বয়ঃসন্ধির পর ছেলেমেয়েরা মা-বাবার কাছে গোপন এক রহস্যে পরিণত হয়। ছেলেমেয়ের বয়স ১২-১৩ বছর পার হওয়ার পর মা-বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন এই ভেবে যে, যাক ওরা বড় হয়েছে। এখন থেকে নিজের ভালো-মন্দটা বুঝে-শুনে চলতে পারবে। কিন্তু ঘটে তার উল্টোটি।
ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে বলে মা-বাবা ওদের একটু স্বাধীনতার স্বাদ নিতে দেন।
আর এতেই ঘটে বিপত্তি। কেননা স্বাধীনতা পেয়ে দিনে দিনে ওরা হয়ে ওঠে বেপরোয়া। ওরা নিজেকে ‘বড় হয়ে গেছি’ ভাবতে শেখে। ভাবে, কাউকে আর তোয়াক্কা না করলেও চলবে। এ অবস্থা দেখে মা-বাবা হঠাৎ সচেতন হয়ে পড়েন।
যাকে তারা মনে করেছেন বড় হয়েছে, সে যে আসলে বড় হয়নি, এটা বোঝার পর নতুন এক দুশ্চিন্তা তাদের জাপ্টে ধরে। সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে তাকে রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে বন্দি করার চেষ্টা করেন। আর ছেলের জন্য জারি করেন কঠিন কঠিন নিষেধাজ্ঞা। এরপর ঘটতে থাকে নানারকম সমস্যা। মা-বাবা আর কুলিয়ে উঠতে পারেন না।
অপরদিকে ছেলেমেয়েরা পরিবারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে থাকে। তখন মাবা-বাকে মনে করে তাদের ঘোর শত্রু।
দুই.
একটা ভুল ধারণা কমবেশি আমাদের সবার মনেই আছে। আমরা মনে করি ১২ বা ১৩-তেই মানুষের বোধশক্তি পূর্ণতা পেয়ে যায়। তাই ছেলেমেয়েদের প্রতি প্রত্যাশা বাড়ে।
তাদের কোনো অপরিপূর্ণ কাজকে আমরা সমর্থন বা গ্রহণ করতে পারি না। যেমনটি ঘটে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট হলে। তাছাড়া প্রতিটি কাজেই থাকে মা-বাবার সজাগ দৃষ্টি। ‘এটা করেছো কেন, ওটা করোনি কেন?’ এ ধরনের প্রশ্নের পর প্রশ্নে ওরা একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠে। অথচ মা-বাবা বুঝতেই চান না, ওরা যে অপরিপক্ক।
কিংবা ওদের এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বয়স হয়নি।
বিজ্ঞানীদের মতে, ২৫ বছরের আগে মানুষের বোধশক্তির পূর্ণতা আসে না। আসলে শৈশবের পর খুব সামান্যই বৃদ্ধি ঘটে মস্তিষ্কে, বিশেষত টিনএজে পা দেওয়া পর্যš। তাই টিনএজ হচ্ছে মানুষের জীবনে সবচে জটিলতম একটা অধ্যায়। এ সময় মস্তিষ্কে পরিবর্তনের তোলপাড় শুরু হয়।
এর ভেতর দিয়েই পরিপক্কতা আসে মস্তিষ্কে। সবচেয়ে আগে ম্যাচিউরিটি আসে মস্তিষ্কের যে অঞ্চলগুলোর, তার মধ্যে আছে দেখা, শোনা, স্পর্শ এবং স্থানসংক্রান্ত জ্ঞান। এর পরের ধাপে ম্যাচিওরড হয়ে এই কাজগুলোতে সহায়তা করে এমন অঞ্চলগুলো। যেমন রাতের অন্ধকারে সুইচ খুঁজে পেতে সাহায্য করবে যে অঞ্চল। মস্তিস্কের যে অঞ্চলটি সবচেয়ে বেশি ম্যাচিওরড হয় তা হলো ‘সিদ্ধান্ত’ নেওয়ার ক্ষমতা।
অর্থাৎ প্যানিং, চিন্তার শৃঙ্খলা, আবেগ সংযত করা, কাজের প্রায়োরিটি স্থির করা, কার্যকারণ বিশ্লে¬ষণ করা ইত্যাদি।
তিন.
হরমোন বিশাল একটা ভূমিকা পালন করে টিনএজারদের লাগামহীন কাজকর্মে। হরমোনের ফলে শরীর পায় প্রাপ্তবয়স্ক আকার। যৌনাঙ্গ পরিণত হয়, বাহুমূল এবং জানুসন্ধিতে কেশোদ্গম হয়। ছেলেদের কণ্ঠে পরিবর্তন আসে।
মেয়েরা গুটিয়ে নেয় নিজেদের। এ সময় তীব্র আবেগ ভর করে ওদের মনে। অযংযত আবেগ বন্য ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদের মধ্যে একটা উগ্র বাসনা কাজ করে। মন তখন রঙিন আকাশ। নিজের মনের ভেতরে কী আছে তা খোঁজার জন্য বুঁদ হয়ে পড়ে কেউ কেউ।
তীব্র আকাক্সক্ষা এবং রহস্যপ্রিয়তা অনেক সময় ওদের জন্য হুমকির কারণ হিসেবে ধরা দেয়। তাই মনের মধ্যে জন্ম নেয় বিপ্লবী চেতনা, ঘৃণা, ঈর্ষা, ড্রাগ আসক্তি, প্রেমে উন্মাদনা, চুরি, খুন, ধর্ষণসহ নানারকম ভয়ঙ্কর বাসনা।
চার.
বয়ঃসন্ধির গোড়ার দিকে ছেলেমেয়েদের মনে উঁকি দেয় হাজার রকমের প্রশ্ন। কেন তাদের এমন পরিবর্তন হলো, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য তারা পাগলের মতো হয়ে পড়ে। তারপর আরো নানান প্রশ্ন।
বিশেষ কিছু শব্দ আছে যেগুলো শুনলেই ওরা শিহরিত হয়। যেমন প্রেগন্যান্সি, কিস, লাভ, সেক্স ইত্যাদি। অনেক সময় বিশেষ কোনো শব্দের অর্থ জেনেও তারা শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়ে বসে শব্দটির মানে কী? একটিমাত্র শব্দ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাই নাওয়া-খাওয়া, পড়াশুনা ভুলে এই রহস্যময় জগতে ডুবে থাকে। ওরা খুঁজতে থাকে নির্জনতা।
তাই পরিবার থেকে নিজেরদের আলাদা ভাবতে থাকে। নিজের সিদ্ধান্তকে বড় মনে করে ওরা এমন সব কাজ করে বসে যার কারণে মা-বাবার মাথা হেট হয়ে যায়। ওরা যে অপূর্ণ, অপরিপক্ক মা-বাবা তা ঘুণাক্ষরেও মনে করেন না।
আমাদের দেশে অপরিণত বয়সে প্রেমের কারণেই সবচে বেশি সমস্যা হয়। ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে।
পড়ার টেবিলে বসে লেখে প্রেমপত্র কিংবা রাত জেগে কথা বলে মোবাইল ফোনে। এছাড়া সাইবার ক্যাফেতে দেখে পর্নো ছবি। এসব কারণে পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করে।
পাঁচ.
এ সময়টাতে ওরা খুব বেশি যৌন-সচেতন হয়ে পড়ে। জীবজগতের সমস্ত পশুপাখির সাথে মানুষের যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলে।
ওরা মনে করে যৌনতাই বড় সুখ। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর নেই কিছু পৃথিবীতে। ফলে ওদের স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি লোপ পায়। পরিণামে এমন সব কাজকর্ম করতে থাকে, যা তার পরিবার ও সমাজকে বিব্রত করে।
প্রাকৃতিকভাবে ওদের একটা পরিবর্তন আসে এটা সত্যি।
তাই বলে অতটা লাগামহীন হওয়া কি সমর্থনযোগ্য? অবশ্যই না। তাহলে কেন এই অপ্রত্যাশিত কাজকর্ম?
ছয়.
এর পেছনে মা-বাবার ভূমিকাও আছে! বিস্ময়কর হলেও কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। ওই বয়সে বাজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবারই থাকে। মা-বাবাও ওরকম বয়স পার করে এসেছেন। তারা জানেন এই বয়সের খারাপ দিকগুলো।
তাদেরই মনে করতে হবে তারা কোন শক্তিবলে সেসব কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। হয়তো সাহায্য করেছে বই, সঙ্গীত কিংবা খেলাধুলা।
সুতরাং মা-বাবারই উচিত নিজ সন্তানের সিদ্ধান্ত ঠিক করে দেওয়া। খানিকটা বড় হলেও ওরা তো অপরিণত। এক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকা হবে বন্ধু আর উপদেষ্টার মতো।
একই সাথে ওদের প্রতিটি আচরণ নিয়ে ভাবতে হবে গভীরভাবে। মনে রাখতে হবে বয়ঃসন্ধিকাল বিপদজ্জনক। মা-বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে ভালোবাসা নিয়ে। অতিরিক্ত শাসন যেমন সন্তানের মানসিক বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে, তেমনি সন্তানকে দূরে ঠেলে দিলেও সমূহ বিপদ ঘনিয়ে আসে। তাই সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়া চাই বন্ধুসুলভ।
একসাথে সময় কাটানো, খেলাধুলা, ওর স্কুল-কলেজের গল্প শোনা, নতুন বন্ধুদের বিষয়ে জানা-- ওর মতো করেই বিচরণ করতে হবে ওর জগতে। খুব রঙিন আলোয় ভরা ওর জীবন। মা-বাবাকে সেই জগতের সব হদিস জেনে রাখতে হবে। কখনো বিপদ ঘটলে যাতে তারা চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আর যদি কিছুই না জানেন তাহলে শাসানো ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না।
ফল হবে আরো খারাপ। অতিরিক্ত শাসন ওরা পছন্দ করে না। একসময় মা-বাবার মতামতকে চ্যালেঞ্জ জানাতেও শুরু করে দেবে। যদি একবার হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় তাহলে ফিরিয়ে আনা কঠিন। তাই সাবধানতার বিকল্প কিছু নেই।
আসলে ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সত্যিকারের বন্ধুকে টিনএজাররা অবহেলা করে না। সুতরাং মা-বাবা যদি হন সেই বন্ধু, ক্ষতি কি? তাই বলে শাসন থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। এমনভাবে থাকবে যাতে ওরা শাসনকে শাসন মনে না করতে পারে। নিয়মের বাঁধন হালকা হবে ধীরে ধীরে।
ম্যাচিওরিটির সঙ্গে।
সাত.
সন্তানের কাছে মা-বাবার প্রত্যাশা অন্তহীন। কিন্তু সেই প্রত্যাশার একটা সীমা থাকা দরকার। সন্তান যেন মা-বাবার সঙ্গে খোলাখুলি মিশতে পারে। বুঝতে পারে পুরোপুরি।
পিতামাতা বলেই যে তারা তাদের সব হুকুম পালন করবে-- এখন আর সে যুগ নেই। অযৌক্তিক শাসনকে না মেনে নেওয়ার সাহস যে কেউ দেখাতে পারে। ফলে সময়ের তুলনায় মা-বাবাকে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। সন্তানের প্রতিটি আচার-আচরণ গুরুত্বের সঙ্গে বুঝে নিতে পারাটাই আসল কাজ।
সন্তানের চিন্তাজগৎ প্রসারিত করতে মা-বাবার ভালোবাসা আর মুক্ত আলোচনা খুবই জরুরি।
তাদের খুব সহজে বুঝিয়ে দিতে হবে বংশগতির ধারা বজায় রাখার জন্য নারী এবং পুরুষ-এ দুটি লিঙ্গের সৃষ্টি। জননক্রিয়া যে বিজ্ঞানসম্মত তা বুঝাতে হবে। এভাবে বয়ঃসন্ধির শারীরিক ও মানসিক বিকাশগত পাঠ জরুরি। সে দায়িত্ব স্কুল-কলেজের। যেহেতু স্কুলে সব পড়ানো হয় না, সুতরাং মায়ের দায়িত্ব এটা।
শারীরিক আকর্ষণের জন্য বা সঙ্কোচমুক্ত জীবনযাপনের জন্য যখন দুটি প্রজননসক্ষম নারী-পুরুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসে, তখন টিনএজারদের সুকুমার মন ওই সম্পর্কটির ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ওদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে তিরস্কার না করে সুন্দর করে বুঝানো উচিত। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের কারণ বুঝিয়ে দেওয়ার ফলে সমস্যার সমাধান আশা করা যায়। এটা সম্ভব হলে অনেক বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কারণ এখান থেকেই জন্ম নেয় হতাশা, ঘৃণা, দুঃখবোধ কিংবা হত্যা বা খুন করার মতো সিদ্ধান্ত।
বন্যার আগে যেমন বাঁধ, ঝড়ের আগে যেমন শক্ত বেড়া প্রয়োজন তেমনি প্রথম যৌবনের আগে থেকেই মা-বাবাকে খেয়াল রাখা উচিত সন্তান কী হতে চলেছে। বা কোন পথে চলছে। কেননা প্রত্যক মা-বাবাই তার সন্তানের জন্য একজন পারফেক্ট গাইড অ্যান্ড ফিলোসফা.ref-banglanews24.com ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।