আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি। Click This Link
আহলে সুন্নাত, নবী (সা.)-এর সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞ
সুধী পাঠকমন্ডলী! উপরোক্ত শিরোণাম দ্বারা বিচলিত হবেন না। আপনারা তো আল্লাহর মেহেরবানীতে হকের উপর চলছেন এবং অবশেষে আল্লাহর মর্জিকে হাসিল করে নিবেন। শয়তানী ধোকা এবং আমিত্ব আপনাদেরকে যেন অহংকারে নিমজ্জিত না করে এবং অন্ধ বিদ্বেষ আপনাদের উপর যেন বিজয় অর্জন করতে না পারে, কেননা উহা সত্য এবং বেহেশত পর্যন্ত পৌছাতে দেয়না।
যেমনটি আমি পূর্বেও বয়ান করেছি যে, “আহলে সুন্নাত” তাদেরকেই বলা হয় যারা ‘খোলাফায়-এ-রাশেদীন’ তথা হযরত আবু বকর, উমর, উসমান ও আলীর খেলাফতকে স্বীকার করে থাকেন এবং এই কথাটি সকলেরই জানা।
কিন্তু ইহাও একটি তিক্ত বাস্তবতা যে, হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে আহলে সুন্নাতগণ খোলাফায়ে রাশেদীনদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করতেন না, আর না তাঁর খেলাফতকে শরীয়াত সম্মত গণ্য করতেন।
হযরত আলীকে অনেক দীর্ঘ সময়ের পর খোলাফায়ে সালাসার (তিন জন খলিফা) দলে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। অর্থাৎ ২৩০ হিজরীতে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের যুগে হযরত আলীকে চতুর্থ খলিফা হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে।
হযরত আলীকে পছন্দ করেন না এমন সাহাবী, খলিফা, বাদশাহগণ এবং হযরত আবু বকরের যুগের শাসকবৃন্দ এমন কি আব্বাসীয় খলিফা মুহাম্মদ বিন আর-রশিদ এবং মো’তাসিমের যুগের শাসকরাও না কেবল হযরত আলীর খেলাফতকে অস্বীকার করতো, বরং তাদের মধ্যেকার কিছু কিছু লোক তো তাঁর প্রতি লা’নত করত এবং তাঁকে মুসলমান বলেই গণ্য করতনা। যদি মুসলমান বলেই গণ্য করত তাহলে মিম্বরের উপর থেকে গাল-মন্দ করার অর্থ কি? এই রাজনীতিকে তো আমরা বুঝতে পারলাম যে, হযরত আবু বকর ও উমর, হযরত আলীকে ‘খেলাফত ও হুকুমত’ থেকে দূরে কেন রেখেছিলেন? আবার ঐ দুজনার পর হযরত উসমান খেলাফতের মসনদে আসীন হলেন এবং তিনি তার বন্ধুদের চেয়েও অধিক হযরত আলীকে অবজ্ঞা করেছেন।
এমনকি একদা হুমকী দিলেন যে, “তোমাকেও আবু যার গিফারীর ন্যায় শহর থেকে বের করে দেয়া হবে”।
আর রাজত্ব যখন মোয়াবিয়ার হাতে এলো তখন সে ইহাকে আরো বিস্তৃত করল এবং হযরত আলীর প্রতি গালমন্দ করা শুরু করল এবং লোকজনকে গালিগালাজ করতে বাদ্ধ করল। সুতরাং বনী উমাইয়ার সকল শাসক প্রত্যেক শহর ও গ্রামে এই বদ রেওয়াজটি চালু করে দিল এবং আশি বছর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে (তাদের মধ্যেকার কেবল উমর বিন আব্দুল আজিজ এই অপকর্ম থেকে বিরত ছিলেন)।
বরং এই গালমন্দ আর হযরত আলী থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এবং তাঁর অনুসারীদের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখার ধারাবাহিকতা এর চেয়েও অধিক কাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অব্বাসীয় খলিফা মোতাওয়াক্কিলের শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, সে ২৪০ হিজরীতে হযরত আলী এবং হযরত ইমাম হুসাইনের কবর উপড়ে ফেলেছিল।
নিজ যুগের আমীরুল মুমেনীন ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের প্রতি লক্ষ্য করুন যে, জুময়ার দিনে মানুষের সম্মুখে খোৎবা প্রদান কালে বলেছিল, “রাসুল হতে হাদীসটি নকল করা হয়েছে যে, ‘(হে আলী) তুমি আমার নিকট তেমনই আছ যেমন মুসার জন্য হারুন ছিলেন’, হাদীসটি সত্য কিন্তু এতে তাহরীফ করা হয়েছে। আসলে রাসুল তাকে (আলীকে) উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, ‘আমার নিকট তুমি তেমনই আছ যেমন মুসার জন্য কারুন ছিল”। [তারিখে বাগদাদ, খন্ড-৮, পৃ-২৬৬]
মোতাসিমের যুগে নাস্তিক ও কাফেরদের সংখ্যাগরিষ্টতা ছিল, দার্শনিকদের যুগ ছিল, খেলাফতে রাশেদার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। মানুষের জন্য নুতন নুতন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে এই কথার জন্য চাবুক মারা হয়েছিল যে, তিনি কোরআনকে ‘ক্বদীম’ (শ্বাস্যত) বলে স্বীকার করতেন।
মানুষ তাদের বাদশাহদের দ্বীন পালন করছিল এবং কোরআনকে ‘মাখলুক’ (সৃষ্ট) জ্ঞান করত। সুতরাং আহমদ বিন হাম্বল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে কোরআনকে ‘মাখলুক’ বলে জীবন রক্ষা করলেন। কিন্তু মোতাওয়াক্কিলের যুগে ইমাম হাম্বলের খুব নাম ডাক হল এবং সে যুগেই হযরত আলীকে প্রথম তিন খলিফার সাথে সম্পৃক্ত করা হল (তথা ৪র্থ ‘রাশিদ’ খলিফা হিসাবে স্বীকার করা হল)।
আহমদ বিন হাম্বলকে সম্ভবত ঐসমস্ত হাদীস অবাক করে দিয়েছিল যা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। আহমদ বিন হাম্বল বলেন যে, “যত হাদীস আলী ইবনে আবি তালিবের ফাযায়েল সম্বন্ধে নাযিল হয়েছে তত হাদীস অন্য কারো সম্বন্ধে নাযিল হয়নি”।
দলিল
‘তাবাকাতে হেনাবেলা’ -ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের বিশ্বস্ততম কিতাব, তাতে ইবনে আবি ইয়োলা এবং দীযাতুল হামসী-এর সনদে লিপিবদ্ধ আছে যে- “আমি আহমদ বিন হাম্বলের নিকট সেসময় গেলাম যখন সে হযরত আলীকে ৪র্থ খলিফা স্বীকার করে নিয়েছিল [এই মুহাদ্দিসের প্রতি লক্ষ্য করুন, যে হযরত আলীর প্রতি গালিগালাজ করে না আর না লা’নত করে বরং রাযিয়াল্লাহু আনহু বলে। কিন্তু এই কথার প্রতি রাজি নয় যে আলীকে খলিফাদের অন্তর্ভূক্ত করা হোক। এ ব্যাপারে আহমদ বিন হাম্বলের সাথে তর্ক জুড়ে দেয় এবং তার কর্তৃক জমার সীগা (বহুবচনের সীগা) ব্যবহার হওয়াতে বুঝে আসে যে, তাকে আহলে সুন্নাতের জামায়াতটি আহমদ বিন হাম্বলের নিকট পাঠিয়ে ছিল]। আমি তাকে বললাম, ‘হে আবু আব্দুল্লাহ! এভাবে তালহা ও জুবায়েরকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়’। তিনি বললেন, ‘তুমি খুব খারাব কথা বলেছ, আমরা কি এই জাতির ঝগড়া ও কিস্সা-কাহিনী নিয়ে পড়ে থাকব’? আমি বললাম, ‘আল্লাহ আপনার সংশোধন করুক, আমি কথাটি এ জন্য বলেছি, কেননা আপনি আলীকে ৪র্থ খলিফা বলে স্বীকার করেছেন এবং তাঁর খেলাফতকে ওয়াজিব গণ্য করেছেন অথচ ইমামগণ তাঁর খেলাফতকে ওয়াজিব গণ্য করেন নি’।
তিনি বললেন, ‘এমন করাতে আমাকে কোন জিনিসটি বাধা দিতে পারে’? আমি বললাম, ‘ইবনে উমরের হাদীস’। তিনি বললেন, ‘হযরত উমর তার পুত্রের চাইতে উত্তম অবস্থানে আছেন, তিনি আলীকে মুসলমানদের খলিফা বানাতে রাজি ছিলেন এবং আলীকে খলিফা নির্বাচনকারী কমিটির সদস্য বানিয়েছিলেন এবং আলী স্বয়ং নিজের নাম ‘আমীরুল মুমেনীন’ রেখেছেন। আমি কি এই বলব যে, আমি মুমিনদের আমীর নই’? রাবী বলে যে, এরপর আমি উঠে চলে এলাম। (তাবাকাতুল হেনাবেলা, খন্ড-১, পৃ-২৯২)।
এই কাহিনী দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আহলে সুন্নাত হযরত আলীকে খলিফা স্বীকার করত না, তবে হ্যাঁ আহমদ বিন হাম্বলের সময় ধেকে তাঁর খেলাফতের বৈধতাকে স্বীকার করেছে।
আবার এ কথাও পরিস্কার হয়ে যায় যে, উক্ত মুহাদ্দিসটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সরদারগণের মুখপাত্র ছিল। কেননা হযরত আলীর খেলাফতকে বাতিল করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের কথা দ্বারা হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা করত। যেহেতু বুখারী তার সহীহতে নকল করেছেন এবং আহলে সুন্নাতগণ ‘সহীহ বুখারী’-কে আল্লাহর কিতাবের পরে সবচাইতে সহীহ-শুদ্ধ গ্রন্থ বলে স্বীকার করে থাকেন, সেহেতু হযরত আলীর খেলাফতকে অস্বীকার করাটাই জরুরী।
যদিও আমি উক্ত হাদীসটি আমার পূর্ববর্তী কিতাব ‘ফাসআলু আহলুয যিকির’-এ উল্লেখ করেছি, কিন্তু সাধারণের উপকারের জন্য পুনরায় উল্লেখ করাতে কোন দোষ নেই। কেননা পুনরাবৃত্তিতে অনেক লাভ আছে।
বুখারী তার সহীহতে আব্দুল্লাহ বিন উমর হতে নকল করেছেন যে, তিনি বলেন, ‘আমরা নবীর যুগে আবু বকরকে সবচাইতে উত্তম জ্ঞান করতাম, তারপর উমর এবং তারপর উসমানের মর্যাদা ছিল’। [সহীহ বুখারী, খন্ড-৪, পৃ-১৯১, কিতাব বাদাউল খাল্ক, বাব-ফসলে আবি বকর বা’দুন নবী]
অনুরূপ বুখারী ইবনে উমর হতে আরো একটি হাদীস নকল করেছেন যা প্রথম হাদীস থেকেও অধিক স্পষ্ট। আব্দুল্লাহ বিন উমর বলেন, ‘আমরা নবী (সা.)-র যুগে কাউকেই আবু বকরের চেয়ে উত্তম জ্ঞান করতাম না। তারপর ছিল উমরের মর্যাদা এবং তারপর উসমান, অত:পর নবী (সা.)-এর প্রত্যেক সাহাবীর মর্যাদা সমান ছিল, তাদের মধ্যে আমরা কাউকেই একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করতাম না’। [সহীহ বুখারী, খন্ড-৪, পৃ-২০৩, বাব-মানাকিবে উসমান বিন আফ্ফান মিন কিতাব বাদাউল খাল্ক]
আর এই হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে রাসুল (সা.)-এর রায় দেয়ার কোন হক নাই আর না এ বিষয়ে তাঁর কোন ভূমিকা আছে, বরং ইহা হল আব্দুল্লাহ বিন উমরের আবিস্কার।
হযরত আলীর সাথে যার শত্রুতা ও বিদ্বেষের কথা অনেক বিখ্যাত। আহলে সুন্নাতে ওয়াল জামায়াতের ভিত্তিই প্রতিষ্টা হয়েছে হযরত আলীর খেলাফতকে স্বীকার না করাকে কেন্দ্র্র করেই।
এমন সব হাদীসগুলির কারণেই বনী উমাইয়াগণ হযরত আলীর প্রতি গালিগালাজ ও লা’নত করাকে ‘মোবাহ’ ঘোষণা দিয়েছে এবং মোয়াবিযার যুগ থেকে মারওয়ান বিন মুহাম্মদ বিন মারওয়ানের যুগ তথা ১৩২ হিজরী পর্যন্ত শাসকমন্ডলীর কর্তব্যই ছিল যে, তারা মিম্বরগুলি থেকে আলীর প্রতি লা’নত করত এবং তাঁর অনুসারী ও শুভাকাঙ্খিকে তরবারী দ্বারা হত্যা করত (একমাত্র হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজের দুই বৎসরের খেলাফত আমলে লা’নত বন্ধ ছিল। কিন্তু উমর বিন আব্দুল আজিজের হত্যাকান্ডের পর এই ধারাবাহিকতা আবারো শুরু হয়ে গেল। শুধু এতটুকুই যথেষ্ট ছিলনা বরং হযরত আলীর কবরকে উপড়ে ফেলা হল এবং তার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখাকেও হারাম ঘোষণা দেয়া হয়েছিল)।
অতঃপর ১৩২ হিজরীতে শাসনভার বনী আব্বাসের হাতে এলো এবং মোতাওয়াক্কিলের যুগ তথা ২৪৭ হিজরী পর্যন্ত সেই বংশেই ছিল। বনী আব্বাসের শাসনামলেও বিভিন্ন পন্থায় হযরত আলী এবং তাঁর অসুসারীদের প্রতি গোপনে দূরত্ব অবলম্বন করা হত। কেননা বনী আব্বাসগণ আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীগণের সহযোগিতা ও সহানুভূতির কারণেই শাসন ক্ষমতা পেয়েছিল, সেজন্যই তারা এবং তাদের শাসকমন্ডলী খোলাখুলি হযরত আলীর প্রতি লা’নত করতে পারতো না। কেননা হুকুমাতের মুসলেহাতের এটাই ছিল দাবী। কিন্তু গোপনে এরা বনী উমাইয়াদের চাইতেও অধিক ষড়যন্ত্র করেছিল।
আহলে বাইত এবং তাঁদের অনুসারীগণের অসহায়ত্ব স্পষ্ট হয়েগিয়েছিল এবং প্রাকৃতিক ভাবেই মানুষের অন্তরে তাঁদের জন্য সহানুভূতির অনুভুতি জাগ্রত হয়েছিল। সুতরাং শাসকমন্ডলী চালাকী ও ধোকাবাজীর আশ্রয় নিয়ে আহলে বাইতের ইমামগণের নৈকট্য অর্জন করল অন্যথায় আহলে বাইতের প্রতি তাদের কোন ভালবাসা ছিলনা আর না তারা তাঁদের অধিকারকে স্বীকার করতো। বরং তাদের মৌনতা তো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সেই বিশৃঙ্খলার কারণে ছিল যা তাদের হুকুমাতের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারতো। সুতরাং মামুনুর রশীদও নবী বংশের অষ্টম ইমাম রেজাকে ‘ওলী আহাদ’ (যুবরাজ) বানিয়েছিল। কিন্তু যখন রাজ্যের আভ্যন্তরীন অবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েগেল তখন ইমামগণ এবং তাঁদের অনুসারীগণের অবমাননা আরম্ভ করেদিল।
অনুরূপভাবে, মোতাওয়াক্কিলও যখন অবস্থা নিজের অনুকুলে দেখল তখন সেও হযরত আলীর প্রতি প্রকাশ্যে হিংসা-বিদ্বেষ প্রদর্শন করতে লাগল। এমনকি তাঁর সন্তান হযরত ইমাম হুসাইনের কবর মোবারককেও উপড়ে ফেলেছিল।
এসমস্ত কথাবার্তার কারণেই তো আমরা বলি যে, “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত” হযরত আলীকে তো খলিফা স্বীকারই করে নাই। তবে হ্যাঁ, আহমদ বিন হাম্বলের পরে স্বীকার করেছেন।
এ কথা অবশ্যই সত্য যে, সর্বপ্রথম আহমদ বিন হাম্বল হযরত আলীর খেলাফতকে স্বীকার করেছেন।
কিন্তু তিনি এর দ্বারা ‘আহলে হাদীস’-কে সন্তুষ্ট করতে পারেন নি, যেমনটি আমি পূর্বেই বয়ান করেছি, কারণ তিনি আব্দুল্লাহ বিন উমরকে অনুসরণ করতেন।
এটা তো স্পষ্ট যে, জনগণ আহমদ বিন হাম্বলের এই চিন্তাকে সহজে কবুল করতে পারতো না। বরং এর জন্য এক দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। আসলে আহলে বাইতগণের ব্যাপারে হাম্বলীদের ন্যায়পরায়ন হওয়া এবং তাঁদের নৈকট্য অর্জন করার পিছনে একটি কারণ ছিল। তা এই যে, নিজেদেরকে যেন অন্যান্য ‘সুন্নী মাযহাব’ তথা মালেকী, হানাফী ও শাফেয়ীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ গণ্য করাতে পারেন আর এভাবে নিজেদের সমর্থকদের বৃত্তটিকে আরো বড় করে নিতে পারেন।
এটাতো স্পষ্ট যে, এর জন্য কোন একটি চিন্তার বিশ্বাসী হওয়াটাও জরুরী ছিল।
যুগের দাবী অনুসারে “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত”-এর সকলেই সেই কথা বলতে লাগল যা আহমদ বিন হাম্বল বলেছিলেন এবং হযরত আলীকে চতুর্থ খলিফা স্বীকার করে নিল এবং তাঁর জন্য সেই সকল বিষয়াবলীকে জায়েজ গণ্য করতে লাগল যা অন্য তিন খলিফার জন্য জায়েজ গণ্য করত, যেমন সম্মান প্রদর্শন করা এবং ‘রাযিয়াল্লাহু আনহু’ ইত্যাদী বলা।
এই কথার প্রতি ইহা কি উত্তম দলিল নয় যে, ইতিপূর্বে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের সম্পর্ক খারেজীদের সাথে ছিল যারা হযরত আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করত, তাঁর অবমাননা করত ও দোষী সাব্যস্ত করত?
জ্বী হ্যাঁ, যুগ যখন অতিবাহিত হয়েগেল, আহলে বাইতের ইমামগণ দুনিয়া থেকে চলে গেলেন আর (দৃশ্যতঃ) ফেরৎ আসবেন না এবং শাসকমন্ডলী ও বাদশাহদের ভীতি শেষ হয়েগেল এবং ইসলামী খেলাফত খন্ডে খন্ডে বিভক্ত হয়েগেল, আর গোলাম ও মোঘল এবং তাঁতাঁরগণ উহা করায়ত্ব করে নিল, তখন দ্বীনের মধ্যে দূর্বলতা এসেগেল এবং অধিকাংশ মুসলমান মদ-নারী এবং খেল-তামাশায় নিমগ্ন হয়েগেল। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকল। নামাজকে তারা ভুলে গেল।
যৌন পূজায় নিমজ্জিত হয়েগেল। ভাল কর্মগুলিকে মন্দ জ্ঞান করতে লাগল এবং মন্দ কর্মগুলিকে ভাল জ্ঞান করতে লাগল। জমিন ও পানিতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়ল, এবার মুসলমান নিজেদের পূর্বপুরুষদের জন্য কান্না জুড়ে দিল, তাদের মর্যাদাকে স্মরণ করতে লাগল। তাদের যুগের নকশা আঁকতে লাগল এবং সেই দিনগুলিকে স্বর্ণের যুগ বলা শুরু করল। সর্বদিক থেকে তাদের নিকট সাহাবাদের যুগই সর্বোত্তম যুগ ছিল।
কেননা তাঁরাই বিভিন্ন দেশ জয় করেছিলেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, কায়সার ও কিসরা (ইরান ও রোমের রাজত্ব) তাদের তুলনায় নগন্য ছিল। সেজন্যই তারা সমস্ত সাহাবাকে ‘রাযিয়াল্লাহুআনহু’ বলতে লাগল। যেহেতু হযরত আলী ইবনে আবি তালিবও সাহাবাদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন, সেহেতু তাঁকেও রাযিয়াল্লাহু আনহু বলতে লাগল। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত যখন সকল সাহাবাদের ন্যায়বান হওয়াকে স্বীকার করে নিলেন তখন তাদের জন্য ইহা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি যে তারা হযরত আলীকে সাহাবাদের দল থেকে খারিজ করে দিবেন।
আবার হযরত আলীকে যদি সাহাবাদের দল থেকে খারিজ করার কথা বলতেন তাহলে বিপদে আটকা পড়তেন এবং প্রত্যেক বিবেকবানদের কাছে তাদের কথা প্রকাশ পেয়ে যেত।
বিধায় তারা সাধারণ মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য খোলাফায়ে রাশেদীনদের মধ্যে হযরত আলীকে চতুর্থ খলিফা, জ্ঞান নগরীর দরজা, রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু বলা শুরু করে দিল।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের কাছে আমার একটি প্রশ্ন করার আছে, তা হলো এই যে, আপনারা যদি হযরত আলীকে “জ্ঞান নগরীর দরজা” স্বীকারই করেন তাহলে নিজেদের দ্বীনী এবং দুনিয়াবী বিষয়াবলীতে তাঁকে অনুসরণ করেন না কেন?
আপনারা জেনে বুঝে ‘জ্ঞানের দরজা’-কে কেন ছেড়ে দিলেন এবং আবু হানিফা, মালিক, শাফেয়ী ও আহমদ বিন হাম্বল এবং ইবনে তাইমিয়্যাহর অনুসরণ কেন করলেন। এরা কি জ্ঞান ও আমল এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও ভদ্র্রতায় হযরত আলীর চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন? “চে নিসবাত খাক রা বা আলামে পাক”।
আপনাদের কাছে যদি আকল অথবা বিবেক থাকতো তাহলে কখনোই হযরত আলী এবং মোয়াবিয়ার মধ্যে তুলনাই করতেন না।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হতে রেওয়ায়েতকৃত সমস্ত হুকুম-আহ্কাম থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবং সেই বিষয় থেকেও যা নবী (সা.)-এর পরে হযরত আলীর আনুগত্য সকল মুসলমানের জন্য ওয়াজিব করা হয়েছে, স্বয়ং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মধ্যেকার একজনের বক্তব্য হল যে, হযরত আলীর শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে তাঁর সর্বাগ্রে ইসলাম গ্রহণে।
আল্লাহর পথে জিহাদ করা, তাঁর জ্ঞান, তাঁর মহান মর্যাদা এবং তাঁর ধার্মিকতা সকলেই জানতো। বরং আহলে সুন্নাত হযরত আলীকে ভাল করেই জানেন এবং তাঁরা শুভাকাঙ্খি অনুসারীদের চেয়েও অধিক তাঁকে ভালবাসেন। (বর্তমান যুগে প্রায়শঃই আহলে সুন্নাতগণ এধরণের কথাবার্তা বলে থাকেন)।
তাদের প্রতি আমার নিবেদন যে-
তোমরা কোন দিকে চলেছ। একটুখানি নিজেদের পূর্বপুরুষ ও ওলামাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, যারা দুইশত বৎসর পর্যন্ত মিম্বরের উপর থেকে আমীরুল মুমেনীন হযরত আলীর প্রতি লা’নত করেছে।
আমরা তাদের মধ্যেকার একজনার ব্যাপারেও এমন কথা শুনিনি আর না ইতিহাস আমাদেরকে বলে যে, অমুক ব্যক্তি হযরত আলীর প্রতি লা’নত করতে অস্বীকার করেছিল অথবা অমুন ব্যক্তিকে হযরত আলীকে ভালবাসার কারণে হত্যা করা হয়েছে। আহলে সুন্নাতের ওলামাগণের মধ্যে না পূর্বে এমন কেউ ছিল আর না ভবিষ্যতে কেউ হবে, যে এমন দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কাজের আঞ্জাম দিতে পারবে। বরং এর বিপরীত তারা সর্বদা রাজা, বাদশা ও শাসকগণেরই নিকটবর্তী ছিলেন। কেননা, তাদের বায়াত এবং সন্তুষ্টির ফলে উপঢৌকন ও বখ্শিশ প্রাপ্তি হত। সুতরাং তারা বায়াত অস্বীকারকারী সেই সকল সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছে যারা হযরত আলী এবং তাঁর বংশধরকে ভাল বাসতেন।
এ জাতীয় অনেক ওলামা আমাদের যুগেও মওজুদ আছেন।
খ্রীষ্টানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইয়াহুদীদেরকে নিজেদের শত্রু গণ্য করে আসছিল এবং হযরত ঈসা বিন মরিয়াম (আ.)-এর হত্যার অপরাধ তাদের ঘাড়েই চাপাতো। কিন্তু খ্রীষ্টানদের মাঝে যখন দূর্বলতা সৃষ্টি হয়েগেল এবং তাদের আকীদা-বিশ্বাসে নোংরামী সৃষ্টি হয়ে গেল আর অধিকাংশের ধর্ম হয়েগেল নাস্তিকতা এবং গীর্জাগুলো সেই নীতির বিপরীত আবর্জনার স্থল হয়েগেল যা জ্ঞান ও জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে ছিল। আর ইয়াহুদীরা শক্তিশালী হয়েগেল এবং তাদের সাহস বেড়েগেল। এমনকি তারা আরবের ইসলামী এলাকাগুলো দখল করে নিল।
পূর্ব ও পশ্চিমে তারা প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তার করে নিল এবং ‘ইসরাইল’ নামক হুকুমত প্রতিষ্ঠা করে নিল। তখন গীর্জাসমূহের পোপ ইউহেনা বোলিস দ্বিতীয় ইয়াহুদীদের ওলামাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হলেন এবং হযরত ঈসা (আ.)-এর হত্যার অপরাধ থেকে তাদেরকে মুক্ত ঘোষণা দিলেন।
মানুষ তো মানুষই আর যুগ তো যুগই।
চলবে............... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।