আমি নতুন কিছু পড়তে ভালবাসি
কয়েকদিন পূর্বে এক ছেলেকে বললাম- তুমি না পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে, এখন পড় না কেন! ছেলেটি সহজভাবে উত্তর দিল- ভাই কয়েকদিন আগে আমি একটা দোয়া শিখেছি, যেই দোয়াটা পড়লে ষাট হাজার নেকি পাওয়া যায়-তার মানে ষাট হাজার নেকির দোয়া। এজন্য এখন নামাজ না পড়ে সেই দোয়াটাই মাঝে মাঝে পড়ি! আমি তাকে বললাম- কত নেকি সংগ্রহ করলে তুমি জান্নাতে যেতে পারবে তা কি জান? সেই ছেলে তখন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মানে সে জানে না যে কত নেকি সংগ্রহ করতে পারলে জান্নাতে যাওয়া যাবে।
আমি তাকে আবারও বললাম- দেখ কোন কাজে কত নেকি, কোন দোয়া পড়লে কত নেকি পাওয়া যাবে সেই ব্যাপারে চিন্তা না করে আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে কি কি কাজ আল্লাহ করতে বলেছেন আর আমি সেই সব কাজ যথাযথভাবে করতে পারছি কি না। আল্লাহর নির্দেশিত সেই কাজগুলো করলে কত সওয়াব পাওয়া যাবে তার হিসাব করার দরকার নাই।
আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে যদি একটা সওয়াবও না হয় কিন্তু আল্লাহ আমার কাজে সন্তুষ্ট হন তাহলেই যথেষ্ট আর কোন কাজ করতে গিয়ে যদি কোটি কোটি সওয়াবও অর্জন করি আর সেই কাজ যদি আল্লাহ নির্দেশিত ফরজ কাজকে উপেক্ষা করে হয় তাহলে এই সওয়াবে আমার মুক্তি মিলবে না। এভাবে বলে তাকে এক পর্যায়ে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে আল্লাহর হুকুম পালন করাই মুখ্য, কোনটাতে কত সওয়াব হল এটা গৌন।
এতক্ষন যে কথাগুলো বললাম তা অনেকের কাছেই অপ্রয়োজনীয় হলেও হতে পারে কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। আমাদের সমাজে আমরা ছোটদেরকে শুধু একটা বিষয় শেখাই আর অন্যটা এড়িয়ে যাই। অর্থাৎ ইতিবাচক দিকটা তাদেরকে শেখানো হয় আর নেতিবাচক দিকটা সর্বদাই শেখানো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা হয়।
অথচ এই ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় বিষয় ভালভাবে না বুঝাতে পারলে তারা অনেক সমস্যার সম্মুখিন হয়। দেখা যায় অনেক ভাল কাজও তারা করে না আর অনেক সময় একটা কাজকে ভাল মনে করে করে ফেলে যা প্রকৃতপক্ষে ভাল নয়। কয়েকটা বিষয় খোলাসা করলেই আশা করি সবাই না হলেও অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন।
১. নামাজ দিয়েই শুরু করি। আমাদের সমাজে অনেক ধরনের নামাজি পাওয়া যায়।
কেউ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, কেউ সপ্তাহে আবার কেউ পড়েন বছরে বা বিশেষ সময়ে। যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তারা তো পড়েনই। কিন্তু যারা শুধু শুক্রবারে নামাজ পড়েন তাদের যুক্তি হলো- যেহেতু শুক্রবার গরীবের হজ্জের দিন (জানি না এ ব্যাপরে কোন সহীহ হাদীস আছে কি না) আর এক জুময়ায় নামাজ পড়লে আল্লাহ অন্য জুময়া পর্যন্ত বান্দার সকল গোনাহ মাফ করে দেন তাছাড়া হজ্জ করলে একজন ব্যক্তি মাসুম হয়ে যায় তাই আমরা শুধু জুময়ার নামাজই আদায় করি।
আবার খেয়াল করুন- যখন কোন জানাজার নামাজ পড়ার জন্য লাশ মসজিদের পাশে আনা হয় আর ঘোষনা করা হয় যে নামাজের পড়েই জানাজা হবে তখন দেখবেন অনেক ব্যক্তিই ফরজ নামাজ না পড়ে জানাজা পড়ারা জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ফরজ নামাজ তাদের কাছে কোন ব্যাপার না, এটা তাদের কাছে গৌণ বিষয় আর অনেক কাজ ফেলে হলেও জানাজায় হাজির হতেই হবে!
অন্যদিকে রমজান মাসের বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন- ফরজ নামাজ পড়ি বা না পড়ি আমাকে তারাবির নামাজ পড়তেই হবে! তার মানে আমি তারাবির নামাজের ব্যাপারে যত সিরিয়াস ফরজ নামাজের ব্যাপারে অত সিরিয়াস নই।
কারন তারাবি না পড়লে আমার কি কি সমস্যা হবে তা হয়তো জানি আর ফরজ নামাজ না পড়লে কি কি সমস্যা হবে তা জানি না, অথবা আমি চাই সহজে কিভাবে জান্নাতে চলে যাওয়া যায় সেই পথ আবিস্কার করতে।
আপনারা হয়তো খেয়াল করেছেন বিশেষ বিশেষ রাতগুলোতে (শবে কদর, শবে বরাত, শবে মেরাজ) ইবাদত করার ধুম লেগে যায়। প্রায় সারা রাত নফল ইবাদত করে অথচ ফজরের নামাজ কাজা করে ফেলে, অথবা মনে করা হয় এই রাতটাই যেহেতু হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাত অতএব এই মাসে ইবাদত করলে আর কি লাগে! এই এক রাতের কামাই দিয়ে তারা সারা বছর চলতে চায়। এই রাতের মর্তবা যেভাবে আলোচনা করা হয়ে থাকে অন্যান্য ফরজ ইবাদতগুলোর মর্তবা সেভাবে আলোচনা করা হয় না, এজন্য এক রাতেই জান্নাত হাসিল করার তালে আমরা লেগে যাই।
এতক্ষন থেকে যেই বিষয়গুলো বললাম তা ঘটার পিছনে যেই কারন দায়ি তা হলো নেতিবাচক বিষয়গুলো তাদের সামনে ভালভাবে তুলে না ধরা।
সারা রাত নফল ইবাদত করা, তারাবি পড়া, জানাজা পড়া, শুধু শুক্রবারে নামাজ পড়া এগুলো যে ফরজের সহায়ক, ফরজ পালন ছাড়া যে এগুলোর তেমন কোন মূল্য নাই সেই বিষয়গুলো আমরা অন্যদের সামনে বিশেষ করে ছোটদের সামনে ভাল ভাবে উপস্থাপন করতে পারি নাই বলেই এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়। আমরা যদি তাদের সামনে পজেটিভ এবং নেগেটিভ সকল বিষয়ই ভালভাবে তুলে ধরতে পারতাম তাহলে আমার বিশ্বাস এই সমস্যাগুলো ভবিষ্যতে আর থাকবে না।
২. কেউ যখন তাঁর ছেলে-মেয়েদের উপদেশ দেন তখন শুধু ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেই উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করেন, নেতিবাচক দিকটা বলতে লজ্জাবোধ করেন-এটা ঠিক নয়। স্বাভাবিক ভাবেই উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা ভাল-মন্দের তেমন একটা ভাল বুঝে না। সামনে যেটাকে ভাল মনে করে সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা ভাল না মন্দ সেই বিষয়ে তারা ভাবে না।
পড়াশোনার ব্যাপারে পরামর্শ দিলে তার সকল দিকই উল্লেখ করে পরামর্শ দেয়া দরকার। লেখা-পড়া করলে কি হবে আর না করলে কি হবে বা কিভাবে করা দরকার এর সব কিছুই স্পষ্ট করে উল্লেখ করা দরকার।
অথবা জীবন নিয়ে যদি উপদেশ দিতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রেও মোটা-মুটি ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো স্পষ্ট করা দরকার। কেউ কেউ তাঁর ছেলে-মেয়েকে জীবনের ভাল দিকগুলো বলেন আর মন্দ দিকগুলো এড়িয়ে যান। যেমন-উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা একসাথে থাকা, হাসি-ঠাট্টা করা, ঘুরতে যাওয়া ভালবাসে, কিন্তু তারা তাৎক্ষনিভাবে জানে না যে এর ক্ষতিকর দিকগুলো কেমন ভয়াবহ।
যখন এই ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝতে শেখে তখন আর করার কিছুই থাকে না। অবিভাবকরা যদি লজ্জা না করে আগেই তাদেরকে ভবিষ্যতের বিষয়গুলো খোলাসা করে বলতেন তাহলে তাৎক্ষনিভাবে হয়তো সেই ছেলে-মেয়েরা অবিভাবককে বাঁকা চোখে দেখতো কিন্তু যখন তারা সবকিছু বুঝতে শিখবে তখন এটাকে এক কল্যাণকর কাজ বলেই মনে করবে।
বৈদ্যতিক তারের নেগেটিভ-পজেটিভ একখানে হলেই তা দিয়ে এসি, ফ্যান, ফ্রিজ বা বাল্ব জ্বলে-তা থেকে আমরা অনেক উপকৃত হই- তবে তা হতে হবে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আর নির্দিষ্ট সময়ে। কেউ যদি মনে করে নেগেটিভ-পজেটিভ একখানে হলেই বুঝি এই সুন্দর কাজগুলো হয়ে যাবে-তা কিন্তু নয়। যার স্থান যেখানে যেভাবে তাকে সেখানেই সেভাবেই বসাতে হবে, যদি এটা করা না হয় তাহলে দূর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক।
আর সেই বিষয়টা সবাই বুঝে না। কেবল বাস্তব ময়দানের কর্মীরাই তা বুঝে থাকে। ছেলে-মেয়েরা যেহেতু বাস্তব ময়দানের কর্মী নয় সেহেতু তারা এ বিষয়গুলো ভালভাবে না বুঝে কখন যে নেগেটিভের জায়গায় পজেটিভ আর পজেটিভের জায়গায় নেগেটিভ লাগিয়ে দর্ঘটনায় পড়ে যাবে তা কিন্তু বলা যায় না। এজন্য অবিভাবকদের উচিত সময় থাকতেই এই বিষয়গুলো তাদের সন্তানদেরকে ভালবাবে বুঝিয়ে দেয়া। মনে রাখা দরকার দূর্ঘটনার পরে উদ্যোগ নিয়ে তেমন কোন লাভ হবে না, যা করার দরকার আগেই করতে হবে।
কোন পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কখনও ঝগড়া না বাধে তাহলে তাঁদের সন্তানরাও ঝগড়া শিখবে না। আর তারা যদি কোন খারাপ গালির সাথে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত পরিচিত না হয় তাহলে বড় হয়ে তারা ইচ্ছা করলেও গালি দিতে পারবে না। অর্থাৎ পরিবার তাদের সন্তানদেরকে কি শেখাবে তা আগেই ভেবে দেখা দরকার। তারা যদি নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে জীবযাপন করেন তাহলে তাঁদের সন্তানরাও সেভাবেই বেড়ে উঠবে আর তাঁরা যদি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে জীবন-যাপন করেন তাহলে তাদের সন্তানরা একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে সন্দেহ নাই।
৩. আমরা কুরআন শরীফ অধ্যয়ন করতে দেখি যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেখানেই নেগেটিভ কথা বলেছেন তার পরে পরেই পজেটিভ কথা বলেছেন।
''যারা তাদের রবকে অস্বীকার করেছে, তাদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের (কঠোরতম) শাস্তি; জাহান্নাম কতই না নিকৃষ্টতম স্থান। ...........
অপর দিকে-
সেসব (সৌভাগ্যবান) মানুষ, যারা নিজেরা (চোখে) না দেখেও তাদের রবকে ভয় করেছে, নিসন্দেহে তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। '' সূরা আল মুলক: ৬-১২
যেখানেই জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন তারপর সেখানেই আবার জান্নাতের সু-সংবাদ দিয়েছেন।
শুনুন আল্লাহ কি বলছেন-
''জাহান্নাম যখন দূর হতে তাদের (জাহান্নামীদের) দেখতে পাবে তখন তারা তার ক্রোধ ও তেজস্বী আওয়াজ (অর্থাৎ তর্জন-গর্জন) শুনতে পাবে। আর যখন তাদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জাহান্নামের কোন সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা সেখানে কেবল মৃত্যুকে ডাকতে থাকবে।
(তাদের তখন বলা হবে ) আজ তোমরা ধ্বংস হওয়াকে একবারই শুধু ডেকো না, বরং বহুবার ধ্বংসকে ডাক (কোন কিছুই আজ তোমাদের কাজে আসবে না)''
এরপর বলছেন-
''(হে নবী, এদের) তুমি বল, এটা (জাহান্নামের) এ (কঠোর আযাব) শ্রেয় না সেই স্থায়ী জান্নাত, যার ওয়াদা পরহেযগার লোকদের (আগেই) দিয়ে রাখা হয়েছে; এ (জান্নাতই) হচ্ছে তাদের যথাযথ পুরস্কার ও চুড়ান্ত প্রত্যাবর্তনের স্থান। সেখানে তারা যা কিছু পেতে চাইবে তাই তাদের জন্যে (মজুদ) থাকবে, (তাও আবার) থাকবে স্থায়ীভাবে; এ প্রতিশ্রুর যথাযথ পালন তোমার মালিকেরই দায়িত্ব। '' সূরা আল ফোরকান:১২-১৬
যেখানে হতাশাজনক কথা বলেছেন তার পরেই বলেছেন আশার কথা।
''সময়ের শপথ। মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে (নিমজ্জিত) আছে।
এরপর বলেছেন-
সে লোক গুলো বাদে, যারা (আল্লাহ তায়ালার উপর) ঈমান এনছে, নেক কাজ করেছে, একে অপরকে (নেক কাজের) তাগিদ দিয়েছে এবং একে অপরকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিয়েছে। '' সূরা আসর:১-৩
এখন সবগুলো বিষয় মিলিয়ে পড়লে আমরা দেখতে পাব যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই শিক্ষা দিচ্ছেন কিভাবে কাজ করতে হবে- কথা বলতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে এই অনুযায়ী চলার মাধ্যমে একটা সুখি-সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ার তাওফীক দান করুন এই দোয়া করেই আজকের লেখা শেষ করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।