প্রভাষক ও সমন্বয়ক, আইন বিভগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়; আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট; যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং অধিকার শ্রমিক, আইন ও অধিকার বিষয়ক গবেষক, ব্লগার ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। গেল ২ ফেব্রুয়ারি নবম জাতীয় সংসদের অষ্টম অধিবেশনে সংবাদকর্মীদের সুরক্ষার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধি (সংশোধন) বিল ২০১১ পাস করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধির আগের বিধনানুযায়ী মানহানিকর সংবাদ প্রকাশের অভিযোগে সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যেত। সংশোধিত আইনানুযায়ী এখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আগে সমন জারির বিধান আরোপ করা হয়েছে। বই বা অন্য কোনো প্রকাশনার লেখক ও প্রকাশকও এ সুবিধার আওতাধীন হবেন।
সরকার অবশ্য অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা সাংবাদিকদের প্রকাশিত সংবাদের জন্য অযথা হয়রানি বা গ্রেপ্তার নিরোধে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করবে। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ সংশোধনের মাধ্যমে সরকার এ ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ নিল। এছাড়া ১৮৬০ সালের দ-বিধির একবিংশতম অধ্যায়ের ৪৯৯-৫০২ ধারাগুলোয় মানহানি ও এর শাস্তি সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত রয়েছে।
সংবাদকর্মীদের জন্য আইন সংশোধনের এমন সরকারি উদ্যোগ আপাতদৃষ্টিতে শুভ মনে হলেও আসলেই সরকার সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা চায় কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। কেবল একটি আইনের একটিমাত্র ধারা সংশোধন করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
নতুন সংশোধনীতে সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার খুব উল্লেখযোগ্য কোনো কাজও করে ফেলেনি। যা করা হয়েছে তা আইনের সাধারণ নীতি অনুযায়ী পাওয়া সব নাগরিকেরই আইনি অধিকার।
কাউকে কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার করতে চাইলে তাকে গ্রেপ্তারের আগে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ জানাতে হবে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে, এটাই আইনের সাধারণ রীতি। কোনো আইনে এ বিধানের উল্লেখ না থাকলেও তা ভোগ করার অধিকার নাগরিক হিসেবে সবারই রয়েছে। বিশেষত, যেখানে আমরা আইনের শাসনের কথা বলি সেখানে নূ্যনতম এ অধিকারটুকু ভোগ করা খুবই মামুলি ব্যাপার।
তাই ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে সরকার সাংবাদিকদের জন্য নতুন কোনো অধিকারের দুয়ার উন্মোচন করেনি।
ফৌজদারি কার্যবিধি আইনটি প্রণয়নের সময় সংবাদমাধ্যম এতটা শক্তিশালী ছিল না বা সাংবাদিকতায় এখনকার মতো এত মাত্রাও ছিল না। তবে অষ্টাদশ শতকে সংবাদ ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের যে মানসিকতা শাসকগোষ্ঠীর ছিল তা এখন খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে, সরকারের কার্যকলাপ দেখলে তা মনে হয় না। অধিকন্তু বর্তমান সংশোধিত আইনটিতেও ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলো (টেলিভিশন, বেতার, ওয়েবসাইট, মুঠোফোন প্রভৃতি) উপেক্ষিত। এসব মাধ্যমের সংবাদকর্মীরা এ সুবিধা পাবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়।
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় একুশে টিভি বন্ধের মাধ্যমে যে খারাপ সংস্কৃতির সূত্রপাত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার টেলিভিশন চ্যানেল সিএসবি বন্ধ করে তার ধারাবাহিকতা রেখেছে। আর বর্তমান ১৪ দলীয় মহাজোট সরকারের আমলেও সে ধারা অব্যাহত (যমুনা টিভি, চ্যানেল ওয়ান)। দৈনিক আমার দেশ বন্ধের মাধ্যমে সরকার খারাপ নজির তৈরি করেছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে প্রকাশনা মাধ্যমও সরকারের রক্তচক্ষুর বাইরে নয়।
আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের রোষানলেই মাঝে মধ্যে পড়ে, যদি তাদের স্বার্থহানিকর (অথচ নিরেট সত্য ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট) কোনোকিছু প্রকাশিত হয়। সংবাদমাধ্যম তখন তাদের শত্রু হয়ে ওঠে এবং নানা পন্থায় (বিজ্ঞাপন বন্ধসহ) তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
সামরিক শক্তিও কখনো কখনো (বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়) এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
অথচ সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ আরোপ সাপেক্ষে সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ক্ষমতাশীলরা কখনই 'যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধের ধার ধারে না। নিজেদের পছন্দের ব্যত্যয় ঘটলেই বেআইনি বল প্রয়োগ করে কিংবা প্রি-সেন্সরশিপ করে কিংবা টকশোর অতিথি কারা হবে তাদের নামের ফর্দ ঝুলিয়ে দেয়; আর দোহাই টানে ৩৯ অনুচ্ছেদের ব্যতিক্রমের। কিন্তু কখনই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে না যে, খবরটি দ্বারা রাষ্ট্র কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
আরো রয়েছে একদিকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অন্যদিকে আদালত অবমাননার খড়গ। বর্তমান সময়ে সংবাদকর্মীদের জন্য সবচেয়ে ভীতিকর হলো আদালত সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা বা সংবাদ প্রচার করা। কারণ কী করলে আদালত অবমাননা হয় আর কী করলে হয় না, তা একমাত্র আদালত ছাড়া আর কেউ জানে না। ১৯২৬ সালের অপূর্ণ আইন দিয়ে বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আদালত অবমাননা এক ধোঁয়াশা।
অথচ নজিরহীনভাবে আপিল বিভাগের বিচারের মাধ্যমে একজন সম্পাদক এর দায়ে জেল খাটছেন।
কিছুকাল আগেই সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা আদালতের দেখানো পথ অনুসরণ করে নজিরবিহীনভাবে সংসদের অধিবেশনে পত্রিকার সম্পাদকদের বিরুদ্ধে বিষোধগার করলেন। খবর প্রকাশের দায়ে সমকাল, প্রথম আলো প্রভৃতি পত্রিকাকে তুলোধুনো করে ছাড়লেন। তাদের বিচার চেয়ে বসলেন, এমনকি সংসদে তলবেরও পরামর্শ দিলেন।
আজ তারাই সমন জারির বিধান সংযুক্ত করে সংবাদকর্মীদের স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ করে দেয়ার সাফাই গাইছেন।
ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য সরকার এখনো কোনো নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি। এখনো পর্যন্ত সরকারের ইচ্ছাতেই টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স আসছে-যাচ্ছে। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে গণমাধ্যমের গলাটিপে ধরার (ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বেশি) চেষ্টা করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন? সে তো পরাবাস্তব কোনো বস্তুর নাম। প্রেস কাউন্সিল কার্যকর করার কোনো উদ্যোগও সরকার নিচ্ছে বলে চোখে পড়ছে না।
আজো সরকারের মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের দুর্নীতির কোনো খবর প্রকাশ হলে তারা মানহানির মামলা করেন। অনেক সময় অযথা হয়রানি, ভয়ভীতি বা অত্যাচারও করেন। সেখানে কেবল সমন জারির বিধান সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অপ্রতুল এক সান্ত্বনা মাত্র। এসবের মধ্যেও হলুদ সাংবাদিকতা যে নেই তাও নয়। কিন্তু তা প্রতিরোধেও সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।
বরং মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম বাড়ছে।
কেবল একটি ধারা সংশোধন করে দিন বদলানো সম্ভব নয়। সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সরকারের উদার মানসিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্য সবই লোক দেখানো সান্ত্বনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।