গর্জে ওঠার এইতো সময়.... তিতাস বাচাও, দেশ বাচাও এটিএন নিউজে প্রচারিত সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ
এটিএন নিউজ : আপনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছে এবং একটু আগেই আমরা জেনেছি যে, এই অভিযোগ আমলে নেয়ার প্রশ্নে আগামী ২৬ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিবেন, আপনার প্রতিক্রিয়াটা আমরা শুনতে চাই।
অধ্যাপক গোলাম আযম : আপনারা তো প্রশ্ন করবেন, আমি একটা প্রশ্নের জবাব পাচ্ছি না, সেটা হচ্ছে, একাত্তরের পরে ৩০ বছর পর্যন্ত কোনদিন আমাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলে নাই। যুদ্ধাপরাধারীরা তো ছিল, শেখ মুজিব সাহেব নিজেই এই ইস্যুর মীমাংসা করে দিয়ে গেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে তিনি যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করেছেন, তালিকাভূক্ত করেছেন, ঐ তালিকায় কোন সিভিলিয়ানের নাম ছিল না। এবং তাদেরকে বিচার করার জন্য একটা আইনও করেছিলেন।
সে আইনটা দিয়ে এখন আমাদের বিচার করার চেষ্টা চলছে। তালিকা করলেন, বিচার করার জন্য আইন করলেন, কিন্তু সিমলায় গিয়ে ভূট্টোর সঙ্গে বৈঠক করে ওদেরকে মাফ করে বিদায় করে দিলেন। মাফ করে দিলেন। এরপরে যাদেরকে তিনি তাদের সহযোগী মনে করেছেন তাদেরকে নাম দিয়েছেন কলেবরেটর, সহযোগী। তাদের জন্য আইন করলেন।
সে আইনে লাখ খানেক লোককে গ্রেফতার করলন। কিছু লোককে বিচার করলেন। তারপর দেখে যে কোন স্বাক্ষী প্রমাণ পাওয়া যায় না, তখন জেনারেল এ্যামনেস্টি, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর এদেরকে মাফ করে দিলেন। তো, উনি তো এটার মীমাংসা করে দিয়ে গেলেন, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুর মীমাংসা করে দিয়ে গেলেন, এখন ৩০ বছর পর; (এখন চল্লিশ বছর হয়ে গেল); ৪০ বছর পর এই ইস্যুটাকে আবার খাড়া করা হলো কেন?
এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করলাম। বিএনপি আওয়ামী লীগ জামায়াত একসাথে আন্দোলন করল, আমাদের সঙ্গে বৈঠকও করল, লিয়াঁজো কমিটির বৈঠকও করল, তখন তো আমরা যুদ্ধাপরাধী ছিলাম না।
বিএনপি যখন ৯১ সালে ক্ষমতায় আসল, কেয়ারটেকার সিস্টেমে নির্বাচন হওয়ার কারনেই বিএনপি ক্ষমতায় আসলো। এরশাদের সময়ে যদি এরশাদের আন্ডারে ইলেকশন হতো তো এরশাদই ক্ষমতায় আসতো। তো এই সিস্টেমটাকে, কেয়ারটেকার সিস্টেমটাকে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য আমরা দাবী জানালাম। বিএনপি গর্ভমেন্ট এটা করতে রাজী হলো না। বিএনপি গর্ভমেন্ট কিন্তু আমাদের সমর্থনেই গভর্মেন্ট ফর্ম করতে পেরেছে।
তাদের মেজরিটি ছিল না পুরা। এবসলিউট মেজরিটি ছিল না। কিন্তু তারা কিছুতেই এটা কনস্টিটিউশনের অর্ন্তভূক্ত করতে রাজী হলো না। তখন মাগুরা জেলার মহম্মদপুরের আ’লীগের একটা আসন উপনির্বাচনে বিএনপি এটা দখল করল, আ’লীগকে পাশ করতে দিল না। তখন আ’লীগ তাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে এসেম্বলী (?) বয়কট করল, আর কেয়ারটেরার সরকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করলো।
আর এই ইস্যুটাতো আমাদের, আমরা কেয়ারটেকার সিস্টেম সাজেস্ট করেছি। তো, আমরা তো এই ইস্যু নিয়ে চুপ করে থাকতে পারি না। আমরাও আ’লীগের সঙ্গে মিলে এই আন্দোলনে শরিক হলাম। ইস্যুটা আমাদের সেজন্য আমাদের চুপ করে থাকা আর স্বাভাবিক ছিল না। তখনও আমাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা হয় নাই।
এ প্রশ্নের জবাব আমি তালাশ করে এক যায়গায় পেয়েছি। আপনারা এ কথা তাদের জিজ্ঞেস করেছেন কি না জানি না, আপনাদের জিজ্ঞেস করা উচিত তাদেরকে, যে তারা কেন ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে কখনো যুদ্ধাপরাধী বলা হয় নাই তাদেরকে, এদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা শুরু করলেন কেন? সেক্টর কমান্ডাররাও এর আগে কোনদিন এই অভিযোগ করে নাই, তো, আমি তালাশ করে পেলাম, এ প্রশ্নের জবাব যে, ২০০১ সালের যে নির্বাচন হলো, তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন (তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে ৩য়?) ঐ নির্বাচনে বিএনপি আর জামায়াত একজোট হয়ে নির্বাচন করেছে। বিএনপি, জামায়াত, জাতীয়পার্টি আর ইসলামী ঐক্যজোট। তো, সেই ইলেকশনে, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট মিলে ৫০টা আসনও প্রতিদ্বন্দীতা করে নাই, ৫০শের কমই। ৩০০ আসনের মধ্যে আড়াইশ আসনে এই দুই ইসলামী পার্টির পক্ষ থেকে কোন ইলেকশন করা হয় নি।
সেখানে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। তো, ঐসব আসনে যে ইসলাম ভোটগুলি ছিল, আমাদের সমর্থক ছিল যারা, তাদের ভোটগুলি সব বিএনপি পেয়েছে। টোটালি দেখা গেল যে আ’লীগ বিএনপি ভোট সমান-সমান, ৪০%, ৪০%। বিএনপি সামান্য কিছু ভোট বেশী পেয়েছে ৪০% এ, ওয়ান পার্সেন্টও পায় নি। অথচ আসন সংখ্যার দিক থেকে আ’লীগ পেল ৫৮, আর বিএনপি পেল ১৯৭।
এতো বড়ো পার্থক্য কেন হলো, সমান সমান ভোট পাওয়া সত্ত্বেও? এ পার্থক্য হয়েছে ইসলামী ভোটগুলি বিএনপি একতরফা পেয়েছে।
এরপর আরও ঘটনা হয়েছে, বিএনপি আর জামায়াত একত্র হলেই আ’লীগ ফেল করে। যেমন চট্টগ্রাম মেয়র ইলেকশনে হলো। জামায়াতের কেন্ডিডেট ছিল, বেগম জিয়া রিকোয়েস্ট করার কারনে জামায়াতে ইসলামী উইথড্র করলো। আর ১ লক্ষ ১০ হাজার ভোট বেশী পেয়ে বিএনপি কেন্ডিডেট পাশ করলো।
আপনার সাংবাদিক, আপনার জানেন, সাংবাদিক ময়দানেও বিএনপি জামায়াত এক হলেই তারা মেজরিটি হয়ে যায়। সাংবাদিক সমিতিওতো এই যে বিভক্ত হয়ে গেছে এই কারনে। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশন ইলেকশন, গত দুইটা ইলেকশনই জামায়াত বিএনপি এক হয়ে গেল আর আ’লীগ ফেল করলো। এরকভাবে বার এসোসিয়েশনগুলোতে, তারপর ইউনিভার্সিটি শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে, তো আ’লীগ হিসাব করে দেখলো যে বিএনপি আর জামায়াত এক হলেই তারা পাশ করতে পারে না, সেজন্য জামায়াতকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে হবে , যাতে জামায়াত বিএনপির সাথে যোগ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দাড়াতে না পারে। এটাই একমাত্র কারন যে জামায়াতে ইসলামীকে নেতৃত্বহীন করতে হবে, রাজনীতির ময়দানে তারা যাতে ভূমিকা রাখতে না পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে, একারনেই যুদ্ধাপরাধী গালিটা ২০০১ সালের নির্বাচনের পর চালু হয়েছে।
এবং পাকিস্তানী আসল যুদ্ধাপরাধী যারা, তাদেরকে বিচারের জন্য যে আইন করা হয়েছিল সে আইনটা প্রয়োগ করে আমাদের বিরুদ্ধে বিচার করতে শুরু করেছে।
সাংবাদিকঃ আমরা তো জানি ১৯৯২ সালে গণ আদালত হয়েছিল, ১৯৯৪ সালে গণতদন্ত কশিশন হয়েছিল, সেই সময়টা তো আসছিল।
গোলাম আযমঃ এইটা একটা সেকশন করেছিল কিন্তু যুদ্ধাপরাধী শব্দ ব্যবহার করে নাই।
সাংবাদিকঃ প্রতীকি বিচার হয়েছিল।
সাংবাদিকঃ এবং আপনার বিদুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে..
গোলাম আযমঃ যে ঘাতক নিমূর্ল কমিটি, জামায়াতে ইসলামীকে ঘাতক গালি দিয়েছে, কিন্তু যুদ্ধাপরাধী ইস্যু সামনে আনে নাই।
রাজাকার বলে গালি দিয়ে কোন সময়, স্বাধীনতা বিরোধী বলেছে।
সাংবাদিকঃ এখন স্যার বিচারটা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। মানবতার বিরুদ্ধে যে কাজগুলি হয়েছে সেগুলির বিচার।
গোলাম আযমঃ হ্যা ঐটাই, মানবতাবিরোধী কাজটাকেই তো তারা যুদ্ধাপরাধ বলছে। দুইটা পরিভাষা তারা ব্যবহার করছে, আর ঐ আইনেই বিচার করছে যেটা যু্দ্ধাপরাধীদের জন্য করা হয়েছিল।
সাংবাদিকঃ এখন স্যার কালকে অভিযোগে আপনার বিরুদ্ধে ৫২টি অভিযোগ এনেছে এবং শতাধিক আপনার বিরুদ্ধে ঘটনার কথা বলেছে যে, সেগুলির ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
গোলাম আযমঃ তো এগুলি, আমার বক্তব্য হলো যে, একটা অভিযোগ নয় সবগুলি অপবাদ, এলিগেশন। তো তারা এলিগেশন দিয়েছে, আমি কোর্টেও বলব, আমাকেতো কোর্টে হাজির করতে হবে, হাজির হতে হবে, আমি বলবো যে একটাও প্রমাণ করুক। আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, একটাও প্রমাণ করতে পারবে না, ইনশাআল্লাহ। শুধু শুধু একটা অভিযোগের নামে অপবাদ যেতে পারে, প্রমাণ না দিতে পারলে এটার কি হবে? আমি নিশ্চিত যে প্রমাণ করতে পারবে না একটাও।
সাংবাদিকঃ তারা বলেছেন যে ২৫ মার্চ যে সার্চ লাইট একটা অপারেশন হয়েছিল, অপারেশন সার্চ লাইট, এর ঠিক ৪ দিন পরে আপনি এবং আপনার নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে টিক্কাখানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন (৪ঠা এপ্রিল).
গোলাম আযমঃ আমার নেতৃত্বে না, নূরুল আমীন সাহেবের নেতৃত্বে।
নেজামে ইসলাম পার্টি, মুসলিম লীগ; আমরা ওনার সঙ্গে দেখা করে বললাম যে, এই যে ২৫শে মার্চে যে আচরণ করা হয়েছে পাবলিককে মারা হয়েছে, এটা করলে তো জনগনের সমর্থন আপনারা পাবেন না, এটা কেন করলেন? তিনি বললেন যে, যে বিদ্রোহ হয়েছে, এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য এটা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। মানে নয়া বাজার পুরাই পুড়াইয়া দিয়েছে, ঐ যে কাঠের দোকান গুলো ছিল, এখন কি কাঠের দোকানগুলি আছে কি না আমি জানি না, সেগুলি সব পুড়াইয়া দিয়েছে, তারপরে শেল নিক্ষেপ করেছে, আমার বাড়ীতেও শেল এসে পড়েছে, তো, উনি বললেন যে আর হবে না, এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য এটা করতে বাধ্য হয়েছি। তো, আমরা বললাম যে দেখেন, সেনাবাহিনী ময়দানে নামলে বাড়াবাড়ি তারা করে, দেশের সেনাবাহিনী দেশের জনগনের সঙ্গেও বাড়াবাড়ী করে, তো বাড়াবাড়ি করলে জনগন প্রতিকারের জন্য কার কাছে যাবে? রাজনৈতিক দলের কাছেই তো আসবে। তো, যেহেতু আ’লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব দেশ থেকে চলে গেছে সব ভারতে, এখন আমাদের কাছে তারা আসে, আমরা তাদেরকে কি করবো? আমরা এটুকু সুযোগ চাই যে, আমাদেরকে এ সুযোগ দেন, আমাদের কাছে যদি কোন কমপ্লেইন আসে, তাহলে যেন সে কমপ্লেইন আপনাদের কাছে পেশ করতে পারি এবং প্রতিকার করা সম্ভব হয়। তো ব্রি: রাও ফরমান আলী খান, উনি বসতেন গভর্নর হাউজে, যদিও টিক্কা খান গভর্নর ছিলেন এবং চীফ মার্শাল এডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন, ইনি বসতেন ক্যান্টনমেন্টে।
আমরা সেখানেই দেখা করেছি তার সঙ্গে। তখন সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফরমান আলী খানকে হুকুম দিলেন যে জরূরী টেলিফোন সব দিয়া দেন, যাতে তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে এবং কমপ্লেইন করতে পারে এবং এটার জন্যই শান্তি কমিটি করা হয়েছিল, শান্তি কমিটির কাজ এটাই ছিল। এবং আমিতো অনেক লোককে সেভ করেছি, তাদেরকে জীপ থেকে উদ্ধার করেছি। একজন এখনো বেঁচে আছেন, সাইফুদ্দিন (সাক্ষাৎকার কালে প্রফেসর জানতে পারেন তিনি আগেই ইন্তেকাল করেছেন) । আমি দুপুরে খাচ্ছি, তার ওয়াইফ এসে বারান্দায় কান্নাকাটা করছে।
কি ব্যাপার? বললো যে ওনাকে ধরে নিয়া গেছে, তো আমি পার্টিকুলারস নিলাম। রাও ফরমান আলী আমাকে বলেছিলেন যে সার্কিট হাউজে ব্রি: কাসেম বসে, কোন কমপ্লেন হলে ওনার কাছে আগে বলবেন। আমি ওনাকে ফোন করলাম। এরপরে, দু’দিন পরে বোধহয়, ঐ লোকের নাম সূর্য মিয়া, ডাক নাম ছিল সূর্য মিয়া, উনি আমার বাড়ী এসে পৌছলেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম, কেমন করে আসলেন, কিভাবে আসলেন? বললেন যে সার্কিট হাউজের ওখানে আর্মির গাড়ীতে আমাকে নিয়া আসছে, এবং লাথি দিয়া আমাকে গাড়ী থেকে ফেলে দিয়েছে, এ কথা বলে যে, গোলাম আযম নাকি কে সুপারিশ করছেন তোর পক্ষে, তো যা, এই বলে গাড়ী থেকে লাথি দিয়া আমাকে ফেলে দিল, আমি সেন্সলেস হয়ে গেলাম, তারপর যখন নাকি সেন্স ফিরেছে তারপরে একটা রিক্সা ডেকে আমি ডাকলাম, এই রিক্সাতে উঠে আপনার বাড়ীতে আসছি।
এইভাবে মানুষের যেটুকু সম্ভব খেদমত করেছি। যারা অন্যান্য পার্টির লোক ছিল, মুসলিম লীগ ছিল, ডেমোক্রেটিক পার্টি ছিল, নেজামে ইসলাম পার্টি ছিল, আমি এরকম অভিযোগ পেয়েছি যে তারা এরকম কমপ্লেইন করে কিছু কামাইও করেছে, খেদমত করেছে কিন্তু টাকা পয়সা কামাইও করেছে। তো এই কাম তো আর আমি করতে পারি নাই। তো এভাবে আমরাতো আর কিচ্ছুই করতে পারি নাই। আর্মির সঙ্গে সহযোগিতা করার সুযোগ কি, সহযোগির কোন, আর্মির কাজ হচ্ছে আর্মস দিয়ে কাজ করার, আমরা কি সহযোগিতা করবো।
তারপরে, তাদের বিরোধিতা করা, বিরুদ্ধে কোন কথা বললেও পত্রিকায় তো আসে না।
এই ২৫শে মার্চের ২ দিন পরে বোধহয় কেরানীগঞ্জেও এরকম হত্যা করা হলো। না, আরো কয়দিন পরে। মানে, টিক্কা খানের সঙ্গে আমার দেখা করার পরের দিনই আমি শুনলাম যে আমাদের লোকও মারা পরছে এই কেরানীগঞ্জে। আমি টেলিফোন করে টিক্কা খানকে বললাম, আপনি বলছেন যে আর এ রকম হবে না, এই যে এই কেরানীগঞ্জে হলো? বললো যে, আমাদের কাছে কমপ্লেইন এসেছে যে, ঢাকা থেকে পালাইয়া এরা, যারা আমাদের বিদ্রোহী, তারা কেরানীগঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, সে জন্য আমরা এটা করেছি।
আমি বললাম, আবার তো করলেন, কিন্তু মরলো তো সাধারণ লোক, যাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগ তারা তো সেখান থেকে পালাইয়া গেছে, চলে গেছে ইন্ডিয়া, এ সাধারণ লোক মরলো। তো, এইভাবে যতটা সম্ভব প্রতিকার করার চেষ্টা হয়েছে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ই আগস্ট। ১৪ই আগস্টে কার্জন হলে নূরুল আমীন সাহেবের নেতৃত্বে, সভাপতিত্বে জনসভা হলো। সে জনসভায় আমার আগে দু’একটা বক্তৃতা হয়েছে, আমার বক্তৃতা থেকে আমি এই অভিযোগ বললাম যে, এ আর্মি যে সমস্ত কাজ করছে এ কাজের দ্বার জনগণ পাকিস্তান বিরোধী হয়ে যাচ্ছে।
তারা পাকিস্তান এক রাখার জন্য কাজ করছে বলে দাবী করে, অথচ পাকিস্তান ভাংছে তাদের কাজে। পাকিস্তান টিকবার কোন আমি সম্ভাবনা দেখি না। আমার বক্তৃতার পরে যারা বক্তৃতা করেছেন তাদের এই লাইনেই বক্তৃতা করতে হয়েছে। কিন্তু এসব তো কোনটাই পত্রিকায় আসে নাই। তখন তো পত্রিকা সেন্সরড হতো।
সাংবাদিকঃ তখন তো আপনাদের পত্রিকা ছিল, সংগ্রাম।
গোলাম আযমঃ পত্রিকা তো সেন্সরড হতো। পত্রিকার তো ক্ষমতা ছিল না যে স্বাধীন ভাবে ছাপায়। সেন্সর করে যা দিত তাই ছাপতে পারতো। বায়তুল মোকাররমে মিটিং করে আমি তাদের বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগ করেছি, কোনটাই পত্রিকায় আসে নাই।
সাংবাদিকঃ আপনি কি এটা বলতে চাচ্ছেন যে ঐ সময়ের পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে আপনাদের নামে সেগুলি সব ভুল ছিল বা পাকিস্তানের চাপে পড়ে পত্রিকা ভুল সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল?
গোলাম আযমঃ ভুল সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল কিনা আমি বলতে পারি না, আমি বলতে পারি আমার বক্তব্য আসতে দেয় নাই পত্রিকায়। তাদের বিরুদ্ধে যেগুলি যায় সেগুলি কোন কথা আসতে দেয় নাই।
সাংবাদিকঃ এটা কি একদম সংগ্রামসহ সব পত্রিকায়?
গোলাম আযমঃ সব পত্রিকায়।
সাংবাদিকঃ গেল যে নির্বাচন, সে নির্বাচনের পর থেকেই তারা যখন জানতে পেরেছে যে ইসলামিক বিশেষ করে জামায়াত যদি বিএনপির সাথে এক হয় সেক্ষেত্রে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সেহেতু তারা যুদ্ধাপরাধের এই বিষয়টা তারা সামনে এনেছে। এই সামগ্রিক যে প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়াটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? এখন যে চলমান প্রক্রিয়াটা।
গোলাম আযমঃ মানে প্রক্রিয়া হইলো যে আ’লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র, আ’লীগ যাতে ক্ষমতায় যেগে পারে সেজন্য এটা একটা ষড়যন্ত্র। আওয়ামী লীগের বিকল্প যে দলটা তারা যাতে বিজয়ী হতে না পারে সেজন্য এটা ষড়যন্ত্র। যে উদ্দেশ্যে তারা কেয়ারটেকার সিস্টেম গুটাইয়া দিল, সে উদ্দেশ্যেই তারা এগুলি সব করছে।
সাংবাদিকঃ মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে আপনার ভূমিকা কি ছিল এটা যদি একটু
গোলাম আযমঃ ঐ যে বললাম, জনগনের যদ্দুর সেবা করা সম্ভব করেছি, বিশ্রাম নিতে পারি নাই, লোক এসে বাড়ী ভর্তি। মানে একটু হার্টে প্রব্লেম দেখা দিল, ডাক্তার বললো যে আপনার বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে এই সময় আপনি দুপুরের খাওয়ার পর অন্তত এক ঘন্টা শুয়ে থাকবেন, যদি ঘুমাইতে সময় নাও পান শুয়ে থাকবেন।
শুইবারও সময় পাচ্ছি না।
সাংবাদিকঃ স্যার, কালকে অভিযোগে তারা এটা বলেছেন যে, শান্তি কমিটি গঠনের পর আপনার রাজাকার বাহিনী, আল-বদর বাহিনী, আল-শামস বাহিনী এগুলি গঠন করে.
গোলাম আযমঃ না, এগুলি শান্তি বাহিনী গঠন করে নাই। এগুলি গঠন করেছে সরকার। এখন যেমন পুলিশের সহকারী আছে না আনছার, এই আনছার হিসেবে পুলিশের সহকারী হিসেবে তারা এই বাহিনীগুলি গঠন করেছে। এখন ইউএনও যাদেরকে বলে, তখন এদের নাম ছিল সার্কেল অফিসার।
এই সার্কেল অফিসারদের মার্ধমে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বোর্ড ফোল পিটিয়ে লোক রিক্রুট করেছে। সব রকম লোক গিয়েছে, কিছু পয়সা পাবে, বেকার লোক, বেকার যুবকরা সবাই গিয়েছে। এবং এতো পুলিশ পাবে কোথায়? প্রতি পুল, প্রতিটা পুলে পাহারা, কারন, মুক্তিযোদ্ধারা এসে পুল উড়ায়া দেয়, উড়ায়া দিলে পরে গ্রামটা জ্বালায়া দিয়া যায় আর্মি। সেজন্য তারা পুল পাহারা দেবার জন্য রাজাকার ব্যবহার করেছে, এই রেডিও টেলিভিশন পাহারা দেবার জন্য এত পুলিশ পাবে কোথায় সেজন্য পুলিশের সহকারী হিসেবে এই ফোর্সটা তারা গঠন করেছিল। বর্তমানে যেমন আনসার পুলিশের সহযোগি, এরকম একটা ফোর্স তারা করেছিল।
এটিএন নিউজে প্রচারিত সাক্ষাৎকারের শেষ অংশ
সাংবাদিকঃ আগামী বুধবার বুদ্ধিজীবী হত্যার ৪০ বছর পার হবে এবং মুক্তিযুদ্ধে সব যে হত্যাকান্ডগুলি হয়েছে সারা বাংলাদেশে সোমবার যে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে আপনার বিরুদ্ধে সবকিছুর জন্যই আপনাকে দায়ী করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর হিসাবে আপনি এটার জন্য দায়ী।
গোলাম আযমঃ আমিই সরকারে ছিলাম আরকি! সরকার আমি পরিচালনা করছিলাম!পাকিস্তান আর্মি কি করলো তাহলে? পাকিস্তান আর্মি আমার হুকুমে কাজ করতো?
সাংবাদিকঃ তারা বলেছে যে আপনার সহযোগিতা, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী তারা কাজ করেছে।
গোলাম আযমঃ এই কথা প্রমাণ করুন। এটা তাদের দায়িত্ব প্রমাণ করার।
সাংবাদিকঃ আপনার কি কখনো মনে হয় যে মুক্তিযুদ্ধের এই সময়টায় আপনার কর্মকান্ডটা ভুল ছিল?
গোলাম আযমঃ না, আমি তো এমন কোন কাজ করি নাই যেটা নাকি করা উচিত ছিল না বলে আমি মনে করি।
সংবাদিকঃ স্যার বিষয়টা এমন না, বিষয়টা হচ্ছে যে, একাত্তরে আপনার ভূমিকা নিয়ে অনেক অনেক কথা বলে, অনেকে অনেক বিষয় বলে, হয়তো আমরা বর্তমান যে প্রজন্ম অনেক কিছুই জানি না, আসলে আপনি আপনার অবস্থান থেকে আপনার সম্পর্কে কি বলবেন?
গোলাম আযমঃ এটাই তো বলছি, আমাদের আর কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। জনগণ আমাদের কাছে কমপ্লেইন করেছে আর্মির ব্যাপারে, এবং আমরা যেটুকু পেরেছি সাধ্যমতো সহায়তা করেছি, যতটুকু হেল্প করতে পেরেছি।
সাংবাদিকঃ স্যার, তারা কিন্তু এটাও বলেছে যে, ১৪ই ডেসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পর্যন্ত ঐ সময় যে হত্যাকান্ডগুলি ঘটেছে সবগুলির পেছনে আপনার প্রত্যক্ষ একটা সহযোগিতা ছিল।
গোলাম আযমঃ আশ্চর্য কথা, এগুলি এতদিনে বলা হচ্ছে কেন? এগুলি তারা যখন ক্ষমতায় আসলো তখন তো তারা বলতে পারতো। এতো বছর পরে মনে হলো কেন? এই প্রশ্নের জবাব কি? এতো বছর পরে এ কথা মনে আসলো কেন তাদের?
সাংবাদিকঃ তদন্ত কর্মকর্তা দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে এই প্রতিবেদন দাখিল করলো আরকি, অভিযোগপত্র।
গোলাম আযমঃ তদন্ত সংস্থা তো তাদের লোক দিয়েই করছে এবং তারা তাদের লোক দিয়েই মিথ্যা স্বাক্ষী দেয়াচ্ছে এবং অনুমান করে সবকিছুর জন্য কাউকে দায়ী করছে। এগুলি কোর্টে একটাও প্রমাণ করতে পারবে না।
সাংবাদিকঃ জি, আরেকটা প্রশ্ন গতকালের অভিযোগেই বলছে যে আপনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন, সংবাদ সম্মেলন করেছেন, রাওয়ালপিন্ডি করাচী এইসব জায়গাতেও আপনি সংবাদ সম্মেলন এবং দলের বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারতের চর, অনুপ্রবেশকারী বলেছেন এটা সোমবার দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়েছে।
গোলাম আযমঃ প্রমাণ করুক। আমিতো চ্যালেঞ্জ করে বলছি প্রমাণ করুক।
সাংবাদিকঃ এও বলেছে যে আপনি ঐ সময়কার রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী তাদের যে প্রশিক্ষণ শিবির সেখানে আপনি গিয়ে, মোহাম্মদপুরে সেপ্টেম্বরে ঘটনা, আপনি দেখেছেন ..
গোলাম আযমঃ আমি শুধু এক যায়গায় গিয়েছিলাম তাদের বলার জন্য যে যদি নাকি নির্দোষ লোকের বিরুদ্ধে তোমরা কর তাহলে আল্লাহর সাহায্য পাবা না। আমি যখন পাকিস্তান আর্মির যাদের সাথে কথা বলি তাদেরকে বলেছি যে সাধারণ জনগনকে, নিরপরাধ জনগনকে যেন নীপিড়ন না করা হয়, ঠিক তেমনি তাদেরকেও একই কথা বলেছি। একদিন গেছি, একবার। আর কোথাও কোন..
সাংবাদিকঃ আরেকটা যেটা বলা হয় যে মুক্তিযুদ্ধের পরে আপনি লন্ডন গিয়েছিলেন, সেখানে পূর্ব পাকিস্তান পূনরুদ্ধার কমিটি গঠন করলেন, এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন..
গোলাম আযমঃ আমি চ্যালেঞ্জ করছি এগুলো সব মিথ্যা কথা। অপবাদ।
সাংবাদিকঃ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্নদেশে নাকি আপনি বলেছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য?
গোলম আযমঃ ব্যারিস্টার আব্বাস ছিলেন একজন পাবনার। আরো কিছু এ দেশী ব্যারিস্টার সেখানে তারা পূর্ব পাকিস্তান সরকার কায়েম করেছিল এবং আমাকে মন্ত্রী বানানোর জন্য তারা দাওয়াত দিয়েছিল আমি তার জবাবও দেইনি।
সাংবাদিকঃ কোন সময় এটা?
গোলাম আযমঃ এটা চুয়াত্তর হবে। চুয়াত্তর কি পচাত্তর সালে।
সাংবাদিকঃ বঙ্গবন্ধুর সরকার?
গোলাম আযমঃ চুয়াত্তর কি পচাত্তর সালে ঐ বাংলাদেশী যারা লন্ডনে আছে ইংল্যান্ডে আছে তাদের একটা গ্রুপ তারা ব্যারিস্টার, এ্যাডভোকেট, একজনের নাম মনে আছে, যিনি চীফ ছিলেন এটার, বাড়ী পাবনা, ব্যারিস্টার আব্বাস।
আমাকে চিঠি দিল, আমি কোন জবাবও দেই নাই। যে কি পাগলামী, এক ছিল সেটা এক রাখা গেল না, এখন পূর্ব পাকিস্তানে তারা আলাদা একটা সরকার গঠন করবে এই পাগলামীতে আমি নাই।
সাংবাদিকঃ তাহলে বিজয় হয়ে যাওয়ার পর পর আপনি দেশে ছিলেন না কেন?
গোলাম আযমঃ আমি, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো, ২০শে নভেম্বর রমজানের পরের দিন, রমজান শেষ হলো, রমজানের পরের দিন, ঈদের পরের দিন, জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে যোগদান করার জন্য আমি লাহোর গেলাম। জামায়াতের হেডকোয়ার্টার তো লাহোর, তখনো ছিল লাহোর, এখনো লাহোর, এটার পরে, আমি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, একথা বলার জন্য যে, আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানে কি হচ্ছে আপনি যান না কেন? আপনি টিক্কা খানরে দিয়া রাখছেন। এরজন্য কয়েকদিন সময় লাগলো আমার সেখানে।
এভাবে আমি ৩রা ডিসেম্বর আমি রওয়ানা দিলাম করাচী থেকে পিআই এর প্লেনে, এটিই পিআই এর শেষ প্লেন ছিল। ঢাকা থেকে সেদিন পিআই এর লার্স্ট প্লেন, লার্স্ট প্লেন এজন্য যে থার্ড ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে বোমা ফেলা হয়েছে। এয়ারপোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সেজন্য আমার প্লেন এসে নামতে পারে নাই, আশ্রয় নিয়েছে গিয়ে জেদ্দায়। পয়লা তো তখন ইন্ডিয়ার সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল তা ইন্ডিয়ার উপর দিয়ে আসতে দিত না, পাকিস্তানের প্লেন আসতো ঐ শ্রীলঙ্কা হয়ে।
তো প্লেন থেকে দেখলাম যে শ্রীলংকার নারিকেল বাগান পার হয়ে আসলাম, করাচী থেকে ওখানে তিন ঘন্টা লাগতো, সেখান থেকে এখানে আসতে আরো তিন ঘন্টা লাগতো, ছয় ঘন্টা ফ্লাইট ছিল। তারপরে দেখি যে প্লেন নামলো কলম্বো। কেন নামলো কিছু বলে না। তারপর দেখি যে, আরেকটা দেখা যায় পিআইএর, ঢাকা থেকে যেটা যাচ্ছিল, এদুটা এসে সেখানে নামলো। তিন ঘন্টা পর, প্লেন আবার উড়লো, তখন ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলো যে, করাচী এবং ঢাকা এয়ারপোর্টের কোথাও যাওয়া সম্ভব না, যুদ্ধ বেধে গেছে, আমাদেরকে, আমাদের দুটা প্লেনকে ইন্টস্ট্রাকশন দেয়া হলো হয় আমরা তেহরান বা জেদ্দায় গিয়ে যেন আমরা আশ্রয় নেই।
যখন নামলাম প্লেন থেকে. এমন আবেগ যে ওমরা করতে পারবো, কাবা ঘর দেখতে পারবো, এখানে আসার কতো স্বপ্ন, তখনো পারি নাই, তো ক্যাপ্টেন যে, ভূপালের লোক, ছ ফুটের ওপর লম্বা, আমাকে বললো যে আপনাকে আমি চিনি, আমি তবলিগ জামায়াতের সাথে সম্পর্ক, আমি কাকরাইল মসজিদে গেছি। তো, তেহরান যাইতে পারতাম, তেহরান বা জেদ্দা যে কোন যায়গায় যাওয়ার জন্য আমাদেরকে অর্ডার দেয়া হয়েছে, ঐ প্লেনটা তেহরান চলে গেছে, আমি বললাম যে জেদ্দা যাওয়ার সুযোগ পাইলে, ওমরা করার সুযোগ পাইলে তেহরান যাব কেন? তো, প্লেনে লন্ডন গেছে, তো এইভাবে আমার প্লেন জেদ্দায় চলে গেল। এরপরে ১০ই ডিসেম্বর ইন্ডিয়া পাকিস্তান সীজফায়ার করলো, একদিন যুদ্ধ বন্ধ থাকবে ঘোষণা করলো, যাতে বিদেশীরা চলে যেতে পারে, সেই দিন সেই ১০ তারিখে আমার প্লেন জেদ্দা থেকে করাচী আসলো। এভাবে আমি পাকিস্তানে আসলাম। তো আমি বলতেছিলাম যে, ৩রা ডিসেম্বর আমার প্লেন নামতে পারলো না, তারপর জেদ্দায় চলে গেলাম, তারপরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
তেহাত্তর সালে শেখ মুজিব সরকার তিন কিস্তিতে ৮৬জন নেতার নাগরিকত্ব বাতিল করলো, পয়লা কিস্তিতে ছিল, উণচল্লিশজন, সেই তালিকায় হামিদুল হক চৌধুরী, নূরুল আমীন, মাহমুদ আলী, আমার নামও ঐ তালিকায় ছিল। নাগরিকত্ব বাতিল করার কারনে তো আমরা বাংলাদেশে আসার অধিকার, সুযোগ পাচ্ছি না, এরপরে ৭৬ সালের জানুয়ারী মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ঘোষণা করলো যে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তাদের মধ্যে যারা নাগরিকত্ব ফেরত চান সরাসরি সচিবকে লেখেন। আমি লেখলাম, কোন জবাব নাই। এরপরে আমার মা দরখাস্ত করলো, যে আমরাতো বেশী ফুসরত দিতে পারবো না, তো আপনার যাই পারেন দেন, তো একমাসের ভিসা দিল, ঐ ভিসায় আমি আসলাম। আসার পর আমি পাকিস্তানী পাসপোর্ট ফেলে দিলাম।
যে আমি এদেশে আসছি, আমার জন্মভূমি, আমার বাড়ীতে আছি, আমার নামে বাড়ী, মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স আমি দেই, আমাকে জোর করে তাড়াইতে পারবানা এখান থেকে। আমাকে এখান থেকে বাড়াবার জন্য চেষ্টা করেছে, পাকিস্তান হাইকমিশনকে রিকোয়েস্ট করেছে তাকে আপনার নেন। উনি যাইতে না চাইলে আমরা নেব কেন?
সাংবাদিকঃ স্যার, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যারা এখন বলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি, এই দুইটা শক্তির মধ্যে আসলে পার্থক্য কি ছিল? কারা কোন ভূমিকায় ছিল?
গোলাম আযমঃ রাজাকারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হতো, কারন তারা পাহার দিত, তাদেরকে মারতে আসতো, আমরা তো সেখানে কোন ভূমিকা পালন করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। ঐ যে, কোন কমপ্লেইন আসলে, কমপ্লেইন নিয়া তাদের কাছে ধরনা দেয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারতাম না।
সাংবাদিকঃ আপনি তো বললেন যে, আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি সোমবার দেয়া হলো, সেটার পেক্ষিতে আপনি কি আপনার মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত কিনা, জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোন বিষয় আছে কি না?
গোলাম আযমঃ দেখেন, মুক্তিযুদ্ধে কেন অংশগ্রহণ করতে পারলাম না, যদি, পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে যে আচরণ ভারত করেছে তাতে ভারতকে বন্ধু মনে করার কোন কারন ছিল না।
যখন বাংলাদেশী জনগণের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের নেতারা ভারতে গিয়া ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ধর্ণা দিল, যে আমাদেরকে স্বাধীন করার জন্য আপনার সাহায্য করেন, তখন আমরা মহা চিন্তায় পরলাম, যে ভারত তো আমাদেরকে স্বাধীন করতে আসবে না, তারা আসবে তাদের স্বার্থে। তারা আসছে তাদের স্বার্থে, সে স্বার্থটা কি, এক নম্বর স্বার্থ হলো তাদের চীর দুশমন পাকিস্তানকে দূর্বল করা। যদি পাকিস্তান থেকে ইস্ট পাকিস্তানকে আলাদা করতে পারে, তবে পাকিস্তান দূর্বল হলো। দুই নম্বর, পাকিস্তান ভারতের বাইরে, আর আমরা ভারতের পেটের ভিতরে, চারিদিক ভারত, দক্ষিণ দিকেও বঙ্গোপসাগর তাদের হাতে, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তাদের হাতে, আমরা যদি তাদের থেকে আলাদা হই, তাহলে আমরা স্বাধীন স্বত্ত্বা রক্ষা করে চলতে পারবো না, আমরা ভারতের আধিপত্যের অধীন থাকতে বাধ্য হবো। ইন্ডিয়ার স্বার্থ তিনটা ছিল, একটা হলো পাকিস্তানকে দূর্বল করা, আর আমার উপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ গ্রহণ করা, আর পাকিস্তানের মেজরিটি এলাকাটাকে তাদের পণ্যের মার্কেট বানানো।
তারা আমাদের স্বাধীনতার জন্য আসে নাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তাদের যে আচরণ, এতদ্বারা কি প্রমাণ হয় আমাদের স্বাধীনতা তারা চায়? আমাদের বর্ডারে তারা পাখির মতো মানুষ মারছে, জনগণ প্রতিবাদ করছে কিন্তু সরকার প্রতিবাদ করে না।
সাংবাদিকঃ না, আপনি অনুতপ্ত কি না? মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগের কথা বলা হয়েছে .
গোলাম আযমঃ আমি তো বললাম যে এসব গুলি অভিযোগ নয়, অপবাদ। আমার বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারবে না যে মানবতাবিরোধী কোন কাজ আমি করেছি, জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো কোন অপরাধ করেছি। এরকম কিছুই তারা পাবে না।
হ্যারাস করবে, আসলে তো বিচারের কি রায় হবে আগেই ফয়সালা হইয়া আছে। এটা তো একটা প্রহসন মাত্র, বিচারের নামে অভিনয় চলছে। এই যে কয়দিন আগেও পাটমন্ত্রী বলেনাই, এ বিচারের কোন দরকার নাই, ফাঁসি দিয়া ফেল, বলেছে কি না?
সাংবাদিকঃ স্যার সর্বশেষ প্রশ্ন স্যার, মাগরিবের আজান দেবে, যে আমরা যেটা জানছি যে সবাই আশা করছে বা আপনি হয়তো অনুমান করছেন যে হয়তো আপনি গ্রেফতার হয়ে যেতে পারেন, আপনি মানসিকভাবে এখন প্রস্তুত কি না গ্রেফতারের জন্য?
গোলাম আযমঃ জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছি। আর মোমেন তো মৃত্যুকে ভয় করে না। আর যদি অন্যায়ভাবে মৃত্যু দেয়া হয়, তাহলে শহীদ হওয়ার গৌরব পাওয়া যায়।
সে হিসাবে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে, শাহাদাতের কামনা করি। সুতরাং ভয় কিসের? আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করা তো জায়েজই না। আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করার অনুমতি নাই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।