আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাত পোহাতে সত্যিই কি দেরি পাঞ্জেরী!!

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক "...... কবি কিছুই বললেন না,শুধু একটু খনি হেসে বললেন, শোন,আমার 'ডাহুক' কবিতা নিয়ে দিগিগজেরা তো মহা চিন্তায় পড়ে গেল। 'ওড টু স্কাই লার্ক" 'ওড টু নাইটিঙ্গেল'-কোনটার সাথেই মেলাতে পারে না। কিন্তু ওরা তো কথার বেপারী। তাল-গোল মিলিয়ে দিয়ে সাব্যস্ত করে ছাড়ল যে, 'ডাহুক" আদৌ মৌলিক কবিতা নয়। ঠিক নকল না হলেও ভাবানুকরণ ইত্যাদি।

আরে ,ওরা কোথা থেকে জানবে বল? ওরা তো খালি বইয়ের পাতায় জীবনের মানে খুঁজে বেড়ায়- ভুল মানেকে সঠিক মানে ভেবে বগল বাজায়। তুই তো জানিস,মুজাদ্দিদী তরীকায় জিকির কি জিনিস। 'ডাহুক' রাতভরে ডেকে ডেকে গলায় রক্ত ওঠায়। মুজাদ্দেদী সাধকও তেমনি রাতভর 'আল্লাহু-আল্লাহু' জিকির করে নিজেকে ফানা করে দেন। গভীর রাতে নীরব-নির্জন কোনো গ্রাম্য মসজিদে মুজাদ্দেদী তরীকায় কোনো সাধক যখন 'আল্লাহু-আল্লাহু' জিকির করতে থাকেন, তখন মনে হয় অবিকল যেন একটা ডাহুক এক মনে ডেকে চলেছে।

আমার 'ডাহুক' কবিতা এই ধরনের মুজাদ্দেদী সাধকের জিকির নিয়েই রচিত। স্কাইলার্ক কিংবা নাইটিঙ্গেলের সাথে তার মিল থাকবে কোত্থেকে?' সাংবাদিক কালামিস্ট আখতার-ঊল-আলমের একটি লেখায় বাংলা ভাষার ও বাংলাদেশের একজন কবির এই অভিব্যক্তিটি প্রকাশ পেয়েছে । **** একই কবি সম্পর্কে পরবর্তী সময়ের আরেক বিখ্যাত কবি শামসুর রহমান লিখেছেন ওই কবির ওফাতের পর পর-" দারিদ্র তাঁর শরীরকে ক্ষইয়ে দিয়েছিল ভীষণভাবে, কিন্তু কখনও কামড় বসাতে পারেনি তাঁর মনের ওপর। তাঁর মতো অসামান্য কবি খুবই সামন্য একটা চাকরি করতেন। মাইনে পেতেন মাত্র ছ'সাত শ' টাকা; অথচ তাঁর ঘরে বার-তের জন পুষ্যি।

আজকের দিনে এই ক'টি টাকায় কি করে চালানো সম্ভব এত বড় সংসার? দারিদ্র ম্লান করে দিয়েছিল তাঁর সংসারের সুখ। পয়সা কামানোর দিকে কখনও মন ছিল না তাঁর। পারলে তিনি হয়তো চাকরিও করতেন না কখনও। ধরা-বাঁধা চাকরি করার মানসিকতা ছিল না । তিনি ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া।

তাই যখন তাঁকে রেডিও অফিসে দেখতাম এওকজন সামান্য চাকুরে হিসেবে, আমার কেমন যেন খটকা লাগতো। সেখানে বড় বেমানান লাগতো ফররুখ আহমদকে। ...... আমার সেই কর্মজীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল ফররুখ আহমদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেওয়া। মতাদর্শের দিক থেকে আমরা অবস্থান করতাম দুই বিপরীত মেরুতে। আমি জানতাম,তাঁর ঝাঁঝালো রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা,তাঁর অসহিষ্ণুতার কথা-কিন্তু এর কোনটাই সে সময় আমার আর তাঁর সম্পর্কের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।

তিনিও ভালো করেই জানতেন আমার বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের কথা ,আমার রাজনৈতিক মতামতের কথা। তাঁর সঙ্গে কখনও আমার কোনো রাজনৈতিক সংলাপ হয়নি। তিনি এড়িয়ে যেতেন, আমিও তাঁকে রাজনৈতিক তর্ক জুড়তে প্ররোচিত করিনি কোনো দিন। আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা মেতে থাকতাম সাহিত্যলোচনায়। ...... ফররুখ আহমদ কোনো ব্যাংক-ব্যালেন্স রেখে যাননি।

রেখে যাননি কোনো জমিজমা। তাঁর চিরনিদ্রার এতটুকু ঠাঁইয়ের জন্য জমি খুঁজতে গিয়েও বিড়ম্বিত হতে হয়েছে তার অনুরাগীদের। শেষ পর্যন্ত উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে এলেন কবি বেনজীর আহমদ। তিনি বললেন, আমি আমার ফররুখ ভাইকে নিয়ে যাব আমার ডেরায়। একজন কবিকে কবরস্থ করা হল অন্য আরেক কবির বসতবাড়ির সীমানায়।

তাঁর কবরের জমি নিয়ে যত ঝামেলাই হোক, তাঁর সন্তানেরা যত বঞ্চিতই হোক পার্থিব জমিজমা থেকে,তিনি রেখে গেছেন অন্য রকম বিঘা বিঘা জমি-যে জমির ফসল দেখে চোখ জুড়াবে সাহিত্য-পথযাত্রীদের। এই সমৃদ্ধ জমি পেছনে রেখে তিনি নিজে যাত্রা করেছেন নতুন রসস্যময় পানিতে,নিরুদ্দেশ সফরে। ' ******* আজকের বর্ষীয়ান আলেম লেখক,মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন-" দার্শনিক কবি ইকবালের ভাষায়,'যে কথা আত্মার গভীর থেকে বের হয়ে আসে, তা সহজেই অন্তর স্পর্শ করে। 'ঈমান-সমৃদ্ধ আত্মার অধিকারী কবিদের অভিহিত করা হয়েছে 'তালামিযাতুর রহমান'-দয়াময় আল্লাহর ছাত্র নামে। রূমি, জামী, সাদী, নিযামী, ইকবাল প্রমুখ ঈমানদীপ্ত কবিকন্ঠগুলো বোধ হয় এর বাস্তব প্রমাণ।

কবি ফররুখ ছিলেন এসব কবিকন্ঠেরই প্রতিধ্বনি। রূমীর মসনবী, জামীর গযল,সাদীর খন্ড কবিতা এবং ইকবালের বক্তব্য প্রধান লেখা ছিল তাঁর আত্মার খোরাক। সাদীকে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লোকশিক্ষক বলে অভিহিত করতেন। তাঁর পরিচ্ছন্ন আত্মার মুকুরে উল্লিখিত কবিদের মরমী বাণীগুলো এক আশ্চর্য বিভায় প্রতিবিম্বিত হত। এঁদের আলোচনা করার সময় তিনি যেন সুদূরে হারিয়ে যেতেন।

বাহ্যিক বেশভূষা থেকে শুরু করে আচার আচরণ এবং জীবনযাত্রার সর্বক্ষেত্রেই সুন্নত তরিকা সাধ্যমত অনুসরণের মাধ্যমে তাঁর ঈমানের অভিব্যক্তি মূর্ত হয়ে উঠত। যা তিনি বলতেন বা লিখতেন, তা নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতেন। বক্তব্যের সাথে বিশ্বাস এবং আচরণের এ বাস্তব সামঞ্জস্যই তাঁর ব্যক্তিত্বকে আপসহীন করে তুলেছিল। ...............। " **** উপরের তিনটি অংশের মতো এ দেশের ডান-বাম ও ইসলামী লেখক,কবি-সাহিত্যিকদের বহু মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ যখন পড়ি তখন আমি যেন প্রতিভাদীপ্ত,ত্যাগী,আদর্শবান কবি ফররুখ আহমদকেই দেখি।

আমাদের কাছাকাছি কাল ও সময়ের মধ্যে এমন একজন অসাধারণ কাব্য নায়কের অস্তিত্ব অনুভব করে রোমাঞ্চিত হই। কল্পকথা,গল্প-উপন্যাস কিংবা ইতিহাসের দুর্লভ চরিত্রে যেসব মহত্বের পলেস্তার থাকে তার একটি আস্ত ও বাস্তব নমুনা এই কিছুদিন আগেও এদেশে এবং এ-ভাষা ও সাহিত্যে উজ্জ্বল ছিল ভাবতে পেরে সাংঘাতিক আলোড়িত হই। কিন্তু আজ তিনি ও কবি বেনজীর আহমদ শাহাজানপুরে কবি বেনজীর আহমদের বাড়ির মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানটিতে পাশাপাশি শুয়ে রয়েছেন। **** 'সাত সাগরে মাঝি,সিরাজাম মুনিরা, নৌফেল ও হাতেম প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কবি ফররুখ আহমদের কর্মজীবনের উওল্লেখযোগ্য একটি সময় কেটেছে নাজিমউদ্দীন রোডের তৎকালীন রেডিও অফিসে। এখন যেটি শেখ বোরহানুদ্দিল কলেজ।

সেই অফিসের সামনেই ছিল আবন মিয়া কিংবা আবুল মিয়ার হোটেল। এখানেই বসত কবির আডদা এবং আসর। বহু কবি- সাহিত্যিকদের স্মৃতিচারণে আবন মিয়ার এই হোটেলের বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৯৯৩-৯৪ সালে একজন লেখক খুঁজতে বের হন আবন মিয়াকে। তিনি তাকে পানও।

কিন্তু সে আর হোটেলের ব্যবসা করেন না। অসুস্থ ও অবিবাহিত পৌঢ় আবন মিয়া থাকেন বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে লক্ষীবাজারে তার ছোট ভাইয়ের বাসায়। তার ভাষায়-" কবি সাব ছিলেন একজন আল্লাহওয়ালা-দিলদরিয়া মানুষ। কবি সাহেবের নাস্তাপানি খেয়ে এখন বহু কবি-লেখক বড় কবি লেখক। তারা কবির দুর্দিনে কবিকে দেখেননি।

হাতে বেতন পেয়েই বেতনের টাকা আমার হাতে দিতেন। হোটেলের টাকা পরিশোধের পর মাসের বাজার করতেন কবি সাব। আর আমি সে গুলো কবি সাবের বাসায় দিয়ে আসতাম। গুলিস্তানের যে জায়গাটায় এখন পীর ইয়ামেনী মার্কেট তার পেছনে একটি প্রাচীন কবর ও মসজিদ ছিল। কবি সাব কোনো কোনো রাতে সেখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ দোয়া করতেন।

পাশের মসজিদে নামজ পড়তেন। "কথা বলার মাঝে মাঝে আবন মিয়া চোখ মুছেন,ধরা গলায় কথা বলেন এবং মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যান। কবি ফররুখের এই নিবেদিত ও ঘনিষ্ঠ সংস্রবধন্য স্বল্প শিক্ষিত সরল লোকটির আদ্র ও আবেগকাতর অভিব্যক্তিতে আবারো এই প্রত্যয়ই অনুভব করছি যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ও বাংলাদেশের বুকে একজন অনুসরণীয় তাওহীদবাদী,সৎ কবি ও মানুষের অস্তিত্বকে আমরা পেয়ে গেছি। এটি এদেশ ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেক বড় একটি ঘটনা,আমাদের কাছে। তিনি যথার্থ অর্থেই ছিলেন আঁধার রাতের পাঞ্জেরী।

রাত পোহানোর পর একটি নির্মল ভোরের জন্য হাহাকার করত তাঁর বুক। ব্যাকুল কন্ঠে তিনি সেই হাহাকার পাঞ্জেরীকেই জানাতেন, পাঞ্জেরীর কাছেই জানাতে চাইতেন। সেই রাত পোহানোর বার্তা কি আজকের পাঞ্জেরীরাও দিবেন না?  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।