আধা-নরমাল জগতের বসবাসকারী পরজীবি আজীব জীব ছোটকালে নানান ধরণের কথাবার্তা শুনেছি। এর ভিতর কিছুর ভাগ কথা কাজের হলেও অনেক কথা ছিল গাঁজাখুড়ি। গাঁজাখোড়েরা গাঁজা খেয়ে নানান প্রকারের নীতিকথা বলার আরম্ভ করে। এক জীপ ড্রাইভার মধ্যরাতে গাঁজা খেয়ে এরকম বকাবকি শুরু করে দিয়েছিল। সেদিন আমি আর এক বড় ভাই সেই ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটে বসেছিলাম।
উনি শুরু করলেন তার এলেমে দুনিয়ার কথাবার্তা। রাস্তা খারাপ হওয়ার কারণে যোগাযোগ মন্ত্রীকে প্রথমে গালি দিলেন কিছুক্ষণ। এরপর এলেন নিজের কথায়। তাকে ছোট থাকতে তার আম্মা বলেছিলেন, 'বাবা ক্ষেতে যা। ' ক্ষেতে তিনি যাননি।
এসেছেন গাড়ির ধান্ধায়। ঘড়াম করে গাড়ির এক চাঁকা খানাখন্দে পরে গড়গড় করতে লাগল। তখন তিনি দ্বিতীয় দফা যোগাযোগমন্ত্রীকে গালি দিয়ে বললেন, 'ছোট থাকতে মায়ের কথায় ক্ষেতে যাইনি কিন্তু বড় হইয়া ঠিকই গাড়ি নিয়া ক্ষেতেই আইসা পড়ছি। ' উনি মনে হয় রাস্তাকেই ক্ষেতের সাথে তুলনা দিয়েছেন।
এসব কথার মতই ছোটকালে একটা কথা শুনতাম, গালি দিলে আল্লাহ জিহ্বা কেটে দেন।
জিহ্বা কাটার কথা আল্লাহ কোথাও না বললেও দুজগের দুনিয়ায় পাঠানোর কথা বলেছেন। সেই ভয়েই ছোট থাকতে অনেক গালি জানা থাকলেও কাউকে গালি দিতাম না। আল্লাহকে এমন ভয়ই পেতাম যে কাউকে শালা-শালীর মত শালীন গালিও দিতাম না। এমনিতেও কাউকে শালা-শালি বলা উচিত না। এই ধরণের আত্মীয়তার সম্পর্ক সাময়িক ব্যাপার।
বউ মারা গেলে এইসব সম্পর্ক হয়তো শেষ হয়ে যায় নাহয় সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয়।
একদিন আমাদের বাড়ির পুকুর পাড়ে বড় কাকা সহ কয়েকজন লোক অনেক উৎসব আয়োজন করে গাছের ডাল কাটছিলেন। বছরে বছরে গাছের ডালপালা না ছাঁটলে গাছ 'ঝাপ্পুইজ্জা' বা ঝাঁকড়া হয়ে যায়। বড় কাকা নিচে দাঁড়িয়ে উপরে উঠা লোকগুলাকে হাত-পা নাড়িয়ে নানান ভঙ্গিতে বলছিলেন, 'ডাইনের ঠাইলে ঠ্যাং রাইখা তোর মাথার উপ্রের ঠাইলটা কাটা শুরু কর। '
ঝাঁকড়া কড়াই গাছ কিছুক্ষণের মধ্যে ন্যাড়িয়ে গেল।
মজা করে আমিও এইসব জিনিসপত্র দেখছিলাম। দেখতে দেখতে একসময় আমি গাছের তলায় হেঁটে চলে গেলাম। হঠাৎ ঝুপুস করে একটা মাঝাড়ি সাইজের গাছের ডাল এসে আমার মাথায় পড়ল। তখন আমার দুনিয়াদারি অন্যরকম লাগছে। কে জানি বলে উঠল, 'অম্মারে মা! পোলারতো মনে হয় এক্কেরে মাথা ফাডি গেছে গই।
' এইসব কথা শুনে আমার আরো ভয় হল। একজন আমাকে কোলে করে ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে আম্মি শুরু করলেন আরেক ড্রামা। উনি আমাকে কোলে নিয়া 'তোর কি হইছে?' জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। আমি কিছু একটা বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম আমার আসলে জিহ্বা কেটে গেছে।
ততক্ষণে বুঝে গেছি আচমকা মাথার উপর ডাল পরার পর আমার জিহ্বা বের হয়ে এসেছিল। মাথা ফাটে নাই। মাথা ফাঁটলে এতক্ষণে রক্ত গড়িয়ে চোখে মুখে হয়ে যেত। এই এক্সপেরিয়েন্সও আমার হয়েছিল।
আমাকে রিক্সায় করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।
তৎকালীন ডাক্তার ভানু গোলাপ বোস। তিনি আমার জিহ্বার রক্ত বন্ধ করে অনেক পরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে এলেন, আমার জিহ্বায় কমের ভিতর দুই থেকে তিনটা সিলাই দিতে হবে। এইকথা শুনে আমার শুকতালু শুকিয়ে গেল।
হঠাৎ করে মনে পড়ল প্রাক্তন ডাক্তার গওহর লালের কথা। উনি আমার নাক সিলাই করেছিলেন।
এই ঘটনার অনেক আগে আমি ঢেঁকি থেকে সিলভার জগের উপর পড়ে নাক কেটে ফেলেছিলাম। আর সেই নাক সেলাই করেছেন ডাঃ গওহর লাল। আমি প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে উনি যখন আমাকে বললেন, 'সেলাই না করলেতো বাপু তোমার নাকে তখন তিনটা ফুঁটা হয়ে থাকবে। আর এটা দেখে কি মেয়েরা তোমাকে ভাল বলবে?' আমি উনাকে এরপর সেলাই করতে দিয়েছিলাম। সেলাইয়ের দাগটা অনেকটা '+' চিহ্নের মত এখনো আমার দুই চোখের মাঝখানে নাকের উপর আছে।
সেই সেলাইয়ের কষ্ট এখন আর মনে নেই। অনেক কষ্টের কথা ভুলা সম্ভব হলেও কিছু কষ্ট চিরদিন থেকে যায়।
ডাঃ ভানু গোলাপকে আমি অনেক কষ্টে বললাম, 'নারে আঙ্কেল আমি আমার জিব্লা সিলাইমু না। অন্য সিস্টেম থাকলে বলেন। ' আমি ছোট বলে তখন আমার কথা উনি কানে না তুলে সবগুলো দাঁত বের করে হেঁসে আশেপাশের কয়েকজনকে ঈশারা করে বললেন আমাকে চেপে ধরার জন্য।
কি আজব ব্যাপার, বিপদের সময় অনেক আপন লোকগুলাও কেমন অন্যরকম হয়ে যায়। আশেপাশের লোকগুলো আমার হাত পা চেপে ধরলেও আমার মুখ তখনো খোলা ছিল।
আমি সেবারই প্রথম কাউকে গালি দিলাম। ডাঃ ভানু গোলাপ বোসকে। তখন আমার বয়স ১১/১২ এর মত হওয়ার কথা।
বুঝার ক্ষমতা হয় নাই। পরে অনেকবার এই কথাগুলো ভেবে হেঁসেছিও আবার ডাক্তার সাহেবের জন্য অনেক খারাপও লেগেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি আমার জিহ্বা সেলাই করতে পারেন নি। আমার গালি শুনে তিনি অনেক কাচুমাচু হয়ে গেলেন। তার দাঁতগুলো মনে হয় সেদিনই প্রথম বাইরের দিক থেকে ভিতরে ঢুকিয়েছিলেন গালি শুনে।
গালি দিলে আল্লাহ জিহ্বা কেটে দেয় কথাটি অন্তত আমার কাছে ব্যার্থ মনে হয়েছে। কারণ আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হল এইরকম 'আল্লাহ জিহ্বা কেটে দিলে গালি দিতে হয়' অথবা 'গালি না দিলে আল্লাহ জিহ্বা কেটে দেয়। '
কথাগুলো বলার পিছনে কারণ আছে। এই সামান্য জিহ্বা কাটার বিষয় বিবেচনা করে আমি এই কথা বলছিনা। আল্লাহপাক মাঝে মাঝে আসলেই এরকম করেন।
তাঁর বদনা টাইপের বান্দাগুলোকে এরকম নাচায়ে কুদায়ে তিনি কি মজা পান কে জানে! যাই হোক, আল্লাহ খুশ তো বান্দা ভি খুশ। বারে... বাহ! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।