বাংলা ছায়াছবির এই বহুল ব্যবহৃত প্লটটা হয়তো সবারই কমবেশী জানা আছে। তবু আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমেই একটু ঘুরে আসা যাক না। দেখে আসা যাক চিরায়ত বাংলা ছলচ্চিত্রের এই রূপালী জগৎ কতখানি বাস্তব আর কতখানি কাল্পনিক!
নায়ক ও নায়িকা দু’জন দু’জনকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু তাদের সেই ভালোবাসায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক অবস্থান। নায়িকা ধনীবাবার একমাত্র আদরের দুলালী, যাকে কিনা বলে একেবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো।
আর অন্যদিকে নায়ক গরীব-দুঃখিনী মায়ের অতিকষ্টে মানুষ করা বস্তি থেকে ভার্সিটিতে পড়া সৎ-ঈমানদার ছেলে। তো পরিচালকের থুক্কু বিধাতার অসীম মহিমায় এই দু’জনের প্রেম। মিষ্টি প্রেমের দুষ্টুমি চলতে চলতে একসময় আসে ঝড়। নায়িকার পরাক্রমশালী-ধনী বাবা(বাড়তি একশন হিসেবে তিনি নায়কের বাবার খুনিও হতে পারেন!) এই প্রেম মেনে নিতে পারে না। তার পছন্দ কালোব্যবসার অংশীদার অমুক মির্জা কিংবা তমুক সওদাগরের ছেলে মিকি/জ্যাকি/হ্যাকিকে।
কিন্তু নায়িকা তা মানবে কেন? তার তো বস্তির সৎ-ঈমানদার নায়ককেই চাই। ………তারপর???
হ্যাঁ পাঠক, আমরা এখন ছলচ্চিত্রের সবচাইতে থ্রিলিং পার্টে পৌঁছে গেছি। নায়িকার বাবা তার গুণ্ডাবাহিনী আর হবুজামাইকে লেলিয়ে দিবে নায়ককে শায়েস্তা করার জন্য। আর নায়ক তার ভালোবাসার শক্তিতে মেরে কুপোকাত করে দিবে সবাইকে! এবং অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিবে।
কিন্তু বাস্তব আর সিনেমায় যে বড্ডো ফারাক! বাস্তবের নায়কেরা তাই নায়িকার বাবা চৌধুরীসাহেবের সামনে দাঁড়াতেই পারে না।
তাহলে কি ঘটে তাদের জীবনে???
---------------------------------------------
ছোট্ট একটা মফস্বলশহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে সোহেলের জন্ম। ছাত্র হিসেবে মাঝামাঝি মানের হলেও যথেষ্ট পরিশ্রমী একটা ছেলে। এস,এস,সি পাশ করার পরপরই ফার্মেসী বিষয়ক একটা কোর্সে ভর্তি হয়ে যায়। কোর্স শেষে এলাকায় এসে পরিবারের শেষসম্বল ধানীজমিটুকু বিক্রি করে বাজারে একটা ঔষধের দোকান দিয়ে বসে। এমনিতে পারিবারিক অবস্থা ততটা ভালো না হলেও নিজের পরিশ্রম দিয়ে সেটা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা চালিয়ে যাতে থাকে।
এমনি একটা সময় ওর সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয় স্থানীয় কলেজের ২য়বর্ষের ছাত্রী রাবেয়ার । আমার জানা-শোনা-দেখা অনুযায়ী সেই সম্পর্কটা একমুখীতো নয়ই, বরং ভীষণরকমের উভমুখী ছিলো। কিন্তু রাবেয়া এলাকার প্রতাপশালী ইদ্রিস কমিশনারের মেয়ে। আর তার ফলে যা হওয়ার তাই হলো। ওদের সম্পর্কের কথা ইদ্রিসসাহেবের কানে যাওয়ামাত্র তিনি যথারীতি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন।
প্রথমে সোহেলকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে শাসানো হলো। কিন্তু তাতেও যখন কাজ হলো না তখন তিনি আশ্রয় নিলেন এক অভিনব কৌশলের্; সিদ্ধান্ত নিলেন ঘোলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কার্যসিদ্ধির। সময়টা তখন এমন যে, সারাদেশেই ইভটিজিং নিয়ে ব্যাপক শোরগোল চলছিলো। ইভটিজিং এর শাস্তির জন্য আইনও পাশ হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় ইভটিজিংয়ের দায়ে বিভিন্ন জায়গায় বখাটেদের শাস্তির খবর আসছিলো।
তিনি এই আইনকেই কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তার পরিচিত এক ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যোগাযোগ করে সোহেলকে অভিযুক্ত করলেন ইভটিজিংয়ের দায়ে। বাংলাছবির নায়িকা পারলেও রাবেয়া তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারলো না, “আমি সোহেলকে ভালোবাসি। ও ইভটিজার নয়। ” বরং ওর নিরবতা সায় দিলো অভিযোগের পক্ষেই।
কিন্তু মনে হয় না এর জন্য ওকে দোষ দেয়া যায়। সামাজিক বাস্তবতায় মফস্বলের একটা মেয়ের পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক! তাছাড়া এর জন্য বাড়ির অন্দরমহলে ওর উপর কতো অত্যাচারের ঝড় গেছে কে জানে!
ভ্রাম্যমান আদালতের রায়ে সোহেলের ছয়মাসের কারাদণ্ড হলো। (সর্বোচ্চ শাস্তির হিসেবে এটাতো কমই! কি জানি! হয়তো এটুকুই ইদ্রিসসাহেবের চাওয়া ছিলো। ) তারপর দণ্ডভোগ শেষ করে সোহেল আবার এলাকায় ফিরে এলো। কিন্তু তার গায়ে যে এখন জেলখাটা-দাগী আসামীর লেবাস।
এই ছয়মাসে বদলেও তো গেছে অনেককিছু। তার রাবেয়া এখন অন্যের বউ হয়ে গেছে। জেলে যাওয়ার দোষে দুষ্ট হয়ে আর বাজার কমিটির চাপে পড়ে তাকে ছেড়ে দিতে হলো ঔষধের দোকানটাও। ক্রমাগত অপমানে জর্জরিত হয়ে সবশেষে বাধ্য হলো এলাকাই ছেড়ে যেতে।
তবুও, আশার কথা এই যে নতুন জায়গায় গিয়ে ও আবার নতুন করে সব গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ওর মতো পরিশ্রমী যুবকেরা কখনো হারতে পারে না। আশা করি ও আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে, আবারো ফিরে যেতে পারবে স্বপ্নপূরনের ট্র্যাকে। কিন্তু আইনের ব্যাপারে ওর বুকে যেই দগদগে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা কি কোনোদিন শুকাবে?
-------------------------------
গল্পটা এখানেই শেষ। হ্যাঁ, এটাকে গল্পই ভাবা হোক। এড়িয়ে যাওয়া হোক এই প্রশ্নও যে, পাত্র-পাত্রী গুলো কি বাস্তব, নাকি শুধুই কল্পনা।
কারণ, তারা বাস্তব কিংবা কাল্পনিক যাই হোক না কেন, তারা যা হারিয়েছে তার কিছুই আজ আর তাদেরকে ফিরিয়ে দেবার সামর্থ্য আমাদের নেই। বরং আমাদের অতি-কৌতুহলে তাদের হারানোর পাল্লাটাই শুধু ভারী হতে পারে। তাই তাদের নিয়ে নয়, বরং আলোচনা হোক, এ ধরণের ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা নিয়ে। প্রশ্ন উঠুক, এ ধরনের কিছু ঘটা কি আদৌ সম্ভব? যদি উত্তর না হয়, তাহলে তো আলোচনার অবকাশই থাকে না। কিন্তু যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলার, ভাবার, করার থেকে যায়, এসে যায় অনেক কিছুই।
পর্যালোচনা করার দরকার পড়ে ইভটিজিং আইন নিয়ে, এর প্রয়োগ নিয়ে। ভাবনার জন্ম নেয় যে, এটা কতটুকু নিরাপদ। কেননা, যে আইন তৈরি করা হয়েছে বিব্রতকরণ(বিশেষত, উইমেন হ্যারাসমেন্ট) প্রতিরোধের জন্য, সেই আইনের কবলে পড়েই কেউ বিব্রত হবে, সামাজিক মর্যাদা হারাবে, কারো ভবিষ্যত বিপর্যস্ত হবে এটা নিশ্চয়ই আমরা চাইবো না। আমরা আরো চাইবো না, এটাকে কেউ ব্ল্যাকমেইলিং এর কাজে, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার কাজে তথা অন্যায় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করুক।
একটা সময় ছিলো, যখন কোনো এক বিশেষধারাকে (সন্দেহভাজন মনে হলেই এ্যারেস্ট করা যেত কিংবা এখনো ঐ ধারা দিয়ে) পুলিশের টু-পাইস কামানোর উৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হত।
সেইসময় পেরিয়ে এখন পুলিশের হাতে তার চেয়েও উৎকৃষ্ট অনেক ধারা-উপধারা চলে এসেছে। তাই ঐধারা নিয়ে আগের সেই আলোচনাগুলো শোনা না গেলেও পরিস্থিতির যে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। কেননা, এখনো পত্রিকার পাতা খুলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে লিমন, মিলন, কাদের, নাহিয়ানদের মতো কারো না কারো খবর। তবু ইভটিজিং আইনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ একটি আইন সেধরনের কোনো পরিণতি বরণ করুক, সেটা কখনোই কাম্য নয়। তাই বলে এটাও কাম্য নয় যে, আইনের অভাবে ইভটিজাররা পার পেয়ে যাবে, বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যাবে বিকৃত মানসিকতার।
প্রয়োজন শুধু একে নিশ্ছিদ্র করা, যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। যাতে আমাদের মা-বোনেরা পাবে একটা স্বাভাবিক-স্বতস্ফূর্ত জীবনযাপনের পরিবেশ আর নিশ্চিত হবে যেন কখনো কোনো চৌধুরীসাহেব কিংবা ইদ্রিসসাহেব একে হাতিয়ারে পরিণত করতে না পারে; যেন কোনো নিরপরাধ সোহেলের জীবনে এটা অভিশাপ হয়ে না আসে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।