বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত! কোন ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অসুচি হন জগন্নাথ! আজ থেকে একশ বছর আগে রোকেয়ার সময় ছিল বাংলার নারী সমাজের জন্য অন্ধকার যুগ। যার অর্থ পশ্চাৎপদ অবস্থা, ধর্মান্ধতা, পর্দা প্রথা, গোঁড়ামী, কুসংস্কার, নির্যাতন, বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণের বেড়াজালে নারীকে শুধুমাত্র বন্দি করেই রাখা হয়নি মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হতো। পাশবিক, ভয়াবহ ও অমানবিক সেই সময় একটা দুঃসময় ছাড়া আর কিছু নয়। রোকেয়া একশ বছর আগে পদ্মরাগ উপন্যাস লেখার সময় বলেছেন, ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক। ’ কত সত্য ও কঠিন কথা।
সেদিন সেই দুঃসহ সময়ে তিনি এমন কথাটি দুঃসাহসের সাথে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন।
—————————————————————–
“সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইত। ছাই, কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারও সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দা করিতে হইত। পুরুষদের ত অন্তঃপুরে যাইতে নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই। কিন্তু মেয়ে মানুষের অবাধ গতি—অথচ তাহাদের দেখিতে না দেখিতে লুকাইতে হইবে।
পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ীর কোন লোকচক্ষুর ইসারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র কখনও রান্নাঘরে ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরানীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নীচে লুকাইতাম। ”
—————————————————————-
আজ একশ বছর পর যখন আমরা দেখি পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে, ইউনিসেফ ও জাতিসঙ্ঘ যখন বলে, ‘কন্যাশিশুকে রক্ষা করতে হবে। কন্যাকে শিক্ষা দিতে হবে। নারীর আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।
নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন। নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ’ তখন নিশ্চয় আমরা আশ্বস্ত হই। আমরা রোকেয়ার সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারায় আকৃষ্ট না হয়ে পারি না। রোকেয়ার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী বা সার্টিফিকেট ছিল না, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত একজন আধুনিক ব্যক্তিত্ব, যার আলোকছ্টায় তার সময়কে বিদ্যুতের মত চমকিত করেছেন এবং আজ আমাদের সময়কেও আলোকিত করে রেখেছেন।
রোকেয়ার চিন্তাধারার শক্তিমত্তা তার প্রতিভাকে বিকশিত হতে শুধু সাহায্য করেনি, নারীর স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে রোকেয়া মানস আমাদের আরও বেশি করে সাহস যোগায়। তার উপন্যাসে নায়িকার কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়, “আমি আজীবন… নারীজাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ-প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব। ” (পদ্মরাগ) তখন নিশ্চয় আমরা দাবি করতে পারি রোকেয়া আমাদের মনে ও মননে সর্বদাই ধ্রুবতারার মতো জ্বলবেন। আমাদের সামনে তিনি এক আলোকবর্তিকা।
রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালে এক ক্ষয়িষ্ণু জমিদার ঘরে, পিতা ছিল চরিত্রহীন ধর্মান্ধ স্বেচ্ছাচারী।
রোকেয়ার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, বড়বোন ও বড় দু’ভাইয়ের কাছে লেখাপড়া শেখেন, কিন্তু এর পেছনে তার মেধা, আগ্রহ ও সাধনা ছিল। বাংলা, ইংরেজি, ফার্সী, আরবী, হিন্দী ভাষা ভালোভাবে জানতেন, তার লেখা পড়লেই বোঝা যায় এসব ভাষার ওপর কতখানি দখল ও জ্ঞানের চর্চা তার ছিল। আর সঙ্গে ছিল তার চারপাশের জগৎ ও মানুষকে দেখার আশ্চর্যরকম ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা। রোকেয়ার একটি কোমল হৃদয় ছিল, আর ছিল গভীর অনুভূতিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গী, যে কারণে খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে পারতেন। সে মানুষ ঘরের ঝি-দাসী হোক, আর কোট-প্যান্ট পড়া সরকারি অফিসার হোক।
তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এই ঝিদের সঙ্গে গল্প করে, চুড়ি বা শাক বেচতে আসা মেয়েদের সঙ্গে হাসি তামাশা করেও তিনি জ্ঞানার্জন করেছেন, যা অবশ্যই তাঁর চিন্তাভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। তিনি কোনো কিছুই অবহেলা বা তাচ্ছিল্যভরে বিস্মৃত হননি। একজন সমাজ সংস্কারক বা সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গীতে রোকেয়া তাঁর সময়ের বাঙালি নারীর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হন। তার দৃষ্টিটি ছিল সামনে এগিয়ে চলার পথে, আলোকের ঝর্নাধারায়। সম্পূর্ণ মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক।
রোকেয়ার মৃত্যু হয়েছিল ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে, স্বল্পায়ু ছিলেন তিনি। এর মধ্যে বিশ বছর কেটেছে জ্ঞানার্জন, বাকি বাইশ বছর কেটেছে তার ক্ষুরধার লেখনীর সংগ্রাম, স্কুল প্রতিষ্ঠা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে রোকেয়ার চেতনার উন্মেষ ঘটে। তিনি একুশ শতকের নারীর জন্য এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিলেন। অবশ্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় নি।
আমরা দু’টো বিশ্ব যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ও দেশ ভাগ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নারীকে দেখেছি অসহায়ত্ব, পতিতাবৃত্তি পেশা গ্রহণে বিদেশে পাচার এবং ধর্ষণের শিকার হতে। বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে নারী তার রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় রেখেছে। বাংলার নারী সমাজ ১৯২৫ সালে ভোটাধিকার পাওয়ায় এই চেতনা আরও মজবুত হয় এবং পরবর্তীতে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছে, নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে জোরালো বক্তব্য রেখেছে।
একশ বছর পর আজকে আমাদের সময়ে বসে আমরা যদি সেই সময়ের চিত্রটা একবার দেখতে চাই তাহলে রোকেয়ার লেখা অবরোধবাসিনীর কাহিনীগুলো পড়লেই খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবো। যেখানে রোকেয়া খুব তীক্ষ্ণভাবে তা তুলে ধরেছেন:
“সে অনেকদিন আগের কথা—রংপুর জিলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ নামক গ্রামের জমীদার বাড়ীতে বেলা আন্দাজ ১ টা-২ টার সময় জমীদার-কন্যাগণ জোহরের নামাজ পড়িবার জন্য ওজু করিতেছিলেন।
সকলের ওজু শেষ হইয়াছে কেবল ‘আ’ খাতুন নামী সাহেবজাদী তখনও আঙ্গিনায় ওজু করিতেছিলেন। আলতার মা বদনা হাতে তাহাকে ওজুর জন্য পানি ঢালিয়া দিতেছিল। ঠিক সেই সময় এক মস্ত লম্বাচৌড়া কাবুলী স্ত্রীলোক আঙ্গিনায় আসিয়া উপস্থিত। হায়, হায়, সে কি বিপদ। আলতার মার হাত হইতে বদনা পড়িয়া গেল।
সে চেঁচাইতে লাগিল—‘আউ আউ! মরদটা কেন আইল। !’ সেই স্ত্রী লোকটি হাসিয়া বলিল, ‘হে মরদানা! হ্যাম মরদানা হ্যায়?’ সেইটুকু শুনিয়াই ‘আ’ সাহেবজাদী প্রাণপণে উর্ধশ্বাসে ছুটিয়া তাহার চাচী আম্মার নিকট গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে ও কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, ‘চাচীআম্মা পায়জামা পরা একটা মেয়ে মানুষ আসিয়াছে!! কর্ত্রী সাহেবা ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সে তোমাকে দেখিয়াছে?’ ‘আ’ সরোদনে বলিলেন, ‘হ্যাঁ!’ অপর মেয়েরা নামাজ ভাঙ্গিয়া শশব্যস্তভাবে দ্বারে অর্গল দিলেন—যাহাতে সে কাবুলী স্ত্রীলোক এ কুমারী মেয়েদের দেখিতে না পায়। কেহ বাঘ ভাল্লুকের ভয়েও বোধহয় অমন করিয়া কপাট বন্ধ করে না। ” (অবরোধবাসিনী-১নং)
আরেকটি কাহিনী হচ্ছে:
“অপরের কথা দূরে থাকুক। এখন নিজের কথা কিছু বলি।
সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইত। ছাই, কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারও সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দা করিতে হইত। পুরুষদের ত অন্তঃপুরে যাইতে নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই। কিন্তু মেয়ে মানুষের অবাধ গতি—অথচ তাহাদের দেখিতে না দেখিতে লুকাইতে হইবে। পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ীর কোন লোকচক্ষুর ইসারা করিত, আমি যেন প্রাণ-ভয়ে যত্র-তত্র কখনও রান্নাঘরে ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরানীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নীচে লুকাইতাম।
বাচ্চাওয়ালী মুরগী যেমন আকাশে চিল দেখিয়া ইঙ্গিত করিবা মাত্র তাহার ছানাগুলি মায়ের পাখার নীচে পলায়, আমাকেও সেইরূপ পলাইতে হইত। কিন্তু মুরগীর ছানার ত মায়ের বুক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট আশ্রয় থাকে, তাহারা সেখানে পলাইয়া থাকে; আমার জন্য সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান ছিল না। ” (অবরোধবাসিনী-২৩নং)
এমনিভাবে ভ্রাতৃবধূর খালার বাড়ী বিহার থেকে একবার দুই চাকরানী রোকেয়াদের বাড়ীতে এলে রোকেয়াকে কখনও টেবিলের তলা, কখনও ত্রিতলে একটি নির্জনে কক্ষের ছাপার খাটের নীচে বাক্সপেটরার ভেতর লুকাইয়া থাকিতে হইত। তখন তার বয়স ছয় বা সাতের বেশী নয়। সারাদিন অনাহারেও কাটাতে হত।
চাকরানীদের সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর পাসপোর্ট ছিল, আর রোকেয়ার কর্তব্য ছিল লুকিয়ে থাকা। যদি তারা দেখে ফেলে, তাহলে কত কথা বলবে, মুরুব্বীরা গঞ্জনা দেবে ‘বেহায়া বেপর্দ্দা মেয়ে’ বলে।
অবরোধবাসীনি খুব কাছ থেকে দেখা ও শোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা। এ কাহিনীগুলো পড়লে বিস্মিত হতে হয় সেই সময়ের নারীর কী দুঃসহ অবস্থা ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে কীভাবে তার পায়ে শেকল পরানো হয়েছে।
পুরুষ কখনও চায়নি নারী পর্দার বাইরে আসুক, লেখাপড়া শিখুক, চাকরী করুক, অর্থ আয় করুক এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করুক।
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, “ধর্ম অত্যন্ত শক্তিশালী একটি বিশ্বাস। এই শিক্ষা অস্থিমজ্জায় মিশে থাকে। ভেতর থেকেই সে আমাদের শাসন করে। তার বিধানকে অগ্রাহ্য করা অথবা অবহেলা করা তাই আদৌ সহজ নয়।
কিন্তু তাই বলে ধর্ম চিরকাল এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সব ধর্মের দিকে তাকিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, তাতে ধীরে ধীরে কমবেশি পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। তাই ধর্ম যতই শক্তিশালি হোক, সে সময়ের ঘড়িটাকে আটকে রাখতে পারবে না, অথবা যে-নারী একবার মুক্ত হাওয়ার স্বাদ পেয়েছে, তাকেও ফের অন্ধকারে ঘরে বন্দী করতে পারবে না। ” (নারী, ধর্ম ইত্যাদি)
ইতিহাসবিদ সৈয়দ আমীর আলি, তার দি স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন ইসলাম প্রবন্ধে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিতে নারীর অবস্থান নিয়ে তুলনামূলক বিশদ আলোচনা করে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ইসলাম নারী ও পুরুষকে পরিপূর্ণ সমানাধিকার দিয়েছে আইনত ক্ষমতা ও কাজ করার।
” তিনি আরও বলেছেন, “হজরত সে আমলের নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা লক্ষ্য করেই মেয়েদের গুপ্তস্থান ঢাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ নির্দেশ দ্বারা যদি বোঝানো হয় যে তিনি বর্তমান কুৎসিত পর্দা প্রথার ইঙ্গিত করেছিলেন, অথবা তিনি কারা প্রাচীরের অন্তরালে বন্দিনী রাখবার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাহলে তার সমাজ সংস্কার নীতির আসল মর্মই ভুল বোঝা হবে। ’
কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন, “অংশের তারতম্যে যেন মনে না করা হয় যে এ বিধান দ্বারা নারীর উপর পুরুষের উৎকর্ষতা দেখানো হয়েছে; এ রকম চিন্তা করাই ইসলামের আসল শিক্ষার পরিপন্থী। ’ তুর্কী নেতা কামাল আতাতুর্ক যখন স্মার্নায় বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন তখন প্রথমেই মেয়েদের সভা ডেকে বলেছিলেন, “যুদ্ধে আমরা নিসংশয়িত জয় সাধন করেছি, কিন্তু সে জয় নিরর্থক হবে, যদি তোমরা আমাদের আনুকূল্য না কর। শিক্ষার জয় সাধন করো তোমরা, কারণ তাহলে অনেক বেশি করতে পারবে।
সমস্তই নিষ্ফল হবে যদি আধুনিক প্রাণ-যাত্রার পথে তোমরা দৃঢচিত্তে অগ্রসর না হও। সমস্ত নিষ্ফল হবে, যদি তোমরা গ্রহণ না কর আধুনিক জীবন যাত্রার নীতি যা তোমাদের উপর অর্পন করা হয়েছে। ” ( সূত্র: আবদুল মওদুদ লিখিত ‘নয়া জমানায় মুসলিম নারীর অবস্থান’ প্রবন্ধ, দিলরুবা পত্রিকা)
রোকেয়ার সমসাময়িক লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ-এর এ রুম অফ ওমেনস ঔন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে, যেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন নারী কেন সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে নি? তার উত্তর হচ্ছে দারিদ্র। নারীর অসহায়ত্বের প্রধান কারণ সে অর্থহীন, তাই সে ক্ষমতাহীন, উপেক্ষিত ও অবহেলিত। ১৭৯২ সালে মেরি ওলস্টোন ক্রাফট-এর ‘ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অফ ওম্যান’ নামে ঘোষিত হয় নারী মুক্তির প্রথম ইশতেহার।
এর মূল দাবি হচ্ছে নারী মানুষ, বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, নারী যৌনপ্রাণী নয়; তাকে দিতে হবে স্বাধিকার। (সূত্র: নারী, হুমায়ুন আজাদ)
আমরা দেখেছি রোকেয়া ছিলেন এ সময়ের সন্তান। নারীর অধিকার নিয়ে পাশ্চাত্যে তখন ঢেউ উঠে গেছে। নারীর অধিকার ও শিক্ষার্জন নিয়ে দাবি উঠেছে। সর্বত্র একটা জোরালো অভিমত গড়ে উঠছে এবং নারীও ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে আসছে।
বিশেষ করে রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক দেশে নারী জাগরণ ও ক্ষমতায়ণ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এশিয়ার যুগ প্রতিনিধি হিসেবে রোকেয়া তাই নারীর অগ্রগতির কথা উচ্চারণ করেছেন। তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলেছেন, “পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব।
আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্টেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জজ—সবই হইব। পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী ভাইসরয় হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে রানী করিয়া ফেলিব!! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকর্মে ব্যায় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন?” (স্ত্রী জাতির অবণতি)
রোকেয়া নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হতে দেখতে চেয়েছেন এবং জোরালো কণ্ঠে তা উচ্চারণ করেছেন। আজকের সময়ে এসে আমরা রোকেয়ার স্বপ্ন সফল হতে দেখছি। রোকেয়ার আন্দোলনকে তার সময়ের পুরুষরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হন, বিশেষ করে শিক্ষিত, সচেতন ও বিবেকসম্পন্ন পুরুষরা সমাজকে এগিয়ে নেবার লক্ষে নারীর গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
তারা নিজেরাও শিক্ষাদীক্ষায় প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন বলে ঘরের মেয়েদের শিক্ষা দিতে স্কুলে-কলেজে ভর্তি করেন এবং এভাবে একদিন ধীরে ধীরে পর্দা ছেড়ে মেয়েরা ঘরের বাইরে এলেন। এটা ত্রিশের দশক থেকেই ব্যাপকভাবে আমরা লক্ষ্য করি। যদিও হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেয়েরা সেই শিক্ষার্জনে এগিয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই নারী শিক্ষার্জনে ঘরের বাইরে আসায় পর্দাপ্রথা ও বেড়াজাল ভেঙে গেল, এতে মা-বাবার উৎসাহ ছিল। পাকিস্তান শাসনামলেও সরকারি চাকুরির মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া কোথাও নারীর প্রবেশাধিকার ছিল না।
বিশেষ করে প্রশাসন, পররাষ্ট্র ক্যাডারে মেধা থাকলেও মেয়েদের চাকুরি দেয়া হতো না। মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত রাখার প্রয়াস চালানো হতো। পাকিস্তানের আদর্শ ও চেতনা হচ্ছে ধর্ম। এর ফলে নারীর ওপর দমন-পীড়নের নানা মাত্রা তৈরি হয়। মধ্যযুগীয় পন্থায় তারা নারীকে ফতোয়া ইত্যাদি নানাভাবে নির্যাতন করেও থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সংবিধানে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারী এখন প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, কূটনীতি, সামরিক বাহিনী, বিমানের পাইলট, প্রকৌশলী, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সর্বত্র কাজ করছে। বিউটি পার্লার, হোটেল থেকে কলে-কারখানায়, কৃষি-খামার, ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি সকল কাজে অংশ নিয়ে অর্থোপার্জন করছে। পরিবারে তার ক্ষমতায়ণ প্রতিষ্ঠা করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হচ্ছে।
এমন কী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আজ নারীর অবস্থান উল্লেখযোগ্য। নারী দেশের প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার আসন অলংকৃত করেছে। সেখানে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশকে এবং নিজের দলকে। এই রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীকে সাহস যুগিয়েছে। নারী নির্যাতন বিরোধী আইন হয়েছে, মেয়েদের শিক্ষা ও চাকুরির সুযোগ বেড়েছে এবং একের অধিক বিবাহের বিরুদ্ধে আইন কার্যকর হচ্ছে।
সন্তানের অভিভাবক হিসাবে মায়ের নামের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তারপরও প্রশ্ন থাকে। রোকেয়ার সময়ের যে নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চনা তা থেকে আমরা কি মুক্ত হতে পেরেছি? পারিনি। নারী এগিয়েছে যতখানি, ঠিক ততখানি তাদের নির্যাতন ও শোষণ করে চলেছে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক ও রক্ষণশীল গোষ্টি, শাসকবর্গ ও পুরুষ শাসিত সমাজ। প্রতিহিংসাপরায়ণতা তার মধ্যে রয়ে গেছে।
আজও নারীকে ধর্ম ও শারীরিক দুর্বলতার কথা বলে পর্দাপ্রথার বেড়াজালে আটক রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত কঠোর। নির্যাতনের নানা মাত্রাও বেড়েছে। নারীর অসহায়ত্ব ও দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাকে এখন যৌনকর্মী বানিয়ে এই পাশবিক পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। নারী তাদের কাছে বাণিজ্যের পণ্য হিসেবে বিবেচিত।
নারীকে তারা শরীরসর্বস্ব করে চলচ্চিত্রে ও মিডিয়ায় ব্যবহার করছে অশ্লীল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে। নারীর নিজস্ব পোশাক ফেলে টি-শার্ট, শর্ট প্যান্ট, জিন্স ও স্যুটে দেখতে চায় পুরুষ। এটা বিকৃত মানসিকতা। পাশ্চাত্যে যে উদ্দাম নারী স্বাধীনতার কথা আমরা শুনি, রোকেয়া তা সমর্থন করেননি। তাঁর আন্দোলন সেটা ছিল না।
তিনি নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলেছেন। আজকের সময়ে এসে আমরা অধিকার হিসাবে প্রেম-বিয়ে-গর্ভধারণ ইত্যাদি কথা বলছি। যৌন স্বাধীনতার দাবি করছি সত্য তবে তার মানে এই নয় যে, পুরুষের বাধ্য হয়ে যৌনাচার চলবে, নিয়ন্ত্রিত হবে। নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নারী শিল্প সংস্কৃতির চর্চা করবে, খেলাধুলা করবে এবং চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করবে।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে। নারীও মানুষ, তাকে মানুষের মর্যাদায় জীবনযাপন, পেশাবৃত্তি গ্রহণ ও বেঁচে থাকার অধিকার দিতে হবে। এটাই ছিল রোকেয়ার স্বপ্ন-সাধনা। আমরা দেখেছি নারীর অশিক্ষা-অচেতনা ও অধিকারহীনতার জন্য দারিদ্রই প্রধান অন্তরায়। আজও যখন কন্যাশিশু ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, কন্যা ভ্রুণ হত্যা, যৌতুকের কারণে স্ত্রী হত্যা ইত্যাদি নির্যাতনের কথা শোনা যায় রোকেয়ার সত্য ও স্পষ্ট উচ্চারণটি মনে পড়ে—“তুই জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হ! মুষ্ঠিমেয় অন্নের জন্য যাহাতে তোকে কোন দুরাচার পুরুষের গলগ্রহ না হইতে হয় আমি তোকে সেইরূপ শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া প্রস্তুত করিব।
তোকে বাল-বিধবা কিংবা চিরকুমারীর ন্যায় জীবন-যাপন করিতে হইবে; তুই সেজন্য আপন পায়ে দূঢ় ভাবে দাঁড়া। ” (পদ্মরাগ)
রোকেয়া ছিলেন এক মহিয়সী নারী। যুগের স্রষ্টা, সমাজ সংস্কারক, জ্ঞানের সাধক, মানবিক হৃদয়ের অধিকারী এবং এই শ্রেণীর মানুষই তো মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে ওঠে। যুগে যুগে এরাই অমর, অক্ষয় ও মৃত্যুঞ্জয়ি হয়ে থাকে।
সবশেষে আমি একজন ইরাকি কবি জামিল সিদকীর কথা দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি—“নারী ও পুরুষের মূল্য একবারে সমান সমান; কারণ নারীই হচ্ছে কালচারের প্রতীক।
”
- সংকলিত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।