বিরোধী দল যত উচ্চ স্বরে বলছে, সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না, সরকারি দল তার চেয়ে কয়েক গুণ জোরালো কণ্ঠে দাবি করছে, বিরোধী দল অবশ্যই নির্বাচনে আসবে। এই আসা না-আসার মধ্যে পেন্ডুলামের মতো দুলছে দেশ। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাজিয়া চলে আসছে দুই দশক ধরে। এর শেষ কোথায় আমরা জানি না। আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশের মানুষ তো বটেই, বিদেশি বন্ধু-শুভার্থীদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
সবার মনে জিজ্ঞাসা, আমরা কি আবারও একটি বড় ধরনের সংঘাতের দিকে যাচ্ছি? ক্ষমতাসীন দল যদি তার মতো করে একটি নির্বাচন করে এবং বিরোধী দল সেই নির্বাচন ঠেকাতে মাঠে নামে, তাহলে সংঘর্ঘ ও রক্তপাত অনিবার্য। দেশবাসী কোনোভাবেই ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের দুর্যোগের পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। তারা চায় শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল; যাতে জনগণ পছন্দসই দলকে বেছে নেবে। কিন্তু বিজিতদের ওপর বিজয়ীরা সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, যেমনটি পড়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিএনপি যতই অভিযোগের তির হানুক না কেন, নির্বাচনের পর দলের নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া হতে হয়নি।
বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব যেমন দাবি করতে পারে, তেমনি তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটি সম্পূর্ণ অকার্যকর করার দায়ও তাদের নিতে হবে। ২০০৬ সালের আগে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পছন্দসই ব্যক্তিকে বেছে নেওয়ার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়স না বাড়ালে হয়তো বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। আগামী নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইতিমধ্যে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি গত মে মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। আবারও তাঁর আসার সম্ভাবনা আছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন দল ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা প্রায় প্রতিদিনই সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। সবারই উদ্দেশ্য—বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। কিন্তু তা রক্ষার নিয়ামক শক্তি যে রাজনৈতিক দলগুলো, তাদের মনোভাবে এখনো দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকলেও তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে মাঠপর্যায় থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু সেসব খবরও দেশবাসীকে পুরো আশ্বস্ত করতে পারছে না। ২০০৭ সালে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশের পরও নির্বাচনটি হতে পারেনি তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের একগুঁয়েমির কারণে। এবারেও পরিস্থিতি সেদিকে মোড় নেবে কি না, তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপর। নানা অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও দুই শিবিরেই নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি লক্ষ করা গেছে। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সাতটি বিভাগীয় শহরে যে জনসভা করছেন, তার মূল লক্ষ্য নির্বাচন ও দলের পক্ষে জনমত গঠন।
ইতিমধ্যে নরসিংদীর বিশাল জনসভা দলীয় নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করেছে। তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিএনপি মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বললেও তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। আগে বিএনপির নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনড় থাকলেও এখন তাঁরা ন্যূনতম দাবি পূরণ হলেও নির্বাচনে যাবেন বলে আভাস দিচ্ছেন। তাঁরা এখন সংবিধানের ভেতরেও যেকোনো সমঝোতায় আগ্রহী। কেননা বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জনমত জরিপ তাদের পক্ষে।
সম্প্রতি নিয়েলসনের জরিপে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করছে, যেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে মাত্র ৩২ ভাগ মানুষ। ২০০৮ সালে যেই তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে এনেছিল, সেই তরুণ প্রজন্ম এখন বিএনপির পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, জামায়াতে ইসলামী নিয়ে বিএনপি এত দিন যেই অস্বস্তিতে ছিল, সরকারই তার অনেকটা ফয়সালা করে দিয়েছে। হাইকোর্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছেন। দলটির পক্ষে আপিল করা হলেও আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেননি।
নির্বাচন কমিশন বলেছে, হাইকোর্টের আদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী স্বনামে ও স্বপ্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে জামায়াতের কতিপয় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়লেও বাকি সব আসনে তাঁদের সমর্থকেরা বিএনপিকেই ভোট দেবে। আবার বিএনপির ওপর জামায়াত তোষণের অপবাদও থাকছে না। এর সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম নামের অরাজনৈতিক দলটির পুরো সমর্থনও পাবে তারা।
তাই, যেকোনো অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়াকেই বিএনপির নেতা-কর্মীরা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন।
কিন্তু সেই নির্বাচনে যেতে অন্তত মুখ রক্ষার জন্য হলেও দুটি বিষয়ে নিশ্চয়তা চায় বিএনপি। এক. নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া; দুই. শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য যেকোনো ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সাম্প্রতিক সভা-সমাবেশে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া ও অন্য নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিও লক্ষণীয়। তাঁরা বলছেন, সংসদ রেখে নির্বাচন হবে না। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।
বিএনপির নেতাদের এসব বক্তৃতা-বিবৃতি ১৯৯৫-৯৬ সালে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। সে সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি এতটা শক্ত হয়নি। অনেকের মতে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামীই প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সামনে নিয়ে আসে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটি ছিল মূলত সাংবিধানিকভাবে এরশাদের শাসনেরই ধারাবাহিকতা। প্রথমে এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন।
এরপর এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন এবং সবশেষে তিনি পদত্যাগ করেন। এভাবেই নয় বছরব্যাপী সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন সংসদে। তৎকালীন বিরোধী দলগুলো সেই সংসদ মেনে না নিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে তাদের আন্দোলনের বিজয় হিসেবে মেনে নেয়। পরে দেখা যায়, এই তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থায় গুরুতর ত্রুটি ছিল।
বাংলাদেশে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু আছে, অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিএনপি সেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জারিই করেছিল রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে সামনে রেখে এবং তিনি অঘটন ঘটানোর চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার কারণে পারেননি।
বিএনপি মুখে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা চাইলেও আসল নজর শেখ হাসিনার বিকল্প অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের প্রতি। নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যে-ই হোক, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু শেখ হাসিনা হতে পারবেন না।
বিএনপির অপর দাবি নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া। সেই দাবির সঙ্গে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি—এমনকি আওয়ামী লীগেরও একাংশ সহমত পোষণ করে। সম্ভবত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বও এটিকে দর-কষাকষির বিষয় হিসেবে নেবেন। বিএনপি যদি সরকারপ্রধানের ব্যাপারে ছাড় দেয়, তারা সংসদের ব্যাপারে ছাড় দেবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তিনি তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যেতে পারেন না। সব ব্যাপারে জবরদস্তির ফল ভালো হয় না। বিএনপির নেতৃত্ব মনে করেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল রেখে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা আর আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কেননা এটি হবে আওয়ামী লীগ সরকারেরই এক্সটেনশন। এ ক্ষেত্রে তারা এখন পর্যন্ত ছাড় দিতে নারাজ।
তবে বিএনপির নেতৃত্ব যদি বুঝতে পারে, যেকোনো অবস্থায় তারাই জয়ী হবে, তাহলে শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচন করতে পারে। তবে সেটি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে, বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা থাকবেন না। কারণ, বিএনপি ঠিক করে রেখেছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে। কিন্তু সেই সরকারে বিএনপির প্রতিনিধিরা থাকলে সে আন্দোলন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংসদ ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে নমনীয় হলেও শেখ হাসিনার প্রশ্নে ছাড় দিতে চাইবে না, সেটা দলের নেতাদের বক্তৃৃতা-বিবৃতিতেই বোঝা যায়।
ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনাই তাঁদের ভরসা। দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। আবার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, তাঁরা সর্বোচ্চ ছাড় দিতে রাজি আছেন। কিন্তু সর্বোচ্চ ছাড় কী, তা খোলাসা না করলেও শেখ হাসিনার তনয় সজীব ওয়াজেদ জয় তিন দিনের মধ্যে চমক দেখানোর কথা বলেছেন। বিএনপির শাসনামলে খালেদার তনয় তারেক রহমান যেসব চমক দেখিয়েছিলেন, তাতে চমকের কথা শুনলেই মানুষ শঙ্কিত হয়।
তারেক রহমান এখন লন্ডনে বসে নতুন ধারার রাজনীতির কথা বলছেন। আর সজীব ওয়াজেদ জয় নতুন চমক দেখাতে চাইছেন। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।