আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিনেমালোচনাঃ অত্তো এ মেজো- ফেদেরিকো ফেলিনি

শূন্য "It was self-centered of me, I suppose, not only that my own ideas seemed more attractive to me, as our own ideas seem attractive to all of us, but I believed I could carry them out with greater feeling, I could stay with them and give them a unity because they were born of me, and I could achieve the greatest understanding and intimacy with my characters." ফেদেরিকো ফেলিনি। ১৯৬৩ সালে তার নির্মিত অত্তো এ মেজো (এইট এন্ড আ হাফ) সিনেমাটি মুক্তি পায়। সিনেমাটিকেই ফেলিনির শ্রেষ্ট কাজ বলে মনে করা হয়। ১৯৬৩ সালে, যখন সিনেমার বিষয়বস্তু হিসেবে আত্মজৈবনিক কোনো কিছুকে ভাবা একটু নয় বেশ কঠিন ছিলো তখন ফেলিনি অত্তো এ মেজো বানানোর সাহসিকতা দেখান। পুরো সিনেমাটিই ফেলিনির নিজের জীবন থেকে নেওয়া।

সংক্ষেপে স্টোরিলাইনে যাওয়া যাক, গুইদো একজন স্বনামধন্য পরিচালক। সে তার নতুন সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়ায় আছে যেটা একটি সায়েন্স ফিকশান। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে তার নিজের এই সিনেমা সম্পর্কে নূন্যতম কোনো ধারণা নাই। সে কমপ্লিটলি একটা আর্টিস্টস ব্লকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার প্রোডিউসার, রাইটার, সিনেম্যাটোগ্রাফার ও অন্যান্য কলাকুশলী জানে সিনেমা হচ্ছে।

ইট ইজ অল রিটেন ইন দ্য ডাইরেকটারস ব্রেইন। কিন্তু গুইদো, পরিচালক, তার মাথায় কোনো সিনেমা নাই! সে নানাভাবে ট্রেইস করার চেষ্টা করছে কিভাবে সিনেমাটা দাঁড়াবে, কে হবে কলাকুশলী, কি হবে ডায়লোগ। কিন্তু, ইটস এম্পটি! শিল্পী মাত্রই জানেন এইরকম ব্লক কতোটা বিধ্বংসী। কাজ হচ্ছে শিল্পীর আত্মা। সে যদি কাজ না করতে পারে, বা তার যদি কোনো আইডিয়াই না থাকে তার পরবর্তী কাজ কি হতে যাচ্ছে দ্যান হি ইজ এজ গুড এজ ডেড।

ফেলিনি মূলত এটাই দেখাতে চেয়েছেন এই সিনেমায়। তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। যে মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে হুবুহু সেটাই তুলে ধরা হয়েছে অত্তো এ মেজো-তে। গুইদো ক্রমশ নিজেকে হারাতে থাকে। ট্রমা, শৈশবের স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়া, বিভিন্ন স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, সম্পর্কের জটিলতা- একে একে তীক্ষ থেকে তীক্ষতর হয়ে উঠে সিনেমাটির প্রতিটি ফ্রেমে।

এই সিনেমার প্রথম দৃশ্যটা আমি কতোবার দেখেছি জানি না। হাই পিচ টেনশান বিল্ড আপ করতে হয় ধীরে। কম সময়ের মধ্যে ধীরে একটা টেনশান বিল্ড আপ করা- প্যারাডক্সিয়াল বুঝাই যাচ্ছে। মূলত দৃশ্যটি গুইদোর একটি দুঃস্বপ্ন- সাফোক্যাশানের দুঃস্বপ্ন। দেখা যায়, রাশ আওয়ারের সময় একটা টানেলে গুইদোর গাড়ি থেমে আছে।

হঠাৎ করেই গুইদোর গাড়ির সব কাচ বন্ধ হয়ে আসছে। সে শ্বাস নিতে পারছে না। টানেলের মধ্যে চারপাশের গাড়িতে বিভিন্ন মানুষ তাকে দেখছে। প্রত্যেকের অভিব্যক্তি একই সাথে এক এবং আলাদা। এইখানে ফেলিনির ট্রিটমেন্ট এর ভয়াবহ ইমপ্যাক্ট চিহ্নিত করা যায়।

ড্রামাটিক্যাল টেনশান বিল্ড আপ করার সহজাত টেকনিক হচ্ছে মূল ব্যাপার বা সোর্স অফ ইভেন্ট কে দর্শকের আড়ালে রেখে দেওয়া। কিন্তু ফেলিনি খুব সহজাত দক্ষতায় পুরো একটা ঘটনা দর্শকের সামনে রেখেই টেনশানটা বিল্ড আপ করেছেন। এই দৃশ্য মাত্র অল্প কিছু সময়ের কিন্তু অনুভব করতে পারলে আপনার নার্ভের উপর ভয়াবহ চাপ ফেলবে। চকিতে দেখা যায় গুইদো আকাশে উড়ছে আর তাকে টেনে নামাচ্ছে তার প্রোডিউসার ও অন্যান্যরা। এই একটি দৃশ্য দিয়েই গুইদোর সিনেমাটি থেকে পালানোর এবং একই সাথে এসোসিয়েটসদের চাপে অনেকটা মনের বিরুদ্ধে আবার ফিরে আসা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ফেলিনির আত্মজৈবনিক সিনেমা এটি- এই সম্পর্কে ইঙ্গিত দিতে তিনি কার্পণ্য করেন নাই। দ্বিতীয় দৃশ্যে, গুইদোর চিকিৎসক তাকে জিজ্ঞেস করে যে তুমি কি আরেকটা নৈরাশ্যবাদী সিনেমা বানাতে যাচ্ছো? এখান থেকে বোঝা যায় গুইদো আসলে ফেলিনি নিজেই। এমনকি শুধু তাই না, সিনেমার তৃতীয় দৃশ্য যেটা একটা স্পা’তে শ্যুট করা হয়েছে অইখানে তার সহ-লেখককে গুইদোর স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়, যেখানে সে গুইদোকে বলে যে তার স্ক্রিপটিকে কয়েকটা সেন্সলেস ইভেন্টের সমস্টি বলে মনে হয়েছে তখন ফেলিনি নিজের সিনেমাটি সম্পর্কেও একধরণের ঘোষনা দিয়ে দ্যান যে এটা (অত্তো এ মেজো) আসলে কিছু সেন্সলেস এপিসোডের সমস্টি। এইটাকে আত্মবিশ্বাস বা উইট বা প্লেইন জিনিয়াস- যেকোনো একটা বলা যেতে পারে! অত্তো এ মেজোর সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য বোধ হয় এতে রিয়াল ও সুরিয়াল ঘটনার সহাবস্থান। দর্শকের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হয়ে যায় কোনটা আসলেই ঘটছে আর কোনটা ইমাজিনেশানে।

কিছু দৃশ্য অভিয়াস খুব। যেমন গুইদোর বাবা ও মার সাথে যেখানে তার দেখা হয়। তার বাবা নিজের কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, যে সিলিং টা খুব নিচু, আরেকটু উঁচু হলে ভালো লাগতো উনার। এই দৃশ্যতেই আবার তার প্রোডিউসার এসে ইন্টারভিন করে। বার বার এই উপস্থিতি, এই মানসিক চাপ নানাভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

আরেকটা দৃশ্য খুব মনে পড়ছে, যখন গুইদো কার্ডিনালের সাথে দেখা করতে গিয়ে একজন মহিলাকে দেখে তার শৈশবের স্মৃতি রিকল করে, সারাজিনা নামের একটি পতিতাকে দেখতে সৈকতে গুইদোর বন্ধুদের সাথে সে যায়। সারাজিনার উপস্থিতি, ড্রামাটিক মিউজিক সবকিছু মিলে অই দৃশ্যটি খুব আলোড়িত করেছিলো। হিডেন বিউটি ছিলো কিছু দৃশ্যটিতে। সেটা কি এখনো বুঝি নাই। সিনেমায় সিম্বলিজম এর ব্যবহারও ফেলিনির ট্রেইডমার্ক।

যেমন সারাজিনা কে দেখার অপরাধে গুইদোকে যখন তার ক্যাথোলিক স্কুলের শিক্ষকেরা শাস্তি দ্যান তখন সেইন্ট ডোমিনিক স্যাভিও এর একটি পোট্রেট এর সামনে বালক গুইদোকে দেখানো হয় এবঙ স্যাভিও এর ছবিটিকে অল্প কিছু সেকেন্ডের জন্য ফোকাস করা হয়। স্যাভিও তখনকার ইতালিতে বিশুদ্ধতার প্রতীক ছিলেন। ছবিটির সামনে বালক গুইদোকে দাঁড় করিয়ে যেন তার পাপ ও অপরাধবোধের দিকেই আঙুল তোলা হয়। ক্রিস্টিয়ানিটিকে অনেক ঋণাত্মক ভাবেও দেখানো হয়েছে এইখানে। যেমন সেই কার্ডিনাল এর সাথের সিকোয়েন্স যেখানে কার্ডিনাল বলেন যে চার্চের বাইরে কোনো স্যালভ্যাশান নাই! আরেকটি সিম্বোলিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হচ্ছে হারেমের মধ্যে গুইদো যেখানে অসংখ্য নারীদের প্রভু এবং সে চাবুক দিয়ে তাদের আঘাত করে যেভাবে সার্কাসে পশুদের প্রশিক্ষন দেয়া হয়।

অনেকটা অসরাসরিভাবে সরাসরি এইখানে চার্চের দমনকারী মূর্তিকে সমালোচিত করা হয়েছে। দুইজন নারীর সাথে গুইদোর সম্পর্ককে হাইলাইট করা হয়েছে এখানে। তার স্ত্রী লুইজা আর রক্ষিতা কার্লা। স্ত্রী লুইজা সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী- কিন্তু ঠিক কোনো এক কারণে তাদের দুইজনের মধ্যে সম্পর্কটা সাংঘর্ষিকই রয়ে যায়। কার্লা সেইদিক থেকে খানিক স্বস্তা ও উগ্র।

কিন্তু এই উগ্রতার ভেতরি গুইদো এক ধরণের প্রবল শারীরিক আকর্ষণ খুঁজে পায়। এই দুই নারীর সাথে সম্পর্কের মাধ্যমে ফেলিনি গুইদোর ভেতরের অন্তর্দ্বন্দ আর টানাপোড়েন দেখাতে চেয়েছেন। নিজের ধারণাশূন্যতায় বিদ্ধ হয়ে সে একজন সম্পূর্ণ নারীকে কল্পনা করে। যার বাহ্যিক মূর্তি হচ্ছে ক্লদিয়ার (গুইদোর প্রাক্তন সিনেমার অভিনেত্রী যার গুইদো একজন এডমায়রার)। কিন্তু সেও গুইদোকে হতাশ করে, তার নিজস্ব সীমাবদ্ধতায় ভেঙে পড়ে।

এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত সিনেমার। গুইদোর ভেতরের নিঃসীম শূন্যতাকে প্রোজেক্ট করা হয়েছে যেন এটির মাধ্যমে। অভিনয় নিয়ে বেশী কিছু বলার নাই। ফেলিনির মতো জিনিয়াসেরা আসলে অন্য কারো উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস রাখেন বলে মনে হয় না। একটা ফুলের টবকে দিয়েও অভিনয় করিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তার আছে- লাইনটা ক্লিশে শোনাইতে পারে কিন্তু আমার বিবেচনায় এই কথাটিকে সত্য মনে হয়।

গুইদোর চরিত্রে মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানির অভিনয় দূর্দান্ত। আমার মজা লেগেছে তার কমিক্যাল কিছু ভঙ্গি, মানে গুইদোর জায়গায় ফেলিনিকে চিন্তা করে আর কি। ফেলিনির ডিরেকশান নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তার ক্যামেরাওয়ার্ক নিয়ে অল্প কিছু কথা বলার আছে। যারা মায়েস্ত্রো তারা ক্যামেরার চোখ দিয়ে জীবনকে দেখেন।

ফেলিনির ক্যামেরা সবসময়ই আমার কাছে একটা এন্ডলেস ডিলাইট! সাধারণ থেকে সাধারণতম দৃশ্যগুলোকে একটা অলীক সৌন্দর্য্য দিতে জানেন তিনি। ছোটোখাট জিনিসগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় হয়তো একটি চেহারা ফোকাসে আছে, ফেলিনি তার পিছনের কিছু দৃশ্যাদি যেমন কয়েকজন হেঁটে যাচ্ছে এই ব্যাকগ্রাউন্ডকে এমনভাবে প্রোজেক্ট করার ক্ষমতা রাখেন যে ফোকাস ও প্রোজেকশান মিলে একটা সামগ্রিক দৃশ্য হয়ে ওঠে। তার সিনেমার ড্যান্সের সিকোয়েন্সগুলোও সবসময়েই চমৎকার। ফেলিনির সার্কাসপ্রীতিও প্রচলিত। তার সিনেমায় বিভিন্ন প্যারেড দেখা যায় যেমন এই সিনেমার শেষদৃশ্যের প্যারেডটি।

অতি সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু ফেলিনি যখন পুরো জিনিসটাকে সিংক্রোনাইজ করেন তখন তা অদ্ভূতরকমের নতুন কিছু হয়ে উঠে। সবকিছু ছাপিয়ে অত্তো এ মেজো কোথায় অসাধারণ? এর সততায়। সিনেমায় গুইদোকে বলতে শোনা যায় যে, আই ওয়ান্টেড টু মেইক এন অনেস্ট মুভি। কথাটি আসলে এই সিনেমা নিয়েই ছিলো।

তার নিজের এই দূর্বিষহ পর্যায়টা ফেলিনি নিখুঁত সততার সাথে তুলে ধরেছেন। শার্ল বোদলেয়ার বলেছিলেন, শিল্প হচ্ছে বেশ্যাবৃত্তি। কথা সত্য। এই সিনেমায় ফেলিনি একইসাথে বেশ্যার মতো সত্য ও নির্মম ছিলেন। এই জন্যই আমরা বার বার অত্তো এ মেজোতে ফিরে যাই।

তৎকালীন নিওয়াভান্তগার্দে সিনেমার পথিকৃত বলা যায় এই সিনেমাটিকে। শেষ দৃশ্যে যখন স্পেইসশিপ এর কাঠামো ভেঙ্গে ফেলা হয় তখন ফেলিনি স্পস্টতই বলে দ্যান যে বাণিজ্যিক সিনেমার সময় শেষ- তা ভেঙে যাচ্ছে! আমি যখন সিনেমাটি শেষ করেছিলাম তখন কিছুসময় বোকা হয়ে বসেছিলাম। তারমানে ফেলিনি সিনেমা বানাতে পারছেন না তো কি হয়েছে ! সিনেমা না বানাতে পারা নিয়েই তো একটা আস্ত সিনেমা বানিয়ে ফেললেন যা আমি গোগ্রাসে গিললাম এতোক্ষণ! মুখ দিয়ে বের হয়ে গ্যালো- ক্রেইজি সান অফ আ বিয়াচ! ডাউনলোড লিঙ্কঃ অত্তো এ মেজো --------------- উৎসর্গঃ কাউসার রুশো, স্নিগ এবঙ দারাশিকো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।