জ্যোৎস্নাবিলাস!!! অন্ধকার গলির ম্যানহোলের পাশে একটা দুর্গন্ধময় বিকৃত লাশ পড়ে আছে। লাশের চোখ গুলো খুবলে নেয়া হয়েছে ধারালো কোন অস্ত্র দিয়ে, মুখ টা হা করা, ভেতরে জিহ্বা নেই, হাতের আঙ্গুল গুলো টুকরো করে কেটে কেটে পাশে রাখা হয়েছে! লাশের চারিদিকে মাছি উড়ছে, আর পাশে ভিড় করছে পাড়ার সব কুকুর গুলো! আলোবিহীন দুর্গন্ধ যুক্ত নোংরা এই জায়গাটার থেকেও অনেক বেশি নোংরা আর বীভৎস এই লাশটা। সব ছাপিয়ে নোংরা আর বীভৎস হওয়া এই লাশটা আজমের।
পুকুরের পানিতে মননের আবছা ছায়া পড়ছে। সে তাকিয়ে আছে সেই ছায়াতে! কি মায়াবী একটা চেহারা! মনন আস্তে করে পানিতে হাত বুলিয়ে দিল, কুৎসিত রক্ত মাখা হাত, হাত থেকে রক্ত গুলো ধুয়ে যাচ্ছে।
মনন সেই জল ছুয়ে পবিত্র হচ্ছে, অথবা কে জানে হয়তো জল গুলোই অপবিত্র হচ্ছে!
দুই দিন আগে-
রাত ১০টা, ১৪ই ডিসেম্বর, ২০১১।
বাজারের ব্যাগ হাতে আজম বাসায় ফিরছেন। ইদানিং তাঁর কিছু সমস্যা হয়েছে! রোজ এই গলি দিয়ে যাবার সময় তাঁর বুক ধড়ফড় করে! মনেহয় কোন ছায়া তাঁর পিছু নিচ্ছে, তিনি তেমন পাত্তা দেন না। আপন মনেই হেঁটে যান! তবু ভেতর টা আজকাল বড় কু ডাকছে!
মনন গলির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে তাকে দেখা না যায়! আজকাল সে রোজ রাতেই এখানে দাঁড়িয়ে থাকে, আর অপেক্ষা করে আজমের।
আজম যখন রোজ এই গলি দিয়ে যাবার সময় ভয় ভয় চোখে এদিক ওদিক তাকায়, তখন মননের খুব হাসি পায়। সে খুব কষ্টে হাসিটা চাপিয়ে রাখে।
সাত দিন আগে-
সন্ধ্যা ৭টা, ৯ ডিসেম্বর, ২০১১।
আজমের চোখ জ্বল জ্বল করছে, তিনি তাকিয়ে আছেন তাঁর হাতের কাগজটির দিকে। ১৬ই ডিসেম্বর কলেজে ভাষণ দেবার জন্য এটা রেডি করেছেন।
এর মধ্যে কিছু মিথ্যা মেশাতে পেরে তিনি আরাম বোধ করছেন, এখন মানুষের মাথায় এসব ভাল ভাবে ঢালতে পারলেই তিনি শান্তি পাবেন! অবশ্য ঢালার কাজটা জানতে হয়, সবাই এসব পারে না, কিন্তু উনি খুব ভাল ভাবে পারেন। মিথ্যা কথা গুলোর সাথে সুন্দর ভাবে তিনি ধর্ম মিশিয়ে দেবেন, যাতে কেউ লাফানোর আগেই মিইয়ে যায়! ‘আহ!’ বলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন শান্তিতে।
মনন তাকিয়ে আছে একটা ধারালো চাকুর দিকে, আজ কয়েক দিন থেকে রোজ সে এই চাকুটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকে, কিন্তু টাকার অভাবে কেনা হয়না। আজ সে সব টাকা এনেছে, চাকুটার দিকে তাকিয়েই মননের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছে। সে চাকুটা হাতে উঠিয়ে নিল! ‘আহ!’ বলে খুশি হয়ে ওঠে মনন! কি অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে তাঁর ভেতর!
দশ দিন আগে-
সকাল ১০ টা,৬ ডিসেম্বর,২০১১।
আজমের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। উপরের লেভেল থেকে কি সব ঝামেলার কথা শুনছে আজকাল! কি সব বিচার টিচার না কি যেন! সে এখনও ভেবে পায়না মানুষ ৪০ বছর আগে কার বিষয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে এত পছন্দ করে কেন! আর আজকাল কার ছোকরা ছেলে পিলে গুলো বিচার চাই বলে লাফিয়ে ওঠে! ‘ধুর শালা, দেশটা রসাতলে গেল। ’ আজম আপন মনে খিচতে থাকে।
মনন বন্ধুদের কবিতা আবৃতি করে শোনাচ্ছে। যুদ্ধের কবিতা।
প্রতিটা শব্দ যেন একেক টা যুদ্ধের গল্প,কি আবেগ সেই শব্দে, কি আবেগ সেই উচ্চারনে! প্রতিটা শব্দ স্পর্শ করে যায়! মনন চোখ বন্ধ করে সেই আবেগের ঝড় তুলছে! প্রতিটা বন্ধু মুগ্ধ হয়ে শুনছে! মুগ্ধ হয়ে শুনছে সেই কবিতা!
_____________________________________________
ক্লাসের মাঝে-
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
‘কি! ত্রিশ লাখ! নাহ নাহ, ত্রিশ হাজারো নাহ!’
‘কিন্তু স্যার আমার দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, আমি জানি...’
‘আরে ধুর ধুর! ওসব কুত্তার জাত, বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলে!’
‘আমার ফুপি বীরাঙ্গনা, আমি জানি পাকিস্তানিরা...’
‘গনিমতের মাল গনিমতের, আর যারা দেশ ভাঙ্গতে লাফায় তাঁদের কপালে ওরকম জোটে একটু আধটু!’
মননের চোখে রাজ্যের বিস্ময় সাথে ভয়ংকর ক্রোধ! সে তীব্র ক্ষোভে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে! তাঁকে এই অসম্মানের প্রতিশোধ নিতেই হবে, হবেই হবে। নাহলে সমস্ত মুক্তিযুদ্ধ মিথ্যা হয়ে যাবে! সে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, সেই যুদ্ধ হবে এই বেঁচে যাওয়া রাজাকার গুলোর বিরুদ্ধে! সেই যুদ্ধ হবে দেশকে নতুন করে সাজানোর যুদ্ধ! সে জানে সে পারবে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে যে প্রান শক্তি নিয়ে মননের দাদা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, সেই একই প্রান শক্তি, একই উদ্দীপনা, একই মাতলামো নিয়ে মনন যুদ্ধে নামবে! দেশ স্বাধীন হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হবে! এত্ত গুলো মানুষের মৃত্যু, ত্যাগ সে কিছুতেই বৃথা যেতে দিতে পারেনা, সে বৃথা যেতে দিবেনা!!!
দুটো দৃশ্য ও কিছু তুলনা-
ডিসেম্বর,১৯৭১।
‘বল, বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ , বল বেটা!’
‘হাহাহা, আজম, তোর আর বেশি সময় নাইরে, কতক্ষণ আর লাফাবি?’
‘শালা, বল পাকিস্তান জিন্দাবাদ, নাইলে জিহ্বাটা টাইনা ছিঁড়া দিব। ’
‘ জয় বাংলা। ’
‘আর একবার খালি...’
‘জয় বাংলা, পাকিস্তান থুঃ’
‘এটাই তোর মুখের শেষ কথা...’
... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
ডিসেম্বর, ২০১১।
‘বল, জয় বাংলা বল’
‘বাবা, মনন, ও বাবা তুই রে, বাবা ভুল হইছে বাবা মাফ দে, সেইদিন আমি মিথ্যা বলছিলাম রে বাবা, মিথ্যা বলছিলাম... ’
‘বল জয় বাংলা বল’
‘ও বাবারে, অনেক পাপ করছি বাবা, মাফ কর মাফ কর, তোর দাদা ফুপুও মাফ করে দিছে, তুই করবিনা বাবা?’
‘জয় বাংলা বল’
‘জয় বাংলা , জয় বাংলা...’
‘এটাই তোর মুখের শেষ কথা...’
জ্বর আর প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে লিখলাম! জানিনা কি লিখলাম , কি হল! শুধু জানি প্রচণ্ড ঘৃণা আর ক্ষোভ নিয়ে লিখছি!! কিছু নব্য রাজাকার দের তো আমরা দেখেছি, আর আজ এমন কিছু মানুষ কে দেখলাম যারা মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্বকে নিয়ে মিথ্যা বলছে! পাকিস্তানিরা আদৌ এত বাঙালি মেরেছিল কিনা, বা মারা অনুচিত ছিল কিনা সে ব্যাপারেই তারা সন্দিহান!! বিজয়ের মাসে এসব দেখতে হয়!! আমার আজ খুব যুদ্ধ করতে ইচ্ছে হয়, খুব ইচ্ছা হয় এই রাজাকার আর আবর্জনা গুলো কে দেশ থেকে বিদায় করি! আমার আজ খুব মনন হতে ইচ্ছে করছে! ধারালো ছুড়ি দিয়ে টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছা করছে তাঁদের পাপবিদ্ধ শরীরের অংশ গুলোন! সব পাপী গুলোকে ধবংস করে , ময়ূরাক্ষীতে হাত ধুয়ে তারপর আমি ঘুমাতে যাব, তারপর আমার আসবে সত্যিকারের ঘুম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।