মানুষে মানুষে সমানাধিকারে বিশ্বাস করি
বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়। তাঁর একটি ধ্রুপদী সৃষ্টি ‘হীরক রাজার দেশে’। মানবজাতির বিবর্তনের একটি পর্যায়ে এসে দেখা দেয় শ্রম বিভাজন। এরই পরিণতিতে শোষণের উদ্ভব ঘটে। মানবজাতি বিভক্ত হয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট দুটি শ্রেণিতে- শোষক ও শোষিত।
এ দুটি শ্রেণির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়েই রচিত হয় মানবজাতির ইতিহাস। এরকমই একটি দ্বন্দ্বকে উপজীব্য করে গড়ে উঠেছে হীরক রাজার দেশে ছবির কাহিনি। এখানে সূক্ষ্ম হাস্যরসের মাধ্যমে বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির সিক্যুয়াল এই ছবিটি ১৯৮০ সালে মুক্তি পায়। ছবিটির প্রযোজক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
গুপী-বাঘা ট্রিলজির শেষ ছবি ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’।
‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো অত্যাচারী রাজা ও তার দোসরদের প্রায় সব ডায়ালগ ছন্দে ছন্দে উচ্চারিত, কিন্তু একমাত্র চরিত্র যিনি সুর করে কথা বলেন নি তিনি হলেন উদয়ন পণ্ডিত। এটি পরিচালকের অনন্য এক উপস্থাপন। উদয়ন পণ্ডিতের চরিত্রটি স্বাধীন চিন্তা ও মূল্যবোধের প্রতীক। চরিত্রটি একই সঙ্গে শোষণ ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত চিরন্তন মানব সমাজের স্বরূপ উপস্থাপন করে।
হীরকের স্বৈরাচারী শোষক রাজা সাধারণ প্রজাদের অনাহারে রেখে নিজে রাজ্যের খনি থেকে উত্তোলিত বিপুল পরিমাণ হীরার সাহায্যে পর্বতপ্রমাণ ধন-সম্পদ গড়ে তুলেছে। রাজার এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তাকে ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে নিয়ে গিয়ে মগজধোলাই করে দেয়া হচ্ছে।
শিক্ষাই একটি জাতিকে আলোকিত করে, আন্দোলিত করে মূল্যবোধের সপক্ষে। তাই শিক্ষাকে ইতিহাসের অপরাপর শোষকদের মত হীরকের রাজাও ভয় পান। তিনি জানেন রাজ্যের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে ফেললে তাদেরকে অধীনস্ত ও পরাধীন রাখা সম্ভব হবে না।
রাজা তাই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন, উদয়ন পণ্ডিতকে পাকড়াও করতে চেষ্টা করেন। সত্যজিতের চলচ্চিত্রের এ এক অনবদ্য নান্দনিকতা। আমাদের বর্তমান নষ্ট সময়ের বিচারেও সত্যজিতের ছবি খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। আমাদের চারপাশে অসংখ্য হীরক রাজার রাজত্ব। কিন্তু, একদিন ন্যায়েরই জয় হয় স্বৈরাচারী শোষকের বিরুদ্ধে।
শোষিতের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে পাহাড়সম রাজসিংহাসনও হয় চূর্ণ-বিচূর্ণ, পতন হয় হীরক রাজার। রাজা নিজেও তার পতন কামনা করেন ছবির শেষ অংশে এসে।
সত্যজিৎ বলতেন, চলচ্চিত্র কখনও সমাজ পরিবর্তন করতে পারে না, করেও নি কোনদিন। তার প্রায় সব চলচ্চিত্রই এ বক্তব্যকে ভুল প্রমাণিত করে, প্রতিষ্ঠিত করে সেই সমাজবোধকে যে সমাজবোধকে আইজেনস্টাইন বারবার তুলে ধরেছেন তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, চ্যাপলিন নির্বাকভাবে সক্রিয় রেখেছেন তার চলচ্চিত্রকে। সত্যজিতের ছবি সত্যিকার অর্থেই প্রতিরোধ, সাহস, আর স্বাধীনতার অমর কাব্য।
হীরক রাজার দেশে এমনই একটি চলচ্চিত্র যা দেখতে পারে শিশু থেকে শুরু করে সকল বয়সের দর্শক। এ ছবিতে হীরক রাজার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। এছাড়া গুপী গাইন চরিত্রে তপেন চ্যাটার্জী, বাঘা বাইন চরিত্রে রবি ঘোষ এবং উদয়ন পণ্ডিত চরিত্রে সৌমিত্র চ্যাটার্জী স্বমহিমহিমায় ভাস্বর।
বিঃদ্রঃ গত ১৪ ও ১৫ অক্টোবর সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত দু'দিনব্যাপী চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় এই ছবিটি নাগরিক দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত হয়। আর এই রিভিউটি আমাকে লিখতে হয়েছিল প্রদর্শনীর ফোল্ডার এবং পত্রিকার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।