আমি এবং আরণ্যক ছাইরংয়া বধ্যভূমিতে দাড়িয়ে দেখছি শেষ সূর্যাস্ত # দৃশ্য-১
জানলার ফাঁক দিয়ে দুরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রাশেদের একসময় মনে হলো কানের কাছে ফিসফিস শব্দ করে উঠছে কেউ, দুরে কোথায় ঠুকঠাক হাতুড়ি পেটানোর শব্দের সাথে ফিসফিস শব্দের উপরিপাতনটা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে । মাথার ভেতর উইপোকার মতো কিলবিল করছে কিছু একটা । নাহ্ এখনই পালানো দরকার, কিন্তু কিভাবে পালাই, চাবিটা যে কখনোই তার হাতে থাকেনা । এখানকার নিয়মটা প্রচন্ড একমুখি, কোনভাবে একবার প্রবেশ করলে ,প্রস্থানটার উপর নিজের দখলদারিত্বটা একদম শূন্য। সেখেত্রে প্রবেশের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে চিন্তা করবার অধিকারটা নিজের কাছে ।
ঘরের দেয়ালগুলো জীবন্ত হয়ে তাঁকিয়ে আছে তার দিকে, যতবার সে বলতে চাইলো সে কোন অন্যায় করেনি কিংবা করলেও সেটা চেতনার অগোচরে, তবুও যেন গিলে খাবার বাসনাটা প্রকট হয়ে উঠছে বিবর্ণ সাদা পলেস্তরা জুড়ে । একা থাকাটা ইদানিং তার কাছে চরম ভয়ংকর, ভেতরে ভেতরে দুরন্ত এক দানব জোর করেই ঢুকিয়ে দেয় অদ্ভুত রহস্যময় এক জগতে যেখানে আলো অন্ধকারের মাঝামাঝি ভৌতিক আবছায়াটা ক্রমান্বয়ে মসতিষ্কের প্রতি ইঞ্চি জায়গা মুহূর্তে দখল করে নেয়, তারপর শুরু হয় বেহিসাবী দংশন। এভাবে বেশিক্ষণ থাকাটা সম্ভব নয়,,,পালাতে হবে,,,যত দ্রুত সম্ভব পালাতে হবে । রাশেদের মনে হলো এই মুহূর্তে একটা সিগারেট ধরানো দরকার, কিন্তু হাতের কাছে কোথাও আগুন জ্বালাবার উপকরণ খুঁজে পাওয়া গেলোনা। কোন কিছুর প্রয়োজনীয়তা বাড়লেই আপনা আপনিই তা দূর্লভ বনে যায়, শালার যত্ত্বসব ফালতু নিয়ম।
টেবিলের একোনা ওকোনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা দশেক বইপত্র এবং কাগজ কলম । লাইটার খুঁজতে গিয়ে সে সবগুলোকে মেঝেতে ফেলে দিলো । উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সিগারেট টা পকেটে পুরে রাস্তায় কোন একটি চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে সে বেরিয়ে পড়লো। দুপুরের কড়কড়ে রোদের দাপুটেপনায় শরতের স্বাভাবিক বৈচিত্র উধাও হয়ে গেছে, কি সব হচ্ছে আজকাল। যা কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার সেটা তার ধারে কাছেই নেই ।
ষড়ঋতুর পর্যায়বৃত্ত্ব আবর্তণটাও ইদানিং পুরোটাই গোলমেলে। শুধূ অসহ্য নিয়মগুলো দিন দিন সদর্ভে মাথা তুলে দাড়াচ্ছে ।
রাস্তার পাশের ছোট একটি চায়ের দোকান, চায়ের কাপের টুং টাং শব্দের সাথে চতুর্দিক থেকে আশা এলোমেলো ধোয়ার কুন্ডলিতে হামাগুড়ি দিয়ে আসা ছোট বড় কথারা হোচট খাচ্ছে বারবার। দোকানের সামনে সুতোর ঝুলানো লাইটার থেকে সিগারেটটা ধরিয়ে নিলো । মাথার ভেতরের হাতুড়ি – ফিস ফিসের দৌরাত্ব এখনও কমেনি।
অকারণে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কোন মানে হয়না । রাস্তার বিলবোর্ডগুলোও যেন অসহ্যভাবে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । চায়ের দোকানে গোটা দশেক বুদ্ধিজীবি গোছের মানুষজন বসে আছে, এদিকে ওদিকে সিগারেটের ধোঁয়া সেই সাথে দুপুরের গুমোট গরমে ফুসফুসটা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে । তবুও কারও মুখ থেমে নেই, ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথা থেকে শুরু করে , ঢাকা শহর, যানজট, সরকার ব্যবস্থা এমনকি বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে অনর্গল কথার খই ফুটছে। রাশেদ বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের কথায় মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলো , কিন্তু কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারলো না।
ইদানিং জীবন যাপন সম্পর্কিত যাবতীয় দর্শণ এবং কতা-বার্তায় তার কাছে ফালতু –অর্থহীন প্যাঁচাল মনে হয়। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই খেয়াল হলো ভাবনায় সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে অনেকদুর চলে এসেছে ।
সিগারেটটাতে বেশ বড় একটা টান দিয়ে দোকানী বললো “ মামা একখান কড়া করে লাল চা বানাওতো”.দোকানী তার দিকে বিরক্তির ভরা চোখে তাকিয়ে বললো “ না মামা, লাল চা বেচিনা, দুধ চা খাইলে খাইতে পারেন” । হঠাৎ করেই রাশেদের মেজাজটা চড়ে গেলো “ ঐ মিয়া লাল বেচোনা তাতো চায়ের দোকান দিয়া বইছ ক্যান হ্যা?”
দোকানীটাও সাথে সাথে বিদ্যুত বেগে উত্তর দিলো “ আমার ইচ্ছা হইছে আমি লাল চা বেচুম না আপনার কোন সমস্যা? আপনারে এইহানে আইতে কইছে কেডা?
রাগে রাশেদের পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করলো, দোকানের এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলো বুদ্ধিজীবি টাইপের লোকজন তাদের আলোচনা থামিয়ে তার দিকে তাঁকিয়ে আছে, মনে হলো এ ধরনের ঘটনায় তারা খুব মজা পাচ্ছে । রাশেদ অনেক কষ্টেও নিয়ন্ত্রন করতে পারলো না, দাঁতমুখ খিচিয়ে চিতকার করে উঠলো” ঐ মিয়া এইরকম কইরা তাকাইয়া আছেন ক্যান? নাটক পাইছেন নাকি? শালার যত্তসব ফাউল লোকজন ।
রাশেদের মাথাটা কেমন যেন গোলমাল ঠেকতে লাগলো ,আর কোন কথা না বলে হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে হাটা দিলো । গত রাতের ঘুমের ট্যাবলেটের ইফেক্টটা এখনও কাটেনি । মাথার ভেতরের ঝিমুনিটা শরীরের উধ্বাংর্শ ছাড়িয়ে পায়ের গোড়ালিতে এসে টোকা মারছে একারনেই সরলরেখা বরাবর পায়ের গতিটা নিয়ন্ত্রণ করাটা চরম দু:সাধ্য হয়ে যাচ্ছে ।
পকেটের ভেতর কিছু একটা নড়ছে, রাশেদ এলোপাথাড়ি ভাবে এ পকেট ও পকেট হাতড়াতে লাগলো । হুমম মোবাইলটা বাজছে ।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলো, তারপর সবুজ বাটনটি প্রেস করে মোবাইলের রিসিভারটা কানের কাছ ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা রুহীর গলা ভেসে এলো ।
-কি হলো কতক্ষণ ধরে কল করছি, ধরছো না কেন?
-কই কখন? ও হ্যা,,,আসলে খেয়াল করতে পারিনি
-খেয়াল করতে পারিনি মানে কি? তুমি কি আবার ঘুমের ওষুধ খেয়েছো? একদম সত্যি করে বলবে ।
-ঘুমের ওষুধ? না না ঘুমের ওষুধ খাবো ক্যানো? আর খেলেই বা কার কি আসে যায় ।
-কার কি আসে যায় তাইনা? আচ্ছা, আমাকে তুমি আর কতো কষ্ট দেবে।
-শোন, ওসব সিনেমাটিক ডায়ালগ আমার কাছে দিওনা ।
অযথা কাউকে কষ্ট দেবার মতো ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই । তুমি নিজে থেকেই কষ্ট পাচ্ছ এবং যেটার দায়ভার নিজে না নিয়ে শুধু শুধুই আমার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছ । আমি শুধু নিজেকে অবাক করবার চেষ্টা করছি । কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছে , শালার আশপাশে এমন কিছুই নেই যা আমাকে অবাক করতে পারে । বড় অদ্ভুত তাইনা? আচ্ছা তোমার চকলেট কালারটা কেমন লাগে?
-তুমি ভালো করেই জানো, এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের কালার ।
-ভাবছি কষ্টের রং টা এখন থেকে নীল না হয়ে চকলেট হলে কেমন হয়? কবি সাহিত্যিকেরা চকলেট জাতীয়
উপন্যাস লেখার আগে তোমার মুখটা একবার মনে করলেই খাটি কষ্টের যাবতীয় রসদ পেয়ে যাবে । ওপার থেকে ফোপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, নাহ্ এভাবে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা । দেরি করলেই ইমোশনের ঘুনপোকারা মাথার ভেতরে সিঁধ কাটতে শুরু করবে । রাশেদ কোন কিছু না ভেবেই ফোনটা কেটে দিয়ে, পকেটে রেখে দিলো । মাথার ভেতর থেকে রাগটা বেশ পড়ে আসছে, রাস্তার কোনায় ঝুপড়ির মতো অস্থায়ী দোকানগুলোতে ঝুলানো চানাচুর, বিস্কিটের জ্বলজলে প্যাকেট ,সারি সারি পাউরুটি-কলার পারষ্পরিক বিন্যাসকে অনেকটা ফুলদানিতে রাখা কয়েকরকম বাহারী রংয়ের ফুলের মতো লাগছে।
রাশেদ এই মুহূর্তে নতুন একটি দর্শণ আবিষ্কার করলো যেটির মর্মকথা হলো এই যে পৃথিবীর কোন কিছুরই নিজস্ব সৌন্দর্য্য বলে কিছু নেই । অনেক নোংরা জিনিসকেউ দেখার কারুকার্যতায় মুগ্ধতা সৃষ্টি করা যায় । নিজেকে এই মুহূর্তে দার্শনিক টাইপের কিছু একটা মনে হচ্ছে । রাশেদ দু’হাত দিয়ে মাথার চুলটাকে একবার একটু ঠিক করে নিলো, পাশের সেলুন থেকে ভেসে আসা গানের তাল শরীরের ভেতর দ্রুত লয়ের আলোড়ন তুললো । এবারে পায়ের দু’লুনিটা মন্দ লাগছে না, গানের তালের সাথে শরীরের বিচ্যুতিটার উপরিপাতন করতে গিয়ে, সে বিড় বিড় করে বলে উঠলো “মাঝে মাঝে জীবনটাকে সিনেমা ভাবতে মন্দ লাগেনা” ।
# দৃশ্য-২
তিন রাস্তার মোড়ে অনেক লোকের জটলা । মনে হচ্ছে সিরিয়াস টাইপের কিছু একটা ঘটেছে সেখানে । পকেটের ভেতর ঘামে ভিজে কুকড়ে যাওয়া কমদামী একটা সিগারেট বার কয়েক চেষ্টা করে জ্বালানোর পর টানতে টানতে সেলিম ধীর পায়ে ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে গেল । সিগারেট থেকে কেমন যেন পঁচা তামাকের গন্ধ আসছে, তাছাড়া স্বাদটাও অস্বাভাবিক রকমের তেতো । টান দিতেও মনে হলো পেটের ভেতর নাড়িভুড়িটা যেন পাক দিয়ে উঠছে ।
সিগারেটটা মুখ থেকে বের করে রাস্তায় ফেলতে ফেলতে সে শুন্যের প্রতি একটা গালি দিলো
“ ধুর শালা ! হারাদিন পর বিড়িতে টান দিয়া কই একটু মজা পামু তানা মনে হইতাছে গু খাইতাছি”।
মানুষজনের ভীড় টেলে কেন্দ্রবিন্দুতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দেখাও অনেকটা যুদ্ধের শামিল । সেলিম এদিক ওদিক তাকিয়ে বার কয়েক দেখবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো
“ ভাই কি হইছে, এইহানে এতো লোকজনের ভীড় ক্যান? লোকটির মুখায়াবে কৃত্রিম টেনশানের ছাপ, চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আশপাশের ঘটমান পরিস্থিতি নিয়ে সে ব্যপক চিন্তিত ।
কন্ঠস্বরের ভেতর অস্বাভাবিক গাঢ়তা এনে উত্তর দিলো “ আর বইলেন না , ছিন্তাইকারী ধরা পড়ছে । পিচ্চি একখান পোলা, আরে ব্যাটা তুই এই বয়সে স্কুল কলেজে বইয়া আড্ডা দিবি, তানা কইরা ছিনতাইয়ের ব্যবসা ধরছে।
দিছে পাবলিকে কায়দামতো , এইবার বুঝবো ঠ্যালা কারে কয়। দিন দিন যে যুগ জামানার কি হইতাছে আল্লাই জানে”। সেলিম লোকটির কথায় সায় দিতে দিতে জবাব দিলো “ ঠিকই কইছেন, হালার পো হালারা সেইরহম খারাপ, কতা নায় বার্তা নায় মাইনেষের ঠেক দিয়া টেকা নিয়া সেইডা দিয়া হারাদিন নেশা কইরা পইরা থাহে। ওগো আসলেই একটু শিক্ষা দেওন দরকার” । সেলিম আশপাশের ভীড় ঠেলে একটু সামনে এগিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।
বৃত্তাকার মানুষের কেন্দ্রবিন্দুতে ১৭-১৮ বছর বয়সের একটা ছেলে মাথা নিচু করে, পা ছড়িয়ে বসে আছে । তার নাকের ডগায় লাল রক্তের ছাপ, দু’চোখের গোড়ালী অস্বাভাবিক রকমের ফোলা । গায়ের শার্ট এখানে সেখানে ছেড়া এবং ধুলো মাখা । দেখে মনে হলো মারের বিন্দুমাত্র কমতি হয়নি। লোকজনের ভেতর কযেকজনকে তখনও বেশ উত্তপ্ত দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে এটুকুতে যেন তৃপ্তি মেটেনি ।
ছিনতাইকারীকে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিৎ এটা নিয়ে সবাই বাক বিতন্ডায় মশগুল। সেলিমের ডান হাতের তিন আঙ্গুলের ভেতর তির তির করছে,এদিক সেদিক তাকিয়ে অতিদ্রুত পরিস্থিতি বুঝে কাজ সেরে ফেলতে হবে । এটাই মোক্ষম সময়, সবাই ছিনতাইকারী নিয়ে ব্যস্ত। এই ক্ষুদ্র মনোযোগের ঘাটতিটা যে কোন ভাবেই হোক কাজে লাগাতে হবে । সে একে একে চোখের পলকে হাতের কাজ সেরে ভীড় থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বেরিয়ে এসে বাম দিকের রাস্তা বরাবর হাঁটা শুরু করলো।
রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা সন্ধ্যা হলেই অস্বাভাবিকরকম বেড়ে যায়, এ গুলোর ভেতর বেশিরভাগই প্রাইভেট কার । বাংলাদেশ যে দরিত্র দেশ তা এ এই রাজধানীতে বসবাসকারী অভিজাত শ্রেনীর জীবন যাপন দেখে একটুও বোঝার উপায় নেই। ছোট বড় সিটি বাসগুলোতে তিল ধারনের জায়গা নেই, বাসের দরজা থেকে ভেতর পর্যন্ত যে যেভাবে পারে ঝুলে আছে অথচ প্রায়ই দেখা যায় শহরের যানজট সৃষ্টিকারী এ সমস্ত প্রাইভেট কারে মাত্র একজন মানুষ আয়েশে হেলান দিয়ে গাড়ির কাঁচের ভেতর থেকে জীবন যুদ্ধের সিনেমাটা বেশ উপভোগ করছে । দু’টো বিপরীত জীবন ব্যবস্থার পাশাপাশি সহবস্থানের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দেয় । হাঁটতে হাঁটতে কিছুদুর থেমে সেলিম রাস্তার পাশের দোকান থেকে একটা বেনসন এন্ড হেজেস কিনে নিলো, কমদামী সিগারেটে অন্ত:ত আগামী কয়েক ঘন্টা তৃষ্ণা মিটবেনা ।
একটা জায়গা খুঁজে বের করা দরকার, ম্যানিব্যগ গুলোর ভেতর থেকে টাকাগুলো যত দ্রুত সম্ভব বের করে ঝামেলাটা ফেলে দিতে পারলে তবেই স্বস্তি । বুকের ভেতরটা এখন আর কাঁপেনা আগের মতো , প্রথম দিকে কাজ সারবার পর পুরোপুরি নিরাপদ জায়গায় না যাওয়া পর্যন্ত বুকের কাঁপুনিটা থামতো না। সেলিম বেশ কিছুদুর এগিয়ে যাবার পর মেইন রোর্ড ছেড়ে পাশের গলির দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে পড়লো । পাশাপাশি কয়েক বাড়ির ফাঁকে ঘুপচির মতো একটা জায়গা দেখে সেখানে ঢুকে পড়লো । এই জায়গাটা একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়, পাশের লাম্পপোষ্ট থেকে আশা একটুখানি আলোর ছিটে লেগে ঠিক আলো অন্ধকারের মাঝামাঝি কিছু একটার মতো মনে হচ্ছে।
মানিব্যাগ গুলো হাতড়ে মোটমাট হাজার দেড়েকের মতো টাকা পাওয়া গেলো, সেগুলো অতিদ্রুত পকেটের ভেতর পুরে নিয়ে ম্যানিব্যাগ গুলো অন্ধকারের ভেতর ছুড়ে দিলো । আপাতত দু:শ্চিন্তা মুক্ত, এখন সময় মতো খুপরিতে ফিরতে পারলেই হয় । পকেটের ভেতর থেকে বেনসনটা বের করে জ্বালিয়ে নিলো, আপাতত দু’দিনের নির্ভারতার কন্তা চিন্তা করতে করতে সিগারেটের দমের পরিধিটা ক্রমেই বাড়তে লাগলো ।
#দৃশ্য-৩.
. বহুদিন লোভ নেই, শব্দে শিহরণ স্বপ্নে শিহরণ, ঘুম
. শরীরে দুপুর এলো, যেন বহুদিন লোভ নেই
.বহুদিন লোভ নেই, শ্মশানের পাশে গিয়ে বিকেলে বসিনি;
সুনীলের এই লাইন কটা মাথার ভেতর রেকর্ডের মতো বাঁজছে। মাথার ভেতর শব্দ থেকে থাকেনা ।
একটা শেষ তো আবার নতুন একটা শুরু । সময়ের সাথে সাথে শব্দের তীব্রতা বাড়ে, যেমনটি বয়স বাড়লে বাড়ে স্থবির প্রার্থনার একাগ্রতা। রুমের এদিকে সেদিকে ছড়ানো ছিটানো সিগারেটের প্যাকেট, টেবিলের উপরে ছড়ানো বইয়ের স্তুপ, বিছানার চাদর বালিশে রাজ্যের ধুলো । মুহূর্তে রাশেদের মনে হলো তাকে কোন জাহান্নামে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে । ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলাতেই একেবারেই সাধারনত অথচ সংখ্যাই অনেক প্রশ্নগুলো মৌমাছির মতো দল বেঁধে মাথার উপরিভাগ দখল করে নিলো।
মনে হলো সুদীর্ঘ ঘুমের পর নিজেকে হঠা মোড়ের পঁচা-গলা ডাস্টবিনের পাশে নিজেকে আবিষ্কার করেছে । মাথার ভেতর লাইনগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো “বহুদিন লোভ নেই, শব্দে শিহরণ স্বপ্নে শিহরণ,বহুদিন লোভ নেই, শ্মশানের পাশে গিয়ে বিকেলে বসিনি;
বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াতে গিয়ে নিজেকে পুরো অচেনা মনে হলো , যত্ন করে দাঁড়ি কামালো। তারপর গোসল করে কালো জিন্সের সাথে পান্জাবীটা শরীরে গলিয়ে ফুরফুরে মেজাজে রাস্তায় বের হলো । রুহীকে একটা ফোন দেওয়া দরকার, বেশ কয়েকদিন হলো ওর সাথে দেখা হয়নি, ভালো করে কথা বলা হয়নি, মাঝে মাঝে এরকম সামাজিক হওয়াটা খারাপ না তাতে করে সামাজিকতার পুরো আনন্দ পাওয়া যায়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে রুহীর নম্বরে ডায়াল করলো ।
বেশ কিছুক্ষণ রিং হবার পরও ওপার থেকে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেলোনা । রাশেদ আরেকবার ডায়াল করতে গিয়েও করলো না, আবেগটা চেপে রাখার ভেতরেও একটা আনন্দ আছে । পকেট থেকে সিগারেট বের ধরালো, টানতে টানতে সামনের গলি দিয়ে হাঁটা শুরু করলো । মাথার ভেতর থেকে শব্দেরা মিলিয়ে গেছে শরীরটা এখন বেশ হালকা লাগছে ।
#দৃশ্য-৪.
গলির মুখে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সেলিম বেশ কয়েকবার তার নিজের পকেট হাতড়ালো, অবশেষে সিগারেট কেনার মতো কোন টাকা পয়সা না পেয়ে আপনা আপনিই নিজেকে এবং নিজের কপালকে গালি দিতে লাগলো।
গতকালের ইনকামটা বেশ ভালোই ছিলো, ভেবেছিলো অন্ত:ত ৪-৫ দিন নিশ্চিন্তে থাকা যাবে । কিন্তু কে জানে শালার মাইনকার চিপায় পড়তে হবে । ৮-৯ মাস আগে মহল্লার পরিচিতো একজনের কাছ থেকে মায়ের অসুখের কথা বলে ২ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলো । তারপর থেকেই সে সেইখান থেকে হাওয়া, ভুলেও আর ঐ মহল্লার দিকে পা বাড়াতো না । কাল রাতে কোথা থেকে যেন চিলের মতো উড়ে এসে তারে খপ করে ধরে ফেললো ।
শেষে টাকা তো গেলোই সেই সাথে মুখের জ্যামিতির একদম বারোটা বাঁজিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা হতে এখনো ঘন্টা খানেক বাকি এ পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাও অনেক কষ্টকর । ক্ষুধায় পেটের ভেতরটা টনটন করছে । একটা নতুন জিনিস সে জোগাড় করেছে,খাটি বাংলায় যেটাকে বলে ক্ষুর। সকালে নাপিতের দোকানে বসে গল্প করতে করতে আস্তে করে সে এটিকে পকেটে পুরে চলে এসেছে ।
আজ পকেট না কাটতে পারলে এইটার প্রয়োজন হতে পারে । ক্ষুধার মাত্রাটা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উপায়ান্তর না দেখে সে দু’হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে গলির এক কোনায় বসে পড়লো ।
#দৃশ্য-৫.
মাথার ভেতর শব্দেরা ফিরে আসছে, তবে এবার শব্দের প্রকৃতিটা অন্য রকমের । ঠিক আগের মতো কর্কশ কিংবা আততায়ীর বেশে নয়।
উলঙ্গ সময়ের ধার ঘেষে মাঝে মাঝে আলোরা যেমন আসে ঠিক তেমন করে মসতিষ্কের ফাঁক ফোকড় দিয়ে শব্দেরা ঢুকছে শৈশবের সতেজ কোলাহলের মতো। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে, আঙ্গুলের ফাঁকে পুড়তে থাকা সিগারেট মুখে নিয়ে টান দিতেই একটা অদ্ভুত তেতো স্বাদ কন্ঠনালী বেয়ে পাকস্থলীতে ঢুকে গেলো । সিগারেট টা ফেলে দিয়ে রাশেদ বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো, আজ একটা কবিতা লিখতে হবে , খুব নির্মল এবং সহজ একটা কবিতা । মেইন রোর্ড পার হয়ে পাশের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । একটু আগে রুহী ফোন করেছিলো ।
আজ অনেকদিন পর সে প্রানখুলে কথা বলেছে, যে স্থুল ভাবনাগুলোকে সংক্রামক ব্যধি ভেবে এতোদিন সে আঙ্গিনায় ভীড়তে দেয়নি । সেই সহজ আদিখ্যেতাগুলোকে আজ অনেক বেশি তাৎপর্য্যপূর্ণ মনে হলো । অন্ধকারটা বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে, রাশেদ রাস্তা ছেড়ে গলির মুখে ঢুকতেই পিঠের কাছে আচমকা আঘাতে মাটিতে বসে পড়লো । তারপরের ঘটনাগুলো তার কাছে অনেকটা সিনেমার মতো ঘটতে লাগলো । আক্রমনকারী ক্ষুরটা তার পিঠে গেথে রেখেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো ।
চিৎকার দিতে গিয়ে রাশেদের মনে হলো কেউ একজন তার কন্ঠ চেপে ধরে আছে । মাথার ভেতর থেকে চেতনাগুলো কেমন ধোঁয়ার মিলিয়ে যাচ্ছে, হাত বাড়িয়ে কয়েকবার অবলম্ভন খোঁজার চেষ্টা করলো তারপর ঐখানেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো । থাক দরকার নেই শুধু শুধু উঠে দাঁড়াবার মাথার ভেতর কবিতার লাইনগুলো আসছে , খু্ব সহজ এবং নির্মল একটা কবিতা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।