মাঝে মাঝে মন নিয়ন্ত্রনহীন হতে চায়; কিন্তু...............
১ম পর্বের পর
ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ঘটে কিভাবেঃ
মানবদেহে আর্সেনিক প্রবেশ করছে খাবার পানির মাধ্যমে। এই খাবার পানি আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকেই সংগ্রহ করে। পরীক্ষা করেও দেখা গেছে শুধুমাত্র ভূ-গর্ভস্থ পানিতেই আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে, ভূ-পৃষ্ঠস্থ অর্থাৎ পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালার পানিতে নয়। এ দূষণটা ঘটে ভূ-গর্ভস্থ আর্সেনিক থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আর্সেনিক বলয়ে যখন গভীর নলকুপ বসিযে পানি তোলা হয় তখন ভূ-গর্ভস্থ জলগহ্বরে পানির উপরিতল নেমে যায়।
এর ফলে পানির উপরের অংশে বায়ুর পরিমাণ বেড়ে যায়। এই বায়ুর অক্সিজেন কাছাকাছি অবস্থিত অদ্রাব্য আর্সেনাইট যৌগকে জারিত করে দ্রবণীয় আর্সেনেট যৌগে পরিণত করে। এই জারিত যৌগ পানির সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে দ্রবীভূত হযে যায়। এভাবেই ভূ-গর্ভের পানিতে আর্সেনিক জমা হয়। আর পানির স্তর নীচে নামার সাথে সাথে আর্সেনিক যৌগগুলোও নীচের দিকে নামতে থাকে।
আবার ভূ-গর্ভস্থ পানি যত তোলা হয় তত নীচের জলগহ্বরগুলোতে প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে আর্সেনিক আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার যত বাড়ে আর্সেনিক দূষণও নীচের দিকে ও চারপাশে ততই বাড়তে থাকে।
ইতিমধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েগেছে যে শুধু বংলাদেশ নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গেরও বিসত্মীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভূ-গর্ভের পানিতে আর্সেনিকে দূষণ ঘটছে। বিশেষ করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ইত্যাদি নদীর স্রোতধারাবাহিত পলি দিয়ে দু’দেশের যেসব অঞ্চল গঠিত হয়েছে সেখানে আর্সেনিকের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত বেশী। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত নবীন (২৪/২৫ হাজার বছর আগে সৃষ্টি) ভূ-খন্ডে এর মাত্র সবচেয়ে বেশি।
তাই বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত যে, হিমালয় এবং রাজস্থান পাহাড়ই এই আর্সেনিকের উৎস। সেখান থেকে উক্ত নদীসমূহের স্রোতধারায় আসা পলি দিয়েই ভূখন্ডটি গঠিত হয়েছে।
সবার জানা যে, অতীতে আমাদের দেশে মানুষের নিত্যব্যবহার্য পানির প্রয়োজন মিটানোর উৎস ছিল নদী, পুকুর নবা দীঘি। এগুযলোকে পানির ভূ-পৃষ্ঠস্থ উৎস বলা হয়। খাবার পানিও সাধারণতঃ সেখান থেকেই সংগ্রহীত হত।
আবস্থা সম্পন্ন মানুষেরা বাড়ির আঙ্গিনায় ‘কূপ’ খনন করে সে প্রয়োজন মেটাত। তবে বেশিরভাগ মানুষেরই নিরাপদ পানির কোন সংস্থান ছিল না।
কিন্তু, কালক্রমে, এদিকে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, অন্যদিকে কোন সংস্কার না হওয়ার কারণে নদী-নালা, পুকুর, দীঘি ইত্যাদির কোনটা মজে যায় আবার কোনটা ভরাট হয়ে যায়। ফলে এক সময় পানির সংকট মারাত্মক রূপ নেয়। খাবার তো বটেই সেচ কাজেও পর্যাপ্ত পানির সংস্থান দুরূহ হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায়, বিশেষতঃ ষাটের দশকে, বিশ্বব্যাঙ্ক ভূ-গর্ভস্থপানি ব্যাপক হাও বে্যবহারের ধারণা সামনে নিয়ে আসে। কৃষি বিপস্নবের নামে প্রচুর ডিপ-টিউবওয়েল বসানো হয়। আর নিরাপদ খাবারের জন্য বসানো হয় টিউবওয়েল। ’৭০এর দশকে এ প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়। ভারতের ফারক্কা বাঁধের প্রভাবে দেশের একটা বড় অংশে মরুকরণ শুরু হয়।
ফলে খাবার কাজতো বটেই, গৃহস'লি কাজেও ভূ-গর্ভস্থপানির ব্যবহার বেড়ে যায। পরিণামে, ’৯০এর দশকের মধ্যভাগে এসে দেখা যায় দেশের ৯৫% মানুষ ‘নিরাপদ’ পানির আওতায় চলে এসেছে। এবং এজন্য সারদেশে প্রায় ১ কোটি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। কিন্ত ভূ-পৃষ্ঠস্থপানির উৎসগুলোকে ধ্বংস করে এভাবে গণহারে ভূ-গর্ভস্থপানি ব্যবহারের ফলে হরিষে বিষাদ সৃষ্টি হয়েছে।
আর্সেনিক দূষণ থেকে রক্ষা পাবার উপায়ঃ
সম্প্রতিক সময়ে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আর্সেনিক দূষণ নিয়ে অনেক কথা উচ্চারতি হয়েছে।
কিন্ত দেখা যাচ্ছে আমাদের সরকার এ ব্যপারে কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাচ্ছে। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। আর্সেনিক দূষনের ফলে যারা ক্ষতিগ্রসত্ম হচ্ছে তাদের প্রয় সবাই গরীব, ধনীর সংখ্যা খুবই কম। কারণ ধনীরা অনেক বিষয়ে, অন্ততঃ নিজেদের ভাল-মন্দ সম্পর্কে বেশ সচেতন। অসুস্থহলে ডাক্তার দেখাতে পারে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ-পথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
বিশুদ্ধ পানির বিকল্প উৎসও তৈরি করতে পারে। তাই আর্সেনিকও তাদের কাবু করতে পারে না। আর গরীব মানুষ উপায়হীন হয়ে আর্সেনিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় না। উপরন্ত এরা অশিক্ষিত, অসংগঠিত, নিজেদের ভাল-মন্দ সম্পর্কে কথা বলতে পারে না, আমাদের প্রতি কোন দায়িত্ব বোধ করে না।
এখন, এই ভয়াবহ আর্সেনিক দূষনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আর্সেনিক দূষিত এলাকাগুলোর নলকূপের পানি ব্যবহার বন্ধ করা।
ওইসব এলাকার জনগনকে কি করে পুকুর, নদী, খালের পানি প্রথমে ফুটিয়ে, তারপর থিতিয়ে খেতে হয় তা শিখিয়ে দেয়া। যারা ইতিমধ্যে আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছে তাদের সুচিকিৎসা করা।
দ্বিতীয়ত, খাওয়ার কাজ ছাড়া কৃষি ও গৃহস'লি সকল কাজে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহার করার লক্ষ্যে দেশের সব নদী-নালা, পুকুর, হাওড় প্রভৃতি সংস্কার করা। বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। সে পানি বিশেষ ব্যব স্থায় জমিয়ে রেখে খাবার কাজেও ব্যবহার করা যায়।
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, বৃষ্টির পানি, এমনকি সনাতন পন্থায় ফিল্টার করলেও, তাতে আর্সেনিক তো দুরের কথা, কোন জীবানুও থাকে না।
কিন্ত এসবরে কোন উদ্যোগ-আয়োজন দেখা যাচ্ছে না। বরং একটা ধারণা জনপ্রিয় করার চেষ্টা চলছে যে, ডিপ টিউবওয়েলের পনিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়নি, তাই প্রচুর পরিমানে ডিপ টিউবওয়েল বসাতে হবে। এটা বিশ্বব্যাংকের একটা প্রচারণা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাতার সাথে সায় দিচ্ছে।
অথচ এটা একটা আত্মঘাতী বিষয়। কারণ নির্বিচারে ভূ-গর্ভস্থপানি তোলার ফলেই আজকের এ দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। ’৬০-এর দশকে এ পন্থায় পানি তোলার তত্ত্বটাও বিশ্বব্যাংকই সরবরাহ করেছিল। এদের এহেন তত্ত্ব প্রচারের উদ্দেশ্যের পিছনে আছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কর্তৃক তৈরি ডিপ-টিউবওয়েল বেশি সংখ্যায় এ দেশে রপ্তানীর অভিপ্রায়। তাছাড়া, ইতিপূর্বে কয়েকটি ডিপ-টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া না গেলেও অদুর ভবিষ্যতে যে পাওয়া যাবে না সে-ব্যপারে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই নিঃসন্দেহ নন।
এ ব্যপারে পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা তুলনা করা যেতে পারে। “১৯৮৯ সালে রাজ্য সরকারের জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ নদীয়া জেলায় নয়টি গভীর নলকূপ (১৫০-৪৫০ ফুট) খনন করে। প্রথম কিছুদিন ঐসব নলকূপের জল আর্সেনিকমুক্ত ছিল। কিন্ত ১৯৯২ সালে ধরা পড়ল এগুলোও আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মারদা জেলার যদুগোপাল জল সরবরাহ প্রকল্প-এর অন্তর্ভূক্ত একটি ৮০০ ফুট গভীর নলকূপ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫০ কেজি আর্সেনিক অথবা ৫০৩ কেজি আর্সেনিক লবন জলের সাথে উঠে আসে।
এ থেকে নিঃসন্দেহে বুঝা যায় গভীর নলকূপ কোন স'ায়ী সমাধান হতে পারে না। ” (আর্সেনিক দূষণঃ সমস্যা ও প্রতিকার; ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোসাইটি, কলকাতা)
এদিকে আর্সেনিক টেস্ট করার কিট এবং আর্সেনিক দূষিত পানি ফিল্টারের নামে চলছে এক প্রতারণা। বাজারে যে-সব কিট আছে সেগুলো .০৫মি.গ্রাম/লি. মাত্রার নীচে আর্সেনিক সনাক্ত করতে পারে না। এমন অভিযোগ উঠেছে এসব কিট থেকে ‘আর্সিন’ নামক এক গ্যাস নিঃসৃত হয় যার বিষক্রিয়া আর্সেনিকের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
আর্সেনিক এক নিরব ঘাতক।
এর কোন বর্ণ, গন্ধ বা অন্য কোন বৈশিষ্ট্য নেই যার মাধ্যমে কেউ ইন্দ্রিয় দিয়ে পানি বা খাবারে এই নৃশংস ঘাতকের উপসি'তি টের পেতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এর লক্ষণগুলোও ফুটে উঠে ১০-১২ বছর পর। তখন রোগীর পক্ষে খুব বেশী কিছু করার থাকে না। পরিসি'তিটার আশু মোকাবেলা করা তাই খুব জরুরী। দুঃখজনক হল, বহু সংস্থাএই পরিস্থিতি দেখিয়ে বিদেশ থেকে কোটি কোটি ডরার এনে স্রেফ হজম করে ফেলেছে, আর্সেনিক আক্রান্ত মানুষদের এতটুকু লাভ হয়নি।
সরকারি উদ্যোগ চাড়া এত বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে এতুকু গাফিলতি মানে কোটি কোটি মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। যার দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না।
কিন্ত আমাদেও সরকার একেবারে নির্বিকার। যেন এ বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতি তার কোন দায়িত্ব নেই।
আসলে একটা কথা খুবই গুরুত্বের সাথে বোঝা প্রয়োজন, আমরা বাস করছি এমন একটা রাষ্ট্রে, যেখানে ধনী ও গরীবের মধ্যকার বৈষম্য বিরাট, এবং প্রতিনিয়তই তা বাড়ছে। এখানে যারা সরকারে আসেন তারা জনগনকে অনেক আশার বাণী শুনিয়ে ক্ষমতায় আসলেও এ বৈষম্যেও অবসানে রাজী নন। এদের কাজই হল এ বৈষম্যকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। রাষ্ট্রের সমসত্ম সম্পদকে এরা নিজেদের সেবায় লাগায়, বৃত্তর জনগনের স্বার্থে সম্পদ ব্যয় করাটাকে অপচয় মনে করে। এটা সর্বক্ষেত্রেই সত্য, আর্সেনিকের ক্ষেত্রে তো বটেই।
সেজন্য দেখা যায় এরা একদিকে পরিবেশ দিবস পালন করছে অন্যদিকে পাহাড়, গাছ-পালা, বন-বাদার উজার করছে; নদী-পুকুর-জলাভূমি দখল ও ভরাট করে দেশটাকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে। জনগনকে দিক নির্দেশনাহীন রেখে ক্ষমতায় এসে জনগনের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। তাই আজ আর্সেনিক দূষণের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি ও পরিণতি ঠেকাতে সবাইকে কথা বলতে হবে। শাসকদের চৈতন্যদোয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ফোবানা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আলোচনার আয়োজন করার জন্য আমি তাদেও ধন্যবাদ জানাই এবং আমাকে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
খালেকুজ্জামান
আহবায়ক (বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক)
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ
*ষোড়শ উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত “Arsenic , Water Problem” শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর আহবায়ক (বর্তমানে সাধারণ সম্পাদক) কমরডে খালেকুজ্জামান কর্তৃক উত্থাপিত প্রবন্ধ। ১ সেপ্টেম্বর ২০০২ ম্যানহাটন সেন্টার, নিউইয়র্ক সিটি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।