আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিতে মাহে রমজান এবং তারাবী লা লীগা

এবার বিদায়ের পালা ...

রোজার দিনের বেশুমার স্মৃতি থেকে ছেঁকে ছেঁকে সবচে মজারগুলো বের করে আনা সহজ কম্মো নয় । সেহরী ইফতারের মজা তো সবাই অল্পবিস্তর করেছে ,তবে আমি ছিলাম আরও এককাঠি সরেস । মনে পড়ে ,ছেলেবেলায় বাবা -চাচারা ইফতারের পর খানিক জিরিয়ে তারাবীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন তখন আমিও গাড়লের মত তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতাম । কিন্তু আমার মত নেহায়েত পিচ্চি যে ২০ রাকাত নামাজ পড়তে পেরেশান হয়ে পড়বে ,তা জানা ছিল বলে আমাকে তারা নিতে চাইতেননা । কিন্তু কাহাঁতক আর প্রতিদিন আমার ত্রাহি চিৎকারে কান বুঝে থাকা যায় ।

তাই একদিন আমার এহেন অন্যায় আবদারের ঠেলা সইতে না পেরে আমাকে তারাবীতে নিয়ে যান । খানিক বাদেই টের পেলাম আমার যারপরনাই ঘুম ঘুম আসছে । ইমামা সাহেব ওদিকে কোরানের আয়াত পাঠ করছেন আর আমি দাঁড়াতে দাঁড়াতে ত্যাক্ত এবং অবশেষে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে কখন যে চোখ বুজে ফেলতাম তা আমি নিজেই জানিনা । প্রথম চার ছয় রাকাত তাও যা ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আমি মোটামুটি কান খাড়া করে ইমামের আয়াত শোনার চেষ্টা করেছিলাম । কিন্তু পরে এমনই অবস্থা হল ,ইমাম সাহেব রুকুতে যেতে আল্লাহু আকবার বলার আগ পর্যন্ত এক রাকাত মোটামুটি আরবী ঘোড়ার মত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম ।

এরপর যখন বিশ রাকাত শেষ হল তখন দুর্বল পায়ে আর একরত্তি শক্তি ছিলনা । বলাই বাহুল্য ,ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় আর এরপর আমি ঐ বয়েসেই বুঝে গিয়েছিলাম ,এই আবদার ফের করলে আরও গাড্ডায় পড়তে হবে,তাই এটা না করাই সমীচীন । খানিক বড় হতে আরো একটু বুদ্ধি যখন মাথায় গজাল তখন আমি বাবার সাথে তারাবীতে যাওয়ার জন্য বের হতাম ঠিকই ,কিন্তু মওকা পেলেই ফুড়ুত করে সটকে পড়ার ধান্দা করতাম । তখনা আবার আমাদের কলোনীতে আমার বেশ কিছু বিচ্ছু দোস্ত জুটে গিয়েছিল । আমরা এমনই দস্যি ছিলাম যে ,কেলাসে টিচারের হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে মায় তারাবীর নামাজেও কিভাবে সবার নজর এড়িয়ে ফাঁকি দেওয়া যায় ,তার তরিকাও আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম ।

প্ল্যানমাফিক তারাবী শুরু হলে ভাল ছেলের মত আমরা সটান দাঁড়িয়ে অপরিসীম মনোযোগের সাথে নামাজ পড়তাম । খানিক বাদে চুপিচুপি এলাকার মুরব্বীদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে আমরা সব কটা জমায়েত হতাম মসজিদের পেছনে । এরপর শুরু হত ওখানেই আমার ইন্সট্যান্ট বাঁদরামো । দুই রাকাত পর পর নতুন ভাবে ইমাম সাহেব যখন নিয়্যাত ধরতেন তখনও আমরা ব্যস্ত ছিলাম একজন আরেকজনের ঘাড়ে চিমটি কাটায়, মৃদুস্বরে হিহি করে হাসাহাসি করায় । এরপর যখন ইমাম রুকুতে যেতেন তখনই পড়ি কি মরি করে আমরাও চলে যেতাম রুকুতে ।

উচ্চতায় আরও খানিক লম্বা হলে আমাদের বাঁদরামির তলিকায় নিত্যনতুন সৃজনশীল কৌশল যোগ হতে থাকে । কারও চপ্পল লুকিয়ে রাখা বা কারও একপাটি চপ্পলের সাথে অন্য কারওটা বদলে দেওয়া এসব তো ছিল মোটামুটি কমন । আমি নিজে অবশ্য নিজে প্রায়ই এই হামলা থেকে বেঁচে যেতাম ,কিন্তু ভুক্তভোগীরাদের রীতিমত নরক গুলজার করে ছাড়তাম আমরা । এরপর ধীরে ধীরে কৈশোরের রঙ চড়ানোর সাথে সাথে আমাদের তারাবী পড়ার উৎসবে খানিকটা ভাটা পড়তে শুরু করে । এরই মাঝে আমরা চলে আসি নতুন বাসায়,সেখানে আমার নতুন কিছু বন্ধুও জোটে এবং অবধারিতভাবে এখানে শুরু হয় তারাবীতে ফাঁকি দেওয়ার নতুন অপারেশন ।

আগে ফাঁকি দিতাম কিছুটা রয়েসয়ে ,মুরুব্বীদের চক্ষুলজ্জার ভয় তো ছিলই ,তার ওপর নিজেদের মধ্যেও বোধ হয় কিঞ্চিত ভালমানুষী অবশিষ্ট ছিল । কিন্তু কখন যে ইবিলিশ শয়তানের ওসওয়াসায় সেইটুকুও যে ধুয়ে মুছে সাফ হুয়ে গেছে তা বুঝতেও পারিনি । তাই তারাবীতে ফাঁকি দিতে আমরা হয়ে উঠলাম অনেক বেশি ডেসপারেট আর ইনোভেটিভ । আমাদের এই নতুন বাসা আবার ছিল স্কুলের সাথে লাগোয়া ,তাই আমরা তারাবীতে যাওয়ার নাম করে সবকটা দল বেঁধে স্কুলে চলে আসতাম । স্কুলের ভেতরের ছোট্ট মাঠে টিমটিম করে দুটি একশ ওয়াটের বাতি জ্বলত ,সেই আলো আঁধারিতেই আমরা সবাই সক্রোশে বলের ওপর লাথি হাকাতাম ।

আমাদের এই নৈশকালীন ফুটবলের কোড নেম ছিল তারাবী লা লীগা । তারাবী শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমাদের এই ফুটবল স্যাগা শুরু হয়ে যেত আর তারাবী শেষ হওয়ার খানিক আগে আমরা ইস্তফা দিতাম । এরপর উদোম গায়ের ঘামটুকু ভালমত শুকিয়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে বাসায় ফিরে আসা । কাউকে কাউকে তারপরও প্রশ্ন করা হত ,"কিরে তোর গায়ে এত ঘামের গন্ধ কেন ? " । যাদের বরাত খারাপ ,তারা জাঁদরেল বাবা মার দুর্ধর্ষ জেরার মুখে ফেঁসে যেত ,বাকিরা অবশ্য মোটামুটি সবাই উতরেই যেত বলা চলে ।

এমনকি কলেজে ওঠার পরেও আমাদের এই এই সিজনাল তারাবী লা লীগা মোটামুটি বহাল তবিয়তেই অনুষ্টিত হত । এখন ছুটিতে বাসায় গেলে সব বন্ধুদের একসাথে আড্ডায় ঘুরে ফিরে সেই তারাবী লা লীগার স্মৃতিই ঘুরে ফিরে উঠে আসে ,আমরা হয়ে পড়ি নস্টালজিক । তারাবী না পড়ে নিজের পরকালীন জীবনের অপরিমেয় ক্ষতি হয়তো করেছি ,কিন্তু সেই দুরন্ত দিনগুলির জন্য এমন ক্ষতি স্বীকার করতেও আমি একপায়ে খাড়া ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।