আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুরবানীঃ জীবন্ত রক্তপাতের উৎসব

চিন্তাচেতনার স্বাধীনতাহীন জীবন মৃতপ্রায়। লেখকঃ নায়ার খান || বাংলা অনুবাদঃ আলমগীর হুসেন প্রতি বছর ঈদুল-আযহার বা বড় ঈদ উৎসবের সময় আমার মনে হয় আমি যেন একটা প্রাচীন সমাজে বাস করছি, যখন জীবন্ত মানব বলি দিয়ে তার রক্ত উৎসর্গ করা হতো ঈশ্বরকে খুশী করার জন্য। প্রত্যেক ঈদের দিন দেশের সর্বত্র রাস্তার কোণে কোণে প্রকাশ্যে জীবন্ত প্রাণী হত্যা দেখার জন্য আনন্দ-উল্লাসে সমেবেত ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে আমি দেখি একটা একটা সম্ভাব্য তালেবানের প্রতিচ্ছবি। সেসব প্রাণীগুলো বাঁচার জন্য কি আপ্রাণ চেষ্টা করে! এবং শেষ পর্যন্ত তাদের ছেদনকৃত গলা দিয়ে ফিনকি রক্ত বেরিয়ে আসে। যেন তালেবানদের জীবন্ত মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ করার মতো।

আর সে দৃশ্য ওসব বাচ্চা মুসলিম ছেলেমেয়েদের জন্য সবচেয়ে আনন্দ-উৎসবের বস্তু বা অংশ। আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, ওসব ছেলেদের অনেকে একদিন অন্য মানুষের উপর অনুরূপ কার্য ঘটাতে দ্বিধা করে না ব্যক্তিগতভাবে আমি শাকাহারী নই। তবে মাংসের চাহিদার জন্য জনচক্ষুর আড়ালে কষাইখানায় প্রাণী জবাই করা এক জিনিস, আর সেটাকে গণ-তামাশা বানানো অন্য জিনিস। একটা উটের জীবন কবজ করতে প্রায় আধা-ঘণ্টা দস্তাদস্তি করতে হয়, যে প্রক্রিয়া কালে উটের লম্বা গলায় বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটা হয়। এবং শত শত মানুষ, যাদের বেশীরভাগ বাচ্চা ছেলেমেয়ে, সে দৃষ্ট দেখতে থাকে।

অথচ সভ্য সমাজে প্রাণীকে কেবল জনচক্ষুর অন্তরালেই নয়, তাদেরকে সর্বাধিক ব্যথাহীন প্রক্রিয়ায় জবাই করাও নিশ্চিত করা হয়, যা ইসলামে হারাম গণ্য। জনগণ আমার মন্তব্যকে ধর্ম-বিরোধী বলবে নিঃসন্দেহে। তবে আমার বক্তব্যঃ আজকের বিবেক-সম্পন্ন মানুষের অন্তত উচিত ধর্মীয় আচারকে বর্তমান সভ্য ধারণার সাথে তাল রেখে চালানো। গত কয়েক শত বছরে মানুষ শহুরে হয়ে উঠার সাথে সম্পদ ও কুরবানীর অর্থ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কৃষি-প্রধান সমাজে পশু-প্রাণী হলো সম্পদ; সুতরাং সে সম্পদের তথা পশু-প্রাণীর উৎসর্গ বা কুরবানী।

কিন্তু শহুরে সমাজে সম্পদ হচ্ছে টাকা-পয়সা। কাজেই কেউ পশু কুরবানী না দিয়ে আল্লাহর নামে সমপরিমাণ টাকা গরীবদেরকে খাওয়ানোর জন্য কিংবা হাসপাতালে দান করার জন্য দিলে একই পরিমাণ বা তারও বেশী উপকার আনবে, এবং তা প্রকাশ্যে পশু হত্যার মত কুৎসিত ও নির্মম দৃশ্য ও পরিবেশ নোংরা করা থেকে আমাদেরকে বাঁচাবে। আমাদের সমাজে যখন সুষ্ঠ ও বিবেকবান চিন্তাভাবনার চেয়ে আচার-প্রথা ধর্মের মূল, তখন কে শুনবে এমন পরামর্শ? বিশেষত ঈদে রাস্তায় রাস্তায় মহড়া করে কুরবানী দেওয়া যখন নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যগুলো হাসিল করেঃ • একটা মোটাকাটা দামী প্রাণীকে জনসমক্ষে কুরবানী দেওয়া কোরবানী-দাতার প্রতিপত্তি প্রদর্শন করে; • যৌন ও সামাজিকভাবে নিষ্পেষিত মানুষের অন্যকে যাতনা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করে; • অন্য ধর্মের লোকদের উপর নিজেদের প্রাধান্য প্রদর্শন, বিশেষত মুসলিম সংখ্যালঘু সমাজে – যেমন ভারতে। ঈদ একদিকে উচ্চ-বিত্তদের সামাজিক প্রতিপত্তি ও অহংকার প্রদর্শনের এক উৎসব; অন্যদিকে মাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যকে সাধারণ মানুষের সামর্থ্যের আরও বাইরে নিয়ে যাওয়ার এক আয়োজন। প্রত্যেক ঈদ ও তার পরবর্তি সময়ে গরু ও ছাগল-ভেড়ার মাংসের দাম উর্ধ্বমুখী হয়, কেননা ঈদের সময়ে ব্যাপক সংখ্যায় এসব প্রাণী হত্যা তাদের ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি করে।

অনেকে আমার সাথে দ্বিমত করবে যেঃ পশু-প্রাণী জবাই নয় – বরং পাশ্চাত্য থেকে আগত সহিংসতাপূর্ণ চলচ্চিত্র ও ভিডিও খেলা ইত্যাদি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মাঝে সহিংসতা ও হত্যার ঝোক সৃষ্টি করার বেশী ক্ষমতা রাখে। সে দাবী যুক্তিযুক্ত। তবে সহিংসতাপূর্ণ ছবিগুলো প্রথমেই হুশিয়ারী দেয় যে, বাচ্চারা সেটা দেখার উপযুক্ত নয়। দ্বিতীয়তঃ ছবিতে গোলাগুলি, খুনাখুনী আর জীবন্ত প্রাণীর রক্তপাতে মাঝে ব্যবধান রয়েছে। খুনাখুনী সবক্ষেত্রেই খারাপ, কিন্তু সাংঘাতিকতা প্রদর্শনে পরিমিতি বা ব্যবধান থাকা উচিত।

বিশ্বব্যাপী শহরগুলোতে প্রতিদিন শত শত মানুষ খুন হয়। কিন্তু বছরখানেক আগে শিয়ালকোটে দুই ভাইয়ের জনসমক্ষে হত্যায় পাকিস্তানের শিক্ষিত ও সুশীল সমাজ এতটা আশ্চর্য ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল কেন? পাকিস্তানে অর্ধেকের বেশী খুন করা হয় ভোতা অস্ত্র, যেমন কুঠার দিয়ে “ইজ্জত বাঁচাতে হত্যা” (honor killing) – যা ভোক্তভুগীকে সর্বাধিক যন্ত্রণা দেয় মৃত্যুকালে। এরূপে হত্যাকৃত ভোক্তভুগীরা একই ধরণের ব্যাথা ও যন্ত্রণা অনুভব করে, যেরূপ করেছিল শিয়ালকোটে হত্যাকৃত ভ্রাতৃদ্বয়। তবে দেশবাসী এতটা বিক্ষুব্ধ কেন হয়েছিল সে ভাই দু’জনের হত্যায়। তার কারণ ছিলঃ বর্বর-নির্দয় হত্যার সে দৃশ্যটি উপস্থিত সাধারণ লোকজন উৎসুক্যের সাথে দেখছিল, যেন একটা মজাদায়ক খেলার মত।

অনুরূপভাবে কোন মানব ব্যক্তিকে গুলি করে মারা খারাপ। কিন্তু একজন অসহায় সাধারণ মানুষকে, যেমন হাত-পা বাঁধা ড্যানিয়েল পার্লকে, “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি তুলে ধীরে ধীরে গলা কেটে হত্যা করা এবং সে দৃশ্যের ভিডিও বানিয়ে ইন্টারনেটে সম্প্রচার করা সভ্য মানুষের কাছে অগ্রহণীয়। অনুরূপভাবে মহড়া করে মানুষ হত্যা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবানদের জন্য একটা সচরাচর চর্চা। এরূপ প্রত্যেকটি প্রদর্শণীর পর বলিদানকৃত ব্যক্তির ছিন্নমস্তককে চুল ধরে তোলা হয় ক্যামেরার সামনে, যা সমেবেত এক উৎফুল্ল জনতা দেখে আনন্দিত হয়। সৌদি আরবে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর মোমিনরা দৌঁড়ে ছুটে মসজিদের নিকটবর্তি উন্মুক্ত মাঠে সেখানে সমেবেত জনতার সবচেয়ে সামনে জায়গা নেওয়ার জন্য – যারা সেখানে জাহির হয় দাগী আসামীদেরকে জনসমক্ষে মস্তক ছিন্ন করে হত্যা করার দৃশ্য দেখার জন্য।

এরূপে মানুষ হত্যা ও ঈদুল-আযহায় প্রকাশ্যে মহড়া করে পশু কুরবানী দেওয়ার মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়ই একই ধরনের মনোবৃত্তির কার্যকর প্রতিফলন মাত্র। ---- পাকিস্তানী লেখক নায়ার খান ইতহাস, ধর্ম ও পারস্পারিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের উপর গবেষণায় উৎসাহী। লেখাটি ইংরেজীতে http://www.viewpointonline.net-এ প্রকাশিত হবে। লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে ইমেইলঃ . ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.