শক্তের ভক্ত, নরমের জম। জেনে গ্যাছে এবার কানা আজম।
শহীদুল ইসলাম : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সরকার পক্ষের হাজির করা সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবিদার রুহুল আমিন নবীন অভিযোগ করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ৭ মে পাড়েরহাট বাজারে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে লুটের মাল নিয়ে যেতে দেখেছেন। তিনি বলেন, ঐ দিন বেলা সাড়ে ১০টা থেকে অনুমান ১১টার দিকে পাড়েরহাট বাজারের মাসুম স্টোরের সামনে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তৎকালীন দেলাওয়ার হোসেন সিকদারকে (বর্তমান সাঈদী) বোগলে ঢেউটিন মাথায় ঝাকা নিয়ে যেতে দেখেছি।
এই ঝাকার মধ্যে কাসা পিতলের প্লেট, গ্লাস, বাটি, জগ ইত্যাদি ছিল। পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি মালকোচা দিয়ে পরা দেলাওয়ার সিকদারকে আমি আমার কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে শুট করতে চেয়েছিলাম। নূরুল হক মৌলভী আমাকে বাধা দেয়ার কারণে তখন তাকে গুলী করি নাই। ভানু সাহা নামের এক হিন্দু মহিলাকে কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পে রেখে পাক হানাদার বাহিনী ধর্ষণ করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তবে আগের দিন এক নম্বর সাক্ষী মাহবুবুল আলম হাওলাদার
সংশ্লিষ্ট খবর
অভিযুক্ত পক্ষের ৩টি আবেদনের একটিও গৃহীত হয়নি
মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বাধা দেয়া হয়েছে
সাঈদীর আইনজীবী দলের পিরোজপুর ত্যাগ
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীদের পিরোজপুরে মামলার ঘটনাস্থল পরিদর্শন
এ সংশ্লিষ্ট আরো খবর
ঐ ধর্ষণের সাথে মাওলানা সাঈদীকে জড়িত করে সাক্ষ্য প্রদান করলেও ২নং সাক্ষী শুধুই পাক বাহিনীর জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২নং সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে আসা রুহুল আমিন নবীন গত বুধবার বিকেলে সাক্ষ্য দেয়া শুরু করেন। ১৫ মিনিট তার বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার পর ঐ দিন আদালত মূলতবি করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩ বিচারক নিজামুল হক নাসিম, এটিএম ফজলে কবির ও একেএম জহির আহমেদ সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে এজলাসে বসেন। মাওলানা সাঈদীকে তার মিনিট খানেক আগেই নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায়। আর বেলা সাড়ে ৯টা থেকে তাকে বসিয়ে রাখা হয়।
ট্রাইব্যুনালের নীচ তলার হাজত খানায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় ট্রাইব্যুনালে। সরকার পক্ষের আপত্তির কারণে গত বুধবার মাওলানা সাঈদীর দুইজন নিকটাত্মীয়কে আদালত কক্ষ থেকে বের করে দেয়ার পর গতকাল পাস ইস্যুতে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। মাওলানা সাঈদীর ৩ ছেলে ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়কে গতকাল পাসই দেয়া হয়নি।
গতকাল বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল আসন গ্রহণ করার পরপরই মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন ট্রাইব্যুনালকে জানান, আমার মক্কেল ডায়বেটিস আক্রান্ত এবং বয়োবৃদ্ধ।
আদালতর কাঠগড়ায় দীর্ঘক্ষণ থাকার কারণে তিনি কোন খাদ্য গ্রহণ না করায় শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এ ব্যাপারে তিনি কাঠগড়ায় মাওলানা সাঈদীর হালকা খাওয়ানোর অনুমতি প্রার্থনা করেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, এতে কোন অসুবিধা নেই। আপনাদের ব্যবস্থাপনায় খাওয়াবেন। এরপরই ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, মিথ্যা বলিব না, সত্য গোপন করিব না' বলে শপথ নিয়ে ২ নম্বর সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন তার বক্তব্য শুরু করেন।
প্রসিকিউটর সাইদুর রহমান তার সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করেন।
সাক্ষীকে ধীরে ধীরে বক্তব্য রাখতে বলা হয় এবং তা কম্পিউটারে লিপিবদ্ধ করা হয় যা সরাসরি অভিযুক্ত ব্যক্তি, প্রসিকিউশন, ডিফেন্স এবং ৩ বিচারক স্ক্রিনে দেখতে পান।
২ নম্বর সাক্ষী রুহুল আমিন নবীন তার অসমাপ্ত বক্তব্য সমাপ্ত করেন গতকাল সোয়া ১ ঘণ্টায়। এ সময় তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৩ মে বর্বর পাকিস্তানীবাহিনী পিরোজপুর আগমন করে শান্তি কমিটির সাথে মিটিং করে। তারা পাকবাহিনীর কাছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি-ঘর সম্পর্কে তথ্য দেয়।
৭ মে ২৬টি রিক্সাযোগে প্রায় ৫২ জন পাকসেনা আসে পাড়েরহাট। পাড়েরহাট রিক্সা স্ট্যান্ডে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানায় শান্তি কমিটির নেতা সেকান্দার আলী সিকদার, দানেশ আলী মোল্লা, মাওলানা মোসলেহ উদ্দিন ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ অনেকেই। এই বাহিনীর নেতৃতে ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ। শান্তি কমিটির লোকেরা পাড়েরহাট বাজারে পাক সেনাদের নিয়ে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগ ও হিন্দুদের বাড়ি-ঘর দোকানপাট ভেঙ্গে দেয়। ক্যাপ্টেন এজাজের সাথে সাঈদী সাহেব পরামর্শ করার পর বলা হয়, লে লো অর্থাৎ এগিয়ে লও।
তখনই শান্তি কমিটির লোকজনও রাজাকারদের দেখিয়ে দেয়া দোকানপাট ও বাড়ি-ঘরে লুটপাট শুরু হয়। লুটের এক পর্যায়ে পাড়েরহাট বন্দরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী মাখন সাহার দোকানের মাটির নীচে লোহার সিন্দুক থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রূপা লুট করে। ঐসব স্বর্ণ ও রূপা পাক হানাদারবাহিনী নিয়ে যায়। একই দিন পাড়েরহাট বাজারের ৩০/৩৫টি দোকানের মেঝের মাটি খোঁড়া হয় আরো স্বর্ণ পাওয়ার আশায়। এই লুটের পর পাক হানাদারবাহিনী পাড়েরহাট রাজলক্ষ্মী উচ্চবিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এর পূর্বেই ফকির দাসের দোকানে ২টি ক্যাম্প স্থাপন করে রাজাকাররা। পরের দিন ৮ মে পাড়েরহাট বন্দরের পূর্বপাড়ে পাদুয়া ও চিতলিয়া গ্রামে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রইস উদ্দিন পসারী, হেলাল উদ্দিন পসারী ও মানিক পসারীর ঘরসহ ৭/৮টি ঘর লুটপাট করে। পরে তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝা-মাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ ক্রয়ের জন্য আমি পাড়েরহাট বাজারে আসি। মাসুম স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমি দেখতে পাই পাঞ্জাবী ও মাল কোচা দিয়ে লুঙ্গি পরিহিত সাঈদী সাহেব।
বোগলে একটি ঢেউটিন এবং কাসা পিতলের প্লেট গ্লাস, বাটি, জগ ভর্তি একটি ঝাকা মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তৎকালীন দেলোয়ার হোসেন সিকদার। এসব লুটের মাল দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমার কাছে থাকা রিভলভার দিয়ে শুট করব বলে মৌলবী নুরুল হককে বলি। তিনি আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, এই মুহূর্তে ঝামেলা বাড়বে। যেসব ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট পাড়েরহাটে অবশিষ্ট আছে তাও পাক বাহিনী জ্বালিয়ে দেবে এবং নির্বিচারে গণহত্যা চালাবে।
পরে মফিজ উদ্দিন মৌলবীর দোকানের সামনে গিয়ে জানতে পারি মদন সাহার দোকান লুট হয়েছে। কিছুক্ষণ পর দেলোয়ার সাহেব কাঠ মিস্ত্রি তৈয়ব আলীসহ আরো ৪-৫ জন লোক নিয়ে মদন সাহার দোকানঘর ভাঙ্গা শুরু করে। ভাঙ্গার পর মালামাল নৌকাযোগে তার শ্বশুরবাড়ি ইউনুস মুন্সীর বাড়িতে নিয়ে যায়।
সাক্ষী রুহুল আমিন আরো বলেন, পাড়েরহাট বাজারের পুরাতন ঘর নগরবাসী সাহার দোকান ঘর জোর করে দখল করে পাঁচতহবিলের অফিস বানানো হয়। সাঈদীসহ আরো ৪/৫ জন এটা পরিচালনা করতো।
আর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন দেলোয়ার হোসেন সিকদার। লুটপাটের সব মালামাল ঐ দোকানে এনে পাঁচতহবিলে ভাগ করা হতো। স্থান সংকুলান না হওয়ায় মাওলানা নাসিমের ঘরও গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিজন সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে পাকিস্তানী বাহিনী ধর্ষণ করে। সাক্ষ্য-প্রদানের শেষে এই জায়গায় তিনি অতিরিক্ত যোগ করেন যে, ভানু সাহাকে কয়েক মাস আটকে রেখে পাক হানাদার বাহিনী ধর্ষণ করে।
রুহুল আমিন নবীন আরো অভিযোগ করেন যে ৫০/৬০ জন হিন্দুকে শান্তি কমিটির লোকেরা জোরপূর্বক হিন্দু থেকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করায় এবং ৫ ওয়াক্ত নামায পড়তে বাধ্য করে মসজিদে গিয়ে। ২/৪টি আরবী সূরাও শেখানো হয়। স্বাধীনতার পর তারা আবার স্বধর্মে ফিরে আসে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধর্ষিতা ছবি রায় ও ভানুসাহা পরে ভারতে পালিয়ে যায়। আমি ভারতে ট্রেনিং শেষে দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করি।
স্বাধীনতার পর অনেক স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণকারী রাজাকারদের অনেককে আটক করতে পারলেও দেলোয়ার সিকদারকে গ্রেফতার করতে পারি নাই। শুনতে পাই তিনি পালিয়ে গেছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তল্লাশি চালিয়ে লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার করে তাদেরকে ফেরত দিই, মদন সাহার যে ঘরটি লুট করে নেয়া হয়, সাঈদী সাহেবের শ্বশুরবাড়ী থেকে ঐ ঘরটি উদ্ধার করে এনে মদন সাহাকে ফেরত দিই। সাক্ষী নবীন আরো জানান, ১৯৮৬ সালে পারেরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সাঈদী সাহেব একটি মাহফিল করেন তার দলীয় জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায়। আমি বাধা দিতে পারি মনে করে মোকাররম হোসেন কবিসহ ৩ জন জামায়াত কর্মী আমার বাড়িতে আসে। আমি তাদেরকে বলি রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে মাহফিল করতে দেয়া হবে না।
তিনি হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত সকল রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্যদের উপযুক্ত বিচার প্রার্থণা করেন।
সাক্ষী নবীনের সাক্ষ্য প্রদান শেষে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবী এডভোকেট মিজানুল ইসলাম তার কাছে জানতে চান যে এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সাব কমান্ডার কারা ছিলেন? ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর কি দায়িত্বে ছিলেন তাও জানতে চান। জবাবে নবীন জানান, শাজাহান ওমর ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার কমান্ডার ছিলেন। মেজর জিয়াউদ্দিন ছিলেন সাব সেক্টর কমান্ডার, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন শামসুল হক যাকে আমি এডভোকেট বলে জানি। তবে তার সনদ ছিলো কি না জানি না।
আমার ভাই জামাল উদ্দিন কোনো দায়িত্বে ছিলো না। আমার অধীনেই ছিলো।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে এডভোকেট মিজানুল ইসলাম (রাজশাহী বার থেকে আগত) বলেন, মাত্র ২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রদান শেষ হয়েছে। তাদের জেরা করা হবে আগামী রোববার। এই পর্যায়ে এই মামলার মেরিট সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না।
অভিযুক্ত পক্ষে গতকাল ট্রাইব্যুনালে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, রাজশাহী বার থেকে আসা এডভোকেট মিজানুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বার থেকে আসা এডভোকেট মনজুর আহমেদ আনসারী ও কফিল উদ্দিন চৌধুরী, হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানভীর আল আমিন, ব্যারিস্টার অনুশী আহসান কবির, এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, শাজাহান কবির প্রমুখ। সরকার পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর এস হায়দার আলী, সৈয়দ রেজাউর রহমান, জিয়াদ আল মালুম প্রমুখ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।