Miles to go before I sleep..... আগের পর্ব।
স্মরণ করা যেতে পারে যে যাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই তমদ্দুন মজলিশের উদ্দেশ্য ছিল পুর্ব পাকিস্তানে ইসলামিক ভাবধারা পূণরুদ্ধার করা। কিন্তু পরিস্থিতির দাবি এবং নিয়তির খেলায় তাদেরকেই ভাষা আন্দোলনের প্রথমদিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়েছিল। সাধারণত সংস্কৃতিবিষয়ক আন্দোলন শুরু হয়, চালিত হয় শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের দ্বারা। ষাটের দশকে ছায়ানটের বাংলা নববর্ষ পালন করা এবং বাঙাল মধ্যবিত্ত মুসলমানদের নিজেদেরকে বাঙালি প্রমাণ করার যে তাড়া দেখা দিয়েছিল সেসবও পুরোদমেই পেশাজীবি মধ্যবিত্ত দ্বারাই চালিত।
মূলকথা অন্যসময় তো বটেই, পূর্বপাকিস্তানের ২৪ বছরেও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ছিল পেশাজীবি মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তরা সরাসরি কনফ্রন্টেশানে যেতে চায়না। তাই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের অগ্রগামিতা থাকলেও প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদেরকে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মজুর-মেটে-ছাত্র-শিক্ষক-আনসার-পুলিশ ইত্যাকার শ্রেণীর লোকই সরাসরি বড়অংকে যুদ্ধ করেছে, ঢাকাকেন্দ্রীক পেশাজীবি মধ্যবিত্তরা, যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ছিল, তারা মূলত গ্রামে যেখানে পাক-আর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল সেখানে গিয়ে লুকিয়েছিল আর যাদের সামর্থ্য ছিল তারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল, কেউ কেউ ঢাকায় থাকলেও নিজের গা বাচিয়ে চলেছিল চাকরিতে হাজিরা দিয়ে বা জিন্নাহর ছবিতে সেলাম করে, ঘরে জিন্নার ছবি রেখে নিজেকে সাচ্চা পাকিস্তানি মুসলমান প্রমান করার নিমিত্তে। তবে নিম্নবিত্ত কৃষক-শ্রমিক-মজুর-মুটে-আনসার-ছাত্র-পুলিশ খেটে খাওয়া মানুষ যারা যুদ্ধ করেছিল তারা যুদ্ধপরবর্তীতে যুদ্ধের ক্রেডিট থেকে বন্ঞিত হয়েছে, কারন এসব ক্রেডিট নেওয়ার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক এবং মিডিয়া আধিপত্য থাকা দরকার, যা শুধু মধ্যবিত্তদের অধিকারে।
দেখা যায় এখন ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ ইত্যাদি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দিবসগুলাতে আবেগের ছড়াছড়ি শুধু মধ্যবিত্তদের মধ্যেই, নিম্নবিত্ত যারা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ফোর্স ছিল, তাদের উপস্থিতি নেই-ই! এখন এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পুরোধা কবীর চৌধুরী বা জাফর ইকবালরা, যারা নিজেরা যুদ্ধ করেননি আবার বিরোধিতাও করেননি, কিন্তু এখন মুক্তিযুদ্ধের তথাকথিত মূলস্রোতের নেতৃত্ব তাদের হাতেই। তারা এখন বই লিখেন, ওয়াজ করেন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তালিম দেন জনগনকে। কিন্তু রাষ্ঠ্রের অসম্ভব গুরুত্বপূর্ন আন্দোলন, তেল-গ্যাস রক্ষা বা বন্দর বেহাত হওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনে এদেরকে পাওয়া যায়না, কারন এসব আন্দোলনে রাস্তায় নামলে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর সামনে দাড়াতে হবে, আনু মুহাম্মদের মত মাথা ফাটিয়ে দিবে পুলিশ। সেটা সহ্য করা আরামপ্রিয়, সংস্কৃতিসর্বস্ব, ড্রয়িংরুমে চায়ের কাপে ঝড় তোলা এসব সুশীল মধ্যবিত্তের প্রতিনিধিত্বকারীদের পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া এরা সংগ্রাম এবং ইতিহাসও পাঠ করে সাদা-কালো দুভাবে ভাগ করে।
নিম্নবিত্ত মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলনে গিয়ে লাথিগোথা খান, আমরা কিছুক্ষণ সেটা নিয়ে কষ্ট পায় কিন্তু পরে আবার নিজেদের জীবন-যাপনে ব্রতী হয়। মেজর কামরুল হাসানের লেখা "জনযুদ্ধের গনযোদ্ধারা" বইয়ের সেইসব গণযোদ্ধারা এসব মধ্যবিত্তদের অনুষ্ঠানে অপাংত্তেয়।
এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কিছুটা সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তদের দৌরাত্ব্য থাকলেও, এবং নিম্নবিত্ত কৃষক-মজুর আর ছাত্র সমাজের সেখানে সেভাবে অংশগ্রহন না থাকলেও, ৫২-র ভাষা আন্দোলন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আমি যখন মধ্যবিত্ত বলছি, তখন পেশাজীবি মধ্যবিত্তদের বুঝাচ্ছি, ছাত্রসমাজের যে অংশ মধ্যবিত্ত থেকে আসে সে অংশের মধ্যে পেশাজীবি মধ্যবিত্তদের সুবিধাবাদিতা দেখা যায়না। তাই তারা ছাত্রসমাজ, মধ্যবিত্ত সমাজ না।
ভাষা আন্দোলনকে যদি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ধরা হয় (যদিও আমি এটাকে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন মনে করি, কেননা এই আন্দোলনের সাথে সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেমন বাংলা নববর্ষ আন্দোলন ইত্যাদির বৈশিষ্ঠের সাথে মিল নাই, যদিও ভাষাকে সংস্কৃতিরই অংশ ধরা হয়। ), তাহলে এটাই একমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেখানে বাংলার আপামর ছাত্র-জনতা-মুটে-মজুর-কৃষক-শ্রমিক সবাই মধ্যবিত্তদের সাথে একাত্ম ঘোষণা করেছিল। কেন করেছিল তার একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমরা আগেই বলেছি বিশ শতকের শুরু থেকেই বাঙাল মুসলমান নিম্নবিত্ত কৃষক-শ্রমিক-মজুর-মুটেরা তাদের ছেলেদেরকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ধান বেচে পাট বেচে, অনেক সময় জমি বেচেও শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিল। তাই ৫০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক বাংলার মুক্তি আন্দোলনের পুরোভাগে যে ছাত্রসমাজ ছিল, সে ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ট অংশই মূলত গ্রামের এই কৃষক-মজুর-মুটে শ্রেণীর পরিবার থেকে আগত।
যখন এই ছাত্রদের বুকে ভাষা আন্দোলনে গুলি লাগল, যখন তাদের বুক ঝাঁজরা হল, তখন তা যেন বাংলার আপামর কৃষক-শ্রমিক-মজুরদের বুকেই লাগল, তারা তাদের সন্তানদেরকে শিক্ষিত করতে পাঠিয়েছিল, সে সন্তান লাশ হয়ে ফিরে এসেছিল। এতে আপাতদৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক আন্দোলন হওয়ার কথা থাকলেও এ আন্দোলনে মধ্যবিত্তদের সাথে সারা বাংলার সবাই একাত্ম হয়েছিল, কৃষক-শ্রমিক-মজুর-মুটে সবাই সক্রিয়ভাবে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করল। ১৯৫৬ সালে বাংলাকে অফিসিয়ালি স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের সাংস্কৃতিক সমাপ্তি ঘটলেও তার রাজনৈতিক রেশটা রয়েই গেল। এরপরে আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে শুধু পেশাজীবি মধ্যবিত্তরাই রইল, সেখানে বাংলার আপামার জনতার তেমন অংশগ্রহন ছিলনা। ছায়ানটের নববর্ষ উদযাপন আর রবীন্দ্রসাহিত্যের উপর শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র চর্চা চালিয়ে যাওয়ার আন্দোলন শুধু পেশাজীবি মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল।
আপামর জনগন সেখানে অংশগ্রহণ করলনা, কারন আপামর জনগনের মূল আন্দোলন হচ্ছে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আন্দোলন। ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি এসব জনগনের পেট ভরায়না, তাই এসবে তাদের পাওয়া সম্ভব না। এসবকে ইউনিফায়িং ফোর্স হিসেবে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করতে পারবে যদি এবং কেবল যদি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকারজনিত সংকট বিদ্যমান থাকে বা কোন একটা বিশেষ গোষ্ঠী সমস্ত জাতিরাষ্ঠ্রের কাঠামোতে নিজেদেরকে বণ্ঞিত হিসেবে দেখে, সেই দেখাটা একচুয়াল হতে পারে বা পার্সিভড হতে পারে।
মধ্যবিত্ত শিক্ষিতদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবল বদ্ধমূল ধারণাকে আমরা মোটামোটি দুজন প্রিয় (এবং জনপ্রিয়) ব্লগারের (আশরাফ মাহমুদ এবং অনীক) মতামতের কিয়দংশ উদ্ধৃতি হিসেবে দিয়ে আলোচনা করব। এই ধারার চিন্তাকে রেট্রসপেক্টিভ ইতিহাসচর্চা হিসেবে দেখা যায় এবং এই ধারার চিন্তাই মূলত: বাংলাদেশী মধ্যবিত্তদের মূলধারার চিন্তাধারা বলা যায়।
আমার একটা অনেক আগের ফেইসবুক পোস্টে আশরাফ মাহমুদের কমেন্ট:
"আপনি দেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস দেখেন। আমরা বাঙালি, আমাদের ভাষা বাঙলা, তাই আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এই দীর্ঘ আন্দোলনের সময়ে মূল চালিকাশক্তি ছিলো বাঙালি সংস্কৃতি, ছিলো বাঙলা ভাষা.................."
নেটপোকার বাঙালি বা বাংলাদেশী নিয়ে পোস্টে অনীকের কমেন্ট:
আমার জানা মতে মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট ছিলো ধর্মরাষ্ট্র ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠন। পাকিস্তান একটা ধর্মরাষ্ট্র, এবং তা ব্যর্থরাষ্ট্র। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধ।
অনেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, হত্যার শোধ নিতে বা অত্যাচারে রুখে দাঁড়াতে। কিন্তু মূলমন্ত্র ছিলো অন্য।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের এরকম ধারণার বড় কারন রেট্রোস্পেক্টিভ ইতিহাস চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের দিক বাদ দিয়ে, যেটা মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অংশ, মধ্যবিত্তরা এটাকে সংস্কৃতির সংঘর্ষটাইপ (clash of culture) একটা আন্দোলন হিসেবে পাঠ করতে চায়। তাদের মোটাদাগে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ উপরের প্রিয় ব্লগার আশরাফ মাহমুদ এবং অনীকের মন্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে।
তাদের মতে ভাষা বা সংস্কৃতি এক না হলে রাষ্ঠ্র কাঠামো টিকবেনা, যেজন্য দ্বিজাতি তত্ত্বের পতন ঘটেছে। কিন্তু তারা ইতিহাস দেখে ১৯৪৭ সালের পর থেকে, তাদের এই সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী মধ্যবিত্তদের সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা দ্বারা চরমভাবে প্রভাবিত। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে দ্বিজাতি তত্ত্বের পতন হয়েছে, কিন্তু তারও অনেক আগেই একজাতি তত্ত্বের পতন হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ইতিহাস চোখ বুলালেই পরিষ্কার যে কি ভয়ংকরভাবে, কি জোরালোভাবে একজাতি তত্ত্বের পতন হয়েছিল, যেমন হয়েছিল ১৯৭১ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের পতন। প্রমাণ হয়েছে সংস্কৃতি, ভাষা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ঠ্য এক হলেও আমরা একসাথে থাকতে পারিনি, ১৯৪৭ সালের কলকাতাকেন্দ্রীক বাঙালি হিন্দু সমাজ এবং পূর্ব বাংলার মোসলমান সমাজ সজ্ঞানে দেশভাগ করেছি, এতে দু-অংশের সায় ছিল।
ভাষা এবং সংস্কৃতি আমাদের একসাথে রাখতে পারেনি। ১৯৭১ সালে আমরা তথাকথিত ধর্মের ভাই হয়েও পাকিস্তানিদের সাথে একসাথে থাকতে পারিনি, এক-ধর্ম তত্ত্বের পতন হয়েছে। একজাতি তত্ত্ব, দ্বিজাতি-তত্ত্ব এবং এক-ধর্ম তত্ত্ব সবই ধরা খেয়েছে। তাহলে কি সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা এসব বিশেষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে অন্যান্য স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেনা? ফেলে, অবশ্যই ফেলে, তবে তা প্রধান অনুঘটক হিসেবে নয়, কেবলমাত্র টুল বা উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবেই। এ প্রসংগে পরের (শেষ) পর্বে যুক্তরাষ্ঠ্রের নাগরিক আন্দোলনের উদাহরন দিয়ে আমার লেখা শেষ করব।
শেষ পর্ব। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।