স্টিভ জবস নেই, অ্যাপলের সেই সুদিনও নেই। অ্যাপল এখন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রযুক্তির বাজারে সংগ্রাম করছে। অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস মারা যাওয়ার পর থেকে কিছুটা হলেও জৌলুস হারিয়েছে একসময়ের উদ্ভাবনী প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানটি। স্বর্গচ্যুতি, নাকি পুনর্জন্ম? অ্যাপলকে ঘিরে এ প্রশ্নটি ঘুরেফিরেই আসছে। এনএন সম্প্রতি অ্যাপলের ভবিষ্যত্ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
যেভাবে অ্যাপলের স্বর্গচ্যুতি
অ্যাপলে জনপ্রিয়তায় কি ভাটা পড়েছে? প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা এ প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন অবলীলায়। তাঁদের মতে, তিন বছর আগে অ্যাপল থেকে এসেছে সর্বশেষ উদ্ভাবনী প্রযুক্তিপণ্য আইপ্যাড। সম্প্রতি ঘোষিত আইওএস অপারেটিং সিস্টেম নিয়েও অভিনব কিছু দেখাতে পারেনি। জনপ্রিয় অ্যান্ড্রয়েড ও উইন্ডোজের তুলনায় অতি সাধারণ মনে হয়েছে অ্যাপলের নতুন অপারেটিং সিস্টেমকে। বর্তমানে জনপ্রিয়তায় গুগল, মাইক্রোসফট, স্যামসাংয়ের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়ে জৌলুস হারাচ্ছে অ্যাপল।
সাম্প্রতিক কালে অ্যাপলের কর্মকর্তাদের ম্লান দেখাচ্ছে। শুধু উদ্ভাবনী দক্ষতার বদলে তাঁরা সুরক্ষানীতি দেখাচ্ছেন। এর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপ বাড়ছে। একসময় যে দ্রুতগতিতে লাভ করছিল প্রতিষ্ঠানটি, সেই লাভের চাকা থেমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন, এমনকি অ্যাপল আবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
পড়ে গেছে অ্যাপলের শেয়ারের দাম। তবে প্রযুক্তি পর্যবেক্ষকেরা একে রোগ নয়, শুধু উপসর্গই বলেই আপাত সন্তুষ্ট।
স্টিভ জবস থেকে টিম কুক
স্টিভ জবস এবং কুকের মধ্যে চিন্তা, ব্যবসা পরিকল্পনা ও নীতিতে রয়েছে বিশাল ফারাক। এক দিকে জবস। যিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য প্রতিভাধর; খামখেয়ালি।
ব্যবসার ব্যাকরণ মেনে চলার থেকে চিন্তার স্বকীয়তার ওপরেই বেশি ভরসা করতেন যিনি। আর কুক ব্যবসায়ী, বাজারপ্রবণ। মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। রুটিন মেনে সব নিখুঁতভাবে পরিচালনাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ। দক্ষতার সঙ্গেই অ্যাপল সামলাচ্ছেন কুক।
কিন্তু পণ্যের নকশায় উদ্ভাবনী জবসের অভিনবত্বের স্বাদ যেন ম্লান হতে চলেছে। অ্যাপলের পণ্য নকশা গুরু জনি আইভ একা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তবে জবসের অভাব বেশি করে অনুভব করছেন অ্যাপলের লগ্নিকারীরা। তাঁদের একটি বড়ই অংশ মনে করছেন ‘অ্যান্ড্রয়েড’ সর্বনাশ করেছে অ্যাপলের। অবশ্য এর পেছনে যুক্তিও রয়েছে। বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েডের দখলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৫২ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এপ্রিল থেকে মে এই তিন মাসের হিসাবে বাজারের ৪১ দশমিক ৯ শতাংশ আইফোনের দখলে। অ্যাপলের সঙ্গে প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান স্যামসাংয়ের। পেটেন্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে চলছে দ্বন্দ্ব। পণ্যের বাজারে একের পর ‘টাচ স্ক্রিন’ মোবাইল বা আইপ্যাড ঘরানার পণ্য আনছে স্যামসাং আর সিংহাসন ফিরে পেতে নতুন করে ঝাঁপাচ্ছে মাইক্রোসফট। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে টিম কুককে।
অ্যাপলের প্রযুক্তি-ভাবনা
প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বর্তমান যুগকে বলছেন সাশ্রয়ী ট্যাবলেট, ফ্যাবলেট আর পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্যের যুগ। আইপ্যাড বাজারে এনে ট্যাবলেট জনপ্রিয় করলেও বর্তমানে বিভিন্ন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানের সাশ্রয়ী ট্যাবলেটের কারণে মার খাচ্ছে অ্যাপল। আইফোনের বাইরে কোনো বড়মাপের স্মার্টফোন আনেনি অ্যাপল। আইপ্যাড মিনি দিয়ে কিছুটা পণ্য বাজারে আনার ক্ষেত্রে প্রচলিত কট্টর নীতি থেকে সরে এলেও অ্যাপল ঠিকমতো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বাজার বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, আগামীতে প্রযুক্তি-বাজার হবে পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্যের, যেমন স্মার্ট হাতঘড়ি, প্রযুক্তি চশমা, পরিধেয় কম্পিউটার প্রভৃতি।
গুগল সম্প্রতি প্রযুক্তি চশমা তৈরি করে দেখিয়েছে, তবে গুগলের তৈরি প্রযুক্তি চশমা মনে ধরেনি অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুকের। তাঁর মতে, গুগল গ্লাসের ভবিষ্যত্ খুব উজ্জ্বল নয়, এ পণ্যটি সত্যিই ‘জটিল’। সাধারণ ব্যবহারকারীদের এ পণ্যটি মনে ধরবে কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। অল থিংস ডিজিটাল নামের একটি সম্মেলনে অ্যাপলের বর্তমান অবস্থাসহ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তি নিয়ে কথা বলেন তিনি। টিম কুক মনে করেন অ্যাপল এখনো তার জৌলুস হারায়নি।
শিগগিরই অ্যাপলের চমক দেখা যাবে। পরিধেয় প্রযুক্তিপণ্য তৈরিতে অ্যাপল কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। অ্যাপল ভবিষ্যতে আরও উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়ে ভোক্তাদের মন জয় করতে সক্ষম হবে বলেও আশা করছেন টিম কুক।
অ্যাপল চমক
অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রযুক্তি-গুরু স্টিভ ওজনিয়াক সম্প্রতি অ্যাপলের পুনর্জন্ম সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যে বলেন, নতুন নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তিপণ্য বাজারে এনে চমকে দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাপলের খ্যাতি রয়েছে। অ্যাপলের পরবর্তী বড় ধরনের চমকের আগে কিছুটা সময় নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এরপর কিছুটা অন্যদিকে মোড় নিতে পারে অ্যাপল। মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত এক ফোরামে স্টিভ ওজনিয়াক বলেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস মারা যাওয়ার দুই বছর পর অ্যাপলে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
অ্যাপল প্রসঙ্গে ওজনিয়াকের মন্তব্য হচ্ছে, অ্যাপল এখন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং নিজের সংস্কৃতি চালু রাখতে পেরেছে। অ্যাপলের নেতা স্টিভ চলে গেলেও এখনো প্রতিষ্ঠানটির সংগ্রহে অসাধারণ পেটেন্ট রয়েছে। বর্তমানে নতুন মোড় নেওয়ার আগে কিছুটা সময় নিচ্ছে অ্যাপল।
নতুন পণ্য উদ্ভাবন সম্পর্কে ওজনিয়াক বলেন, ইলেকট্রনিক ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবছর বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা করা যায় না।
অ্যাপলের স্বর্গ চ্যুতির ঝুঁকি
প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, হারিয়ে যাচ্ছে অ্যাপলের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভাবন আর প্রাণশক্তি। তাঁরা বলছেন, ম্যাকবুক, আইফোন আর আইপ্যাডের জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে অ্যাপল যে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে, তা এখন হুমকির মুখে। একসময়ের অ্যাপলপ্রেমীরা অ্যাপল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। নতুন নতুন প্রযুক্তিপণ্য বাজারে আনতে না পারলে অ্যাপলের স্বর্গ চ্যুতি সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তবে অ্যাপল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি নতুন ম্যাকবুক ল্যাপটপের নকশা, নতুন সফটওয়্যারসহ নানা পণ্যের নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্পর্কে জানিয়েছে। পাশাপাশি নতুন নতুন প্রযুক্তির পেটেন্ট করছে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যাপলের নতুন প্রযুক্তিপণ্য হিসেবে আসতে পারে নতুন নকশার ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, নমনীয় আইফোন, স্মার্ট-হাতঘড়িসহ প্রয়োজনীয় গৃহস্থালির কিছু পণ্য। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে স্টিভ জবস মারা যাওয়ার পর থেকে পরিচিত অ্যাপল অপরিচিত হতে শুরু করেছে। মানুষের মধ্যে ধারণা জন্মেছে, অ্যাপল যে আর সেই পরিচিত অ্যাপল নেই; অনিশ্চিত অবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছে অ্যাপল।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের দাম রেকর্ডমূল্যে পৌঁছার পর ক্রমশ অ্যাপলের শেয়ারের দাম কমছে। অ্যাপল নিয়ে মানুষের মধ্যে যে বিশ্বাসের স্থান ছিল, সেটা বোধ হয় নড়বড়ে হয়ে গেছে!
দাম বনাম মান
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন দামের স্যামসাং ‘ফ্যাবলেট’-এর কাছে মার খাচ্ছে অ্যাপল। বাজার বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, আগামী বছরনাগাদ বড়মাপের ডিসপ্লেযুক্ত আইফোনের নতুন একটি মডেলের পাশাপাশি ছোট মডেলের আইফোন বাজারে আনতে পারে অ্যাপল কর্তৃপক্ষ। এশিয়ার স্মার্টফোন বাজারে জনপ্রিয়তা পেতে আইফোনের মডেলে রদবদল আনতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের ১০ জুন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ডেভেলপারস সম্মেলনে মোবাইল পণ্যের জন্য নতুন নকশায় অপারেটিং সিস্টেম আইওএস ৭ ঘোষণা করেছে অ্যাপল।
এ অনুষ্ঠানে ম্যাক অপারেটিং সিস্টেমের নতুন সংস্করণ ম্যাভেরিকসের ঘোষণা দিয়েছে অ্যাপল। নতুন ম্যাক প্রো, ম্যাকবুক এয়ারও দেখিয়েছে অ্যাপল। তবে আইফোন ও আইপ্যাড সম্পর্কে কোনো ঘোষণা আসেনি।
বাজার বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, আইওএসের নতুন সংস্করণযুক্ত সাশ্রয়ী দামের আইফোনের ঘোষণা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতাপ্রতিষ্ঠানটি। সাশ্রয়ী দামের এই আইফোনগুলোতে ব্যবহূত হবে প্লাস্টিকের কাঠামো আর এগুলো বাজারে আসবে বিভিন্ন রঙে।
এ আইফোনের দাম ১০০ ডলারের নিচে রাখতে পারে অ্যাপল। তাঁরা আরও ধারণা করছেন, স্যামসাং যেভাবে এশিয়ার স্মার্টফোন বাজার দখল করেছে, অ্যাপলের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী দামের ও বিভিন্ন মাপের আইফোন আনলে তবেই তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক বিষয়টিকে ভবিষ্যতের ভাবনা বলেছেন। তাঁর মন্তব্য হচ্ছে, অ্যাপল মানের সঙ্গে আপস করে না।
অ্যাপলের ভবিতব্য
ক্রেতাদের ভবিষ্যত্ চাহিদার ‘ফর্দ’ অনেক আগেই নিখুঁতভাবে পড়ে ফেলতে পারতেন স্টিভ জবস।
তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে তৈরি করতেন এমন সব পণ্য, যা নতুন বাজার তৈরি করত। কিন্তু টিম কুকের বর্তমান অ্যাপলের ভবিষ্যত্ কোন পথে? ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসবে, নাকি এক দশকের মধ্যেই প্রযুক্তি বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে অ্যাপলের রং ম্লান হয়ে যাবে—সে উত্তর সময়ই বলে দেবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।