গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা: মেট্রোরেল নিয়ে বিমানবাহিনীর আপত্তি অগ্রহণযোগ্য
পরিকল্পিত নগরায়ণে বাধা তেজগাঁও বিমানবন্দর
বিশেষ প্রতিনিধি | তারিখ: ১৬-১০-২০১১
রাজধানীতে এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, আশির দশকে পরিত্যক্ত ঘোষিত তেজগাঁও বিমানবন্দরের কারণে পরিকল্পিত নগরায়ণ বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা এই বিমানবন্দরটি বিলুপ্ত করে সেখানে একটি জনকেন্দ্র (সিভিক সেন্টার) করার দাবি তুলেছেন।
বক্তাদের মতে, এই বিমানবন্দরের উড্ডয়ন নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিমানবাহিনীর আপত্তির মুখে মেট্রোরেল প্রকল্প অনিশ্চয়তায় পড়েছে। বিমানবাহিনী যে যুক্তিতে বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেল যাওয়ার বিরোধিতা করছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
গতকাল শনিবার ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স মিলনায়তনে ‘রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন ও তেজগাঁও বিমানবন্দর’ শীর্ষক এই আলোচনার আয়োজন করে স্থাপত্যবিষয়ক পত্রিকা মুক্ত আকাশ।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সভাপতিত্বে এই আলোচনা সভায় স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিবেশ আন্দোলন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
বক্তারা রাজধানীর সমন্বিত উন্নয়নে পরিকল্পিত নগরায়ণ, সুষ্ঠু গণপরিবহনব্যবস্থা, ভূমির সুষম ব্যবহারবিন্যাস নিশ্চিত করে যানজট, জলজট ও জনজটমুক্ত মহানগর গড়ে তুলতে পরিত্যক্ত তেজগাঁও বিমানবন্দরসহ সব সামরিক স্থাপনা নগরের বাইরে স্থানান্তরের সুপারিশ করেন।
গোলটেবিলে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নকশা, আলোকচিত্র ও কারিগরি তথ্য-উপাত্তসহ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, রাজধানীর মোট জমির ৪৩ শতাংশ বিনির্মাণ শিল্পের উপযোগী। আর এর বেশির ভাগই তেজগাঁও পুরোনো বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা।
কিন্তু এই বিমানবন্দরের চার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ঊর্ধ্বমুখী উন্নয়ন আটকে গেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের আইনের কারণে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিমানবাহিনীর মতে, তেজগাঁও বিমানবন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনাল স্থাপনা তথা কৌশলগত সম্পদ (স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট)। এখানে অবস্থানকারী বিমানবাহিনীর তিনটি স্কোয়াড্রনের দুটি হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন, যা মূলত ‘রোটারি ইঞ্জিন’নির্ভর। তাই এগুলোর জন্য দীর্ঘ রানওয়ে দরকার পড়ে না। অপর স্কোয়াড্রন ‘স্পেশাল ফ্লাইং ইউনিট’ দুটি সি-১৩০ বিমান পরিচালনা করে, যা স্বল্প দূরত্বে রানওয়ের উপযোগী।
অথচ এর রানওয়ের (আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অননুমোদিত) উড্ডয়ন-অবতরণ অ্যাপ্রোচ ফানেল সংরক্ষণের নামে নগরের বিশাল এলাকায় ঊর্ধ্বমুখী উন্নয়ন আটকে দেওয়া হয়েছে।
ইকবাল হাবিব বলেন, ওই এলাকায় যখন ১১০ ফুট উচ্চতার ফ্যালকন টাওয়ার কিংবা সদ্য তৈরি হওয়া ১৭০ ফুট উচ্চতার ট্রাস্ট ব্যাংক ভবন নির্মাণে কোনো সমস্যা হয় না। অথচ যানজট নিরসনে কার্যকর গণপরিবহনব্যবস্থা মেট্রোরেলের পথ (সর্বোচ্চ উচ্চতা ৬০ ফুট) তৈরির ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য যুক্তি উপস্থাপন করে আপত্তি তুলেছে বিমানবাহিনী।
গোলটেবিলে বক্তারা বলেন, দুর্যোগকালীন সময়ের ব্যবহার আর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিকল্প হিসেবে বিমানবাহিনী যুক্তি দেখিয়েছে। কিন্তু গত শতকের প্রায় সব দুর্যোগে কুর্মিটোলার সাবেক জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তথা বর্তমান শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ে ব্যবহূত হয়েছে।
আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এত কাছাকাছি অবস্থানের কারণে দুটি বিমানবন্দরই একই পরিস্থিতির মুখে পড়বে। সে ক্ষেত্রে জরুরি অবতরণে ব্যবহূত হওয়ার কথা চট্টগ্রাম বা সিলেটের বিমানবন্দর। তা ছাড়া বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নথিতে তেজগাঁওকে পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর নয়, ‘শর্ট টেক অফ ল্যান্ডিং’ (এসটিওএল) বন্দর।
সভাপতির বক্তব্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আমাদের এখন দাবি, তেজগাঁও বিমানবন্দরে সিভিক সেন্টার করা হোক। সেখানে ন্যাশনাল স্কয়ার থাকবে।
সুরম্য ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার ভবন, ফেস্টিভ্যাল সেন্টার, ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি, স্থায়ীভাবে বই, কৃষি, প্রযুক্ত ইত্যাদি প্রদর্শনী কেন্দ্র, শিশুপার্ক, উন্মুক্ত থিয়েটার সেন্টার থাকবে। সেখানে কোনো গাড়ি যাবে না। মানুষ পায়ে হেঁটে যাবে। এটি হতে পারে আনন্দ-বিনোদনের এক খোলা জায়গা। ’ তিনি বলেন, দেশের প্রতিরক্ষা ও সামরিক কৌশলগত কারণে বিমানবাহিনীর দরকার আছে।
তার জন্য দরকার বিমানবন্দর। কিন্তু সেটা শহরের মধ্যখানে কেন হতে হবে। সেটাও করা হোক, শহরের বাইরে উপযুক্ত স্থানে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, অনেক বিশেষজ্ঞ মিলে দেড় বছর ধরে প্রতিটি রাস্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় পর্যালোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের পথ যাবে, যা পরে মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিজয় সরণির পরিবর্তে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে পথটি গেলে সবচেয়ে ভালো হবে।
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যেহেতু বলছেন, তাহলে সেটাই সর্বোত্তম পথ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন সেই বিশেষজ্ঞ, যাঁরা মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে আবিষ্কার করলেন, সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে গেলে সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা জানতে চাই, তাঁরা কারা? তাঁদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হোক। আর দেড় বছর ধরে যেসব বিশেষজ্ঞ কাজ করে নকশা ঠিক করলেন, তাঁরা কেন এই “সবচেয়ে ভালো পথটির” কথা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন না, সেটাও খতিয়ে দেখা হোক। ’
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, যেখানে সরকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাদ দিয়ে নতুন বিমানবন্দর বানাতে চায়, সেখানে তেজগাঁওয়ের এই ভাঙাচোরা বিমানবন্দরটি কেন বিমানবাহিনী রাখতে চায়।
বিমানবাহিনীর উচিত, ঢাকার বাইরে তাদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত আধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের দাবি তোলা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, বিজয় সরণি দিয়ে মেট্রোরেলের গতিপথ নিয়ে বিমানবাহিনীর আপত্তি ও যুক্তি কিছুতেই আইনি দৃষ্টিতে টেকে না।
বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম ইদ্রিস আলী বলেন, ‘টক শোতে এমনভাবে আলোচনা হচ্ছে, যেন বিমানবাহিনী জনহিতকর কাজে বাধা দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিমানবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি করা হচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না।
’
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম বলেন, ১৯৮১ সালে কুর্মিটোলায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পর তৎকালীন এরশাদ সরকার তেজগাঁও বিমানবন্দরকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। তখন এই বিমানবন্দরের জমিতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আবাসন প্রকল্প করারও পরিকল্পনা ছিল।
অন্যান্যের মধ্যে আবাসন কোম্পানিগুলোর সংগঠন রিহ্যাব-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, স্থপতি এ এস এম ইসমাইল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।