পরীক্ষামূলক সম্প্রচার ... ... !!! (প্রথমেই বলা দরকার এই পোস্টের সকল চরিত্র বাস্তব এবং কারো নামের সাথে বাস্তব মানুষটির মিল খুঁজে না পাওয়াটিই অস্বাভাবিক!!)
বুয়েট বন্ধ।
কারণ? - শিক্ষক সমিতির স্ট্রাইক।
স্ট্রাইকের কারণ কি?
প্রথমে জানতাম কারণ হল শিক্ষকদের অবসরের বয়স বাড়ানো। কিন্তু তারপর বুয়েটিয়ানদের ফেসবুক স্ট্যাটাস মারফত জানা গেলো "বুয়েটের ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম'-এ এই স্ট্রাইক। কিন্তু তারপর আবার শিক্ষক সমিতির প্রচারিত প্রেস রিলিজে দেখি আগের কথারই প্রতিধ্বনি!! বয়স বাড়ানো!!! পাশাপাশি অবশ্য আরও কিছু কারণ তাঁরা তুলে ধরেছেন।
দলীয়করণ, পদোন্নতি, রাজনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে লিখছি সেসব কথা। যদিও কারণ হিসাবে ওগুলাই অনেক বেশি স্ট্রং!!! অন্তত স্টুডেন্টদের কাছে তো বটেই!!!
গত সপ্তাহ থেকেই ব্লগ ফেসবুক মেতে আছে বুয়েটে কি হচ্ছে এ নিয়ে। কিন্তু প্রথমে আসলে কারো বক্তব্যই ঠিক মতো জানার উপায় ছিলোনা। পরে অবশ্য বেশ কয়টা প্রেস রিলিজ আসায় কারণ কিছুটা বুঝতে পারলাম।
আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা চিঠি হাতে আসায় আরও কিছু জিনিস জানতে পারলাম। হাতের কাছে অ্যাভাইলেবল কাগজগুলাই ঘেঁটে জানার চেষ্টা করলাম শিক্ষক সমিতির কি বক্তব্য আর প্রশাসনের জবাবই বা কি!!
কিন্তু তাদের বক্তব্যগুলা পড়ে যা বুঝলাম ঘটনার পিছনের ঘটনা অনেকদিনের। প্যাঁচগোজও কম না। সবচেয়ে প্যাথেটিক বিষয় মনে হইসে দুইটা প্রেস রিলিজেই ঘটনা প্রবাহকে নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করা হইসে। প্রথমে ভাবলাম পেন্সিল দিয়া দাগাদাগি কইরা ঘটনাগুলা সাজাতে চেষ্টা করি, পরে বুঝলাম কম্মখানা মোটেও সুবিধার না!!
তাই, এইবার বিভিন্ন ঘটনার তারিখ ধরে ধরে চেষ্টা করলাম পুরা ঘটনার একটা টাইমলাইন তৈরি করতে।
ব্র্যাকেটে আমার নিজস্ব মতামতগুলাও অ্যাড করে দিলাম!!
১৯৬২
বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু তৎকালীন ইপুয়েটের। শুরুর বছর থেকেই অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। তবে ৬০ বছর হল অবসরের প্রকৃত বয়স, আর পরের পাঁচ বছর তিন ধাপে ২+২+১ বছর করে সিন্ডিকেটের অনুমোদনসাপেক্ষ।
(সিন্ডিকেটে বুয়েটের ভিসি, প্রোভিসি, ডিন, বাইরের ভার্সিটির কয়েকজন টিচার, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাসহ ১০ জনের মতো মেম্বার থাকে। উনারা অনুমোদন দিলে অবসরের বয়স বাড়ে।
নয়তো ৬০ এর পরে অবসরে যেতে হয়। )
১৯৬২ থেকে ১৯৯৭
কোন ঘটনার উল্লেখ নাই!!
(অবশ্য মাঝে ৭১ এ দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। ইপুয়েটও নাম বদলে হয়েছে বুয়েট!
অবশ্য এর মাঝে ৮০ সালে বুয়েটের ফ্যাকাল্টি বাড়ানো হয়। পরিবর্তন আসে আরো কিছু আইনকানুনে। )
১৯৯৮
ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ করার জন্য ঢাবি এককভাবে প্রচেষ্টা শুরু করে।
কিন্তু বুয়েট প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে নাকি শিক্ষকদের অবসরের বয়স বাড়েনি।
(ঢাবিতে উদ্যোগ কার ছিলো?? শিক্ষক সমিতির, না প্রশাসনের??? আর ঢাবি প্রশাসন তখন পারলে কেন বুয়েট প্রশাসন এখনও পারছেনা???
তবে যদ্দুর জানি ৯৮ থেকেই ঢাবি, রাবি, জাবি, চবি শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫ বছর করা হয়। )
২০০৮
২৯ ডিসেম্বরঃ
বুয়েট সিন্ডিকেটে স্ট্যাটুটস ৪৩ সংশোধনের প্রস্তাব পাশ
(স্ট্যাটুটস ৪৩ এই অবসরের বয়সসীমা নিয়া নীতিমালা আছে। )
৩১ ডিসেম্বরঃ
সংশোধনের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ
(এইখানেই আসলে ঝামেলার শুরু!! সিন্ডিকেট নিজেই যদি সংশোধনের ক্ষমতা রাখে তাহলে মন্ত্রণালয়ে পাঠাইতে হইলো ক্যান??)
২০০৯
২৩ মার্চঃ
মন্ত্রনালয় জানায় যে সংশোধন করা সম্ভব নয়। ফলে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
(কেন সম্ভব হয়নি? সুনির্দিষ্ট উত্তর নাই। আর কেনইবা তখন প্রশাসন আর কোন উদ্যোগ নেয়নি? শিক্ষক সমিতি তখন কি ভূমিকা রাখসিলো?? কোনটারই জবাব মিলেনি!!)
২০১০
মেঃ
রাষ্ট্রপতি এই বিষয়ে মৌখিক নির্দেশ আর প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় আশ্বাস দেয়।
(কাদের কাছে?? সঠিক জবাব পাইনি। )
২৩ সেপ্টেম্বরঃ
রাষ্ট্রপতিকে ভিসি, প্রোভিসির অনুরোধ জানায় অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার জন্য।
(এটা কিন্তু নতুন ভিসি আসার পরের ঘটনা।
)
২০১১
৩ ফেব্রুয়ারিঃ
সমাবর্তনে বয়স বাড়ানো সংক্রান্ত বিষয়াবলী প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়।
১০ বা ২৩ এপ্রিলঃ
শিক্ষক সমিতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে যেখানে প্রধানমন্ত্রী বয়স বাড়ানোর কথা বলে।
(যদি সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তই সব হয় তাহলে শিক্ষক সমিতি প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর কি দরকার ছিল?? আর তারিখ নিয়েও একটা কনফিউশান আছে। সমিতি আর প্রশাসনের বক্তব্যে দুই তারিখ পাওয়া গেছে!!)
২০ মেঃ
সিন্ডিকেট বয়স বাড়ানোর জন্য সরকারকে চিঠি দেবার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার জন্য সচিবালয়ে চিঠি দেয়।
(যদিও পরে মন্ত্রণালয় জানায় যে প্রজ্ঞাপন জারি কইরা বয়স বাড়ানো যাবেনা।
কথা হইল যে, প্রশাসন কি সেটা আগে থেকে জানতো না ব্যাপারটা??? অবশ্য প্রশাসনই যদি না জানে যে কে কিভাবে এটা সিদ্ধান্ত দিতে পারে, তাহলে তো কথাই নাই!! )
জুলাইঃ
মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বয়স বাড়ানোর বিষয়ে উপাচার্যকে আশ্বস্ত করেন।
২১ জুলাইঃ
শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে ভিসি এ বিষয় উপস্থাপন করেন। তিনিও চেষ্টা করার আশ্বাস দেন।
(এতজন এতো এতো আশ্বাস দিতেসে তবুও ক্যান এটা সল্ভ হয়না??? )
২৭ আগস্টঃ
সব ভার্সিটির টিচারদের বয়স বাড়ানোর জন্য মঞ্জুরি কমিশনের তৈরি করা আইনের খসড়া শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়। বুয়েট থেকে বলা হয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করার জন্য।
কিন্তু শিক্ষামন্ত্রি জানান যে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটা চেঞ্জ করা যাবেনা।
(তার মানে হল বুয়েটের টিচারদের বয়স বাড়ানোর জন্য আলাদাভাবে কিছুই সরকার করছেনা?! সবার জন্য করছে, তাই সবার বাড়লে বুয়েটের বাড়বে; যতক্ষণ সবার জন্য আইন তৈরি না হবে ততক্ষণ বুয়েটেরও কিছু হবেনা?!)
১৮ বা ১৯ অক্টোবরঃ
স্ট্যাটুটস ৪৩ সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে আবার চিঠি দেয়া হয়।
১৬ নভেম্বরঃ
শিক্ষা মন্ত্রনালয় এক "অতি জরুরী" বার্তায় জানায় যে দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর করতে ইতোমধ্যে অর্থবিভাগের সম্মতিসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি খসড়া প্রণয়ন করেছে। এখন বিভিন্ন মন্ত্রনালয় থেকে মতামত চাওয়া হয়েছে। তাই "এমুহূর্তে বুয়েটের সংশ্লিষ্ট সংবিধির অনুচ্ছেদ ৪৩ এ পৃথকভাবে সংশোধনী আনয়নের কোন প্রয়োজন নেই।
"
(এবং কাকতালীয়ভাবে এই দিন থেকেই কিন্তু টিচারদের স্ট্রাইকে যাওয়ার কথা ছিল!! পুরাই বাংলা সিনামার কাহিনী!! যেদিন স্ট্রাইকে যাওয়ার কথা ঐদিনই নোটিশ চলে আসলো!!!)
২১ নভেম্বরঃ
সকালঃ ডিনরা শিক্ষক সমিতির প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়।
দুপুর বা বিকালঃ স্ট্রাইকের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
সন্ধ্যাঃ ডিন, বিভাগীয় প্রধান, প্রভোস্টদের নিয়ে ভিসি স্যার মিটিং করে।
(তবে মিটিঙে কি সিদ্ধান্ত হয় এ নিয়ে দ্বিমুখী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসন বলছে এই মিটিঙের বক্তব্যই তাঁরা প্রেস রিলিজ আকারে প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে স্যাররা বলছে যে এ মিটিঙে অনুরোধ করা হয় স্যারদের দাবি সিন্ডিকেটের সভায় মেনে নিতে। আল্লাহই মালুম আসলে মিটিঙে কি হইসে!! আরও একটা বিষয় হল প্রশাসনের প্রেস রিলিজে এ মিটিঙের তারিখ বলা হইসে ১৮ অক্টোবর!! ধরে নিচ্ছি সেটা টাইপিং মিস্টেক ছিল। )
২২ নভেম্বরঃ
সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় স্যারদের স্ট্রাইক।
সংক্ষেপে(!) এই হল বয়স বাড়ানো নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ঘটা ঘটনাগুলোর সার সংক্ষেপ!!
এখন স্যাররা স্ট্রাইকের কারণ যে দাবিগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো নিয়ে দুয়েকটা কথা বলি। প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষক সমিতি তাদের বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট করে কোন দাবির কথা বলেনি।
তারপরেও যেসব কথা বলেছেন সেগুলো পয়েন্ট করলে দাঁড়ায়-
১) রেজিস্ট্রার নিয়োগ,
২) পদোন্নতি,
৩) দলীয়করণ,
৪) বিতর্কিত কমিটি গঠন,
৫) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাঁদাবাজি,
৬) ফলাফলে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ,
৭) প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষক নিয়োগ।
এখন একটা জিনিস খেয়াল করা যায় যে, এখানে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হলগুলোতে বা ক্যাম্পাসে ঘটা বিভিন্ন স্টুডেন্ট অকারেন্সের বিষয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে কিছু বলা হয়নি। আশা করেছিলাম শিক্ষক সমিতি এই বিষয়টাকেও সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে।
আর প্রশাসনের বক্তব্যের সুর মিলে গেলেও বলতেই হয় যে জুন মাসের আগে যখন নতুন করে কেউ অবসরে যাচ্ছেনা, তখন এই নভেম্বরে ক্লাশ বর্জনের মতো হার্ডলাইনে যাওয়ার মানে কি??
তবে এর সবচেয়ে ভালো জবাবটা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সেজন্য যে সময় অপচয় হয় সেটা মাথায় রেখেই দেয়া হয়েছে এ কর্মসূচি।
প্রশাসন সম্পর্কে নতুন করে বলার অবশ্য কিছু নাই।
একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে, তবু নির্বিকার প্রশাসনযন্ত্র। তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে, কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়ার নাম গন্ধ নাই। দাবি করা হচ্ছে শাস্তি দেয়ার, কিন্তু কোন বিজ্ঞপ্তি নাই!! নাই সচেতনতা বৃদ্ধির কোন চেষ্টা। বরং দুর্নীতি, দলীয়করণ আর অযোগ্যতার অভিযোগে বেসামাল অবস্থা পুরো প্রশাসনের। রেজিস্ট্রার নিয়োগ নিয়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট অভিযোগে ইতোমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ এর ভূমিকা।
তাই, প্রশাসনের উচিত যথাযথ ভূমিকায় ফিরে আসার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ফিরে পাওয়া। নয়তো শিক্ষকদের শুরু করা এই আন্দোলন বহুমুখী রূপ ধারণ করার মাধ্যমে নাড়িয়ে দিতে পারে ক্ষমতার ভিত্তিমূল।
সবশেষে বলতে হয়, এতো সব ঘটনা, যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু সামনে ঘটতে পারে, তার ভিকটিম কিন্তু আর কেউ না - সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যারা বিশাল স্বপ্নের ডালি হাতে নিয়ে এসে বলির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত...
পরের পর্বঃ চলমান ঘটনাবলী ০১ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।