বামলীগের অর্থনীতি
নূর-এ-আলম সিদ্দিকী
প্রাণ ভরা প্রত্যাশা নিয়ে, ২৪ বছরের শোষণের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত নেতৃত্বে বাংলাদেশেরর নিরস্ত্র ৭ কোটি মানুষ রক্তস্নাত স্বাধীনতা সূর্যকে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে উদ্ভাসিত করল, অথচ ৪০ বছরের মাথায় এসে আজকে স্বপ্ন ভঙ্গের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস না হলেও বিকলাঙ্গ বললে অত্যুক্তি হবে না। সা¤প্রতিককালের ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকই কেবল ৪০ ভাগ কমে নাই, বরং ৩৩ লক্ষ পরিবার যড়যন্ত্রর এবং অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের শিকার হয়ে নি:স্ব হয়ে গেছে, পথে বসে গেছে। তারা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে এতিমের মত, অসহায়ের মত, অতি দরিদ্রের মত সর্বস্ব হারিয়ে পথে পথে ঘুরছে। সরকার একটা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
এখনো বলার সময় আসে নাই, কিন্তু তার কি প্রতিফল হবে, অর্থনৈতিক অঙ্গনে কি পরিবর্তন আনবে? সত্যিকারেই পরিবর্তন আনতে পারবে কিনা সেটা অনুধাবন করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এ কয়দিনে বেদনা বিধূর চিত্তে, বিস্মিত নয়নে লক্ষ্য করলাম, যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মারাত্মক লুন্ঠনের প্রেক্ষাপটে জনগণের দাবী এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদে সরকার একটি কমিশন গঠন করেছিল। ইব্রাহিম খালেদ সাহেবের নেতৃত্বে। ইব্রাহিম খালেদ সাহেব একটি রিপোর্ট তৈরিও করেছিলেন। যে রিপোর্টটি অতি সহজ, অতি সাধারণ এবং যেকোনো ব্যক্তি কম্পিউটারে অনুপ্রবেশ করলেই ওই রিপোর্টের যথার্থতা, যুক্তিসঙ্গত কারণসমূহ যে কোন মুহুর্তেই উৎঘাটন করতে পারবে।
বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, ন্যূনতম রাজনৈতিক সচেতনতা, রাজনৈতিক সম্মানবোধ, রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ থাকলে অর্থমন্ত্রী এটা বলতে পারতেন না, যে তাদের নাম আমি প্রকাশ করতে পারব না। লালবাহাদুর শাস্ত্রী যখন ভারতের রেল মন্ত্রী তখন একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল। উনি গার্ডও ছিলেন না, উনি ট্রেনটি চালানও নাই। কিন্তু উনি রেলওয়ের মন্ত্রী ছিলেন, সারা ভারতবাসীকে বিস্মিত করে সেই দুর্ঘটনার দায় দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে তুলে নিয়ে মন্ত্রীত্ব থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।
ভারতের দীর্ঘ সেই ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এতভাল একাডেমীক রেকর্ড যার নাই, সেই হুমায়ুন কবীর সাহেব শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে ইংরেজী। কিন্তু কেবিনেটে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার সাথে সাথে শত অনুরোধ, উপরোধ স্বত্ত্বেও তিনি আর শিক্ষামন্ত্রী থাকেন নাই। অথচ আমাদের অর্থমন্ত্রী নির্লজ্জের মত বললেন, যারা স্টক এক্সচেঞ্জ কেলেঙ্কারীতে যুক্ত, ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্ট যাদের নাম আছে, তাদের বৈভব, প্রাচুর্য্য, প্রতিপত্তি, ঐশর্য্য -এর প্রভাব এতই মারাত্মক, যে আমি তাদের নাম প্রকাশে অক্ষম। উনার উচিৎছিল পদত্যাগ করে একথাটি বলা। যদি ন্যূনতম সৌজন্যবোধ থাকত, আত্মসম্মাবোধত থাকত তাহলে তিনি অবশ্যই বলতেন, যেহেতু আমি তাদের নাম প্রকাশ করতে অক্ষম হলাম, তাই আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হলাম।
তখন সংসদ অধিভেশন চলছিল, প্রত্যাশা করেছিলম, সংসদে দাঁড়িয়ে অন্তুত প্রধানমন্ত্রী একথাটি বলবেন। কেননা যখন তিনি সংসদে প্রবেশ করেন তখন তিনি শুধু মাত্র আওয়ামীলীগের নেত্রী থাকেন না, তিনি পনের কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। উনি সংসদে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার নির্বাচিত প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। তাই প্রত্যশা করেছিলাম, যে তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে অন্তুত এটা বলবেন, যে ব্যক্তির ঐশর্য্য, প্রাচুর্য্য, বৈভব, প্রতিপত্তি যত উপরেরই হোক না কেন তারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তারা রাষ্ট্রে ঊর্ধ্বে নয়। আমি এই সংসদের দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে, দৃঢ় চিত্তে, অকুতভয়ে জাতিকে আশ্বাস দিচ্ছি, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যে তাদের আইনানুগ বিচার হবে।
মানুষের মনে বিশ্বাস আসত, আস্থা আসত, স্টক বাজারের জন্য যা হতো সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি। কিন্তু সেটা আমরা শুনতে পাই নাই। পক্ষান্তরে প্রত্যাশা করেছিলাম, খালেদা জিয়া উল্কার মত সংসদে ছোটে যাবেন। উনার জন্য এটা একটা অনেক বড় সুযোগ গেল। বাড়ির জন্য, ছেলের জন্য, সংসদের সামনের সিটে বসার জন্য কত সংগ্রাম করেছেন, কত কথা বলেছেন, হরতাল ডেকেছেন, কত মিছিল করেছেন; তাই প্রত্যাশা ছিল, তিনি সংসদে গিয়ে বলবেন, যে যতক্ষণ পর্যন্ত ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্ট সম্পূর্ণ প্রকাশ করা না হবে এবং দোষীদের বিচারের ঘোষণা মাননীয় সংসদনেত্রী না দিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এ সংসদ ছাড়ব না।
আন্না হাজারের মত ব্যক্তি ১২৬ বছরের কংগ্রেসকে হেলিয়ে দিল, দুর্নীতির প্রশ্নে। আর উনিতো বিরোধী দলীয় নেত্রী, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। উনিতো সে সাহস দেখালেন না, উনি তো মানুষের মনে যে রুদ্ধ কান্না তার প্রতিনিধিত্ব করলেন না। উনি বেতন নিচ্ছেন, ভাতা নিচ্ছেন, বিরোধীদলীয় নেতার সকল সুবিধা নিচ্ছেন। অথচ কার সঙ্গে রাগ করে, কার সঙ্গে অভিমান করে, সংসদে যাচ্ছেন না? সংসদ তো শেখ হাসিনার একার নয়, সংসদ জাতির।
যারা তাদেরকে ভোট দিয়েছেন, তাদের কাছে এবং উনার যে নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সেখানে স্পস্ট লেখা আছে, যে উনি সংসদ বর্জন করবেন না। কিন্তু উনি সে অঙ্গীকার রক্ষা করলেন না । তার ফলাফল কি হলো? মানুষের মন থেকে স্টক এক্সচেঞ্জ, দেশের অর্থনীতি, দেশের শাসন ব্যবস্থা সর্বোপরি দেশ যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উপর থেকে আস্থা ওঠে গেল, বিশ্বাস করপুরের মত উড়ে গেল।
অর্থমন্ত্রী বারবার বলেছেন, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলছেন, কিছু লোক ক্যাসিনোর মধ্যে জুয়া খেলতে গিয়েছিল, এখন জুয়ায় হেরে গেছে আমি কি করব? স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাক্তন সভাপতি হিসেবে নয়, স্টক এক্সচেঞ্জের প্রবীণতম সদস্য হিসেবে নয়, এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, রাস্তার ধারে চাটাই বিছিয়ে যে জুয়া খেলা এই ক্যাসিনোতো সেটা নয়, এর লাইসেন্স দিয়েছেন কারা? একটি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে যখন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত হয় তখন তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছরের লেনদেন স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে পেশ করতে হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠায়, তারা দেখার পর জাতীয় ভাবে অডিটের প্রয়োজন হলে তাও করা হয়।
এর পরেই কেবল সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ তার অনুমোদন দেন, কোম্পানির শর্ত অনুযায়ী।
কোম্পানি ক্লাসিফাইড, পাঁচ বছর ধরে বন্ধ। সেই সব কোম্পানির ১০টাকার শেয়ার ২০০ টাকা পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯০ টাকা পর্যন্ত হাই চার্জ করে; এমন কোম্পানিও আছে যে কোম্পানির মূল্য নিক্তি দিয়ে মাপলেও ২শ’ কোটি টাকা হবে না সেটার ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকার ভ্যালু ধরে স্টক এক্সচেঞ্জের ২-৩টা হাউজের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যাডিং- এর মাধ্যমে লেনদেন করে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা মাথার গাম পায়ে ফেলে, প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা দুনিয়া থেকে প্রবাসী যারা টাকা পাঠায় তারা, অসংখ্য সৈনিক যারা জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিদেশে চাকরী করে যে টাকা পাঠায় সেসব টাকা এখানে ইনভেস্ট করা হয়েছিল, যা লুণ্ঠন করা হয়েছে। অনেকে ঘর-বাড়ি, ভিটা-মাটি বন্ধক দিয়ে ইনভেস্ট করে সর্বস্বান্ত হয়েছে।
এদেশে কর্মসংস্থানের অভাবে অসংখ্য যুবক বেকার। তাই তারা যখন দেখেছে, যে শেয়ার মার্কেটে গেলে কিছু উপার্জন করা যায় তখন তারা সর্বোচ্চ পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। তাদের এই বিনিয়োগ লুণ্ঠনে স্টক এক্সচেঞ্জের কোন কোন হাউজ অবশ্যই জড়িত ছিল। কিন্তু সকলে নয়। কারণ ক্লাইন্ট যদি বলে, যে ওই শেয়ারটা কিনেন তাহলে স্টক এক্সচেঞ্জের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সেই শেয়ারটি তাদের কিনে দেয়া।
আর যদি বলে ওই শেয়ারটি বেচেন তাহলে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে বেচে দেয়া। তাই সকলকে দোষী করি না, কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু কিছু লোকের সহযোগিতা, কোন কোন হাউজের সহযোগিতা ছিল। আর এদের চিহ্নিত করার জন্য সেটেলাইটের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের দরকার নাই, কম্পিউটারের সুইচ টিপলেই বের হয়ে আসবে। ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্ট প্রকাশ করলেই বের হয়ে আসবে, এর জন্য দায়ী কারা।
এই অবস্থায় স্টক এক্সচেঞ্জের বাজারকে স্থিতিশীল করতে গেলে আমার ন্যূনতম পরামর্শ হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীকে বদলাতে হবে।
উনি নিজেই বললেন, যে উনি পুঁজি বাজার বোঝেন না। যা বোঝেন না সেখানে থাকার দরাকর কী? যেটা বোঝেন সেই মন্ত্রণালয়ে যান। দুই নম্বর হচ্ছে, জনমনে বিশ্বাস এবং আস্থা জন্মানের জন্য, পুঁজি বিনিয়োগের সাহস পুনরুদ্ধার করার জন্য ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টে যারা দোষী সাব্যস্থ, তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে এবং তাদের শাস্তি দিতে হবে। কম্পিউটার খুলে দেখুন, কারা সকল শেয়ার বেচে দিয়ে সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়েছে? যে জুয়া খেলার কথা অর্থমন্ত্রী বললেন, এই জুয়া খেলার পথটা কারা সৃষ্টি করেছেন? দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যারা যুক্ত সেই সব লোক, অর্থমন্ত্রীও তাদের একজন।
ব্যাংকিংখাতে তারল্যের প্রচণ্ড অভাব, রিজার্ভে টান পড়েছে, অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে অর্থনীতি।
পৃথিবীর সর্বত্রই ডলারের দাম পড়ছে। অথচ একমাত্র বাংলাদেশে দাম বাড়ছে। তার মানে কি? আমাদের অর্থনীতির শক্তি, স্ট্রেংথ সম্পর্কে যতই বলা হোক, যে আমাদের আর্থিক অবস্থা সুস্থ আছে, সেটা আসলে ঠিক না। ১ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হলো, আর তার মধ্যে ৪৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট। কিন্তু এই বিপুল অংকের অর্থের সঙ্কুলান কে করবে তার কোন ব্যাখ্যা অর্থমন্ত্রী দেন নাই।
কি অদ্ভুত একটা দেশ? যে সেখানে কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকার একটা উদ্বৃত্ত বাজেট পেশ করা সম্ভব! এটা কি কোন সুস্থ অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর উদাহরণ হতে পারে? ড. ইউনুছ সাবেহের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত সখ্যতা নেই। সামনা সামনি হয়ত তার সাথে আমার দেখাও হয় নাই। কিন্তু এই লোকটি মাইক্রো ইকোনমিকে একজন পথিকৃৎ। জার্মানির প্রেসিডেন্ট এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট উনারা উভয়ে একটা অর্থনৈতিক সম্মেলনে মন্তব্য করেছিলেন, যে ড. ইউনুছের মাইক্রোইকোনমিক আজকের বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়। অথচ আমরা তার কোন মূল্যায়ন করছি না! সরকার বলছে, যে উনার গ্রামীন ব্যাংকের এমডির পোষ্ট হচ্ছে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারীর পোষ্ট; তো সেই জয়েন্ট সেক্রেটারীর পোষ্টের সঙ্গে পা মাড়িয়ে ঝগড়া করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ- এর সঙ্গে মতপার্থক্য সৃষ্টি করে লাভ হলো কার? আমাদের দেশে কারা অনুদান দেয়, কারা সাহায্য দেয় সেটাতো কারো অজানা নয়।
তাদের গালাগালি করে লাভ নেই। আমেরিকার অনুমতি ছাড়া বিশ্ব ব্যাংক কাউকে কোন সাহায্য দিতে পারে না, দেয় না। তার জন্য একটা বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে তো। তারা যদি বিকল্প পথ তৈরি করে নিয়ে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটাতেন তাহলেও বোঝতাম যে এই সরকারের একটা অলটারনেটিভ চিন্তা আছে। কিন্তু সেটা তো দেখছিনা।
পদ্মা সেতুর বিষয়টি দেখলেই বোঝতে পারবেন, যে এগুলোর প্রত্যেকটিই একটার সাথে একটা জড়িত। তারা যে অভিযোগগুলো আনল সেই অভিযোগগুলোর উত্তরে আমরা নিশ্চুপ, নিস্তব্দ। কাউকে আমি পরোয়া করিনা, এরকম একটা ভাবভঙ্গী না দেখিয়ে অন্তত তাদেরকে বলা উচিৎ ছিল, যে স্প্যাসিফিকভাবে তদন্ত করে বলেন, কোন কোন জায়গায় দুর্নীতি হয়েছে, যদিও তারা কিছু কিছু বিষয়ে ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু তিনি যেন ধনুকভাঙ্গা পণ করেছেন। ভাবটা এমন, যে সিদ্ধান্তটি তিনি নিবেন সেই সিদ্ধান্তটিই চূড়ান্ত।
তার যত সমালোচনা হোক, তিনি তার বাইরে যাবেন না। একদিকে একদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, তাদের দাম্ভিকতা এবং অন্যদিকে ভ্রান্ত বামের প্ররোচনায় (বামপšী’রা শিল্পায়নে অর্থায়নের পরিপূর্ণ একটা পরিপন্থী শক্তি, বিপরীত শক্তি) দেশের অর্থনীতি আজ অনেকটা দিশেহারা।
এই দেশে বামদের কোন শিকড় নেই। নৌকা মার্কা বাদ দিয়ে তারা কোনদিন জামানতও রাখতে পারবে না। অথচ আজ তারা আওয়ামী লীগের ঘারে চেপে বসেছে।
দিলীপ বড়ুয়ার কথাই ধরুন, ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। শিল্পপতি, শিল্পায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে তার রাজনীতি। আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসাবে তিনিই আজ আমাদের শিল্প মন্ত্রী! আজকে যখন সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বজুড়ে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়, যে আপনারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন তখন কোন প্রতি উত্তর আসে না। কারণ বুঝতে হলে, বাংলাদেশে যারা শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছেন তাদের হাল হকিকতটা ভেবে দেখতে হবে। গ্যাস নাই, বিদ্যুৎ নাই, শিল্পগোষ্ঠীর নেতারা বলতে বলতে হয়রান হয়ে গেছে, যে দশ ঘন্টাও বিদ্যুৎ দিতে পারলে একটানা দেন, একটা এলাকায়।
এক ঘন্টা অন্তর অন্তর যদি বিদ্যুৎ চলে যায় তাহলে উৎপাদনের স্পিডটি আর থাকে না। কিন্তু কার কথা কে শুনে? তাই বাংলাদেশের বর্তমান শিল্প কারখানাগুলো যেখানে ৪০-৪৫% এর উপরে প্রডাকশন পাচ্ছে না সেখানে আপনি নতুন বিনিয়োগের আশা করেন কিভাবে?
আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রি ডুবে যাওয়ার পথে। আমরা তো তুলা থেকে সুতা বানাতে পারছি না। কারণ এদেশে চাহিদামত তুলা উৎপাদিত হয় না। সুতা আসছে আর তা থেকে কাপড় বানাচ্ছি।
সুতা রপ্তানিতে যদি বাংলাদেশে অধিক কর বসিয়ে দেয় বা কাপড়ের উপর যদি বোনাস দিয়ে দেয়, তাহলে অন্যরা বাংলাদেশে সুতা আসা বন্ধ করে দিবে। একটা অন্তরায় সৃষ্টি করবে। তাই টেক্সটাইল মিল ও বস্ত্র কারখানাগুলো একেকবার দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু সুতা নিয়ে যখনই দাবা খেলা হচ্ছে, তখন আবার পড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর আমলে রিজার্ভ ছিল, কিন্তু সেটা পাকিস্তান নিয়ে চলে গেছে। আর সে আমলে সোনার দাম ছিল ৭৫ টাকা ভরি।
তারপরেও দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মক হোঁচট খেতে হয়েছে। আর সেটা হয়েছে এই বামদের চক্রান্তেই। এই বামরা তখন বঙ্গবন্ধুকে রাহুর মত গ্রাস করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শোষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল। অতি বামরা গুদাম লুট, থানা লুট, পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ করল। আর মস্কোপন্থী বামরা বঙ্গ বন্ধুর কাঁধে চড়ে বলল, যে এখন যদি আপনি অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না নেন, সম্পূর্ণ শাসন ক্ষমতা এককভাবে না নেন তাহলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুত হবে।
বঙ্গবন্ধু বামদের কুপরামর্শে যদি চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণ না করতেন তাহলে এই দেশে সামরিক শাসন আসার প্রশ্নই উঠত না। গণতন্ত্র বিকশিত হতো, অন্য কেউ ক্ষমতায় আসলেও আসতো গণতান্ত্রিক পালাবদলের হাত ধরে। ওই বামদের কুচক্রান্তেই এটা সম্ভব হয়েছে। জিয়া এবং এরশাদ সাহেবকে দখল করল পিকিং পন্থী বাম আর আওয়ামীলীগকে এখন দখল করেছে মস্কোপন্থী বাম। শিকড়বিহীন পরগাছার মত এরা গাছকে বেয়ে বেয়ে উঠে, এক সময় গোটা গাছটাকেই গ্রাস করে ফেলছে।
তাই বর্তমান আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগ না বলে, এটাকে বামলীগ বলা কোন অন্যায় হবে না। এই বামদের চক্রান্তে আজ শেখ হাসিনাই বরং জাতির চাইতে বেশি বিপদগ্রস্থ। না পারছেন গিলতে, না পারছেন ওগড়াতে। অর্থ, পররাষ্ট্র, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প সবই তো তাদের দখলে। মন্ত্রী প্রশাসন তো বামদেরই দখলে।
একসময় যে বামরা পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে বলত, যে শেখ মুজিব তুমি প্রস্তুত থাক। তোমার হাড্ডি দিয়ে আমরা ডুগডুগি বাজাব, চামড়া দিয়ে পায়ের জুতা বানাব। আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হিসেবে সেই বামরাই আজ শেখ হাসিনার মন্ত্রী সভা দখল করে আছে।
বামদের সঙ্গে আমি দীর্ঘ ৭ বছর কারাগারে ছিলাম। তারা ছিলেন নীতির প্রতি নিষ্ঠ বাম, চেতনার প্রতি সুদৃঢ় আনুগত্য তাদের ছিল।
তারা তাত্ত্বিক ছিলেন, অতি বেশি তাত্ত্বিক ছিলেন। তবে আদর্শ নিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু আজ, কোন বাম তার স্বকীয় চিন্তা ধারায় স্থির আছে? সে পিকিংই বলেন, মস্কোপন্থীই বলেন। সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক পল্টি খেয়েছে, তোষামোদী করেছে মোসাহেবী করছে এরা। যে যত উগ্রবাম ছিল সে তত বেশি তোষামোধী করছে।
সে ততবার পল্টি খেয়েছে। আমাদের রাজনীতি একটা আদর্শের ক্রমবিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা বার বার ব্যহত হয়েছে এই বামদের কুচক্রান্তেই। মতিয়া চৌধুরীসহ ওই বামরা প্রতিনিয়ত অতি সূক্ষ্মভাবে নিজস্ব আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা থেকে, রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে, গণতান্ত্রিক প্রত্যয় বোধ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে।
এখনকার যারা বাম রাজনীতিবিদ তারা সুবিধাবাদী। তারা পদলোভী। তারা পুঁজিপতিতে বিশ্বাস করেন। এরা স্তাবকতা করে, মোসাহেদী করে শেখ হাসিনার মননশীলতাকেই একটা অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। অথচ এরাই আবার সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার নিতে চাচ্ছে না।
কেটে পড়তে চাইছে। আজকেও যদি আল্লাহ না করুক, কোন আঘাত আসে তাহলে ওরা (বামরা) থাকবে না। ওরা কখনই থাকে না।
যখন চতুর্থ সংশোধনী হয়েছিল তখন বঙ্গবন্ধুর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তোমার নির্দেশে, স্বাধীনতা যুদ্ধে এমন কোন পথ নাই যে পথ আমি অতিক্রম করি নাই, আজো চাইলে বুকের রক্তে রাঙিয়ে দিব সারা বাংলার মাঠ-প্রান্তর, রক্তস্নাত করে দিব বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গমালাকে। কিন্তু আজকে যে পথ, এক দলীয় পথ, সমাজতান্ত্রিক পথ, এ পথ ভ্রান্ত পথ, এ পথে তুমি যেয়ো না।
এ পথে একবার গেলে আর ফেরত আসা যায় না। বঙ্গবন্ধু বাকশাল করার আগে আমাকে ডেকে বলেছিলেন, আমি সোহরাওয়ার্দীর শীষ্য, আমি গণতন্ত্র ত্যাগ করে যাব না। আমি কিছুটা সময় চাচ্ছি, একটা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। এর জবাবে সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ যদি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাইত, তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো মনি সিং অথবা মওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে। বাংলাদেশের মানুষ শোষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে একটি দেশ চেয়েছিল বলেই আপনি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চির অম্লান।
আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের একক নেতা, আপনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং জাতির পিতা। আমি ২ ঘন্টা ৫৫ মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম।
নিশ্চিত করেই বলতে পারি, আওয়ামী লীগ যদি বাকশাল না হয়ে আওয়ামী লীগই থাকত তাহলে ওই ২৬ জন কাপুরুষ যারা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে নিকৃষ্টতম, নির্মম ও মানবতা বিরোধী আত্মস্বীকৃত খুনি তাদের এই দুঃসাহসই হতো না বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার। আমি প্রায়ই টিভি টক-শোতে বলি যে, ২৫ মার্চে আমি কাঁদি নাই, কারণ সেদিন আমরা দেশ স্বাধীনের প্ল্যান করেছিলাম, প্রত্যয়ের সাথে। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর আমি চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছি।
কিন্তু তখন সংগঠন আমাদের হাতে ছিল না।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য প্রথমত প্রবাসীদের জন্য আরো সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। নতুন নতুন শ্রম বাজার খোঁজতে হবে। সমস্ত সউদী আরবকে রেললাইনের আওতায় আনার জন্য ৩ লক্ষ শ্রমিক নেয়া হবে। সেখান থেকে ইতোমধ্যে ভারত ১ লক্ষ শ্রমিক সর্বরাহের অর্ডার নিয়ে গেছে।
সেই জায়গাটায় আমাদের নক করতে হবে। প্রয়োজন হলে হুসেই মুহাম্মদ এরশাদ সাহেবকে বিশেষ দুত করে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো যেতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের সন্তান, বাংলাদেশের গৌরব, বাংলাদেশের অহঙ্কার ড. ইউনুছ (আমি নিশ্চিত আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বলতেন তুই আমার সোনার ছেলে, তুই আমার সোনার বাংলা গড়ার একটা কারিগর হয়ে থাক) -কে কাজে লাগানো যায়। আজকে প্রাশ্চাত্যের সঙ্গে তার একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাকে ডেকে নিয়ে বলুন, যে আপনি বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ বা অন্যান্য জায়গা যেখান থেকে অর্থায়ন সম্ভব সেসব জায়গা থেকে যেন আমাদের উন্নয়নে কোন বাধা না আসে সে ব্যাপারে কথা বলুন, আপনি দেশের উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করুণ।
ঠিক তেমনিভাবে স্টক এক্সচেঞ্জের এই লুণ্ঠনটি যারা করেছেন তাাদের নাম প্রকাশ করে শাস্তির ব্যবস্থা করুণ।
দেশে বোধ হয় আর নির্বাচন হবে না, আর বোধ হয় গণতান্ত্রিক সরকার আসবে না -এই যে একটা আতঙ্ক, এই আতঙ্ক থেকে ফিরিয়ে এনে জনগণের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করতে হবে। সহবাস্থান, সহনশীলতা, গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি সংসদের নেতা, পনের কোটি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আপনাকে হৃদয়ের ওদার্য্য দেখাতে হবে। দেশ যাতে সংঘাতের দিকে না যায়, সংবিধানের প্রতি মানুষের যেন অনাস্থা সৃষ্টি না হয় তার জন্য যা কিছু করা দরকার তা করতে হবে।
অন্যদিকে বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান, আপনারা মিছিল করুন, রোড মার্চ করুন ঠিক আছে কিন্তু দেশের স্বার্থে, সার্বভৌমত্বের স্বার্থে, টিপাইমুখ প্রশ্নে, তিস্তা নদীর পানির প্রশ্নে কোন অনৈক্য থাকা উচিৎ নয়। সংসদে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্নে কোন অনৈক্য থাকা উচিৎ নয়। আমি তো বার বার বলি, আপনারা তিন জন মিলে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব দেন, যদি টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ না হয় তাহলে যে কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি। কিন্তু আমরা জাতিগতভাবে যদি ঐক্যবদ্ধ না হই তাহলে এর সুযোগ তো যেকোন লোকই নিবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য ও আহ্বায়ক, প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন সূত্র: দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১ইং
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।