দেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেয়ার বিধান রেখে অবশেষে গতকাল সোমবার জাতীয় সংসদে পাস হলো বহুল আলোচিত ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) বিল, ২০১১’। বিলটি পাসের ফলে সংখ্যালঘুদের অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে গত ৪০ বছরের হয়রানি ও বঞ্চনার অবসান হবে বলে দাবি করছে সরকার। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, আইনটিতে অনেক ফাঁক-ফোঁকর রয়েই গেছে।
গতকাল সোমবার সংসদে বিলটি পাসের জন্য উত্থাপন করেন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
বিলের বিরোধিতা করে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা যাচাই-বাছাই ও সংশোধনী প্রস্তাব আনলেও তাদের অনুপস্থিতির কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। বিলের ওপর চার দফা সংশোধনী এনে মহাজোট নেতা ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, কিছু ধারা এই বিলে না থাকায় এ আইনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিলটি আনা হলে এই সংশোধনী আনা প্রয়োজন পড়ত না। যেভাবে বিলটি আনা হয়েছে, তাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হয়রানি মুক্ত হবে না।
জবাবে ভূমিমন্ত্রী বলেন, জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই এই সংশোধনী আনা হয়েছে এবং জাতীয় প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই রাশেদ খান মেননের একটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়েছে।
পরে স্পিকার আবদুল হামিদ বিলটি ভোটে দিলে তা সংশোধিত আকারে কণ্ঠভোটে পাস হয়। রাশেদ খান মেনন ২০০১ সালের ১৬ নম্বর আইনের ধারা ৬ এ সংশোধনী এনে বলেন, উক্ত আইনের ধারা ৬ এর শেষ পঙক্তিতে অবস্থিত ‘অব্যাহতভাবে’ শব্দটি বিলুপ্ত হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিলের চারটি ধারায় সংশোধনী আনলেও তার অনুপস্থিতির কারণে তা উত্থাপিত হয়নি।
বিলে বাংলাদেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, এ আইন কার্যকর হওয়ার ১৫০ দিনের মধ্যে প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তি জেলাওয়ারি তালিকা প্রস্তুত করে সরকারি গ্রেজেট প্রকাশ করা হবে।
গেজেটে বর্ণিত জমির মালিকানা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাবি করলে তা গেজেট প্রকাশের ৯০ দিনের মধ্যে দাবির সমর্থনে সকল কাগজপত্র এবং প্রমাণাদিসহ জেলা কমিটির কাছে আবেদন করতে হবে।
আইনে আরও বলা হয়েছে, জেলা কমিটি ১২০ দিনের মধ্যে আবেদন যাচাই বাছাই করে লিখিত সুপারিশ জেলা প্রশাসকের কাছে পেশ করবে। প্রাপ্ত মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসককে ৩০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। জেলা কমিটির সুপারিশে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বিলের ৪ এর উপরাধা (৩)-এর অধীনে ৬০ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে আপিল দায়ের করতে পারবে।
বিলে ক্রয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, তফসিলে বর্ণিত সম্পত্তি বিক্রি বা স্থায়ী ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তি যে হোল্ডিং/ খতিয়ানভুক্ত সেই হোল্ডিং/খতিয়ানের যিনি উত্তরাধিকার সূত্রে সহ-অংশীদার, যদি থাকে, তিনি অগ্রাধিকার পাবেন এবং এরূপ সহ-অংশীদার না থাকলে যিনি বিক্রয়ের পূর্বে ইজারাসূত্রে ভোগদখলভুক্ত ছিলেন তিনি অগ্রাধিকার পাবেন।
‘তফসিল খ’ বর্ণিত সরকারি সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বিক্রি বা স্থায়ী ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে যিনি বিক্রির বা ইজারার অব্যবহিত পূর্বে ভোগদখলে ছিলেন তিনি দখলকালীন সময়ের জন্য প্রযোজ্য ক্ষতিপূরণ প্রদান সাপেক্ষে অগ্রাধিকার পাবেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এক মাসের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বিলটি সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হলে এ নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দেয়। প্রায় ৮ মাস পর এ ব্যাপারে সংসদে রিপোর্ট উত্থাপন করে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদীয় কমিটি সংসদে উত্থাপিত বিলের অধিকাংশ দফায় সংশোধন করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি নতুন দফা ও উপদফা প্রতিস্থাপন করেছে। এতে অর্পিত সম্পত্তির তালিকা প্রকাশের সময় ২১০ দিন থেকে কমিয়ে ১৫০ দিন করতে বলা হয়েছে।
জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে আপিলের সময়সীমা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত দেয়ার সময়সীমা ৬০ দিনের পরিবর্তে ১২০ দিন করা হয়েছে।
পাসকৃত বিলের ধারা ৯/খ অনুসারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা রেজিস্টার, স্থানীয় একজন সংসদ সদস্যসহ ৭ সদস্যের জেলা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। আর ৯/গ ধারায় ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের ২৬ নম্বর দফায় বলা হয়েছে অর্পিত সম্পত্তির দাবিনামা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে সেটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে। আর সরকারি সম্পত্তি সরকার বিক্রি বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর বা সরকারের বিবেচনা মতো ব্যবহার করতে পারবে।
২৭ নম্বর দফায় বলা হয়েছে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি বা স্থায়ী ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা ইজারাসূত্রে ভোগদখলকারী অগ্রাধিকার পাবেন।
এছাড়া অদাবিকৃত অর্পিত সম্পত্তিও প্রত্যর্পণের জন্য এ আইনে বিধান রাখা হয়েছে। এসব সম্পত্তির আবেদনের নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষ হওয়ার পর কোন ব্যক্তি তাতে স্বত্ব, স্বার্থ বা অধিকার দাবি করতে পারবে না। সরকারি খাস অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর, ব্যবহার ও নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে এসব কমিটি।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিনেন্স এবং ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস জারি করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।
ঐ ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস অনুসারে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক তত্কালীন পাকিস্তান ছেড়ে ভারত চলে গিয়েছিলেন তাদের ফেলে যাওয়া সম্পক্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আরো বলা হয়, ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন-২০০১ জারি করা হয়। ২০০২ সালে এটি আবার সংশোধন করা হয়। তবে আইনটি এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এছাড়া অর্পিত সম্পত্তি আইন ২০০১ দ্বারা অর্পিত সম্পত্তিকে প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তি এবং প্রত্যর্পণযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির বহির্ভূত সম্পত্তি (ব্যক্তির দখলে থাকা) এই ২ ভাগে ভাগ করা হয়।
এই দুই ধরনের সম্পত্তি দেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের ফেরত দেয়ার লক্ষ্যে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১ এর ৯(১) এবং ৯(৬) ধারা সংশোধন করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, ঐ আইনের ২৬ নম্বর ধারা প্রতিস্থাপন করে অদাবিকৃত বা দাবি প্রমাণিত হয় নাই তালিকাভুক্ত এমন প্রত্যর্পণযোগ্য সম্পত্তি এবং প্রত্যর্পণ তালিকা বহির্ভূত (ব্যক্তির দখলীয়) উভয় প্রকার অর্পিত সম্পত্তি খাস ঘোষণার বিধান করার লক্ষ্যে এই ধারায় সংশোধনী প্রয়োজন
লেখক: শামছুদ্দীন আহমেদ | মঙ্গল, ২৯ নভেম্বর ২০১১, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪১৮
মন্ত্রী বললেন, সংখ্যালঘু হয়রানি বন্ধ হবে; মেনন বললেন, হবে না ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।