আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ময়মনসিংহ-সিলেট-কুমিল্লা-নোয়াখালি সংলগ্ন অঞ্চলের নদীগুলোতে ভারতের অসংখ্য বাঁধ : উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক জীবনযাত্রায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা

পৃথিবীর কাছে তুমি হয়তো কিছুই নও, কিন্তু কারও কাছে তুমিই তার পৃথিবী" ফটো: ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদীগুলোতে তৈরী বহু সংখ্যক প্রকল্পের একটি সিলেটের সারি নদীর উজানে মাইনথ্রু নদীর ওপর পাহাড় কেটে নির্মিত হচ্ছে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প । বৃহত্তর ময়মনসিংহ-সিলেট-কুমিল্লা-নোয়াখালি সংলগ্ন অঞ্চলের নদীগুলোতে ভারতের অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক জীবনযাত্রায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহকে ‘ভবিষ্যৎ পাওয়ার হাউজ' হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাজুড়ে অন্তত ১৬৮টি স্থান চিহ্নিত করেছে বৃহদাকার পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য।

এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০টি প্রকল্প স্থাপিত হবে অরুণাচল প্রদেশে। এসব প্রকল্প থেকে আগামী বছরগুলোতে তারা ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবে বলে আশা করছে। যদিও এসব প্রকল্পের কারণে রাজ্যের ভূস্তর ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই রাজ্য সাধারণভাবে ভূমিকম্প প্রবণ। এই ১৬৮টি প্রকল্পের মধ্যে ১১টি প্রকল্প যথারীতি বাস্তবায়িত হয়েছে।

এগুলো ইতোমধ্যে পরিবেশগত আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে বলে জানা গেছে। অরুণাচল ও আসাম প্রদেশের সীমান্তে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বৃহত্তম ‘নিম্ন সুবর্ণসিঁড়ি বাঁধ প্রকল্প' সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরেই জনঅসন্তোষ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়কে পাত্তা দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ আছে। সুবর্ণসিঁড়ি নদী ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। ভারত ১১৬ মিটার উঁচু এই বাঁধ নির্মাণের জন্য ব্যয় করেছে ২শ' কোটি ডলার।

এছাড়া আন্তর্জাতিক নদী বারাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সিলেটের অন্যতম পাহাড়ি নদী সারি'র উজানে জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকার মাইনথ্রু নদীতে ড্যাম তৈরির কাজ শেষ করেছে ভারত। এদিকে, আরেক রাজ্য সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর ২৬টি বৃহৎ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেখানকার বৃহত্তর লেপচা জনগোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৮টি রাজ্যের ভূমিগঠন এবং জীববৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক-জীবন অন্য এলাকা থেকে পৃথক এবং একই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো জীবনধারার সঙ্গে সস্পৃক্ত।

ফলে এই মূল তিনটি নদী বিপর্যস্ত হলে এই অঞ্চলের পুরো আর্থ-সামাজিক জীবনই ওলোটপালট হয়ে যেতে পারে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা নদীকেন্দ্রিক প্রাণপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বলেন, এসব নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত কিংবা বিপন্ন হলে বহু ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। যেমন, বাঁধের বিপরীতে নদীর ভাটিতে (ডাউনস্ট্রীম) পানির প্রবাহ কমে যায়। ফলে একদিকে সেচ-এর জন্য পানিপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়ে ফসল উৎপাদন মার খায়। এতে পলি বহনও কমে গিয়ে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়।

পানির প্রবাহ স্তিমিত হয়ে মাছ এবং জলজ প্রাণীসমূহের জীবন ধারণ ও প্রজনন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়। এর সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া হয় ফুড চেইন বা খাদ্য চক্রের ওপর এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ হারায় তার আবাদি জমি, হতে হয় বাস্তুচ্যুত। এসব নদীর শাখা, প্রশাখা, উপশাখা, খাল-নালা ও বিল-হাওরের ওপর প্রতিক্রিয়া করে।

এসব জলাশয়ও অকাল মৃত্যুর শিকার হয়। ভূ-গর্ভের পানির স্তরও ব্যাপকভাবে নিম্নগামী হয়ে পড়ে। এই পুরো ব্যাপারটি সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামগ্রিক জীবনধারায় নীরব ঘাতকের কাজ করে চলে। আর দীর্ঘ মেয়াদে তা একদা নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলোকে চিরতরে মুছে দেবার কাজ করে চলে। একদা তা বাতাসের ওজন স্তরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পর্যায়ক্রমে তা ঐ এলাকাকে মরু প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, যে কোন নদীর কোন বিপর্যয় ঘটলে তা শুধু বিশেষ এলাকায় সীমিত থাকেনা, তা ঐ নদীর পুরো অববাহিকাকে বিপর্যস্ত করে ছাড়ে। ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর এই অববাহিকা শুধু ভারতের উল্লিখিত রাজ্যগুলোই নয়- ভাটিতে বাংলাদেশের এক বিশাল-বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই বিস্তৃত। ফলে এসব নদীকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের ভূ-ভাগকেও আক্রান্ত করে সঙ্গত কারণেই। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী প্রভৃতি জেলার কৃষি, প্রকৃতি ও মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনকেও আঘাত করবে। এসব অঞ্চল দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে, সোমেশ্বরী, যদুকাটা, ধামালিয়া, নোয়াগঞ্জ, ইউসিয়াম, ধলা, পিয়ান, সারিগোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই বড়দাল, জুরি, মনু, ধলাই, লংগলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, ফেনী-ডাকাতিয়া, সেলুনিয়া, মুহুরী ও ফেনী।

আবার, এসব নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা এই অঞ্চলকে সিক্ত ও উর্বর রাখতে এবং মানুষের প্রাণপ্রবাহ জীবিত রাখতে সহায়ক হচ্ছে। ভারত শুধু ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর ওপরেই অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, এই অঞ্চলের আরো উল্লেখযোগ্য নদীগুলোতে নানান প্রকল্প করেছে। এর মধ্যে ভারত কর্তৃক নির্মিত বৃহদাকার প্রকল্পের মধ্যে আছে মনু নদীতে মনু বাঁধ, খোয়াই নদীতে খোয়াই বাঁধ, গোমতি নদীতে মহারাণী বাঁধ, মুহুরী নদীতে কালনি বাঁধ প্রভৃতি। শুধু বারাক নদীতেই ৩০ প্রকল্প: ভারত আন্তর্জাতিক নদী বারাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।

এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। এসব বাঁধের কারণে বারাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বারাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশূন্য হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বারাক নদী একাধারে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

ফলে এটি ত্রিদেশীয় তথা আন্তর্জাতিক নদীর মর্যাদা লাভ করেছে। পূর্বে নাগাল্যান্ডের লুসাই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে এই নদী দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ পর্যন্ত এর উপত্যাকা বিস্তৃত হয়েছে। এর দৈর্ঘ ৪১ হাজার ৭শ' ২৩ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়ি নদী হবার কারণে বিপুল খরস্রোতা বারাক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার।

বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১শ' কিলোমিটার উজানে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ভারতের পরিকল্পনা রয়েছে আগামী ২০১২ সালের মধ্যে এর কাজ সম্পন্ন করা। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বারাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে বলে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে, আমাগাম স্টোরেজ (৩৫ মেগাওয়াট), কিনসি-২য় পর্যায় (১৭৫ মেগাওয়াট), মানহু (৯০ মেগাওয়াট), মাওয়াবলেই স্টোরেজ (১০০ মেগাওয়াট), মাওপাট (৫৫ মেগাওয়াট), মাওসিরপাট (১৮০ মেগাওয়াট), নিংমাওলার (২৯ মেগাওয়াট), নংকোলাইট (১৮০ মেগাওয়াট), নংলাইংকিয়েন (৪৭ মেগাওয়াট), নংনাম (৩৬ মেগাওয়াট), সুসেন (১৫০ মেগাওয়াট), উমদাউনা (৯৫ মেগাওয়াট) এবং উমজাউট (৮৫ মেগাওয়াট)।

মিজোরাম রাজ্যের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, দিহ (২৬ মেগাওয়াট), কলোনডাইন স্টোরেজ (১২০ মেগাওয়াট) ও টুইবওয়াল (৪৮ মেগাওয়াট)। মনিপুর রাজ্যের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ইরাং (৭৫ মেগাওয়াট), ইরাং (৬০ মেগাওয়াট), খোনজেম ছাখা (৯০ মেগাওয়াট), খোনজেম ছাখা (৪৮ মেগাওয়াট), লেনাই-১ম পর্যায় (৩৪ মেগাওয়াট) ও লেনাই-২য় পর্যায় (২৭ মেগাওয়াট), নাগলিবান (৮৫ মেগাওয়াট) এবং টুইভাই (৫১ মেগাওয়াট)। নাগাল্যান্ড রাজ্যের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, খুজামি (৩২ মেগাওয়াট), লালুরি (৮০ মেগাওয়াট), রারুর (৩৬ মেগাওয়াট), শাখাই-২য় পর্যায় (৩১ মেগাওয়াট) এবং জাংকি (৪৮ মেগাওয়াট)। ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ বিভাগ এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাঁচাইয়ের কাজ করে যাচ্ছে বলে সূত্রে প্রকাশ। এদিকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে উত্তর সিলেটের অন্যতম পাহাড়ী নদী সারি'র উজানে জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকার মাইনথ্রু নদীতে ড্যাম তৈরির কাজ শেষ করেছে ভারতের মেঘালয় সরকার।

এই প্রকল্পের তিনটি ইউনিটে মোট ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তারা। এই নদীর ভাটিতে একাধিক নামে সিলেটের জৈন্তিয়া, গোয়াইনঘাট ও সদর উত্তরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সারি নদী মূলত এ অঞ্চলের জীবনপ্রবাহের মতোই। জানা গেছে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ডাউকির কাছাকাছি মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রো-ইলেকট্রিক ড্যামটির অবস্থান। প্রকল্পটি মাইনথ্রু ও অপর দুই উৎস লামু নদী এবং উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখ সঙ্গমে অবস্থিত। মেঘালয়ের জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকা আমলারিম ব্লকের পাহাড়ি খরস্রোতা মাইনথ্রু নদীর ওপর ৬৩ মিটার উচুঁ ড্যাম নির্মাণের কাজ এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বৃহত্তর ময়মনসিংহ-সিলেট-কুমিল্লা-নোয়াখালি সংলগ্ন অঞ্চলের নদীগুলোতে ভারতের অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প তৈরির কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ ও মানবিক জীবনযাত্রায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহকে ‘ভবিষ্যৎ পাওয়ার হাউজ' হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাজুড়ে অন্তত ১৬৮টি স্থান চিহ্নিত করেছে বৃহদাকার পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য। এর মধ্যে কমপক্ষে ৮০টি প্রকল্প স্থাপিত হবে অরুণাচল প্রদেশে।

এসব প্রকল্প থেকে আগামী বছরগুলোতে তারা ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবে বলে আশা করছে। যদিও এসব প্রকল্পের কারণে রাজ্যের ভূস্তর ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বলা হচ্ছে, এই রাজ্য সাধারণভাবে ভূমিকম্প প্রবণ। এই ১৬৮টি প্রকল্পের মধ্যে ১১টি প্রকল্প যথারীতি বাস্তবায়িত হয়েছে। এগুলো ইতোমধ্যে পরিবেশগত আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে বলে জানা গেছে।

অরুণাচল ও আসাম প্রদেশের সীমান্তে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বৃহত্তম ‘নিম্ন সুবর্ণসিঁড়ি বাঁধ প্রকল্প' সম্পর্কে গত কয়েক বছর ধরেই জনঅসন্তোষ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সরকার সেসব বিষয়কে পাত্তা দিচ্ছেনা বলে অভিযোগ আছে। সুবর্ণসিঁড়ি নদী ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস। ভারত ১১৬ মিটার উঁচু এই বাঁধ নির্মাণের জন্য ব্যয় করেছে ২শ' কোটি ডলার। এছাড়া আন্তর্জাতিক নদী বারাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

সিলেটের অন্যতম পাহাড়ি নদী সারি'র উজানে জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকার মাইনথ্রু নদীতে ড্যাম তৈরির কাজ শেষ করেছে ভারত। এদিকে, আরেক রাজ্য সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর ২৬টি বৃহৎ পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সেখানকার বৃহত্তর লেপচা জনগোষ্ঠী এর তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৮টি রাজ্যের ভূমিগঠন এবং জীববৈচিত্র্য ও সাংস্কৃতিক-জীবন অন্য এলাকা থেকে পৃথক এবং একই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো জীবনধারার সঙ্গে সস্পৃক্ত। ফলে এই মূল তিনটি নদী বিপর্যস্ত হলে এই অঞ্চলের পুরো আর্থ-সামাজিক জীবনই ওলোটপালট হয়ে যেতে পারে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা নদীকেন্দ্রিক প্রাণপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বলেন, এসব নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত কিংবা বিপন্ন হলে বহু ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। যেমন, বাঁধের বিপরীতে নদীর ভাটিতে (ডাউনস্ট্রীম) পানির প্রবাহ কমে যায়। ফলে একদিকে সেচ-এর জন্য পানিপ্রাপ্তি বাধাগ্রস্ত হয়ে ফসল উৎপাদন মার খায়। এতে পলি বহনও কমে গিয়ে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। পানির প্রবাহ স্তিমিত হয়ে মাছ এবং জলজ প্রাণীসমূহের জীবন ধারণ ও প্রজনন ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যায়।

এর সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া হয় ফুড চেইন বা খাদ্য চক্রের ওপর এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়। নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষ হারায় তার আবাদি জমি, হতে হয় বাস্তুচ্যুত। এসব নদীর শাখা, প্রশাখা, উপশাখা, খাল-নালা ও বিল-হাওরের ওপর প্রতিক্রিয়া করে। এসব জলাশয়ও অকাল মৃত্যুর শিকার হয়।

ভূ-গর্ভের পানির স্তরও ব্যাপকভাবে নিম্নগামী হয়ে পড়ে। এই পুরো ব্যাপারটি সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামগ্রিক জীবনধারায় নীরব ঘাতকের কাজ করে চলে। আর দীর্ঘ মেয়াদে তা একদা নয়নাভিরাম দৃশ্যগুলোকে চিরতরে মুছে দেবার কাজ করে চলে। একদা তা বাতাসের ওজন স্তরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পর্যায়ক্রমে তা ঐ এলাকাকে মরু প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, যে কোন নদীর কোন বিপর্যয় ঘটলে তা শুধু বিশেষ এলাকায় সীমিত থাকেনা, তা ঐ নদীর পুরো অববাহিকাকে বিপর্যস্ত করে ছাড়ে।

ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর এই অববাহিকা শুধু ভারতের উল্লিখিত রাজ্যগুলোই নয়- ভাটিতে বাংলাদেশের এক বিশাল-বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়েই বিস্তৃত। ফলে এসব নদীকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের ভূ-ভাগকেও আক্রান্ত করে সঙ্গত কারণেই। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী প্রভৃতি জেলার কৃষি, প্রকৃতি ও মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনকেও আঘাত করবে। এসব অঞ্চল দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকারী নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে, সোমেশ্বরী, যদুকাটা, ধামালিয়া, নোয়াগঞ্জ, ইউসিয়াম, ধলা, পিয়ান, সারিগোয়াইন, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাই বড়দাল, জুরি, মনু, ধলাই, লংগলা, খোয়াই, সুতাং, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতি, ফেনী-ডাকাতিয়া, সেলুনিয়া, মুহুরী ও ফেনী। আবার, এসব নদীর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা এই অঞ্চলকে সিক্ত ও উর্বর রাখতে এবং মানুষের প্রাণপ্রবাহ জীবিত রাখতে সহায়ক হচ্ছে।

ভারত শুধু ব্রহ্মপুত্র-বারাক-তিস্তা নদীর ওপরেই অসংখ্য বাঁধ-প্রকল্প নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, এই অঞ্চলের আরো উল্লেখযোগ্য নদীগুলোতে নানান প্রকল্প করেছে। এর মধ্যে ভারত কর্তৃক নির্মিত বৃহদাকার প্রকল্পের মধ্যে আছে মনু নদীতে মনু বাঁধ, খোয়াই নদীতে খোয়াই বাঁধ, গোমতি নদীতে মহারাণী বাঁধ, মুহুরী নদীতে কালনি বাঁধ প্রভৃতি। শুধু বারাক নদীতেই ৩০ প্রকল্প: ভারত আন্তর্জাতিক নদী বারাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে।

এসব বাঁধের কারণে বারাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বারাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশূন্য হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। বারাক নদী একাধারে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে এটি ত্রিদেশীয় তথা আন্তর্জাতিক নদীর মর্যাদা লাভ করেছে।

পূর্বে নাগাল্যান্ডের লুসাই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়ে এই নদী দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ পর্যন্ত এর উপত্যাকা বিস্তৃত হয়েছে। এর দৈর্ঘ ৪১ হাজার ৭শ' ২৩ বর্গকিলোমিটার। পাহাড়ি নদী হবার কারণে বিপুল খরস্রোতা বারাক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১শ' কিলোমিটার উজানে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।

ভারতের পরিকল্পনা রয়েছে আগামী ২০১২ সালের মধ্যে এর কাজ সম্পন্ন করা। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫শ' মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বারাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে বলে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে, আমাগাম স্টোরেজ (৩৫ মেগাওয়াট), কিনসি-২য় পর্যায় (১৭৫ মেগাওয়াট), মানহু (৯০ মেগাওয়াট), মাওয়াবলেই স্টোরেজ (১০০ মেগাওয়াট), মাওপাট (৫৫ মেগাওয়াট), মাওসিরপাট (১৮০ মেগাওয়াট), নিংমাওলার (২৯ মেগাওয়াট), নংকোলাইট (১৮০ মেগাওয়াট), নংলাইংকিয়েন (৪৭ মেগাওয়াট), নংনাম (৩৬ মেগাওয়াট), সুসেন (১৫০ মেগাওয়াট), উমদাউনা (৯৫ মেগাওয়াট) এবং উমজাউট (৮৫ মেগাওয়াট)। মিজোরাম রাজ্যের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, দিহ (২৬ মেগাওয়াট), কলোনডাইন স্টোরেজ (১২০ মেগাওয়াট) ও টুইবওয়াল (৪৮ মেগাওয়াট)।

মনিপুর রাজ্যের প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ইরাং (৭৫ মেগাওয়াট), ইরাং (৬০ মেগাওয়াট), খোনজেম ছাখা (৯০ মেগাওয়াট), খোনজেম ছাখা (৪৮ মেগাওয়াট), লেনাই-১ম পর্যায় (৩৪ মেগাওয়াট) ও লেনাই-২য় পর্যায় (২৭ মেগাওয়াট), নাগলিবান (৮৫ মেগাওয়াট) এবং টুইভাই (৫১ মেগাওয়াট)। নাগাল্যান্ড রাজ্যের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, খুজামি (৩২ মেগাওয়াট), লালুরি (৮০ মেগাওয়াট), রারুর (৩৬ মেগাওয়াট), শাখাই-২য় পর্যায় (৩১ মেগাওয়াট) এবং জাংকি (৪৮ মেগাওয়াট)। ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ বিভাগ এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাঁচাইয়ের কাজ করে যাচ্ছে বলে সূত্রে প্রকাশ। এদিকে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে উত্তর সিলেটের অন্যতম পাহাড়ী নদী সারি'র উজানে জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকার মাইনথ্রু নদীতে ড্যাম তৈরির কাজ শেষ করেছে ভারতের মেঘালয় সরকার। এই প্রকল্পের তিনটি ইউনিটে মোট ১২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তারা।

এই নদীর ভাটিতে একাধিক নামে সিলেটের জৈন্তিয়া, গোয়াইনঘাট ও সদর উত্তরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত সারি নদী মূলত এ অঞ্চলের জীবনপ্রবাহের মতোই। জানা গেছে, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ডাউকির কাছাকাছি মাইনথ্রু-লেসাকা হাইড্রো-ইলেকট্রিক ড্যামটির অবস্থান। প্রকল্পটি মাইনথ্রু ও অপর দুই উৎস লামু নদী এবং উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখ সঙ্গমে অবস্থিত। মেঘালয়ের জৈন্তিয়া পাহাড়ী এলাকা আমলারিম ব্লকের পাহাড়ি খরস্রোতা মাইনথ্রু নদীর ওপর ৬৩ মিটার উচুঁ ড্যাম নির্মাণের কাজ এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।