দিশেহারা বাংলাদেশের জকিগঞ্জ সীমানে-র অদূরে বরাক নদের টিপাইমুখে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাঁধ নির্মাণের প্রস'তি চূড়ান- করেছে। বাঁধটি নির্মিত হলে সিলেট অঞ্চলের দুই কোটি মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উৎসস'ল ভারতের মনিপুর রাজ্যের চন্দ্রচূূড় জেলায় টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ প্রস'তির কারণে সিলেট ও পাশের জেলাসহ পূর্বাঞ্চলের বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভারত কর্তৃক টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করায় সুরমা ও কুশিয়ারা তীরের লাখো মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। এখানকার কৃষক পরিবারগুলোতেও নেমে এসেছে হতাশা।
কারণ নদীভাঙনে বসতভিটা হারানোর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কৃষিজমিও ভাঙনের কবলে পড়বে। সেখানে বাঁধ নির্মাণ করে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স'াপন করতে চায় ভারত। ইতোমধ্যে এ কাজের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে এনএইচপিসি, এসজেবিএন ও মনিপুর রাজ্য সরকার গত ২২ অক্টোবর একটি বিনিয়োগ চুক্তি সই করে বলে জানা গেছে। নয় হাজার ২১১ কোটি টাকার প্রাক্কলিত ব্যয়ের এ প্রকল্প শেষ হবে ৮৭ মাসে।
এ প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছয়টি ইউনিট থাকবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিপাইমুখ বাঁধ এতদঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ হলে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে সিলেটের বিস-ীর্ণ এলাকায় বিপর্যয় নেমে আসবে। এ অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনসহ সুরমা, কুশিয়ারা ও প্রমত্তা মেঘনা নদীর পাশের এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী এবং এ দু’টি নদীর মিলিত স্রোতধারা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
এর ফলে ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমা ও ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ কমে যাবে। নদীগুলো ভরাটের ফলে উজান থেকে নেমা আসা পাহাড়ি ঢলে ফসলহানি ঘটবে আগেকার তুলনায় বেশি। শুষ্ক মওসুমে নদীর পানি হ্রাস পেলে নৌচলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।
জানা যায়, ভারত সরকার ১৯৯০ সালে প্রথম টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এরপর ১৯৯৬ সালে ভারত সরকার আবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়।
ভারতের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অধীন নিপকো কোম্পানি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস-বায়নের কাজ পায়। যদিও পরে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রাপ্তিতে কিছুটা বিলম্ব হয়। এ দিকে ভারত কর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা ও কুশিয়ারা-তীরবর্তী লাখ লাখ মানুষ নদীভাঙনে নিঃস্ব হবে। ইতোমধ্যে এই দুই নদীর ভাঙনে তীরবর্তী ২০ সহস্রাধিক মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছে।
এ দিকে টিপাইমুখ বাঁধের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন।
বিগত সময়ে সাবেক মন্ত্রী এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে নৌমার্চ, সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্বে লংমার্চ, পেশাজীবী নারীদের নেতৃত্বে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনও টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা করে সভা-সমাবেশ ও মিছিল করেছে। সিলেটের সব ক’টি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। সীমান-বর্তী সব উপজেলায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। বিগত দিনে সিলেট থেকে নির্বাচিত এমপি ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদার, মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানসহ অনেকেই টিপাইমুখ বাঁধের অপকারিতা নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেছেন।
সীমান- ও নদী-তীরবর্তী এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের দাবি, সরকার যেন জকিগঞ্জের অদূরে মরণবাঁধ টিপাই নির্মাণ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।
সিলেটে বিভিন্ন সংগঠনের মিছিল ও সমাবেশ
সিলেট ব্যুরো জানায়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারত সরকারের চুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন সিলেটবাসী। গতকাল সিলেট নগরীতে টিপাই বাঁধ নির্মাণ বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। সমাবেশে বক্তারা টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেন, এই টিপাইমুখ বাঁধের ভয়াবহতা পরমাণু বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।
টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলনের উদ্যোগে গতকাল বিকেলে নগরীর কোর্ট পয়েন্টে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ সরকারের নতজানু পররাষ্ট্র নীতির কারণেই ভারত আবারো টিপাই বাঁধ নির্মাণের অপতৎপরতা শুরু করেছে।
সমাবেশে টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধ আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট বেদানন্দ ভট্টাচার্য, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ, শহীদুল ইসলাম শাহীনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অপচেষ্টার প্রতিবাদে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে গতকাল বিকেলে মানববন্ধন করেছে মুক্তস্বর সাংস্কৃতিক ফোরাম। মানববন্ধন চলাকালে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ফোরামের আহ্বায়ক ফায়জুর রহমান।
টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের অপচেষ্টার প্রতিবাদে সিলেট জেলা ছাত্র জমিয়ত গতকাল নগরীতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি বন্দরবাজার থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
এ দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সিলেট মহানগর, জেলা দক্ষিণ ও জেলা উত্তর শাখার উদ্যোগে গতকাল ভারত সরকারকর্তৃক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চুক্তিতে সই করার প্রতিবাদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা বলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্বল ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারত সরকার মরণফাঁদ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ চুক্তিতে সই করেছে। এই টিপাইমুখ বাঁধের ভয়াবহতা পরমাণু বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। তারা বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো চুক্তিতে তার সরকার সই করবে না। কিন' শেষ পর্যন- ভারত চুক্তি সইর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে এবং প্রমাণ করেছে প্রকৃতপক্ষে তারা বাংলাদেশের বন্ধু নয়।
অবিলম্বে ওই চুক্তি বাতিল না করলে জামায়াত অতীতের মতো সিলেটবাসী তথা সারা দেশের দেশপ্রেমিক জনতাকে সাথে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিতে বাধ্য হবে।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য ও সিলেট মহানগরীর আমির অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের সভাপতিত্বে ও মহানগর সেক্রেটারি সিরাজুল ইসলাম শাহীনের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন মহানগর নায়েবে আমির ডা: সায়েফ আহমদ, জেলা দক্ষিণ আমির মাওলানা হাবীবুর রহমান, নায়েবে আমির অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নান, সেক্রেটারি মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, জেলা উত্তর জামায়াতের আমির হাফেজ মাওলানা আনোয়ার হোসাইন খান, সেক্রেটারি উপাধ্যক্ষ সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার, মহানগর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফখরুল ইসলাম, মাওলানা সোহেল আহমদ প্রমুখ। সভায় বক্তারা আরো বলেন, টিপাইমুখ নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। বাংলাদেশের মানুষের অসি-ত্ব রক্ষার স্বার্থে বাঁধের বিরুদ্ধে দেশে ও বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
এই অবস্তায় সরকার টিপাইমুখে বাঁধ নিয়ে বিরোধীদলের সাথে রাজনৈতিক ইস্যু বানাচ্ছে।
হায় ! সেলুকাস!! কি বিচিত্র এই দেশ !!! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।