উত্তর কলকাতার নিমতলা শ্মশান ঘাটে সন্ধ্যা-বিগত রাতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রজ্জ্বলিত মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে বেদনাহত তরুণ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত শোককাতর হয়ে বলে উঠেছিলেন, আজ থেকে সবকিছু পাল্টে যাবে; আর তাই হয়, এই একজন মাত্র মানুষের প্রয়াণে এখানে সবকিছু পাল্টে যায়। বাংলাদেশের মানুষ তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে জেঠে ওঠে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া। শুরু হয় বাঙালির রবীন্দ্রনাথবিহীন জীবন যাপন। মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তিকেই ছিনিয়ে নেয় জীবন থেকে এবং তখন যে শূন্যতা নেমে আসে সেই শূন্যতা হয়তো কখনো কখনো ব্যক্তি ছাড়িয়ে পরিবারে বিস্তৃত হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু একজন ব্যক্তি মাত্র নন, তাই তাঁর মৃত্যু কেবল একজন ব্যক্তি বা একটি পরিবারকে শোকগ্রস্ত করে রাখে না, তাঁর মৃত্যু সমগ্র বাঙালি-জীবনকেই শূন্যতায় ভাসায়।
এর কারণ যে, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সকল কীর্তি ও গৌরব নিয়ে দূরবর্তী একজন হয়ে যান নি। জীবনকালের আশি বছরে সৃষ্টি ও কীর্তিতে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন আমাদের নিবিড় আপনজন। জন্মেছিলেন কলকাতার নাগরিক কোলাহলে, সেখানে বেড়ে উঠেছেন, কিন্তু ভালবেসেছিলেন পল্লি বাংলাকে। কখনো পদ্মা বোটে, কখনো শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে, কখনো শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে কখনো পতিসরে বসবাস করে তিনি যে আনন্দ ও স্বস্তি পেয়েছেন, কলকাতা নগর কখনো তাঁকে সেরকম আনন্দ ও স্বস্তি দিতে পারে নি। তারই টানে তিনি বারবার ছুটে গেছেন নগর থেকে দূরে, নিভৃত পল্লিতে।
তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের প্রায় অর্ধেকটা তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন বীরভূমের শুষ্ক, রু পোড়োজমিতে প্রকৃত অর্থেই একটি ছায়াসুশীতল শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর কবিতা ’দুই বিঘা জমি’র ভিটেমাটি হারানো উপেনের চোখে নিভৃত এই পল্লি বাংলাকেই আমরা নতুন করে দেখি। পল্লি প্রকৃতির এই শান্ত শীতল রূপ উপেনের চোখ দিয়ে মূলত রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেখান। উপেন যা দেখে আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, একসময় আমরা অবাক হয়ে বুঝতে পারি, এই দেখা ও অনুভব করা আসলে সমগ্র বাঙালিরÑ
নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী জন্মভূমি!
গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ গগনললাট চুমে তব পদধূলি-
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন, রাখালের খেলাগেহ-
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল নিশীথশীতলস্নেহ।
বুক-ভরা-মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।
বৃহৎ বিশ্বের পথে জীবনে বহুবার পা বাড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু বারবার ফিরে ফিরে আমাদের কাছেই এসেছেন, স্বস্তি খুঁজেছেন বাংলার মাটিতে পা রেখে। আর যখন বিশ্বভ্রমণে দূরে গেছেন তখনও হৃদয়ে ধারণ করে রেখেছেন বাংলাদেশের নদী, মাঠ, ঘাট, নৈসর্গ। পিতার আদেশে জমিদারি দেখাশুনা করতে এসে পল্লি বাংলাকে তিনি আরও ভাল করে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই একসময় আমরা তাঁর সৃষ্টিতে, বিশেষ করে ছোটগল্পের বিষয়বস্তু বদলে যেতে দেখি; বলা বাহুল্য, এই বদলে যাওয়া রবীন্দ্রসাহিত্যের ক্ষেত্রে বিপুল বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়েছিল বলেই রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বাঙালি জীবনের মর্মমূলে ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন।
তাই নিমতলা শ্মশান ঘাটে, ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণের রাতে, তখন আকাশে শ্রাবণের য়া চাঁদের পূর্ণিমা ছিল কিনা কে জানে; একদিকে যখন রবীন্দ্রনাথের পার্থিব দেহখানা উজ্জ্বল আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল তখন, ‘নিমতলা ঘাটের বাইরে উদ্ভ্রান্ত কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত হিরণকুমার সান্যালকে বলেছিলেন, হাবুল, It makes going to a defference. And what a defference. আর আজও আমার মনে হয়, ’ সত্যি সত্যি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই সুদূরদর্শী উচ্চারণ ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ রাতের পর থেকে যত দিন গেছে সমগ্র বাঙালি-জীবন আরও বেশি করে অনুভব করেছে। তবে এটাও ঠিক, রবীন্দ্রনাথবিহীন বিগত প্রতিটি দিনরাতে রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপনার সঙ্গে আরও বেশিভাবে অনুভববেদ্য হয়ে ওঠেছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।