আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাসিনা সজাগ, খালেদা ঘুমে? এরশাদের স্বপ্ন

এক. সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যখন ঘরে-বাইরে চরম অসন্তোষ, শেয়ারবাজার বিপর্যয় ও নয়ছয়, যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ চিত্র, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃক্সখলা পরিস্থিতির অবনতি, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের চিত্র ধূসর, মন্ত্রীদের অতিকথন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে সরকার ক্রমশ গণবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, বাকি ৩৩ মাসে নির্বাচনী অঙ্গীকার কতটা পূরণ হবে_ এ নিয়ে যখন মহাজোট সরকার প্রশ্নবিদ্ধ তখন বৃহস্পতিবার সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার সচিবকে একহাত নিতে ভুল করেননি। তার প্রশ্ন-অসন্তোষের মুখে পড়েছিলেন যোগাযোগ, বাণিজ্য, সেতু বিভাগ ও পররাষ্টসচিব। প্রধানমন্ত্রী সচিবদের বিদেশ সফর কমাতে যেমন বলেছেন, তেমনি পদ্মা সেতু নিয়ে নয়ছয় সহ্য হবে না বলে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এসব সচিবকে তিনি মিডিয়ার সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে বলেছেন। রাজনৈতিক মন্ত্রীরা জনগণের যেমন গাল খায় তেমনি ক্ষমতার পালাবদলে জেলে যায় কিংবা আদালতপাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে জীবন যায়।

সচিবরা বড় বড় অপকর্মের ফাইল নাড়াচাড়া করেও রেহাই পেয়ে যান। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে বিমান ক্রয় মামলার আসামি হয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান আমাকে দুঃখ করে তার বাসভবনে বলেছিলেন, এত হাত ঘুরে ফাইল আসে কিন্তু দুঃখ লাগে রাজনীতিবিদদের নামে মামলা হলেও আমলারা পার পেয়ে যান। দিন দিন রাজনীতিবিদ মন্ত্রীর সংখ্যা কমছে। ভোটের জোয়ারে নির্বাচনে বিজয়ী বড় বড় দলে ঠাঁই পাওয়া ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলারা মন্ত্রী হয়ে দৃশ্যপটই বদলাচ্ছেন না, এক-একটি সরকারকে বিতর্কের ঝড়ে পতিত করছেন। আর তাদের সাহায্য করছেন স্যুট-টাই পরা আমলারা।

আগে আমলারা ছিলেন পেশাদার। এখন বেশিরভাগই দলবাজ। দলবাজি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। কি বুদ্ধিজীবী, কি পেশাজীবী ক্ষমতার অনুগ্রহ-অনুকম্পা লাভের জন্য কে কত আওয়ামী লীগার বা কত বড় বিএনপি তা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার কর্মীদের অতিক্রম করে ছুটছেন। তাদের জন্য সরকার যেমন জনবিচ্ছিন্ন হয়, তেমনি সত্য থেকে দূরে থাকে।

তারা শুধু সরকারেরই ক্ষতি করে না, দেশেরও ক্ষতি করে। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা যখন মিডিয়াকে আক্রমণ করছেন আক্রোশের সঙ্গে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সভায় দূরত্ব কমানোর যে নির্দেশ দিয়েছেন তাতে তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ায় ট্রানজিট না দেওয়ার কারণে তেমনি তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সরকারের ভেতর থেকে যারা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্প্রচার নীতিমালার নামে নিয়তন্ত্রের উদ্যোগ নিচ্ছেন, টক শো'র ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করতে চাচ্ছেন তারা মিডিয়াবান্ধব শেখ হাসিনাকে ঘুমে রেখে করতে পারবেন বলে আর মনে হচ্ছে না। কারণ গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত মিডিয়ার বিকল্প নেই।

সেনাশাসক আর কমিউনিস্ট শাসকরাই কেবল মিডিয়ার ওপর সেন্সরশীপ আরোপ করে থাকে। গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সেন্সরশিপ সরকার আরোপ করবে এমনটি এখন আমি বিশ্বাস করি না। সেনাশাসকই হোক আর নির্বাচিত সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড বা অপশাসনের চিত্র প্রকাশে এ দেশের মিডিয়া বরাবর সাহসী। আমাদের ইতিহাসের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ভারতের কংগ্রেসের মতো এদেশের ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামে মিডিয়ার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ হতে দেবেন না, সজাগ থাকবেন।

এমনটাই বিশ্বাস করি। কারণ তিনি জানেন এর পরিণতি শুভ নয়। গণতান্ত্রিক সরকার মিডিয়ার মুখোমুখি হলে স্বৈরশাসকে রূপ নেয়। স্বৈরশাসকের পতন হয় গণরোষের মুখে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সজাগ হয়ে উঠেছেন বলেই মিডিয়ার সঙ্গে দূরত্ব কমাতে বলেছেন।

এর আগে সংসদে যারা মিডিয়াকে একহাত নেন তাদের প্রতিও শেখ হাসিনা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বিএনপির শাসনামলে দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আমার একটি লেখার প্রশংসা করে এইচটি ইমাম ফোন করেছিলেন আজকের অর্থমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। চায়ের নিমন্ত্রণ দিলেও আমার যাওয়া হয়নি। শাসকরা ক্ষমতায় থাকলে অনেক ভুল করেন মিডিয়া তা তুলে ধরে। এতে ক্ষমতায় থাকলে মিডিয়া খারাপ, যারা সত্য লেখেন তাদের প্রতি অগি্নরোষে তাকানো কারও কারও স্বভাব।

কিন্তু একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি সবসময় আমার নিজস্ব কৈফিয়তের জায়গা থেকে বলি, পৃথিবীর সব মানুষ কম-বেশি ভুল করেন। আমরা যে ভুল করি না তা নয়। কিন্তু সত্য প্রকাশে আপসহীন পথ চলি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষ আমার দল।

দেশ আমার প্রেম। আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা কোনো দলের অনুগ্রহ ও করুণা নিয়ে পথ চলতে চাই না। আমি সরকারের সৃজনশীল সমালোচক মাত্র। সরকারের পতন নয়, সংশোধন আমার কাম্য। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক পারস্পরিক সৌহার্দ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, কার্যকর সংসদ, দলমুক্ত পেশাদার প্রশাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ আর অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অনেকের সঙ্গে আমারও স্বপ্ন।

চাই রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি। সংসদে রাজনীতিবিদদের মুখ দেখতে চাই। অর্থ ও অস্ত্রমুক্ত নির্বাচন প্রত্যাশা। দুই. বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়ে মঞ্চে আসুন তা চাই না। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ হোক সেই ঐতিহ্যের ধারায় রাজনৈতিক কর্মী সৃষ্টির তীর্থস্থান।

সেনাশাসনামলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হয়েছে। গণতন্ত্রের কুড়ি বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র রাজনীতি মানুষের আকর্ষণ ও শ্রদ্ধার জায়গা থেকে সরে গেছে। মানুষ চায় ছাত্রদের হাতে থাকবে বই, পাঠাগারে তারা হবে নিয়মিত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আর খেলাধুলায় যেমন মগ্ন থাকবে, তেমনি লেখাপড়ায় একাগ্র হবে। ছাত্রদের দাবি-দাওয়ার পাশাপাশি অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াবে।

মূল্যবোধহীন অবক্ষয় আর টেন্ডার-চাঁদাবাজিমুক্ত ছাত্র রাজনীতির গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন অবিলম্বে জরুরি। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ভোটের পথই নয়, নিয়মিত ছাত্রদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আগে ছাত্রনেতারা বাসে-ট্রেনে কষ্ট করে জেলা সফর করতেন। এখন জেলা সফর করেন না। গেলেও বিমানে, পাজেরোতে চড়ে যান! জেলায় জেলায় সম্মেলন হয় না।

নবীনবরণ, কলেজ নির্বাচনে প্যানেল পরিচিতি সভা নির্বাসনে গেছে। এখন তৃণমূল থেকে রাজনীতিতে উঠে আসতে হয় না। টেন্ডারবাজি করে, তদ্বির করে, সিন্ডিকেট করে টাকা কামালে মনোনয়ন পাওয়া যায়_ এ ধারণা থেকে রাজনীতিকে অবশ্যই বের করতে হবে। আর এ দায়িত্ব পালনের দায় আওয়ামী লীগকে যেমন নিতে হবে, তেমনি বিএনপিকেও নিতে হবে। চলমান অসুস্থ রাজনীতির চিত্র দেখে সব স্তরের মানুষের মধ্যেই বাড়ছে অসন্তোষ।

রাজনীতির ময়দান থেকে আদর্শবান সৎ কর্মীরা সরে যাচ্ছে। যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের কেউ মন্ত্রী, কেউবা এমপির কর্মচারী হয়ে পথ হাঁটছে। আগে যারা রাজনীতির ময়দানে ছিলেন তাদের সাদামাটা জীবন মানুষের হৃদয় জয় করত। তারা মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াতেন, মানুষের হৃদয়ে বাস করতেন। এখন যারা ময়দানে তারা মানুষের নিন্দা কুড়ান আর সারা দেশের রাস্তায় রাস্তায় নিজের টাকায় টাঙানো ডিজিটাল ব্যানার আর রঙ্গিন অশ্লীল পোস্টারে শোভা পান।

আগে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা কথা বললে তালি পেতেন, এখন গালি পান। তবুও ক্ষমতার মোহ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। নিজেরা যেমন বদলান না, তেমনি সমাজকেও বদলাতে দেন না। মানুষের কান্না তাদের যেমন স্পর্শ করে না তেমনি দ্রোহ তাদের বিচলিত করে না। ভোগবিলাস-অর্থবিত্ত এখন আসে রাজনীতি থেকে।

আগে রাজনীতি করে মানুষ রিক্ত-নিঃস্ব হতেন, এখন বিত্তবৈভবের মালিক হন। শুধু রাজনীতিবিদ হতে পারেন না। আগে রাজনীতি থেকে জননেতার জন্ম হতো, এখন গণবিরোধী চরিত্র মিডিয়ায় স্থান পায়। ষাটের দশকে কিংবা স্বাধীনতা-উত্তরকালেও একজন ছাত্রনেতার যে সম্মান ছিল মানুষের কাছে আজ একজন মন্ত্রীরও সে সম্মান নেই। এটা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য বেদনার।

আমরা চাই মানুষের হৃদয় জয় করা রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও মন্ত্রী-এমপি। যাদের দিকে তাকালেই মুগ্ধ হওয়া যায়। শ্রদ্ধা আসে। ভালোবাসা জাগে। তিন. অনেকেই প্রশ্ন করেন, সাবেক সেনাশাসক এরশাদের সমর্থক কিনা? আড়ালে-আবডালে কেউ কেউ অভিযোগও করেন।

পেশারতারে জড়ানো জীবনে সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক আছে। সাবেক সেনাশাসক এরশাদের সঙ্গেও আছে। এরশাদ জমানায় জেল খেটেছিলাম উপজেলা নির্বাচন প্রতিরোধ করতে গিয়ে। পরবর্তীতে আজ যখন দেখি উপজেলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতাহীন করুণার পাত্র, কষ্ট হয়। যখন ভাবি '৮৫ সাল থেকে উপজেলা অব্যাহত থাকলে দেশ আজ কোথায় যেত, স্থানীয় সরকার কতটা শক্তিশালী হতো তখন নিজের কাছেই লজ্জিত হই।

সেদিন এরশাদকে প্রতিনিয়ত দুর্নীতির বরমাল্য পরালেও পরবর্তীতে গণতন্ত্রের জমানায় যখন অগণন দুর্নীতির বরপুত্রের আবির্ভাব ঘটতে দেখেছি, তখন নিজেকেই প্রশ্ন করে সদুত্তর পাই না। সেদিনের গণতন্ত্রের সংগ্রামে শরিক হয়ে ঠকেছি না জিতেছি? গণতন্ত্রের জমানায় প্রমাণ হয়েছে, এরশাদ সরকারের অসংখ্য মন্ত্রী-এমপি দুর্নীতি থেকে দূরে থাকলেও পরবর্তীতে গণতন্ত্রের অনেক মন্ত্রী-এমপির জীবন দুর্নীতির অভিযোগে কলঙ্কিত হয়েছে। আজ যখন উপজেলায়-উপজেলায় কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচির টাকা এমপি সিন্ডিকেট লুট করে নিয়ে যায় তখন প্রশ্ন জাগে, এই গণতন্ত্রের জন্যই কি এত রক্ত এত সংগ্রাম? এরশাদ জমানায় দুর্নীতিবাজ ও তদবিরবাজ দালালের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। প্রেম-প্রণয় দুর্নীতির বরমাল্যে অভিষিক্ত একনায়ক এরশাদের জীবন কাটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটে। গণতন্ত্রের জমানায় অজস জনের জীবন কাটছে বিত্তবৈভব বিলাসিতায়।

এসব বলা মানেই এরশাদের সমর্থক হওয়া নয়। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুগ্রহ লাভের পথ আমি নেইনি। আমি একা নই, সমাজের অনেকেই নেননি। তাই এখনো রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে চিৎকার করে কথা বলার লোক ফুরিয়ে যায়নি, বরং বাড়ছে। মুজিবের বাংলায় তার স্বপ্নের শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণে প্রতিবাদী সাহসী মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে সুবিধাবাদী দালালরা তত কোণঠাসা হবে।

আর রাষ্ট্র পরিচালকরা তত পরিষ্কার দেখতে পারবেন নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি ও সমাজের অসঙ্গতি। ভদ্র-বিনয়ী সেনাশাসক এরশাদও একবার হাত মেলাতে গিয়ে বলেছিলেন, নরম হাতে এত শক্ত লেখা আসে কোথা থেকে? এই শক্তির উৎস কোথায়? সেদিন হেসে এড়িয়ে গেলেও আমারও বলতে ইচ্ছা করে, এই শক্তি ও সাহসের নাম শেখ মুজিবুর রহমান। একটি জাতিকে তিনি সাহসী করেছিলেন, সংগ্রাম শিখিয়েছিলেন, যুদ্ধ করিয়েছিলেন এবং একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছিলেন, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। রাজনীতিকে যারা ভোগবিলাসিতা আর আদর্শহীন লুটপাটের ক্ষেত্র বানিয়েছেন তাদের অনুরোধ করব, ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে হবে না। ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে গেলে দেখা যাবে কত সাদামাটা জীবন ছিল মহানায়কের।

অতি সাধারণ আসবাবপত্র শোভিত ছোট্ট রুমে দুনিয়া কাঁপানো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতার জীবন থেকে পাঠ না নিয়ে যারা আজ তার রাজনীতির নামে ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে আখের গোছাচ্ছেন রাষ্ট্র পরিচালনার নামে, মন্ত্রী-এমপি হয়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন, মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগ তৈরি করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমরা তাদের ব্যাপারে শাস্তি তো চাইতেই পারি। শেয়ারবাজার নিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারি হবে, মানুষ রিক্ত-নিঃস্ব হবে আর নায়করা দণ্ডিত হবে না, উল্টো মন্ত্রীরা দায়িত্বহীন কথা বলবেন, তা মানা যায় না। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার লিখেছেন, 'বাংলা কবিতা মূর্খদের হাতে চলে যাচ্ছে, কিছুটা ব্যতিক্রম আছে, কিছু কিছু রয়ে গেছে গণ্ড মূর্খদের হাতে। ' শাসন কাজের সঙ্গেও জড়িত অনেক গণ্ড-মূর্খের চেহারা ২৭ মাসের মাথায় এসে উন্মোচিত হয়েছে। সচিবদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করেছেন, অনেক কিছুই তার আড়ালে নয়।

এ অবস্থায় মানুষ যখন সরকারের মন্ত্রীদের ওপর একে একে আস্থা হারাচ্ছে তখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশা করতেই পারি যে, তিনি অচিরেই গণ্ড-মূর্খদের সরকার পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। সচিবদের বৈঠকে আরও প্রমাণ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সত্য জানা থাকলে তিনি কঠোর হতে পারেন। আর এতে প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা নিলে সরকারের হাতে যেমন সাফল্যের কৃতিত্ব আসে তেমনি মানুষের মুখে আসে তৃপ্তির হাসি। মানুষ চায়, সরকার ভালোভাবে দেশ চালাক। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাক।

বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীরা সরকারের উদার সহযোগিতার ছায়া পাক। আইন-শৃক্সখলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কার্যকর সংসদ, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, আবাসন-শিল্প, কূটনৈতিক উন্নয়ন সব ক্ষেত্রেই সরকার সফল হোক। সরকার সফল হলে দেশ এগিয়ে যায়। দেশ এগিয়ে গেলে মানুষ খুশি। আর সংসদীয় শাসনে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে বিরোধী দলকে দমন-নির্যাতন করে, ভেঙেচুরে সম্ভব নয়।

শক্তিশালী বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে, সংসদ কার্যকর করেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। দায়িত্বশীল বিরোধী দল গণতন্ত্রে সরকারকে কাঠগড়ায় রাখে। সজাগ রাখে। জাতীয় ইস্যুতে অভিন্ন পথে হাঁটে। এখনো চরম বৈরিতার মুখোমুখি সরকার ও বিরোধী দল।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, সরকারের হাতে সময় খুবই কম। মাত্র ৩৩ মাস। কাজ অনেক। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য করে, তাকে ভোটের বাইরে রেখে, সুবিধাবাদী বিএনপি নেতাদের দিয়ে দলটিকে নির্বাচনে আনার খবর শোনা যাচ্ছে। এমনকি বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচনী নীলনকশার খবর প্রকাশ হচ্ছে।

শোনা যাচ্ছে, পতিত সেনাশাসক এরশাদ বিরোধী দলের নেতার আসনে বসবেন। সরকারের ছায়ায় থাকা ফুরফুরে মেজাজে এরশাদও তার চারপাশে মূর্খ আজ্ঞাবহ বিতর্কিতদের নিয়ে এমন স্বপ্নও নাকি দেখছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে না এলে শাসক দলের ওপর ক্ষুব্ধ মানুষ ও বিএনপি ধারার ভোটে তিনিই ক্ষমতায় আসছেন। ইতিহাসের শিক্ষায় বলা যায়, '৯৬ সালেও কারাগারে বসে এরশাদ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ১০০ আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসার প্রস্তাব পান। কারাগারে কাজী ফিরোজ রশিদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী বৈঠক করেছিলেন সরকারি প্রহরায়। খালেদার সঙ্গেও কাজী ফিরোজ রশিদের বৈঠক হয়।

এরশাদ বেরিয়ে আসবেন, প্রেসিডিয়াম নিয়ে বাসায় বৈঠক করবেন! রওশন ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে স্বামীর জন্য পায়েস রান্না করে অপেক্ষা করলেও শেষ মুহূর্তে এরশাদকে বেঁকে বসতে হয়। তেমনি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দুই দল থেকেই এরশাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার লিখিত প্রস্তাব পান। ইতিহাসের স্রোতস্বিনী নদীর শিক্ষাই এমন যে, এরশাদকে নিঃশর্তভাবে মহাজোটে নির্বাচন করতে হয় এবং বঙ্গভবন দূরে থাক গাড়িতে মর্যাদার পতাকাও জোটেনি। মামলায় মামলায় হাত-পা বাঁধা এরশাদ মুক্ত আছেন শাসকদের কাছে এটাই বড় দান! তাই আজ যারা ভাবছেন বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন, তারা ভুলে যাচ্ছেন সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিতর্কের ইতি এখনো ঘটেনি। আর দেশে আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে যেমন নির্বাচন হয়নি, তেমনি বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করার দিনও ফুরিয়ে গেছে।

সবার অংশগ্রহণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যেমন সুযোগ নেই, তেমনি নির্বাচন হলেও গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের সম্ভাবনা নেই। চার. বিএনপি-জামায়াত ও ওয়ান-ইলেভেন সরকারের ব্যর্থতার মুখে শেখ হাসিনার দিনবদলের সনদের ওপর আস্থা রেখে মানুষ ব্যালট বিপ্লবে তিন-চতুর্থাংশ আসনে মহাজোটকে বিজয়ী করে। সরকারের ২৭ মাসের মাথায় এসে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন দূরে থাক, যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বার বার আন্দোলনের হাঁকডাক দিলেও রাজপথে সংগ্রাম দূরে থাক, দলীয় কোন্দলই নিরসন করতে পারেনি দলটি। রাজনৈতিক পার্টনার জামায়াত যুদ্ধাপরাধের কলঙ্কে অভিযুক্ত হলেও ধর্মীয় রাজনীতি পশ্চিমা ও গণতান্ত্রিক দুনিয়ার রোষের মুখে পড়লেও খালেদা জিয়া তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে আধুনিক মধ্যপন্থি দলের চেহারায় বিএনপিকে দাঁড় করিয়ে অগ্রসর হতে পারেননি।

খালেদা জিয়া ওয়ান-ইলেভেনের তাণ্ডব, নির্বাচনী ভরাডুবি, শাসকদের দমননীতির মুখে দলীয় কাউন্সিলে পুত্র তারেক রহমানকে ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হিসেবে অভিষিক্ত করা ছাড়া কোনো বড় অর্জন আনতে পারেননি। দলের স্থায়ী কমিটি, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদকদের চেয়ে কর্মী ও মানুষ বিচ্ছিন্ন একদল অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা ও স্টাফদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তিনি নিজে যেমন দলের কাছে যেতে পারছেন না, তেমনি দল তার কাছে আসতে পারছে না। সাড়ে তিনশ নেতাকর্মীর বিশাল বহরের বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি রাজনীতিতে কোনো গুরুত্বই বহন করছে না। এক পাল্লায় যোগ্য-অযোগ্যদের তোলা হয়েছে এই কেন্দ্রীয় কমিটিতে।

নির্বাসিত পুত্ররাই নয়, স্বয়ং খালেদা জিয়াও সামনে দণ্ডিত হওয়ার মুখে। গৃহহারা, পুত্রহারা মামলার বোঝায় ভারি বেগম খালেদা জিয়া দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এখনো জনগণের বিশাল অংশের সমর্থন পাচ্ছেন। কিন্তু মহাজোট সরকারের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে সামনে তার সোনালী ভবিষ্যৎ এমন ভবিষ্যৎ বাণী কেউ করছেন না। এই সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বেগম খালেদা জিয়া যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারেন বিএনপিকে নিয়ে, তাহলেই হয়তো তার ও তার পুত্রদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ রক্ষা হতে পারে। তাই রাজনৈতিকভাবেই খালেদা জিয়াকে মানুষের হৃদয় জয় করে ফিরতে হবে।

তাকে অতীত ভুলের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে সংসদ ও রাজপথে গণমুখী ভূমিকা আর কর্মসূচি নিয়েই হাঁটতে হবে পথ। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আজ ধর্মীয় রাজনীতির আস্ফালন বা উগ্রতা কিংবা দুর্নীতিবাজদের সমাদর-গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার সুযোগ নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার শুভাকাক্সক্ষীদের প্রশ্ন, তাদের নেত্রীর ঘুম ভাঙবে কবে? আর শাসকদের মনে রাখতে হবে, পাপের ভারে ভোটযুদ্ধে ভেসে যায় বিএনপি-জামায়াত, তেমনি ব্যর্থতার শাসনে ডুববে না নৌকা তার গ্যারান্টি কোথায়? লেখক: পীর হাবিবুর রহমান ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.