আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারাবী বিশ রাকাত পড়া সুন্নত

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঝে মধ্যে সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তারাবী পড়েছেন। কত রাকাত পড়েছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে হযরত উমর রা. এর খেলাফতের দ্বিতীয় বছর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবী পড়া হয়ে আসছে। এ দীর্ঘ সময় কোথাও আট রাকাত পড়ার প্রচলন ছিলনা। আমরা যাদেরকে লা-মাযহাবী বলি এরা ইংরেজ আমলে সৃষ্ট।

প্রথম প্রথম এদের অনেকেই বিশ রাকাত তারাবী পড় গেছেন। সর্বপ্রথম ১২৮৪ হিজরী সালে ভারতের আকবরাবাদ থেকে এদের একজন আট রাকাত তারাবীর ফতোয়া দেন। তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া টিকতে পারেনি। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী নামে এদের আরেক জন ফতোয়া দেন যে, আট রাকাত তারাবী পড়া সুন্নত। বিশ রাকাত পড়া বেদাত।

তার ফতোয়ারও তীব্র বিরোধিতা হয়। এমনকি তাদেরই একজন বিখ্যাত আলেম মাওলানা গোলাম রাসূল ঐ ফতোয়ার খন্ডনে ‘রিসালা তারাবী’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। ১২৯০ সালে সেটি প্রকাশিত হয়। (দ্র.রাসায়েলে আহলে হাদীস, ২খ, ২৮ পৃ)। কিন্তু এতেও আটের ফতোয়া বন্ধ হয়নি।

পরবর্তীতে হাফেজ আব্দুল্লাহ সাহেব ও মাওলানা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী সহ এদের আরো কিছু আলেম জোড়ালোভাবে ঐ ফতোয়া প্রচার করতে থাকেন। আলেমদের পক্ষ থেকে মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী র. মাওলানা কাসেম নানুতুবী র. ও পরবর্তীতে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী র. প্রমুখ স্বতন্ত্র পুস্তিকা লেখে তাদের ফতোয়া খন্ডন করেন। ভারতবর্ষের পরে আরবেও দু’একজন আটের ফতোয়া দিতে শুরু করেন। হারামাইন শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবী অব্যাহত থাকলেও সর্বপ্রথম সেখানে শায়খ নসীব রেফায়ী একটি পুস্তিকা লিখে আট রাকাতের ফতোয়াকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। শায়খ নাসীরুদ্দীন আলবানীও তার সমর্থন করেন।

এর খন্ডনে আরব জাহানের কয়েকজন আলেম কলম ধরেন। একাধিক আলেমের রচনার সমষ্টি الإصابة في الانتصار للخلفاء الراشدين والصحابة নামে প্রকাশিত হয়। সেখানে তাঁরা লিখেছেন, ولم يشذ أحد منهم بمنعها غير هذه الشرذمة القليلة التي ظهرت في زماننا كالشيخ ناصر وإخوانه অর্থাৎ আমাদের যুগে আত্মপ্রকাশকারী নাসিরুদ্দীন আলবানী ও তার সমর্থকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া কেউই অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেননি। (দ্র, পৃ, ৬১) এ পুস্তিকাটির খন্ডনে আলবানী সাহেব ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করে ১৩৭৭ হি. সালে প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটিতে আলবানী সাহেবের উসূলে হাদীস (হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি), উসূলে ফিক্হ (ফিকাহ শাস্ত্রের মূলনীতি), রিজাল শাস্ত্র (হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনীমূলক গ্রন্থ) ও জারাহ-তাদীল (বর্ণনাকারীদের সমালোচনা) সম্পর্কিত মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের অপরিপক্কতা ও দৈন্যতা সুস্পষ্ট রূপে ফুটে উঠেছে।

তদুপরি তিনি সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীগণের কোন একজনকেও দেখাতে পারেননি, যিনি আট রাকাত তারাবীর কথা বলেছেন। এমনিভাবে এমন কোন ঐতিহাসিক মসজিদের নজিরও দেখাতে পারেননি যেখানে আট রাকাত তারাবী হতো। এতদ্সত্তেও আমাদের লা-মাযহাবী বন্ধুরা আলবানী সাহেবের গবেষণাকেই চুড়ান্ত জ্ঞান করে তারই অন্ধ অনুসরণ শুরু করেছে। অধিকন্তু আলবানী সাহেব যা করতে পারেননি অর্থাৎ বর্ণনাকারীদের নাম বিকৃত করা, বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীকে অবিশ্বস্ত আখ্যা দেওয়া, ভুল উদ্ধৃতি দেওয়া ও কোন গ্রন্থের নাম ভুল উচ্চারণ করা ইত্যাদি কাজেরও লজ্জাস্কর নজির স্থাপন করেছেন তাদেরই অনুদিত বুখারী শরীফের টীকায়। কবিগুরু সুন্দর বলেছেন, বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ।

আলবানী সাহেবের পুস্তিকাটির দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সাবেক গবেষক মুহাদ্দিস শায়খ ইসমাঈল আনসারী। তার কিতাবটির নাম- ‘তাসহীহু হাদীসি সালাতিত তারাবী ইশরীনা রাকআতান ওয়ার রাদ্দু আলাল আলবানী ফী তাযয়ীফিহী’। একইভাবে সৌদি আরবের বিখ্যাত আলেম, মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুদাররিস ও মদীনা শরীফের সাবেক কাযী শায়খ আতিয়্যা সালিম ‘আততারাবীহ আকছারু মিন আলফি আম’ নামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সৌদির আরেকজন খ্যাতনামা আলেম, বহুগ্রন্থ প্রনেতা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবূনী সাহেবও এ বিষয়ে ‘আততারাবী ইশরূনা রাকআতান’ নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। আর লা-মাযহাবী আলেম মোবারকপুরী সাহেবের খন্ডনে কলম ধরেছেন বিগত শতকের সেরা মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আজমী র. - মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, সুনানে সাঈদ ইবনে মানসূর, মুসনাদে হুমায়দী সহ বহু হাদীসগ্রন্থ সম্পাদনাপূর্বক যিনি পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন এবং আরব বিশ্বের বড় বড় আলেম শায়খ মুসতাফা যারকা, শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ, নাসিরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ যার কাছ থেকে হাদীসের ইজাযত হাসিল করেছেন।

‘রাকআতে তারাবী’ নামে উর্দূ ভাষায় তিনি অত্যন্ত সারগর্ভ ও তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এটি সর্বপ্রথম ১৩৭৬ হিজরী সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমাদের ঐসব বন্ধুরা উল্লিখিত গ্রন্থগুলো পড়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করেননা। যাহোক , ভূমিকা-স্বরূপ লেখা এ কথাগুলো দীর্ঘ হয়ে গেল। এখন আমি বিশ রাকাত তারাবীর প্রমাণগুলো উপস্থাপন করবো।

এবং সবশেষে আট রাকাতের প্রমাণগুলো সম্পর্কেও কিছু পর্যালোচনা পেশ করবো। আমার নিজস্ব রুচি ভিন্ন থাকলেও এখানে তাদের অনুদিত বুখারী শরীফের টীকার ধারাবাহিকতা যথাসম্ভব রক্ষা করে আলোচনার প্রয়াস পাব। ১নং দলিল: ইবনে আবী শায়বা র. বলেন, حدثنا يزيد بن هارون قال انا ابراهيم بن عثمان عن الحكم عن مقسم عن ابن عباس أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة والوتر . অর্থ: আমাদের নিকট ইয়াযীদ ইবনে হারূন বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদেরকে ইবরাহীম ইবনে উসমান জানিয়েছেন হাকামের সূত্রে, তিনি মিকসামের সূত্রে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবী ও বিতর পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৭৪; তাবারানী , আল কাবীর, হাদীস নং ১২১০২; আল আওসাত, হাদীস নং ৭৯৮; বায়হাকী, ১/৪৯৬। এ হাদীসটির সনদে আবূ শায়বা ইবরাহীম ইবনে উসমান আছেন, তিনি যয়ীফ বা দূর্বল।

এ কারণে বায়হাকী র.সহ অনেকেই এই হাদীসকে যয়ীফ বলেছেন। কিন্তু আলবানী সাহেব ও তার অনুসারী লা-মাযহাবী বন্ধুরা এটিকে ‘মাওযূ’ বা জাল আখ্যা দিয়েছেন। অথচ পূর্ববর্তী কোন মুহাদ্দিসই এটিকে জাল আখ্যায়িত করেননি। জাল ও যয়ীফের মাঝে দুস্তর ব্যবধান। জাল হাদীস তো হাদীসই নয়।

আর যয়ীফ হাদীসকে প্রায় সকল মুহাদ্দিসই শর্ত সাপেক্ষে ফযিলতের ক্ষেত্রে, ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে ও রিকাক বা চিত্তবিগলনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন। আর আহকাম বা বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যয়ীফকে দুভাগে ভাগ করেছেন। এক. এমন যয়ীফ হাদীস, যার সমর্থনে কোন শরয়ী দলিল নেই, বরং এর বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক। এ ধরণের যয়ীফ আমলযোগ্য নয়। দুই. সনদের বিবেচনায় হাদীসটি যয়ীফ বটে, তবে এর সমর্থনে শরয়ী দলিল প্রমাণ আছে, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের যুগ থেকে এ হাদীস অনুসারে আমল চলে আসছে।

এমন যয়ীফ হাদীস শুধু আমলযোগ্যই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা মুতাওয়াতির বা অসংখ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসের মানোত্তীর্ণ। ‘আল আজবিবাতুল ফাযিলা’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ র. এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। হাফেজ ইবনুল কায়্যিম র. তার ‘কিতাবুর রূহ’ গ্রন্থে একটি যয়ীফ হাদীস সম্পর্কে বলেছেন, فهذا الحديث وإن لم يثبت فاتصال العمل به في سائر الأمصار والأعصار من غير إنكار كاف في العمل به অর্থাৎ এ হাদীসটি প্রমাণিত না হলেও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোন রূপ আপত্তি ছাড়া এ অনুযায়ী আমল চালু থাকাই হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। (দ্র, পৃ,১৬) ইমাম যারকাশী র. তাঁর হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘আননুকাত’ এ বলেছেন, إن الحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول عمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر অর্থাৎ যয়ীফ হাদীসকে যখন উম্মাহ ব্যাপকভাবে গ্রহন করে নেয়, তখন সঠিক মতানুসারে সেই হাদীসটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তা মুতাওয়াতির হাদীসের মানে পৌঁছে যায়। (দ্র, ১খ, ৩৯০ পৃ) হাফেজ শামসুদ্দীন আসসাখাবী র.ও তাঁর ‘ফাতহুল মুগীছ’ গ্রন্থে লিখেছেন, وكذا إذا تلقت الأمه الضعيف بالقبول يعمل به على الصحيح حتى أنه ينزل منزلة المتواتر في أنه ينسخ المقطوع به ولهذا قال الشافعي رحمه الله في حديث لا وصية لوارث إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول وعملوا به حتى جعلوه ناسخا لآية الوصية. অর্থাৎ উম্মাহ যখন যয়ীফ হাদীসকে ব্যাপকহারে গ্রহন করে নেয়, তখন সহীহ মত অনুসারে সেটি আমলযোগ্য হয়, এমনকি তার দ্বারা অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেটি মুতাওয়াতির দলিলের মানোত্তীর্ণ হয়।

এ কারণেই ইমাম শাফেয়ী র. ‘উত্তরাধিকারীর জন্যে কোন ওসিয়ত নেই’ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন, হাদীস বিশারদগণ এটিকে সুপ্রমাণিত মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটি গ্রহণ করে নিয়েছেন, এ অনুযায়ী আমল করেছেন, এমনকি তারা এটিকে ওসিয়ত সম্পর্কিত আয়াতটির বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন। (দ্র,১খ, ৩৩৩পৃ) আমাদের আলোচ্য হাদীসটি এই দ্বিতীয় প্রকার যয়ীফের অন্তর্ভূক্ত। সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মাহর ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন আমল এ অনুযায়ী চলে আসছে। সুতরাং উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে এটি অবশ্যই আমলযোগ্য বলে গণ্য হবে। এটিকে জাল আখ্যায়িত করা হাদীস শাস্ত্রের স্বীকৃত মূলনীতি উপেক্ষা করারই নামান্তর।

১ ১. আলবানী সাহেব তিনটি কারণে এই হাদীসকে জাল আখ্যায়িত করেছেন। এক, এটি হযরত আয়েশা রা. ও হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসের বিপরীত। এর জবাবে আমরা বলবো, হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে, আর এটি তারাবী সম্পর্কে। সুতরাং দুটির মধ্যে কোন বিরোধ নেই । তাছাড়া হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসে এগারো রাকাতের উল্লেখ এসেছে।

তার আরেকটি বর্ণনায় তেরো রাকাতের উল্লেখ এসেছে। এই দুটি বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে আলেমগণ বলেছেন, এগারো রাকাত সাধারণ আমল ছিল। আর তের রাকাত মাঝে মধ্যে পড়তেন। একইভাবে বলা চলে, বিশ রাকাতও মাঝে-মধ্যে পড়া হয়েছিল। তের রাকাত যেমন এগারো রাকাতের বিপরীত নয়, তেমনি বিশ রাকাতও এগারো রাকাতের বিপরীত হবেনা।

আর হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসটি যয়ীফ। সুতরাং তার বিপরীত হওয়াতে কিছু আসে যায়না । এ সম্পর্কে আলোচনা শেষ দিকে আসছে। দুই, আবূ শায়বাকে হযরত শো’বা র. মিথ্যুক বলেছেন। আর বুখারী র. তার সম্পর্কে বলেছেন, سكتوا عنه- তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন অর্থাৎ তাঁরা তাকে বর্জন করেছেন।

আর এটা বুখারী র. এর কড়া সমালোচনামূলক শব্দ। উল্লেখ্য, লা-মাযহাবী বন্ধুরা ইমাম বুখারী র. এর কথাটির অনুবাদ করেছেন, ‘তার ব্যাপারে কেউ মত ব্যক্ত করেনি’। এটা ভুল অনুবাদ। এই দ্বিতীয় কারণটির জবাবে আমরা বলবো, মুহাদ্দিসগণের মধ্যে একমাত্র শো’বা র.ই তাকে মিথ্যুক বলেছেন, ....................................................................................................................................... এর কারণও তিনি এই বলে উল্লেখ করেছেন, আবূ শায়বা তার উস্তাদ হাকাম থেকে বর্ণনা করেছেন, সিফফীন যুদ্ধে সত্তর জন বদরী সাহাবী শরিক ছিলেন। শো’বা বলেন, সে মিথ্যা বলেছে।

আমি হাকামের সঙ্গে আলোচনা করে শুধু একজন বদরী সাহাবী পেয়েছি। তিনি হলেন হযরত খুযায়মা রা.। যাহাবী র. ‘মীযানুল ইতিদাল’ গ্রন্থে এটি উল্লেখ করে শো’বার কথাটি এই বলে খন্ডন করেছেন, سبحان الله أما شهدها علي أما شهدها عمار অর্থাৎ বড়ই আশ্চর্য! সিফফীনে কি হযরত আলী রা. শরিক ছিলেননা? হযরত আম্মার রা. শরিক ছিলেননা? (দ্র, ১খ, ৪৭পৃ) অর্থাৎ হযরত আলী রা. ও হযরত আম্মার রা. তো বদরী ছিলেন, তারাও তো সিফফীনে শরিক ছিলেন। তাহলে তো এখানেই তিনজন হয়ে গেল। খুঁজলে হয়তো এভাবে আরো অনেকের নাম বের হয়ে আসবে।

তাহলে শো’বা র. এর কথা ঠিক হলো কি করে? তাছাড়া শো’বা র. বলেছেন, কাযাবা যার একটি অর্থ হলো, মিথ্যা বলেছে। এ অর্থ ধরেই বলা হয়, শো’বা তাকে মিথ্যুক বলেছেন। অথচ এ শব্দটির এ অর্থও হতে পারে- ভুল বলেছে। এ অর্থে কাযাবা শব্দটির ব্যবহারের বহু নজির তুলে ধরা হয়েছে ‘আন-নিহায়া ফী গারীবিল হাদীস’ গ্রন্থে। এ অর্থটি গ্রহণ করলে ‘শো’বা তাকে মিথ্যুক বলেছেন’ সেটা প্রমাণিত হয়না।

আর ইমাম বুখারী র. এর মন্তব্য সম্পর্কে বলবো, এমন একাধিক নজির রয়েছে, যেখানে বুখারী র. ঐ মন্তব্য করা সত্ত্বেও সেই ব্যক্তির হাদীস গ্রহন করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াকিদ আবূ কাতাদার জীবনী দেখুন। বুখারী র. তার ব্যাপারে অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইমাম ইবনে আদী র. তার ‘আল কামিল’ গ্রন্থে তার সঙ্গে একমত হন নি। মুকাতিল ইবনে সুলায়মানের জীবনী দেখুন।

বুখারী র. উক্ত মন্তব্য করা সত্ত্বেও ইবনে আদী র. বলেছেন, له أحاديث صالحة তাঁর কিছু ভাল হাদীসও রয়েছে। আমাদের আলোচ্য আবূ শায়বা সম্পর্কেও ইবনে আদী র. লিখেছেন, له أحاديث صالحة وهو خير من إبراهيم بن أبي حية অর্থাৎ তার কিছু ভাল হাদীসও রয়েছে, তিনি ইবরাহীম ইবনে আবূ হাইয়্যার চেয়ে ভাল। (দ্র, তাহযযযীব, ১খ, ১৪৫পৃ) মোট কথা, আলবানী সাহেব আবূ শায়বা সম্পর্কে পূর্ণ ইনসাফ অবলম্বন করেননি। অন্যথায় ইবনে আদীর উপরোক্ত মন্তব্যও উল্লেখ করতেন। উল্লেখ করতেন ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. এর মন্তব্যও ।

ইয়াযীদ ইবনে হারূন ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও খ্যাতনামা হাফেজে হাদীস, তিনি বুখারী র. এর উস্তাদের উস্তাদও ছিলেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, ما قضى على الناس رجل يعني في زمانه أعدل في قضاء منه অর্থাৎ আমাদের যুগে তাঁর চেয়ে বড় ন্যায়পরায়ন কাজি (বিচারক) কেউ হন নি। উল্লেখ্য, আবূ শায়বা যখন ওয়াসিতের কাজি ছিলেন, তখন ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. তার প্রাইভেট সেক্রেটারী ছিলেন। সুতরাং তাকে কাছ থেকে যাচাই করার যেমন সুযোগ তার হয়েছিল তেমনটি অন্য কারো হয়নি। সুতরাং তার উক্ত মন্তব্য আবূ শায়বার ইলম ও ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে উজ্জল সাক্ষী।

কোন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে দুটি বিষয় বিশেষ লক্ষ্যনীয়। এক, তার দীনদারী ও ন্যায়পরায়নতা; দুই, তার মেধা ও স্মৃতিশক্তি। ইয়াযীদ র. এর সাক্ষ্যপ্রমাণে তার ন্যায়পরায়নতার বিষয়টি সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আর ইবনে আদীর বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, তার মেধাও এত খারাপ ছিলনা। তার কিছু ভাল হাদীসও পাওয়া গেছে।

স্মর্তব্য, আলোচ্য হাদীসটি ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. নিজেই আবূ শায়বা থেকে বর্ণনা করেছেন। আমাদের আলোচনার উদ্দেশ্য আবূ শায়বাকে নির্ভরযোগ্য আখ্যা দেওয়া নয়। বরং আলবানী সাহেব যে তার প্রতি পুরোপুরি ইনসাফ প্রদর্শন করেননি তা তুলে ধরা। আবূ শায়বা যয়ীফ হলেও তার হাদীসকে জাল আখ্যা দেওয়া যেতে পারে এমন পর্যায়ের নন। তাইতো আলবানী সাহেবের পূর্বে কেউ তার এই হাদীসকে জাল বলেননি।

বরং ইমাম বায়হাকী র. তারাবীর রাকাত সংখ্যার জন্যে যে অনুচ্ছেদ কায়েম করেছেন তার অধীনে আবূ শায়বার এ হাদীসটিও উল্লেখ করেছেন। তিন, আলবানী সাহেব এও উল্লেখ করেছেন, আবূ শায়বার হাদীসে বলা হয়েছে, নবী স. রমযান মাসে জামাত ছাড়া নামায পড়েছেন। এটি হযরত জাবের রা. ও হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসের বিরোধী। (পরের পৃষ্ঠায় দেখুন) ২নং দলিল: ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. বর্ণনা করেন: عن السائب بن يزيد قال: كانوا يقومون على عهد عمر بن الخطاب في شهر رمضان بعشرين ركعة অর্থ: হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেছেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম রমযান মাসে বিশ রাকাত পড়তেন। ( বায়হাকী , আসসুনানুল কুবরা ২/৪৯৬) ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফার নীচে বায়হাকী পর্যন্ত এই হাদীসের দুটি সনদ আছে।

একটি সনদ ইমাম বায়হাকী তার ‘আসসুনানুল কুবরা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অপর সনদটি তিনি উল্লেখ করেছেন তার ‘আল-মারিফা’ গ্রন্থে। প্রথম সনদে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন ইমাম নববী, ওয়ালিউদ্দীন ইরাকী, বদরুদ্দীন আয়নী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী ও আল্লামা নিমাভী হিন্দী র. প্রমুখ। আর দ্বিতীয় সনদে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন তাজুদ্দীন সুবকী ও মোল্লা আলী কারী প্রমুখ। তার মানে মূল হাদীসটি সাত জন বড় বড় মনীষীর দৃষ্টিতে সহীহ।

(দ্র, নবীজীর নামায, পৃ ৪০৯, রাকাতে তারাবী, পৃ ৫৪)। মোবাকরকপুরী ও আলবানী সাহেবের পূর্বে কোন মনীষী এই হাদীসকে যয়ীফ বলেননি। লা-মাযহাবী বন্ধুরা প্রথম সনদটির কথা উল্লেখই করেননি। দ্বিতীয় সনদটি এনে .............................................................................................. তার মানে হযরত আয়েশা ও হযরত জাবির রা. এর হাদীসে জামাতের সঙ্গে নামায পড়ার কথা আছে, আর আবূ শায়বা বর্ণিত এ হাদীসে জামাত ছাড়া নামায পড়ার কথা বলা হয়েছে। ব্যাস, তাই এটি জাল।

এমন কথা কোন আলেমের মুখে শোভা পায়না। প্রথমত, ইবনে আবী শায়বা, আবদ ইবনে হুমায়দ ও তাবারানীর কাবীর ও আওসাত গ্রন্থে এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। সেখানে জামাত ছড়া কথাটি নেই। শুধু বায়হাকীর বর্ণনায় একথার উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যকথায়, ইয়াযীদ ইবনে হারূন ও আলী ইবনুল জাদ দুজনই আবূ শায়বা থেকে ঐ শব্দটি ছাড়া হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

শুধু মানসূর ইবনে আবূ মুযাহিম ঐ শব্দটির কথা উল্লেখ করেছেন। আর মানসূরের তুলনায় ঐ দুজন অত্যন্ত শক্তিশালী। তাই তাদের বর্ণনাই প্রাধান্য লাভ করবে। দ্বিতীয়ত, যদি জামাত ছাড়া কথাটিকে সহীহ ধরেও নেওয়া হয়, তবে এটাকে ভিন্ন ঘটনা আখ্যা দিলে তো আর কোন বিরোধিতা থাকেনা। মুসলিম শরীফে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে দেখা যায়, তারা কয়েকজন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তারাবীতে দাঁড়িয়ে যান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে নামায সংক্ষিপ্ত করে ভেতরে চলে যান। (মুসলিম, ১১০৪)। এ ঘটনাটিও হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত হাদীসের বিপরীত। তাই বলে কি এটিকেও জাল বলতে হবে। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী র. তো বলেছেন, والظاهر أن هذا في قصة أخرى অর্থাৎ বাহ্যত এটা ভিন্ন কোন ঘটনা হয়ে থাকবে।

(ফাতহুল বারী, ৩খ, ৮পৃ) অধিকন্তু পূর্বেও বলেছি, হযরত জাবির রা. এর হাদীসটিও দুর্বল। আলবানী সাহেব এটি সম্পর্কে ধোঁকায় পড়েছেন। তাই বারবার আলোচ্য হাদীসকে হযরত জাবির রা. এর হাদীসের বিপরীত বলে এটিকে জাল আখ্যা দেয়ার প্রয়াস চালাচ্ছেন। হযরত জাবির রা. এর হাদীসটি শেষ দিকে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ। তারা যে মন্তব্য করেছেন তা এখানে উল্লেখ করছি।

তারা বলেছেন, এই হাদীসটির সনদ যয়ীফ। হাদীসের সনদে ১.আবূ উসমান বাসরী রয়েছে, সে হাদীসের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত; ২. খালিদ ইবনে মুখাল্লাদ রয়েছে, সে যয়ীফ, তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত, তার কোন বর্ণনা দলিল হিসেবে গন্য নয়, তদুপরি সে ছিল শিয়া ও মিথ্যাবাদী (তাহযীব, ২য় খন্ড); ৩.ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা রয়েছে, তার সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত। (মিযানুল ই’তিদাল, তাহযীবুত তাহযীব, ২য় খন্ড) কথাগুলো পড়ে আমি মাথায় হাত দিয়েছি। মনে মনে বলেছি, এদের কি আখেরাতের ভয়ও নাই? ভয় থাকলে তারা এমন ডাহা মিথ্যা কথা লিখল কিভাবে? এরা বর্ণনাকারীর নামও শুদ্ধ করে লিখতে পারেনা। মাখলাদকে তারা মুখাল্লাদ বানিয়েছে।

আবুল হাসনা কে আবুল হাসানা লিখেছে। রুফাই কে রাফে নামে উল্লেখ করেছে। এক পৃষ্ঠায় তিনটি ভুল। এত বড় বড় ডিগ্রীধারী সম্পাদকরা এমন ভুল করবেন তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনা। খালিদ ইবনে মাখলাদ ও ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা দুজনই বুখারী ও মুসলিম শরীফের রাবী ।

তাদের সকল বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত হলে বুখারী ও মুসলিম শরীফে তাদের বর্ণিত হাদীসগুলোর কি দশা হবে? ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম কি মিথ্যুকের হাদীসও গ্রহণ করেছেন? হায়, হায়!! বন্ধুগণ! এভাবে লাগামহীন ও অসত্য কথা বলে হাদীস অস্বীকারকারী জঙ্গীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেবেননা, এই অনুরোধ রাখছি আপনাদের কাছে। পাঠক, সত্যি বলছি, যে কিতাব দুটির উদ্ধৃতি তারা দিয়েছেন, তাতে এসব কথার গুষ্ঠিও নেই। আরবী কোন কথাটির অর্থ যে তারা লিখেছেন ‘তার হাদীস প্রত্যাখ্যাত’ তা আমরা বুঝতে পারছিনা। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় আমাদের এই বন্ধুরা মদীনা ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রী হাসিল করলেও তারা আরবীও বোঝেননা, বাংলাও না। খালিদ কে উসমান ইবনে আবী শায়বা র., সালিহ ইবনে মুহাম্মাদ র., ইবনে হিব্বান র. ও ইবনে শাহীন র. প্রমুখ মুহাদদ্দিসগণ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলেছেন।

ইবনে মাঈন বলেছেন, ما به بأس অর্থাৎ তার ব্যাপারে কোন অসুবিধা নেই। আবূ দাউদ ও ইবনে হাজার র. তাকে সাদূক বা সত্যবাদী বলেছেন। ইবনে আদী র. বলেছেন, هو عندي إن شاء الله لا بأس به অর্থাৎ ইনশাআল্লাহ আমার দৃষ্টিতে তার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। ইমাম বুখারী তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। হ্যাঁ, ইমাম আহমাদ র. প্রমুখ বলেছেন, له مناكير অর্থাৎ তার কিছু কিছু বর্ণনা আপত্তিকর।

(সম্ভবত এ শব্দটির অর্থই তারা করেছেন- প্রত্যাখ্যাত)। ইবনে আদী র. ঐ ধরণের বর্ণনাগুলো উদ্ধৃতও করেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী র. ফাতহুল বারীর ভূমিকায় তার সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলেছেন: أما التشيع فقد قدمنا أنه إذا كان ثبت الأخذ والأداء لا يضره لا سيما ولم يكن داعية إلى رائه অর্থাৎ বাকি রইল তার শিয়া হওয়ার ব্যাপারটি । এসম্পর্কে আমরা পূর্বেই বলেছি, তিনি যখন হাদীস গ্রহণ ও শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে মজবুত ছিলেন, তাই তার শিয়া হওয়াটা ক্ষতিকর নয়। বিশেষ করে এ কারণে যে, তিনি তার মতবাদের প্রতি কাউকে দাওয়াত দিতেননা।

এসব কথা ‘তাহযীবুত তাহযীব’, ‘ফাতহুল বারী’ ও ‘মিযানুল ই’তিদাল’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি মিথ্যাবাদী ও তার বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত- এমন কথা কোন গ্রন্থেই নেই। কোন মুহাদ্দিসই তাঁর সম্পর্কে বলেননি। এটা তাঁর উপর লা-মাযহাবীদের বড় অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। যাহোক, তাঁর কিছু কিছু বর্ণনায় আপত্তি থাকলেও আলোচ্য হাদীসটি তার অন্তর্ভূক্ত নয়।

কারণ একে তো এতে আপত্তির কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, তিনি ছাড়াও অন্য সনদে ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. সম্পর্কে তো তাদের বক্তব্য আরো মারাত্মক। ইয়াযীদ ছিলেন প্রসিদ্ধ তাবেয়ী, সিহাহ সিত্তার রাবী। বুখারী র. ও মুসলিম র. তার সূত্রে বহু হাদীস গ্রহণ ও উদ্ধৃত করেছেন।

আবূ হাতিম র., নাসায়ী র. ও ইবনে সাদ র. তাকে ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইবনে মাঈন র. বলেছেন, ثقة حجة অর্থাৎ তিনি নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য। আছরাম র. এর বর্ণনা মতে ইমাম আহমাদও তাকে ছিকাহ বলেছেন। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, মুনকারুল হাদীস। এই শব্দটির অর্থ হয়তো তারা করেছেন প্রত্যাখ্যাত।

আর তার সকল বর্ণনা কথাটি নিজেদের পকেট থেকে জুড়ে দিয়েছেন। অথচ ঐ শব্দটির সাধারণ অর্থ আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। কিন্তু ইমাম আহমাদ এই অর্থে শব্দটি ব্যাবহার করতেননা। কোন বর্ণনাকারী কিছু কিছু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে যদি নিঃসঙ্গ হন তার ক্ষেত্রেই তিনি ঐ শব্দ ব্যবহার করেন। ফাতহুল বারীর ভূমিকা গ্রন্থে ইবনে হাজার র. ইয়াযীদের আলোচনাতেই এই কথা পরিস্কার করেছেন।

বাকি রয়ে গেলেন আবূ উসমান। তিনি প্রত্যাখ্যাত এমন কোন কথা কোন কিতাবে নাই। তার নাম আমর ইবনে আব্দুল্লাহ। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবূ তাহির র. ও হাসান ইবনে আলী ইবনে মুআম্মাল তার কাছ থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন। তার বর্ণিত বহু হাদীস বায়হাকী র. তার সুনানে উদ্ধৃত করেছেন।

কোন মুহাদ্দিসই তাকে যয়ীফ বলেননি। এধরণের অনেক রাবী বুখারী ও মুসলিম শরীফেও আছে। তাছাড়া আবূ উসমানের সূূত্র ছাড়াও হাদীসটির অন্য আরেকটি সহীহ সূত্র আছে। তাই তার কারণে মূল হাদীসটির উপর কোন প্রভাব পড়বেনা। এই হাদীস থেকে স্পষ্ট হলো, হযরত উমর রা. এর আমলে তাঁরই ব্যবস্থাপনায় সাহাবায়ে কেরাম -যাদের মধ্যে মুহাজির ও আনসার সকলেই ছিলেন- মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবী পড়তেন।

এতে তাঁদের কেউ কোন আপত্তি করেননি। এটাকেই সাহাবীগণের ইজমা বা সম্মিলিত কর্মপন্থা বলা হয়। হযরত উমর রা. এর আমলে যে বিশ রাকাত তারাবী পড়া হতো সে কথা শুধু সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেছেন তা নয়, আরো চারজন শীর্ষ তাবেয়ীও একই কথা বলেছেন। ক. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল আনসারী র. এর বক্তব্য: إن عمر رض أمر رجلا يصلي بهم عشرين ركعة অর্থাৎ হযরত উমর রা. জনৈক সাহাবীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাহাবীদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৪।

এই বর্ণাটির সনদ সহীহ। তবে ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ যেহেতু হযরত উমর রা. এর যুগ পাননি, আবার কার কাছ থেকে শুনেছেন তাও বলেননি, এই কারণে এটিকে মুনকাতি’ বা সূত্র-বিচ্ছিন্ন বলা হয়। কিন্তু যেহেতু এই ধরণের তাবেয়ীগণের উস্তাদ পর্যায়ে দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলনা বললেই চলে, তাই তাদের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য। তদুপরি তিনি একা নন। আরো তিনজন তাবেয়ী একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

তাই এগুলো পূর্ববর্তী সহীহ ও অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির সমর্থক ও অতিরিক্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য হতে পারে। লা-মাযহাবী বন্ধুরা এই বর্ণনাটির ব্যাপারে সূত্রবিচ্ছিন্নতার আপত্তি ছাড়াও আরো তিনটি আপত্তি পেশ করেছেন। দুটি আলবানী সাহেবের উদ্ধৃতিতে। অপরটি নিজেদের পক্ষ থেকে। প্রথম আপত্তিটি হলো, এই হাদীসটি হযরত উমর রা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত প্রতিষ্ঠিত হাদীসের বিপরীত।

হাদীসটি হলো- হযরত উমর রা. দুজন সাহাবী হযরত উবাই বিন কাব ও তামীম দারীকে (রমযান মাসে ) ১১ রাকাত পড়ানোর নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। (মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ২৫৩)। ইমাম মালেক র. এই হাদীসটি মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের সূত্রে সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ বর্ণিত এ হাদীসে রাকাত-সংখ্যা নিয়ে তার ছাত্রদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। মালেক র. ১১ রাকাতের কথা বলেছেন।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ১৩ রাকাতের কথা বলেছেন। আর দাউদ ইবনে কায়স ২১ রাকাতের কথা বলেছেন। শেষোক্ত সংখ্যাটি মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে দাউদ থেকে উদ্ধৃত। ( দ্র, হাদীস নং ৭৭৩০)। দাউদ ইবনে কায়স একাই যে বলছেন তাও নয়।

আব্দুর রাযযাক বলেছেন, عن داود وغيره অর্থাৎ দাউদের সঙ্গে আরো কেউ কেউ ২১ রাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে পূর্বে উল্লিখিত ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফার সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসটিতে এ ধরণের মতভেদ নেই। আবার দীর্ঘ বারশ’ বছরের ইতিহাসে কোন মনীষী আট রাকাত তারাবীর প্রবক্তা ছিলেন না, এর উপর কারো আমলও ছিলনা। বরং এর বিপরীতে হযরত উমর রা. এর যুগ থেকে অবিচ্ছিন্ন ধারায় বিশ রাকাত বা তার বেশী তারাবীর প্রচলন চলে আসছে। এসব কারণে অনেকে এগার রাকাতের বর্ণনাকে বর্ণনাকারীর ভুল আখ্যা দিয়েছেন।

ইমাম ইবনে আব্দুল বার র. (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) ইমাম মালেক র. এর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এই এগার রাকাতের বর্ণনাকে ইমাম মালেকের ভুল আখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। একেই বলা হয় ইনসাফ। আবার কেউ কেউ এটাকে সুহাম্মদ ইবনে ইউসুফের ভুল বলেও মন্তব্য করেছেন। (দ্র, আওজাযুল মাসালিক, ১খ, ৩৯৪পৃ)। তাছাড়া দুটি বর্ণনার মধ্যে কেউ কেউ সমন্বয় সাধন করেও পরস্পর বিরোধিতা দূর করেছেন।

তারা বলেছেন, প্রথম দিকে যখন কেরাত খুব দীর্ঘ পড়া হতো তখন এগারো রাকাত পড়া হতো। পরে কেরাত কিছুটা হালকা করে রাকাত বাড়িয়ে বিশে উন্নীত করা হয়েছিল। তখন থেকেই বিশ রাকাত পড়ার ধারা অব্যাহত থাকে। ইমাম বায়হাকীসহ আরো কিছু মনীষী এরূপ সমন্বয়ের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয় আপত্তি হলো, বিশ রাকাতের এই হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত বিশুদ্ধ হাদীসের বিরোধী।

এখানে হযরত আয়েশা রা. বর্ণিত তাহাজ্জুদের এগারো রাকাত সম্পর্কিত হাদীসটির দিকে ইংগিত করা হয়েছে। এটি আমরা শেষ দিকে উল্লেখ করবো। সেখানেই প্রমাণিত হবে আলোচ্য হাদীসটি ঐ হাদীসের বিরোধী নয়। তৃতীয় আপত্তি লা-মাযহাবী বন্ধুরা করেছেন বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদের ব্যাপারে। এটাকে আপত্তি না বলে জালিয়াতি বললে অত্যুক্তি হবেনা।

তারা বলেছেন, তাছাড়া ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদকে কেউ কেউ মিথ্যাবাদীও বলেছেন। যেমন, ইমাম আবূ হাতিম র. বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ কর্তৃক বর্ণিত কোন কথাই সত্য নয়, বরং প্রত্যাখ্যাত । কারণ সে হলো মিথ্যাবাদী। (জরহে আততাদীল, ৯ম খন্ড; তাহযীবুত তাহযীব ৬ষ্ঠ খন্ড)। হায়, হায়! ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বিখ্যাত তাবেয়ী, ইমাম মালেকের উস্তাদ।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে তাঁর সূত্রে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাঁর নাকি কোন কথাই সত্য নয়, তিনি নাকি মিথ্যাবাদী। কথাগুলো পড়ে কান্না আসার উপক্রম। ইলমে হাদীস আজ কোন অযোগ্য ও অশুভ লোকদের হাতে এসে পড়েছে? দুটি উদ্ধৃতির কোথাও এমন কথা নেই, থাকতে পারেনা। তাঁকে তো কেউ যয়ীফও বলেননি, মিথ্যাবাদী বলাতো দূরের কথা।

এজন্যেই আমি সাধারণ আহলে হাদীস ভাইদের বলি, আপনারা কাদের অন্ধ অনুসরণ করছেন ভেবে দেখুন। যারা বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে এমন ডাহা মিথ্যা তথ্য পেশ করতে পারে, তারা ইমাম আবূ হানীফা র. সম্পর্কে আপনাদেরকে কত ভুল ধারণায় ফেলে রাখতে পারে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়েত নসীব করুন। খ. তাবেয়ী আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই র. এর বক্তব্য: عن عبد العزيز بن رفيع قال: كان أبي بن كعب يصلي بالناس في رمضان بالمدينة عشرين ركعة ويوتر بثلاث. অর্থ: আব্দুল আযীয ইবনে রুফাই র. (তারা লিখেছেন, রাফে) বলেন, হযরত উবাই ইবনে কাব রা. রমযানে মদীনা শরীফে লোকদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৭৭৬৬।

এ হাদীসটির অনুবাদে তারা জালিয়াতি করেছেন। ‘পড়তেন’ এর স্থলে তারা লিখেছেন ‘পড়েছেন’। অথচ সাধারণ আরবী জানা লোকও বুঝেন, كان يصلي অর্থ ‘পড়তেন’, ‘পড়েছেন’ নয়। যেহেতু ‘পড়তেন’ কথাটি নিয়মিত পড়াকে বোঝায়, আর ‘পড়েছেন’ কথাটি তা বোঝায় না, তাই এই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এর উল্টো পরবর্তী হাদীসটিতে আছে, عن أبي بن كعب أنه صلى في رمضان .... অর্থাৎ হযরত উবাই ইবনে কাব রা. বলেন, তিনি রমযানে পড়েছেন ----।

এখানে صلى অর্থ ‘পড়েছেন’। অথচ তারা অর্থ করেছেন- ‘আদায় করতেন’। এখানেও তারা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। তাইতো আমি বলি, বুখারী শরীফের পূর্ববর্তী অনুবাদগুলো যদি না থাকতো তবেই দেখা যেত বাবু সাহেবরা কত হাজার ভুলের শিকার হয়েছেন। যাহোক, হাদীসটি একজন তাবেয়ীর সাক্ষ্য।

তিনি উমরী যুগ পাননি। একে মুহাদ্দিসগণ মুনকাতি’ বা মুরসাল বলে থাকেন। অর্থাৎ যার সূত্র বিচ্ছিন্ন। সূত্র-বিচ্ছিন্ন হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ এ কারণেই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন যে, মাঝখানে কোন দুর্বলব্যক্তি থেকে যাওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু আব্দুল আযীয র. তাবেয়ী ছিলেন।

তার উস্তাদগণের মধ্যে দুর্বল কেউ নাই বললেই চলে। তাছাড়া তিনি একা নন। তার মতো আরো তিনজন একই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। অধিকন্তু এগুলো পূর্বোল্লিখিত অবিচ্ছিন্ন ও সহীহ সূত্রে বর্ণিত হাদীসটির অতিরিক্ত সাক্ষী ও সমর্থক। তাই এতে কোন অসুবিধা নেই।

এ হাদীসটির ব্যাপারেও তারা সূত্রবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ ছাড়া আরও দুটি অভিযোগ এনেছেন। এক. এটি হযরত উমর রা. বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। দুই. অনুরূপ এটি হযরত উবাই রা. এর সপ্রমাণিত বর্ণনার বিরোধী। হযরত উমর রা. এর হাদীসের বিরোধী না হওয়ার বিষয়টি আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। আর হযরত উবাই রা. এর হাদীসটি দুর্বল।

তদুপরি সেটা একদিনের ঘটনা মাত্র। সুতরাং সেটির বিরোধী হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। গ. তাবেয়ী ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. এর বক্তব্য: عن يزيد بن رومان أنه قال: كان الناس يقومون في زمان عمر بن الخطاب في رمضان بثلاث وعشرين ركعة অর্থ: ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. বলেন, হযরত উমর রা. এর যুগে লোকেরা রমযান মাসে ২৩ রাকাত নামায পড়তেন। (মুয়াত্তা মালিক, ৪০) এটিও একজন তাবেয়ীর সাক্ষ্য। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এটিকে মুনকাতি’ বা মুরসাল বলা হয়।

কারণ ইয়াযীদ ইবনে রূমান হযরত উমর রা. এর যুগ পাননি। এটিকে যয়ীফ বলা উচিত নয়। কেউ যয়ীফ বলেনও নি। সকলে মুনক।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।