ছিলাম ক্রিয়াবাদী এখন হইছি গঠন ব্যবসায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্খ বছরে এসে আমাদের মাঠকর্মের ভিত্তিতে একটা গবেষণাপত্র লিখতে হয়। যেখানে ১০০ নাম্বার বরাদ্দ থাকে। কি নিয়ে করা যায় সেটা নিয়ে সেই ২য় বর্ষ থেকেই চিন্তা করতে থাকি। একটা ইস্যু ভাবি আর পরে নানা প্রতিকূলতার কথা চিন্তা করে ইস্যু বাদ দিই। এরকম ভাবতে ভাবতে ৪র্থ বর্ষ এসে গেল।
কোন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে গবেষণাপত্র সম্পন্ন করতে হয়, তার ও বিলি-বন্টন হল। আমি চিন্তা করতেই থাকি। সিনেমাজগত নিয়ে আগ্রহ আর বেশি বেশি মুভি দেখায় এই দিকেও চিন্তা করতে থাকি।
প্রথমেই বলে রাখি, Karl Marx এর ধর্মের ব্যাপারে আফিম তত্ত্বের কথা। Karl Marx এর মতে, ধর্ম হচ্ছে আফিমের মত যা মানুষকে পরকালের কথা বলে ইহজগতের অত্যাচার, লাঞ্চনা-বঞ্চনার কথা ভূলিয়ে রাখে।
যদিও Marx খালি একথা বলে ক্ষান্ত হননি। তিনি ধর্মকে শোষণ মুক্তির হাতিয়ারও বলেছেন। তিনি আসলে ধর্মকে দোষারোপ করেননি বরং যারা ধর্মকে ব্যবহার করছে নিজ স্বার্থে তাদেরকে ও দোষারোপ করে বুর্জোয়া বলছেন। অনেক বামপন্হী নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য Marx এর কথাকে অর্ধেক ব্যবহার করে, বাকীটা নিজেদের পকেটে রাখে। তা না হলে শ্রেণী শাসন নিজেরাও করতে পারবেনা।
যাহোক, আমার ইচ্ছা ছিল Marx এর কথা অনুযায়ী বাংলাদেশের সিনেমা কতটা কাজ করে। সিনেমা হচ্ছে মানুষকে বাস্তব জগত থেকে সরিয়ে রেখে স্বপ্নের এমন একটা জগতে নিয়ে যায়, যা মানুষ আদৌ হস্তগত করতে পারবে কিনা তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহপোষণ করা যায়। সিনেমা মানুষকে ভূলিয়ে রাখার একটা কৌশল হিসেবে ও কাজ করতে পারে। যেমন ধরুন The Shawshank Redemption এর কথা। এখানে দেখায় কয়েদীদের রিটা হেওয়ার্থ-এর সিনেমা দেখানো হয়।
তারা বারবার একটাই সিনেমা দেখে যাচ্ছে। এটা নিয়ে তাদের কোন অভিযোগ নেই, কারণ ঐ সিনেমায় রিটার লাস্যময়ী আগমন যা কয়েদীদের অনুভূতিতে একটা ভাললাগা এনে দেয়। ফলে কর্তৃপক্ষের সাথে তারা কোন বিরোধীতায় ও যায় না। কিংবা অনেকেই জানেন The Triumph of Will এর কথা। যদিও এর উদ্দেশ্য অন্যরকম।
কিন্তু সপ্তম কলা হিসেবে চলচ্চিত্রে এমন শক্তিশালী মাধ্যম যা মানুষের চিন্তা-শক্তিকে বা তার ইচ্ছা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এদিক থেকে চিন্তা করে আমি ভাবলাম বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্র বানানো হয় এফডিসি থেকে তার সাথে Marx এর তত্ত্ব কতটা মিলে?
কাহিনী থেকে শুরু করে সবকিছু এমনকি সস্তা(!) অনুভূতি বিলানোর ব্যাপারটাতে ও বোঝা যায় যে এসব ছবির প্রধান টার্গেট থাকে গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বিষেশত: নারী শ্রমিকরা। স্বল্প শিক্ষিত অথবা শিক্ষাবিহীন এসব নারীদের অনুভূতি নিয়ে খেলা করা আজকালকার দিনের এফডিসির পরিচালকদের পক্ষে খুবই সহজ কাজ। আমি দেখেছি হপ্তার একটা মাত্র ছুটির দিনে এসব নারী শ্রমিকরা হয় তাদের সহকর্মী বান্ধবীদের সাথে অথবা প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যায় এমন কোন জায়গায় যেখানে খরচ-পাতির সম্ভাবনা খুব একটা নেই আর যায় শাকিব খানের বের হওয়া নতুন কোন বই(চাইলে “ছবি” হিসেবে ও পড়তে পারেন)। শেষেরটার কথা চিন্তা করুন।
সম্পূর্ণ বাস্তবতা বিবর্জিত অনুভূতির ডিলার। আমি এমন কিছু সিনেমার কথা বলছি যাকে এসব নারী শ্রমিকদের একমাত্র বিনোদন বলা যায়। আমি দেখেছি এসব নারী শ্রমিকেরা কিরকম রোমাঞ্চ আর স্বপ্নময় জগতের মধ্যে ডুবে যান শাকিব খানের কোন সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে করতে। আর দেখাটা তো তাদের জন্য কতটা আনন্দের তা আমি তাদের আলোচনা শুনতে আর দেখতে দেখতেই বুঝতে পারি। হপ্তার ছয়টা দিন রাত-ভোরের কঠিন পরিশ্রম, মাসশেষে মাত্র ৩০০০হাজার টাকা, পাড়ার মাস্তানদের জ্বালাতন আর সংসারে নুন-পান্তার সংকট সত্ত্বেও এদের একমাত্র বিনোদন শাকিব খান।
সবকিছু ভুলে ৩ ঘন্টার জন্য স্বপ্নজগতে ডুব দেওয়া। জাগতিক সব যন্ত্রণা ভূলে যাওয়া ৩ ঘন্টার জন্য। মনটাতে যত ক্ষোভ-দু:খ-রাগ-হতাশা জমা আছে তাকে নিশে:ষ করে দেওয়া। আবার সামনের ৬ দিনের জন্য নতুন করে চলার মানসিক শক্তি জমা করা। সবই এই ৩ ঘন্টায়।
এখন কথা হচ্ছে, এই যে এসব শ্রমিকদের জাগতিক ক্ষোভ-দু:খ-রাগ-হতাশা-বঞ্চনা এসব অনুভূতিকে মন থেকে মুছে ফেলার দায়িত্ব টা কি এফডিসির পরিচালকরা সচেতনভাবে করছেন না তারা তাদের পুরনো ধারাটাকে(৯০ এর দশকের বাংলা সিনেমা ও একই ধরনের ছিল) বয়ে নিয়ে চলেছেন?
যদি ধারা টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপার হয় তা হলে আমার গবেষণা হয়তো ঐ পর্যন্তই।
আর যদি তা না হয়ে প্রথম কারণটা হয় তবে এসব পরিচালকদের এই দায়িত্বের পৃষ্ঠপোষক কারা?
গার্মেন্টস মালিকরা নয় তো? Marx এর আফিম ট্যাবলেট তত্ত্ব অনুযায়ী। কারণ, সিনেমা জিনিসটাকে আপনি হিটলারের মত ভক্ত তৈরীর জন্য কাজে লাগাতে পারেন আবার কারাগারের কয়েদীদের বশ করার জন্যও কাজে লাগাতে পারেন। যেমন পারেন মগজ ধোলাই করতে আবার পারেন উত্তেজিত করে তুলতে। অর্থাৎ যেমনে নাচাও তেমনে নাচি।
সুতারাং ন্যূনতম একটা মজুরীতে সারা মাস কাজ করানোর জন্য যেসব দাস দরকার তাদের মানসিকভাবে তৈরী করার দায়টা ও এসব মালিকদের। এখন কথা হচ্ছে, কারণ যদি প্রথমটা হয় তাহলে এ ধরনের সিনেমার পিছনে টাকা ঢালছেন গার্মেন্টস মালিকরা। আমার গবেষণার উদ্দেশ্য এরকম ঘটে থাকলে তার প্রমাণ হাজির করা। যদি ও আমি যে শাস্ত্র অধ্যয়ন করি তার নীতি হচ্ছে আগে থেকে কোন ধারণা নিয়ে মাঠে যাওয়া যাবে না, তা না হলে গবেষক আসলে কি হচ্ছে দেখতে পাবেন না আর এটা আপনাকে সত্যে টা ও জানার ক্ষেত্রে বাঁধা তৈরী করবে।
কয়েকটা বিষয়:
১.অনন্ত জলিল গার্মেন্ট এর মালিক।
তার মতে তার ছবিগুলা এলিটদের জন্য। তার কথা অনুযায়ী মাক্সের তত্ত্ব মিলে না যদিও অনেকে তার ছবিকে এফডিসির গৎবাঁধা ছবির নীলক্ষেতের বইয়ের আজিজ মার্কেট সংস্করণ বলেন।
২.যারা এফডিসির ছবির প্রযোজক তারা আসলে আমার আওতার বাইরে। এফডিসির টাকা ঢালনেওয়ালারা আমার মত নাদান বাচ্চাকে টাইম দিবে না এই চিন্তা এবং আরো অনেক চিন্তা থেকে আমি আমার এই প্রস্তাবিত গবেষণা প্রকল্প থেকে সরে এসে অন্য আরেকটা প্রকল্পে মনোযোগ দিয়েছি। যদিও ভবিষ্যতে এটা নিয়ে গবেষণা চালানোর চিন্তা আছে।
৩.শাকিব খানকে আমি আগে খুবই করুণার চোখে দেখতাম। বেচারা কি সব করে,হেন-তেন। কিন্তু একটা কথা চিন্তা করেছেন আমাদের কাছে সে যাই হোক, সেলাই দিদিমনিদের কাছে কিন্তু সে আসলেই হিরো, বিনোদনের একমাত্র খোরাক। হোকনা বাস্তবের অনেক বাইরের। দিদিদের পছন্দকে আমি শ্রদ্ধা করি? তারা আমাদের কাছে তা আশা করতেই পারে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।