আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেইসময় আর এই অবেলায়

একা আমার জীবন দিনটা মনে আছে স্পষ্টভাবে। ১৯৮৮ সালের ১০ই আগস্ট, মঙ্গলবার। চারপাশে থৈ- থৈ করছে পানি আর পানি। তখন বিটিভি তে প্রচারিত হত ধারাবাহিক নাটক ‌"সংশপ্তক"। আমরা ছোট-বড় সব দর্শক উন্মুখ হয়ে বসে থাকতাম এই নাটক দেখার আশায়।

এই নাটকের অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য চরিত্রের মাঝে "রমজান' চরিত্রটি ছিল দুর্দান্ত। রমজানের আজ কান কাটা হল। আমরা অধির আগ্রহে নাটক দেখা শেষ করে স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। আজ আমাদের বাড়িতে একজন নতূন সদস্য আসবেন। আমরা তিন ভাইবোন ধরে যে স্বপ্ন এতদিন দেখেছি সেটাই বাস্তব রুপ নেবে আজ।

আর এ উপলক্ষ্যে আমাদের দুরসম্পর্কের এক খালা এসেছেন। রাত প্রায় এগারোটার দিকে উনার দক্ষ হাতে আমাদের মাঝে এলেন একজন নতূন জন। খালা সহ আমরা এখন আটজন। সবাই আনন্দচিত্তে আমাদের ছোট্র বোনটাকে ঘিরে রইলাম। তাৎক্ষণিক একটা নাম - সোনামনি ডেকে ক্ষুদেকে আমিই প্রথম কোলে নিলাম।

শরীর থেকে তখনও সব পরিষ্কার করা হয়নি। কি যে আদর লাগছিল তাকে!! জগতের সকল শিশুই মনে হয় একইরকম। খালা বলছিলেন - "এ্যাঁচাকালে প্যাঁচামুখ, বয়সকালে চাঁনমুখ। " এটা শুনে আমাদের মেঝোটা কান্না শুরু করে দিল। ওর মাঝে প্যাঁচার কি আছে ওটাই তার ভাবনা।

খালা হেসে বললেন - "তুমিও এই বয়সে এমনি ছিলে। আর এখন? এক্কেবারে যেন চাঁদের টুকরা। " বোনটা চাঁদ শব্দে একটু থিতু হল। চোখ-মুখ মুছে ক্ষুদেকে কোলে নেয়ার ব্যাকুলতা প্রকাশ করল। আমরা এখন চার ভাইবোন।

পড়াশুনার শ্রেণীটা কাছাকাছি। বড় থেকে যথাক্রমে - দশম, সপ্তম, পঞ্চম। আর ক্ষুদেরতো দিন শুরু হল মাত্র। আমি মাঝেরটায় ছিলাম। এত আনন্দ ছিল আমাদের ভেতরে সেই সময়টায়! দারুন সব উপকরণ চারপাশে।

তখন বর্ষাকাল ছিল। পরে সেটা ভয়ংকর বন্যায় রুপ নিয়েছিল। এ সম্পর্কে একটা ঘটনা না লিখলেই নয়। স্বাভাবিক বর্ষায় আমাদের বাড়িটাকে একটা দ্বীপের মত লাগত। অসাধারণ দৃশ্য তৈরী হত চারপাশে।

স্বচ্ছ পানিতে চাঁদের ছায়ায় কত দেখেছি চাঁদের বুড়িকে! আমাদের ছোট বোনটার বয়স তখন বাইশ দিন। বন্যা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে পানি। আমাদের আব্বা ছিলেন অসম্ভব সচেতন একজন মানুষ। সেই সময়টায় সম্ভবত: সবার সচেতন ভাবটা প্রবলগতিতেই বেড়েছিল।

আব্বা যখন দেখলেন ঘরের ভেতর পানি চলে এসেছে তখন উনি বেশ কিছু ইট দিয়ে ঘরের ভেতরের সব খাটগুলোকে অনেকটুকু উঁচু করে দিলেন। তারপর যথারীতি উনি উনার অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমার মনে আছে সেসময় আমাদের একটা গরু ছিল। নিতান্তই শখের বশে আব্বা এটাকে কিনেছিলেন। মাত্র তিনমাস হল সেই গরুর একটা বাছুর হয়েছে।

কী টকটকে লাল তার গায়ের রং। এই প্রাণীদুটোকে রাখা হয়েছে বাড়ির পাশে একটা উঁচু সড়কে। ছোট্র নৌকো করে আমরা প্রতিদিন যেতাম সেখানে। তাদের জন্য খাবার নিয়ে। কী যে মজা হত! মনে হত সমুদ্রের উপর দিয়ে যাচ্ছি।

মাঝেসাঝে ছোট্র ভেলায় ভাসিয়ে দেয়া লাশ দেখতাম। সাদা কাপড়ে মোড়ানো ছোট্র শরীর। ঐ বয়সে চারপাশে এত অভাব, এত কষ্ট, এত হাহাকার দেখেও ভেতরটা হু -হু করত ঠিকই তবে আনন্দ ছিল লাগামহীন। যাই হোক যে ঘটনা বলতে চাচ্ছিলাম, আব্বা সেই গরুর জন্য খাবার নিয়ে গেছেন। অফিস বন্ধ, বাড়তি কোন ঝামেলা নেই।

একমনে সংসার সামলানো যাচ্ছে। আমার আবার অন্যরকম সুখ তখন। অন্যদিনের মত ছিপ নিয়ে পুকুরঘাটে যেতে হচ্ছেনা মাছ ধরতে। ঘরেই বিশাল পুকুর। খাটের মাঝে বালিশে হেলান দিয়ে এক হাতে ছিপ অন্য হাতে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পসমগ্র।

নেশার মত হয়ে গেছে। সেই বয়সে একরাত্রি পড়েছি। স্কুল বন্ধ, পড়াশুনা একমাত্র রবীন্দ্রনাথ। ঘরের মাঝে এক কোনায় বসে রান্না করছেন আমাদের খালা। তার বেশ কিছুটা দূরে একটা খাটে আম্মা তার ছোট্র কন্যাকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন।

আমি আপন মনে পড়ে যাচ্ছি মাছের আনাগোনা লক্ষ্য করছি। এমন সময় ছপ ছপ শব্দে তাকিয়ে দেখি আমাদের ছোট বোনটার কচি দু পা পানির মাঝে নাচছে। খাটের ইট সম্ভবত: একটু সরে গিয়েছিল বা কিছু একটা হয়েছিল। আম্মা চট করে উঠে বসে কন্যাকে বুকে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। সেদিন আমাদের মাকে অনেক দুঃখি একজন মনে হয়েছিল।

এরপর ধীরে- ধীরে পানির মা্ত্রা কমল। আমাদের বসবাসটা আগের রুপ পেল। সবকিছু ঠিকঠাক। নতূন করে গড়া হল সবকিছু। আমাদের স্কুল শুরু হল।

কিছুটা সময় এর মাঝে কেটে গেছে। ছোট্র বোনটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। তিন বছর বয়স তার। আমাদের আম্মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। আমিই একাকি এই ছোট বোনটার যত্ন নিতাম।

গোসল করাতাম। গ্লাসে দুধ খাওয়াতাম। মাঝে-সাঝে আমাদের স্কুলে নিয়ে যেতাম। আমার পাশে বসিয়ে রেখে ক্লাস করতাম। কোন কান্নাকাটি করতোনা।

গ্রামের স্কুল, শিক্ষকরা সবাই বেশ আদর করতেন। একদিন ম্যাথ স্যার বলে বসলেন - "এই যে আমাদের ক্ষুদে বিদ্যাসাগর এসে গেছেন আর চিন্তা নেই। " আমরা তিন ভাইবোন যেমন এইচ, এস, সি পর্যন্ত আম্মা- আব্বার সংস্পর্শে থেকেছি কিন্তু আমাদের ছোট বোনটা ক্লাশ এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর ঢাকায় ভর্তি হল। মামার বাসায় থেকে শুরু হল নতুন জীবন। অসম্ভব ভাল রেজাল্ট করল এস, এস,সিতে।

বাড়ির সাথে ওর যোগাযোগ ছিল বেশ কম। আম্মা মন খারাপ করে বলত - "ওতো অসামাজিক। শুধু লেখাপড়া করলেই হবে। আর কোন কাজ নেই?" পড়াশুনা ছিল তার একমাত্র ভাবনা। গানের গলা চমৎকার।

দারুন কন্ঠ ওর। টুকটাক ছবি আঁকে। লেখালেখির হাত ভাল। নিজের যত্ন নিত খুব। ওর যেন ভিন্ন একটা জগত।

এখানে ও একদম একাকি থাকে। ওকে দেখতেও বেশ লাগে। সেই খালার কথাই যেন ঠিক। এক্কেবারে চাঁনমুখ। এখন আমাদের এই ছোট বোনটা ঢাকা ভার্সিটিতে সাইকোলজিতে অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছে।

নতূন জীবনে ঢুকবে সামনেই। এই বোনটার বর তার স্বপ্নের পেশায় আছে। পাইলট। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। খুব করে বলত - "দেখিস আমি পাইলট ছাড়া কাউকে বেছে নেবনা।

" তার এই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আমাদের তিন ভাইবোনের জীবন এখন অন্যরকম। সবাই প্রতিষ্ঠিত। কেউ কারো উপর নির্ভরশীল না। একেকজন একেকভাবে সুখটাকে নিয়ে আছে।

কেন জানিনা, এই ছোট বোনটার জন্য আমার বুকটা হু- হু করে। এত মায়া লাগে! সামনে ওর যে জীবন আসছে ও কি পারবে তাতে নিজেকে সুন্দরভাবে ঠিক রাখতে। সবার সাথে সামাজিক পরিবেশে সামাজিক হয়ে!! ওর বেড়ে ওঠার সাথে কিছুটা সময় আমিও যে ছিলাম!! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.