পুরুষ জন্ম-জন্ম সাধনা করেও নারীর মন পাচ্ছে না। নারীর অন্তরের রহস্য বড় জটিল, বড় গোপন। নারী সব দিতে পারে, কিন্তু তার মনের গোপন মঞ্জুষার কুঞ্জিকাটি যেন কিছুতেই দিতে চায় না। শুনেছি, কাউকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে তবে তার হাতে ঐ চাবিকাঠিটি নাকি সমর্পণ করে। তোমার ওপর আজ আমার এত অভিমান, কেন, জানো? তুমি আমার সকল আদর সকল সোহাগ আমার দুরন্ত ভালোবাসার সকল বাড়াবাড়ি নীরবে সয়ে গেছ।
কখনো এতটুকু প্রতিবাদ করনি। তোমার মুখ দেখে কোনোদিন বুঝতে পারিনি, তুমি আমার সে আদর-সোহাগে ব্যথা পেয়েছ, না সুখী হয়েছ। তোমার মুখে কোনোদিন এক রেখা হাসিও ফুটে উঠতে দেখিনি সে সময়! তাই আজ এই কথাটি ভাবতে বুক আমার ভেঙে পড়ছে যে, হয়ত তুমি দায়ে পড়েই আমার অত বাড়াবাড়ি নীরবে সয়েছ, হয়তো ওতে কত ব্যথাই পেয়েছ মনে মনে। কোনো চিঠিতে ও কথাটির ভুলেও উল্লেখ করনি। তাই মনে হয়, ওটাকে কোনো রকমে চাপা দেওয়াই তোমার ইচ্ছা।
আচ্ছা, তাই হোক! এইবার সকল ভুল সকল যাতনা চিরতরেই চাপা পড়বে ফিরলেও আর সে কথা কখনও তুলব না, না ফিরলে তো নয়ই। তাতে প্রাণ যত বেশিই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাক না কেন। যদি ফিরি, তবে আর একবার আত্মবিদ্রোহী হবার শেষ চেষ্টা করব। কিন্তু হায়। কার কাছে এ কথা বলছি! কোন পাষাণ মৌন নির্বাক দেবতা আমার এ তিক্ত ক্রন্দন শুনছে? যা বলছিলাম, তাই বলি।
আমি কেন সুখী হতে পারছি নে জানো? সাধারণ লোকের মতন সহজ ভালোবাসায় তুষ্ট হতে পারছি নে বলে। আমারই চারিপাশে আর সক্কলে কেমন খাচ্ছে দাচ্ছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছে, আবার তখনই মিল হয়েই যাচ্ছেÑ এমনি করে তাদের সুখে-দুঃখে বেশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই সাধারণের পথ ধরে চলতে পারিনে বলেই ওদের একজন হয়ে সুখী হওয়া তো দূরের কথা, অমনি অসুখীও হতে পারলুম না। ওরা বিয়ে করে, ছেলে-পিলে হয়, বড় হলে বিয়ে দেয়, জামাই-বউ ঘরে আসেÑ বাস আর কি চাই? ওরই মধ্যে হাসে, কাঁদে, সব করে। ওরা ওতেই সুখী।
ওরা যা পেয়েছে তাতেই তুষ্ট। কিন্তু আমার মনে হয়, বেচারাদের শতকরা নব্বই জনই যেন জানে না আর জানতে চায় না যে, যে মানুষটিকে নিয়ে এতদিন ঘরকন্না করছে, সেই মানুষটির মনটিই তার নয়। দুই জনাই দুই জনের মন কোনো দিন বোঝেনি, বুঝবার দরকারও হয়নি। এত কাছাকাছি থেকেও তাই- মনের দেশে দুই জন দুই জনের সম্পূর্ণ অপরিচিত। এই ফাঁকি আমার চোখে যে দিন ধরা পড়েছে, সেই দিন থেকে আমি আর কাউকে সাথী করে ঘর বাঁধতে সাহস পাচ্ছি নে।
সদা ভয় আর ব্যথা বাজে এই কথাটি ভাবতে যে আমারই বুকে মাথা রেখে আমারই জীবন-সঙ্গিনী অন্যের কথা ভাববে, তার ব্যর্থ জীবনের জন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, আর আমি তারই কাছে আমার ভালোবাসার অভিনয় করে যাব, সেও, দায়ে প’ড়ে দিব্যি সয়ে যাবে- উঃ। এ-কথা ভাবতেও আমার গা শিউরে ওঠে! আমি যাকে নিয়ে বাসা বাঁধব, আগে দেখে নেব তার মনের মানুষটি আমার মনের মানুষটিকে চিনেছে কি না। তা যত জন্ম না হবে তত জন্ম আমি হয় মায়ের লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে মায়ের কোলেই থাকব, নতুবা লোটা-কমলি নিয়ে বোম বোম করেই বেড়িয়ে বেড়াব।
আমি মানুষ দেখেই তার মনের কথা ধরে দিতে পারি বলে বড্ডো গর্ব করে এসেছি এত দিন, আর অনেক জায়গাতেই চিনেওছি ঠিক। কিন্তু তোমার কাছে যে এমন করে আমার সকল অহঙ্কার চোখের জলে ডুবে যাবে, তা কে জানত! সত্যই
‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কখন কে ধরা পড়ে কে জানে!
সকল গরব হায়, নিমেষে টুটে যায়, সলিল বয়ে যায় নয়নে!’
তা না হলে এত বড় দুর্দান্ত দুর্বার আমাকেও তুমি আজ শিশুর মতন করে কাঁদাচ্ছ! তুমি আর-সকলের কাছে এত সরল, আর আমার কাছেই কেন এত দুর্বোধ হয়ে পড়েছ, বলতে পার লক্ষ্মীমণি? হ্যাঁ, একটি কথা নিবেদন করে রাখি এর মধ্যে-যখন জীবনে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমার ভালোবাসার অবমাননা দেখে, যখন দেখবে তোমার বুক-ভরা অভিমান পদাহত হয়ে ধুলোয় পড়ে লুটাচ্ছে, যখন নিরাশায় বুক ভেঙে যেতে চাইবে (খোদা না করুন), সেদিন এই ভেবে সান্ত¡না পেয়ো প্রিয় আমার, যে, এই দুঃখের সংসারেও অন্তত একজন ছিল, যে তোমায় বড় প্রাণ ভরে ভালোবেসেছিল।
বিনিময়ে তার এক কণাও ভালোবাসা সে পায়নি, তবু সে এতটুকু ব্যথা রেখে যায়নি তোমার জন্যে, এমন কী কোনো দিন তোমার কাছে তা নিয়ে অনুযোগও করেনি! সে তোমায় পেলে মাথার মণি করে রাখত। তোমাকে রাজরাজেন্দ্রাণী করবার সকল ক্ষমতা সকল সাধ তার ছিল। তোমার এত ভালোবাসা এত অভিমানের অধিকারী হলে সে এমন করে তার-বিপুল আশা-আকাক্সক্ষা ভরা উদ্দাম তরুণ জীবনকে এত অল্প দিনে ব্যর্থ করে এমন করে বিদায় নিত না! সে অনেক-অনেক বড় কিছু বিশ্বের বিস্ময় হতে পারত। বড় ব্যথায় তার সারাজীবনটা বিদ্রোহ আর স্বেচ্ছাচারিতা করেই কেটে গেল। আরও মনে করো যে, পর-পারে গিয়েও সে শান্ত হতে পারেনি, চিরদিনের মতো এবারেও সে সেখানে তোমারই তরে মালা হাতে করে তার অশান্ত জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে পথে পথে ঘুরে।
তোমায় বুকে করে তুলে নেবার জন্যে সে সকল সময় তোমার পানে তার সকল প্রাণ-মন নিয়োজিত করে রেখেছে। সে যে তোমায় সত্যিই ভালোবাসে, তাই প্রমাণ করতে সে তার নিজের গর্দানে নিজে খড়গ হেনে মরেছে! আরও মনে করো সেই দিন, যাকে তুমি এক দিন মনে মনে তোমার সুখের পথের কাঁটা, তোমার জীবনের অভিশাপ মনে করেছিলে, সেই তোমার সকল অকল্যাণ, সকল অমঙ্গল থেকে বাঁচাবার জন্যেই চিরদিনের মতো তোমার পথ হতে সরে গিয়েছে। মনে করো, যাকে তুমি অনাদর করেছ তার এককণা ভালোবাসা পাবার জন্যে বহু হতভাগিনী বহু দিন ধরে সাধনা করেছিল, কিন্তু সে কোনোদিন তার মানসী প্রিয়াÑ তোমায় ছাড়া আর কারুর পানে একটু হেসেও চাইতে পারেনি, পাছে তোমার অভিমান হয়, পাছে তুমি ব্যথা পাও ভেবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।