নামহীন। শুক্রবার সন্ধ্যায় নৌভ্রমনরত অবস্থায় ডাকাত দলের হামলায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। শনিবার সকালে শাবি প্রশাসন ও পুলিশের উপস্থিতিতে ৮নং নওয়াগাঁও ইউনিয়নের চেঙ্গের-খাল থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এঘটনার প্রতিবাদে এবং শিক্ষার্থীদের উদ্ধার ও নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে প্রক্টরসহ প্রশাসনের পদানশীন বিভিন্ন ব্যাক্তিদের পদত্যাগ দাবি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ সকল দাবিতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ সহ বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ এবং আমরন অনশন কর্মসূচি পালন করেছে।
শিক্ষার্থীদের আহুত এসকল কর্মসূচির ফলে ক্্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। প্রশাসন এ ঘটনায় ৩দিনের শোক ঘোষণা করেছে এবং জালালাবাদ থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেছে। পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ২জনকে গ্রেফতার করেছে। নিহতদের স্মরণে রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ে শোক-র্যালী ও সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুই শিক্ষার্থীর হত্যাকারীদের দ্রুত বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে শাবি ছাত্রলীগ এবং জাতীয় ছাত্রদল জোর দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এধরনের বর্বরতার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়েছে। রোববার বাদ জোহর ক্যাম্পাসে নিহত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাযা এবং মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছে ছাত্রলীগ।
নিহত দুই শিক্ষার্থী শাবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ২য় বর্ষ ২য় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। এদের একজন হলেন দীপংকর ঘোষ অনিক ও অন্যজন খায়রুল কবির।
অনিকের বাড়ি ঢাকার বাসাবোয়। সে সিলেট নগরীর পাঠানটুলায় বসবাস করত। খায়রুলের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে, সে সিলেট নগরীর জালালিয়া এ্যাপার্টমেন্টের নিচতলায় কক্ষ নং ১/সি এ বসবাস করত।
সকালে শিক্ষার্থীদের লাশ দুটি উদ্ধারের পর সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে সন্ধ্যায় তাদের স্বজনেরা লাশ বাড়িতে নিয়ে গেছে।
খায়রুলের জানাযা ক্যাম্পাসে হওয়ার কথা থাকলেও পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ আর না বাড়ানোর জন্য লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। খায়রুলের পক্ষে তার মামা এবং ভাই এবং অনিকের পক্ষে তার মা-বাবা ও ভাই লাশ গ্রহণ করে।
জানা যায়, নিহত খায়রুল ও অনিক শুক্রবার বিকেলে অনিকের ফুপাতো ভাই রাজীব ঘোষ এবং সহপাঠি জোসেফ, ১ম বর্ষ ২য় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাদ ও তিন মেয়ে সহপাঠি সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বাদাঘাট এলাকায় নৌকাভ্রমণ করতে যায়। ফিরতি পথে সন্ধ্যায় অপর একটি নৌকাযোগে কতিপয় ডাকাত তাদের নৌকা আটকে হামলা চালায়। ডাকাতদের হামলায় এসময় শিক্ষার্থীরা আহত হয়।
এসময় খায়রুল, অনিক জোসেফ সহ রাজীব ও সাদ ডাকাতদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালালে মারধরের পরিমান বেড়ে যায়। একসময় ডাকাতরা খায়রুল ও অনিককে মাথায় ও মুখে এলোপাথাড়ি মারধর করে পানিতে ফেলে দেয় এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন মূল্যবান দ্রব্যাদি নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছুলে বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন ঘটনা স্থলে ছুটে যায়। সেখানে গভীর রাত পর্যন্ত খোঁজাখুজি করেও তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
শনিবার সকাল ৬টা থেকে স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় বাদাঘাট এলাকার চেঙ্গেরখালে খায়রুল ও অনিককে খোঁজ করা শুরু হয়।
পরে সকাল সাড়ে ৭টায় জেলেরা অনিকের লাশ উদ্ধারে সক্ষম হয়। এসময় মারধরের ফলে অনিকের কানের কাছে হওয়া গভীর ক্ষততে এবং মুখে রক্ত জমাট বেঁধে থাকতে দেখা যায়। বুক, পিঠ হাতে মারধরের দাগ পাওয়া যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাম্বুলেন্স যোগে অনিকের লাশ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ময়না তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়।
পরবর্তীতে পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় বড় জাল ব্যবহার করে সাড়ে ৯টায় খায়রুলের লাশ উদ্ধার করা হয়।
লাশ উদ্ধারের পর বিক্ষুব্ধ সহপাঠি এবং ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য ব্যাচের শিক্ষার্থীরা লাশ উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের টাল-বাহানার অভিযোগ এনে লাশ নিয়ে ক্যাম্পাসে চলে আসে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এসময় ক্যাম্পাসে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে এবং খায়রুলের লাশ হাসপাতালে না পাঠানোর ঘোষণা দেয়। শিক্ষার্থীরা এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ভবনে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের বাঁধা প্রদান করার সাহস দেখাননি। ভাংচুর শেষ করে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল সহকাওে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে অবস্থান নেয়।
এসময় তারা টায়ার জ্বালিয়ে এবং বাঁশ-বিজ্ঞাপন বোর্ড দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে রাখে। এসময় প্রায় ২০ জন পথচারী ও একটি বাসের উপর হামলা চালায় তারা। রাস্তা অবরোধ থাকায় দুদিক থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এসময় খবর সংগ্রহ ও ফটো তুলতে গেলে সাংবাদিকদের উপর হামলা চালায় শিক্ষার্থীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ও শিক্ষাথর্েিদও শান্ত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিন ও অন্যান্য শিক্ষকরা এসময় চেষ্টা চালালেও তা সফল হয়নি।
পরবর্তীতে সিলেট সিটি কর্পোরেশন মেয়র বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান, সিলেট ২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান, সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমেদসহ সিলেট আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ ক্যাম্পাসে এসে প্রশাসনকে সাথে নিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দেন এবং শিক্ষার্থীদের অবরোধ তুলে নেয়ার আহবান জানান। তবে শান্ত হতে রাজি হলেও অবরোধ তুলে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনকে হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার দাবিতে এসময় প্রশাসনকে ২৪ ঘন্টা সময়সীমা বেঁধে দেন। এসময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা না হলে আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেয় তারা। পাশাপাশি প্রক্টরের পদত্যাগের দাবি জানান তারা।
ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আহবায়ক করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ হাসানুজ্জামান শ্যামল ও একই বিভারেগ সহযোগী অধ্যাপক ড. সায়ন চক্রবর্তী। কমিটিকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ঘটনার রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শাবির বিভিন্ন বিভাগের সাধারন শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টা থেকে আমরন অনশনের ঘোষণা দিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে। শাবি ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ এসময় তাদের শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যার্থ হয়।
অনশনরত শিক্ষার্থীরা এসময় তদন্ত কমিটি প্রত্যাথ্যান করার ঘোষণা দেয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, দুইজন শিক্ষার্থীর নিখোঁজ সংবাদ ক্যাম্পাসে পৌছুনোর পরও প্রশাসনের বিভিন্ন পদে পদানশীন ব্যাক্তিরা ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠান দেখায় মজে ছিলেন। পরে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় পার্শ্ববর্তী তেমূখি পয়েন্টে এলাকাবাসি সংঘবদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালাবার খবর পেয়ে তেমূখি পয়েন্ট এবং সুরমা আবাসিক এলাকায় দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সড়কের উপর থেকে তুলে নেয়া হয়। পরে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে প্রশাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় এবং উপাচার্য বাসভবন ঘেরাও করে রাখে।
ঘটনা বিষয়ে নিহত অনিকের ফুপাতো ভাই রাজীব ঘোষ জানান, রাতেই এবিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কে জানানো হলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় নি।
ঘটনা সম্পর্কে জালালাবাদ থানা ওসি মো. সেলিম হোসেন বলেন, এপর্যন্ত দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন হল নৌকার মাঝি গুলজার ও অন্যজন ঘটনার পরিকল্পনাকারী তারেক।
সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সালেহ উদ্দিন জানান, সকল সম্পদ, সকল মেধা ও পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে সুষ্ঠু বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসন আন্তরিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।