আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লতাজির সঙ্গে দুই ঘণ্টা ঃ রুনা লায়লা

লতাজির (লতা মঙ্গেশকর) সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল মুম্বাইয়ে, ১৯৭৪ সালে। ওটা ছিল আমার প্রথম অনুষ্ঠান। ভারতীয় বিদ্যাভবনে। তিনি এসেছিলেন। এর পরের বছর হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য আমার প্রথম গান রেকর্ড করা হবে; সুরকার ও সংগীতপরিচালক ছিলেন কল্যাণজি-আনন্দজি; ফিল্ম সেন্টার স্টুডিওতে মহরত ঘোষণা করতে এসেছিলেন লতাজি।

আশির দশকে কলকাতায় সল্ট লেক স্টেডিয়ামে জ্যোতিবসু তিন দিনের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সেখানে প্রথম দিন ছিল আমার গান। শেষ দিন লতাজি আর আশাজির। তাঁদের সঙ্গে আরও ছিলেন অমিত কুমার। শেষ দিনের ওই অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছিলাম তাঁদের গান শুনতে।

জ্যোতিবাবু আমাকে তাঁদের হাতে ফুল তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। বললেন, ‘আমি দেওয়ার চেয়ে আপনার দেওয়াটা অনেক বেশি ভালো দেখাবে। ’ ওটা আমার জন্য অনেক সম্মানের ছিল। আমি মঞ্চে উঠে লতাজি আর আশাজির পা ছুঁয়ে ফুল দিয়েছিলাম। এরপর লতাজির সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়েছে।

টেলিফোনে। এত বছর পর লতাজির সঙ্গে আবার দেখা হবে, ঢাকায় থাকতেই আমার মধ্যে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময়টা পেয়েছি কয়েক মাস আগে। কিন্তু মনে নানা আশঙ্কা ছিল—লতাজির সঙ্গে দেখাটা হবে তো? আমিও এক বছর পর মুম্বাইয়ের পথে। বলিউড নায়িকা রানী মুখার্জি তাঁদের মুখার্জিবাড়ির পূজায় আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

গত বছরও নিমন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু তখন ব্যস্ততার জন্য যেতে পারিনি। যেহেতু লতাজির সঙ্গে দেখা হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে, তাই এবার আমার সঙ্গে যাচ্ছেন আলমগীর সাহেব। লতাজির সঙ্গে আমাদের দেখা করার সুযোগটা তৈরি করে দেন তাঁরই ভাই হূদয়নাথ মঙ্গেশকরের ছেলে বৈজনাথ মঙ্গেশকর। তিনি আমার অনেক বছরের পরিচিত। আমার গানের দারুণ ভক্ত।

আমার সব গান আছে তাঁর কাছে। শুধু তা-ই নয়, কবে কোথায় কোন গানটি রেকর্ড করেছি কিংবা প্রথম গেয়েছি, সব তাঁর মুখস্থ। ২ অক্টোবর সন্ধ্যায় চলে যাই মুখার্জিবাড়ির পূজায়। অনেক বছরের পুরোনো এই পূজা। ইদানীং তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লাহিড়িবাড়ি।

সেদিন রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ আমি মঞ্চে উঠি গান গাইতে। ১৬টা গান গেয়েছি। ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় যেতে হবে সংগীতশিল্পী অভিজিতের পূজায়। আমি ঢাকায় থাকতেই ও ফোন করে খুব অনুরোধ করেছিল। আমিও রাজি হয়ে যাই।

মাঝে আছে একটি দিন—৩ অক্টোবর। এই দিনে আর কোনো কাজ হাতে রাখিনি। কারণ, এদিন লতাজির সঙ্গে আমাদের দেখা হবে। সকালেই ফোন করে বৈজনাথ বলেন, ‘আপনারা বিকেল সাড়ে চারটা অথবা সন্ধ্যা সাতটায় আসতে পারেন। ’ আমরা হোটেল থেকে বের হলাম সন্ধ্যা ছয়টায়।

সাতটার আগেই পৌঁছে গেলাম লতাজির বাসায়। অনেক বড় একজন শিল্পীর বাসায় যাচ্ছি। বাড়িটা নিশ্চয়ই প্যালেস হবে। কিংবা ও রকম বড় কিছু। পেডার রোডের ‘প্রভুকুঞ্জ’ নামের বাড়িতে ঢুকে ধারণাটা একেবারেই পাল্টে গেল।

সাদামাটা একটি বাড়ি। আর এই বাড়ির মানুষগুলোরও খুবই সাধারণ জীবনযাপন। লতা মঙ্গেশকরসহ সংগীতের বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পী, সুরকার আর সংগীতপরিচালক থাকেন এই বাড়িতে। কিন্তু বাড়ির বসার ঘরে ঢুকলে তা কারোরই মনে হবে না। যাওয়ার পর বাড়ির অন্যরা এসে আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।

খুব বিব্রত হচ্ছিলাম! এর মধ্যে দিদিও (লতা মঙ্গেশকর) চলে এসেছেন। তাঁকে আমি পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। আদর করলেন। বললেন, ‘কত বছর পর আপনার সঙ্গে দেখা হলো!’ তিনি সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন।

আমার সঙ্গে ছিলেন আলমগীর সাহেব। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। লতাজি খুব খুশি হলেন। অবাক হলাম। আমার সঙ্গে কবে কোথায় দেখা হয়েছিল, সব ওনার মনে আছে।

ওনার যে ৮৩ বছর বয়স, দেখে কিন্তু তা মনে হয় না। নিজেই ভালোভাবে চলাফেরা করেন, স্মরণশক্তি এখনো খুব প্রখর। তিনি আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কারণ, ওই সময়গুলোতে মা আমার সঙ্গে সব জায়গায় যেতেন। আশির দশকে কলকাতায় যখন গান করতে গিয়েছিলাম, তখন সঙ্গে ছিল আমার মেয়ে তানি।

ওর বয়স তখন পাঁচ-ছয় বছর হবে। আমরা একই হোটেলে ছিলাম—গ্র্যান্ড হোটেলে। ওনার রুমে ফোন করলাম। বললাম, ‘দিদি, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। ’ তিনি বললেন, ‘আপ আইয়ে।

’ তানিকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। ওনার তা মনে আছে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার মেয়ে তানি কেমন আছে?’ বললাম, ‘ওর তো বিয়ে হয়েছে। লন্ডনে থাকে। দুই বাচ্চার মা।

একটার আট বছর হবে, আরেকটার চার বছর বয়স। ’ শুনে তিনি আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘আপ নানি বন গায়ি!’ আমি ফোনে তানির সঙ্গে ওনাকে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলাম। লতাজি রাজি হলেন। তানির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন।

তানির তো বেহুঁশ হওয়ার অবস্থা! ঢাকায় আঁখির (আঁখি আলমগীর) সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিলাম। তানির মতো আঁখিরও একই অবস্থা। ওদের কারোরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। নাশতা এল। দেখি, আমার পছন্দের অনেক খাবার।

রাতের খাবারের জন্যও অনুরোধ করলেন। আমরা রাজি হইনি। তখন ওনারা বললেন, ‘আরেকবার এলে আপনাকে বিরিয়ানি খাওয়াব। ’ আমার ধারণা ছিল, ওনারা সবাই ভেজিটেরিয়ান। বৈজনাথ বললেন, ‘এটা অনেকেরই ধারণা।

আমরা শুধু সপ্তাহে এক দিন ভেজিটেরিয়ান—সোমবার। অন্য দিনগুলোতে মাছ, মাংস, সবজি—সবই রান্না হয়। ’ লতাজিও হাসলেন। বললেন, ‘সবাই ভাবেন, আমরা পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ান। তাই ভয়ে কেউ খেতে চায় না।

অনেক দিন আগে মুম্বাইয়ে মেহেদি হাসান সাহেব এসেছিলেন। ওনাকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছিলাম। দেখি, উনি বেশ ভয়ে ভয়ে এসেছেন। উনি ধারণা করেছিলেন, সব তো ভেজিটেরিয়ান খাবার হবে। তারপর খেতে বসে যখন বিরিয়ানি আর মাংস দেখলেন, খুব খুশি হলেন।

তাঁর ভুল ভাঙল। ’ গান নিয়ে আলাপ হলো। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন বাংলাদেশে কী ধরনের মিউজিক হচ্ছে? ভালো গান হচ্ছে তো?’ লতাজি আফসোস করে বললেন, ‘আমরা কত কষ্ট করে গান করতাম! আপনিও তো বহু বছর লাইভ রেকর্ডিং করেছেন। আর এখন তো এক লাইন এক লাইন করে রেকর্ডিং হয়। গানের ওই ফ্লো থাকে না, ওই ইমোশনও আসে না।

ওই এক্সপ্রেশনও দিতে পারি না। ’ আলমগীর সাহেবের সঙ্গে গল্প করলেন চলচ্চিত্র নিয়ে। লতাজিকে বাংলাদেশে আসার জন্য অনুরোধ করলাম। বললাম, ‘বাংলাদেশের মানুষ আপনাকে খুব বেশি আশা করে। একবার অন্তত আপনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ দিন।

’ তিনি হাসলেন। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরপর তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন বিধ্বস্ত এক বাংলাদেশ দেখেছেন। ওনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল হাসপাতালে। চারদিকের দেয়ালে লেগে থাকা ছোপছোপ রক্ত দেখে আঁতকে উঠেছিলেন।

তাঁদের কারোরই বুঝতে আর অসুবিধা হয়নি, পুরো দেশটার এই একই অবস্থা। আমি বললাম, ‘তখন তো এক রকম বাংলাদেশ দেখেছিলেন। এবার অন্য বাংলাদেশ দেখবেন। ’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কতক্ষণের ফ্লাইট?’ বললাম, ‘মুম্বাই থেকে দুই ঘণ্টা লাগবে। ’ বললেন, ‘ভেবে দেখি।

’ যাওয়ার আগে ভেবেছিলাম, আধঘণ্টা, খুব বেশি হলে ৪০ মিনিট বসব। উনিও নিশ্চয়ই ততক্ষণে ক্লান্ত হয়ে যাবেন। শুনলাম, কিছুদিন আগে ওনার হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে। তবে এখন অনেক ভালো আছেন। হাঁটা, চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হয় না।

কিন্তু আমরা দুই ঘণ্টার বেশি সময় ওনার সঙ্গে ছিলাম। আর পুরো সময়টায় উনি আমাদের পাশেই বসে থেকেছেন। কথা বলেছেন। বিদায়ের সময় তিনি বাসার ভেতর থেকে আমার জন্য উপহার নিয়ে এলেন। এরপর ছবি তোলা হলো।

হোটেলে ফিরে এসে উপহারের প্যাকেটটা খুলে দেখি, শাড়ি। তাতে হাতে আঁকা। খুব সুন্দর করে র‌্যাপিং করা হয়েছে। সাবধানে খুললাম, যাতে র‌্যাপিংয়ের কাগজটা নষ্ট না হয়। ওটাও স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।

এরপর দিল্লি ও কলকাতায় পূজা উপলক্ষে দুটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছি। বাংলাদেশে ফিরেছি শনিবার। কিন্তু লতাজির সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েকের ওই আড্ডা আমি এবং আমার পরিবারের সবার কাছে এক অনন্য স্মৃতি হয়ে রইল। সূত্র ঃ প্রথম আলো ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.