়ে গেলাম। কিভাবে যেন মুখ গোঁজ করে বললাম যাবনা। পরীর মেয়েটা খুব অবাক হল। আমি জানি! আমার জন্য করুনা হল।

আমি করুনাকে তখনো বেশি ভালবাসি। দিনদিন পরীর মেয়েটা কেমন যেন পর হয়ে যাচ্ছিল। আমি পুরোনো সময় ফিরে আসার ভয় পেতে থাকলাম। আমি দেখলাম পরীর মেয়েটা তার আম্মুর সাথে উঁচু গলায় ঝগড়া করে। কুৎসিত করে বলে তোমার মত নষ্টা মেয়ের সাথে আব্বু না থেকে ভালই হয়েছে।

তুমি নাইট ক্লাবে যাও তোমার লজ্জা করেনা? আমি কথা গুলো বোঝার চেষ্টা করি। নিজে নিজেই আড়ালে মৃতা মা কে উদ্দেশ্য করে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলি আমার আব্বা মরে গেল কেন আমি জানিনা ভেবেছো? তোমার মত নষ্টা মেয়েকে সহ্য না করতে পেরে মরে গেছে। বাড়ি বাড়ি কাম করো তোমার লজ্জা করেনা? খুব ছোট বেলাতেই আব্বা মরে গেছে। কি কারনে মরেছে সেটা সে বয়সে আমার জানার কথা ছিলনা। কিন্তু কেন যেন ঘটনা মিলিয়ে আমি খুব সুখ পেতাম।

পরীর মেয়েটার সাথে কোনো একটা ব্যাপারে সামান্যতম মিল আমাকে ভীষণ সুখি করতো। একদিন সকালে উঠে শুনলাম পরীর মেয়েটা স্কুলে চলে গেছে। আর বাড়িতে খুব হইচই। ধীরে ধীরে সব জানলাম। অতিরিক্ত ড্রিংক করার কারনে পরীর মেয়েটার মায়ের লিভার পচে গেছে।

ডাক্তার ড্রিংক করতে নিষেধ করে দিয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। এসব ঘটনা আমাকে খুব যে স্পর্শ করে তা নয়। আমি আসলে বাড়ির কাজে আমার বরাদ্দ অংশ টুকু শেষ করেই পরীর মেয়েটার স্কুল থেকে ফেরার অপেক্ষা করতাম। এর পর সে আমাকে তার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতো আমাকে নিয়ে কড়ি খেলত।

মাঝে মাঝে পরীর মেয়েটা দু একদিনের জন্য দাদু বাড়িতে যেত। ওখান থেকে ফিরলে কত গল্প যে করত। ওখানে তার নতুন মা প্রতিবারই তাকে কিছু না কিছু গিফট দিত। একবার একটা কোনা ভাঙা কাঁচের হাতি আমাকে দিয়ে পরীর মেয়েটা বলল এটা আমার নতুন আম্মু তোমাকে দিয়েছে। আমি খুব যত্ন করে পেঁচিয়ে রাখি আমার জামা দিয়ে হাতিটাকে।

মাঝে মাঝে খুলে দেখি আমার যে কি ভাল লাগে। আরেকদিন সকালের একটা ঘটনায় আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল আবার। রাতে মারা গেছে কখন পরীর মেয়েটার মা। সারা বাড়ির কেউ জানেনা। একটা গ্লাস উল্টে পড়ে আছে।

হাতটা বাড়ানো। মেঝেতে পড়ে আছে মেমসাহেবের মত মানুষি। আমি আবার আতংকে জমে যেতে থাকলাম। সারা রাতের মধ্যে কখন মরে গেছে! কাল রাতে ঘুমুতে গিয়ে পরীর মেয়েটা তার স্কুলের এক ছেলে বন্ধুর কথা বলতে গিয়ে হেঁসে গড়িয়ে পড়ছিল। সিঁড়ির কাছে ছেলেটা চেপে তাকে চুমু দিয়েছে।

এই গল্প বলতে গিয়ে সে হিস হিস করে বলেছে, আমি এই বিচটাকে ছাড়িয়ে যাব। বিচ মানে কি সেটা তখন আমি জানি। কাকে বলছে তাও যে খুব আন্দাজ করতে পারিনা তা নয়। আমার ভয় হত তবু মনে হত বলি কেন তার আম্মুকে সে দেখতে পারেনা। জিজ্ঞেস করেই ফেলব ভেবেও জিজ্ঞেস করতে পারলামনা।

কে জানে যদি পরীর মেয়েটা বিরক্ত হয়। আমি চুপ থাকতে ভালবাসি। আমি ভালবাসাকে হারাতে চাইনা। পরীর মেয়েটা পাকাপাকি ভাবে চলে গেল দাদুর বাড়িতে। নতুন মায়ের কাছে।

ও হ্যা পরীর মেয়েটা তার আম্মুর মৃত্যু দেখে একটুও কাঁদেনি। আমি ভেবেছিলাম তার অনেক কষ্ট হবে। এই সব ভেবে আমি নিজেই খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। অথচ সে কাঁদেনি দেখেও আমার কোথায় যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল। পরীর মেয়েটার সাথে আমার অনেক মিল।

হয়ত সেও মুক্তির আনন্দই পেয়েছে! পরীর মেয়েটা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সময় আমার আঙ্গুল ধরে কেঁদেছিল। মা মরে যাওয়ার পর সেই প্রথম আমিও কেঁদেছিলাম খুব। আমার এখন এলোমেলো জীবন। হে খোদা তুমি পরীর মেয়েটাকে আমার মত এই মিলটুকু দিওনা যেন। শুধু এবার আমি মিলের কথা ভাবলে টের পাই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে আতংক বয়ে যাচ্ছে।

‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।